গত শুক্রবার দেখলাম তরুণ পরিচালক দেবাশীষ বিশ্বাস এর সিনেমা ‘ভালবাসা জিন্দাবাদ’। ফেসবুকে এই সিনেমা নিয়ে গত কয়েকদিনে এতো ঝগড়াঝাটি হচ্ছে, সেগুলি আমাকে আহত করেছে। তাই লিখব কি লিখবনা ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত লিখেই ফেললাম একটি সমালোচনা। এই সিনেমার ভাল মন্দ মিলিয়ে আমার মতামতগুলি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে জানালাম।
একনজরে ‘ভালবাসা জিন্দাবাদ’
কাহিনীঃ আব্দুল্লাহ জহির বাবু।
চরিত্র রূপায়নেঃ আরেফিন শুভ, আইরিন সুলতানা, সাদেক বাচ্চু, কাবিলা, আব্দুল কাদের, তুষার খান ও অন্যান্য।
গানের কথাঃ শওকত আলী ইমন ও অন্যান্য।
সুর ও সঙ্গীত পরিচালনাঃ শওকত আলী ইমন।
কন্ঠঃ তৌসিফ, কনা, পারভেজ, কুনাল, সাইমন, পৃথা ও শান।
চিত্রগ্রহনঃ আজগর আলী।
অঙ্গসজ্জা, সেট ডিজাইন ও অন্যান্যঃ গায়েত্রী বিশ্বাস।
শিল্পনির্দেশকঃ কলমতর।
কোরিওগ্রাফীঃ হাবিব।
এ্যাকশনঃ ডি.এইচ. চুন্নু ও অন্যান্য।
সম্পাদনাঃ মেহফুজুল হাসান সজিব।
কালার গ্রেডিং: আহমেদ রাজু।
প্রধান সহকারী পরিচালকঃ নিপু।
কাহিনী বিন্যাস, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনাঃ দেবাশীষ বিশ্বাস।
প্রযোজনাঃ আশফাহ হক লোপা (ই. আর. সিনেমা)।
মুক্তির তারিখঃ ০৮/১১/১৩ ইং।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
গ্রামের দুরন্ত ছেলে সৌরভ (শুভ) পড়াশুনার উদ্যেশ্যে ঢাকায় আসে। তার ঠাই হয় বোন (শিরিন বকুল) এর বাসায়। ঢাকা শহরের এক বিত্তবান সুলতান মির্জা (সাদেক বাচ্চু) সর্বদাই ব্যতিব্যস্ত থাকেন তার বিশ্ববিদ্যালয়গামী একমাত্র মেয়ে মেঘলা (আইরিন) হয়তো জীবনসঙ্গী হিসেবে ভুল মানুষকে বেছে নেবে। তাই সারাক্ষন মেঘলাকে পাহারা দেয়া সুলতানের অনুচরেরা। বানের জলে যেমন সব ভেসে যায়, ঠিক তেমনি সৌরভের আবির্ভাবে সব বডিগার্ড ভেসে যায় আর মেঘলার প্রেম দরিয়ায় নতুন হাওয়া লাগে। ঘরকোনো মেঘলাকে সৌরভ বের করে নিয়ে আসে বাইরে। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান সৌরভের সাথে মেঘলার প্রেমের বিষয়টি সুলতান মির্জার নজরে আসলে শুরু হয় সংঘাত। কে জিতবে এই সংঘাতে প্রেম নাকি ক্ষমতা? জানতে হলে দেখুন ‘ভালবাসা জিন্দাবাদ’।
শক্তিমত্তাঃ
আরিফিন শুভ, সুন্দর গান, নাচ ও এ্যাকশন।
দুর্বলতাঃ
ত্রুটিপূর্ণ চিত্রগ্রহন, কন্টিনিওয়িটি ব্রেক, চিত্রনাট্যের দুর্বল বিন্যাস।
রেটিং: ৬/১০।
……………………………………………………………………..
সমালোচকের দৃষ্টিতে ‘ভালবাসা জিন্দাবাদ’
কাহিনীঃ
একটি পাঁচমিশালী কাহিনী, যা কাকতালীয়ভাবে বিভিন্ন ভারতীয় সিনেমার বিভিন্ন প্লটের সাথে মিলে যাচ্ছিল। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ কাহিনী যেহেতু এই দোষে দুষ্ট তাই বেশী কিছু বলতে চাইনা। দুঃখজনক ভাবে এই কাহিনী শাকিব খান এর ‘কথা দাও সাথী হবে’ এবং বাপ্পী চৌধুরীর সাম্প্রতিক সিনেমা ‘কি প্রেম দেখাইলা’ এর সাথে অনেকাংশে মিলে যাচ্ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, এই তিনটি সিনেমারই কাহিনীকার ‘আব্দুল্লাহ জহীর বাবু’। যেহেতু ‘দেবাশীষ বিশ্বাস’ নতুন করে কাহিনী বিন্যাস করেছেন তাই তার আরো সচেতন হওয়া উচিৎ ছিল।
সংলাপ ও চিত্রনাট্যঃ
অল্প কিছু দুর্বল সংলাপ বাদ দিলে পুরো সিনেমার সংলাপ মোটামুটি ভাল হয়েছে। তবে চিত্রনাট্যের বিন্যাশ খুবই দুর্বল হয়েছে। শুরুতে ষ্টোরীটেলার (Storyteller) সুলতান মির্জাকে যখন পরিচিত করেন তখন বলা হয়েছিল তিনি কন্যাঅন্তপ্রাণ এবং কন্যার সব ইচ্ছাই পূরণ করেন। কিন্তু এমন কোন দৃশ্য পুরো সিনেমাতে আদৌ কি আমরা দেখতে পেয়েছি? সৌরভ আর মেঘা কি কলেজে পড়ে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সংলাপ অনুযায়ী কলেজ কিন্তু চিত্রায়ন অনুযায়ী শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। তুষার খান অভিনিত চরিত্রটি কি? বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ও বাইরে কাহিনীর বিন্যাস বা চিত্রায়ন হয়েছে সেগুলি কতটুকু যৌক্তিক? অন্য কেউ হলে এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতাম না কিন্তুু কাহিনীকার ও চিত্রনাট্যকার বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও কি করে এই ভুলগুলি করেন? বিদেশী কাহিনীর দেশীয়করন করতে হলে এই ব্যপারগুলি মাথায় রাখা উচিৎ। শুরুতে কাহিনীতে গতি থাকলেও শেয়ের দিকে এসে সেই গতি হারিয়েছে। সবশেষে হঠাৎ করে যেন কাহিনীর যবনিকাপাত হলো যা আমার বোধগম্য হলোনা।
অভিনয়ঃ
আরেফিন শুভ .. মাত করে দিয়েছেন। আমি পুরো সিনেমার প্রাণ বলব আরেফিন শুভকে। অভিনয়, এক্সপ্রেশন, নাচ, ফাইট সবকিছুতেই এত সাবলিল ভাব যা একজন আদর্শ কমার্শিয়াল হিরোর জন্য প্রয়োজন তা সবই তার মাঝে দেখা গেছে। তিনি যে লম্বা রেসের ঘোড়া তা এ সিনেমাতে সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। আইরিন তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন, তবে অভিনয় ও নাচে তার আড়ষ্টতা লক্ষ্য করা গেছে। তিনি চেষ্টা করলে সামনে আরো ভাল করতে পারবেন। সাদেক বাচ্চুর অভিনয়ের গ্রাফটা কখনো উপরের দিকে উঠেছে আবার কখনো নিচের দিকে নেমেছে। অনেকদিন পর পর্দায় হাজির হয়ে ক্ষনিকের জন্য বেশ আনন্দ দিয়েছেন আব্দুল কাদের ও শিরিন বকুল। তুষার খান এর উপস্থিতি কম ছিল, তবে স্বল্পসময়ে অতটা আলো ছড়াতে পারেননি। বরাবরের মতো কাবিলা আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তবে আমার মনে হয় তার উচিৎ একই ঘরনার (বরিশাল) অভিনয় থেকে বের হয়ে আসা। শাহিন খান ও অন্যন্যারা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন।
গানঃ
এই সিনেমার প্রায় সব গানই বেশ ভাল লেগেছে। অনেক গানের কিছু কিছু অংশের সুর পরিচিত লাগলেও এর চিত্রায়ন ভাল হওয়াতে তা ভাল লেগেছে। টাইটেল গানটিতে দর্শকরাও ঠোট মিলিয়েছেন, যা দেখতে সত্যিই ভাল লেগেছে। ভারতীয় শিল্পী শান এর গাওয়া ‘একটি কবিতা’ আশানুরুপ ভাল লাগেনি (এর চিত্রায়নটা হতাশ করেছে)। সুফি ঘরানার গান ‘ জানে খোদা ..’ এর জন্য পারভেজ বিশেষ ধন্যবাদ পাবেন।
এ্যাকশনঃ
এ্যাকশন দৃশ্যগুলি এই সময়ের অন্যান্য সিনেমার চেয়ে অনেকটা যৌক্তিক মনে হয়েছে। শুভ এ্যাকশনে যথেষ্ট ভাল করেছেন। তবে ফাইটার হিসেবে যাদের ব্যবহার করা হয়েছে তাদের অধিকাংশকেই ফাইটারের চেয়ে জোকার মনে হয়েছে (তাদের ছোটখাট গঠন ও দুর্বল এক্সপ্রেশনের কারনে)। যৌক্তিক এ্যাকশন দৃশ্যের জন্য চুন্নু ও বাকি দু’জনকে (নাম মনে পড়ছেনা) ধন্যবাদ।
শিল্প নির্দেশনাঃ
শিল্প নির্দেশনা মোটামুটি ভাল লেগেছে। যে শুটিং হাউজ (সম্ভবত শাকিব খান এর ‘জান্নাত’ নামক বাড়িটি) ইনডোর শ্যুট করা হয়েছে তার ভেতর ও বাইরের কিছু সেট পরিবর্তন করলে ভাল লাগত। হয়তো একসময় এফডিসি’র মতো এটা একসময় পরিচিত হয়ে গিয়ে বিরক্তিকর লাগতে পারে। মনে একটা খটকা লেগে আছে। সেট ডিজাইনার হিসেবে দেখলাম গায়েত্রী বিশ্বাস এর নাম আর শিল্পনির্দেশক হিসেবে কলমতর এর নাম। সেট ডিজাইন কি শিল্পনির্দেশনার অর্ন্তগত নয়?
সেট ডিজাইনে একটু নজর দিলেই কি তা আরো সুন্দর হতো না?
পোষাক, অঙ্গসজ্জা ও মেকাপঃ
পোষাক, অঙ্গসজ্জা ও মেকাপ এর দিকে আরেকটু নজর দিলে ভাল লাগত। কয়েকটি জায়গায় কস্টিউম এর কন্টিনিওয়িটি ব্রেক (Continuity Break) হয়েছে। যেমন শুভ যখন কাবিলাদের বন্দি করে আইরিনকে নিয়ে শহর দেখতে বের হয় সেই দৃশ্যগুলিতে শুভর দরজা লাগানো ও খোলে দেওয়ার সময় পোলোশার্ট (Polo Shirt) পরিবর্তিত হয়েছে এবং অচেতন আইরিনকে ফার্মহাউজে স্থানান্তর করার দৃশ্য। আর আইরিন এর মেকাপে সচেতন হলে ভাল হতো কারন কিছু কিছু ক্লোজ শট (Close shot) তার চেহারায় এজমার্ক (Age mark) প্রবল ছিল।
আলোকসম্পাতঃ
পুরো সিনেমাতে আলোকসম্পাত মোটামুটি ভাল হয়েছে। তবে ইনডোর দৃশ্যগুলি আরো সচেতন হওয়া জরুরী ছিল। আউটডোরের দৃশ্যে অনেক জায়গায় (গান ও অন্যান্য) আলোর তীব্রতা (Light Intensity) উঠানামা করাটা দৃষ্টিকটু লেগেছে।
চিত্রগ্রহনঃ
চিত্রগ্রহন মোটামুটি ভাল হয়েছে। কিছু কিছু শটে হেডরুম (Headroom) বেশী ছিল, কিছু শট বার্ন করেছে। সিনেমার শুরুতেই যখন এক প্রেমিককে সাদেক বাচ্চু ধরে আনেন সেই দৃশ্যে ক্লোজশট এ তার মাথার উপর ছায়া দেখা যাচ্চিল যা দৃশ্য অনুযায়ী থাকার কথা নয় (তবে কি তার মাথার উপর ছাতা বা অন্য কিছু ধরার কারনে হয়েছে?)। আবার শুভ যখন সাদেক বাচ্চু’র সাথে দেখা করতে আসে দৃশ্যটি ডে (Day) ছিল কিন্তু ইনডোর (Indoor) এর চিত্রগ্রহনে লিকেজ (Leakage) করে বাইরের ল্যাম্পপোষ্ট দেখা যাচ্ছিল (মানে রাত !)। আবার শুভ যখন ফার্মহাউজে আইরিন এর সাথে দেখা করতে আসে সেই দৃশ্যে ফ্রেমে বামদিকে থাকলেও পরের শটে ডানদিক দেখা যায় ! এতে ১৮০ ডিগ্রি রোল (180 Degree Rule) ভঙ্গ হয়েছে। চিত্রগ্রহনে বেসিক রোলস (Basic Rules) ভঙ্গ হওয়া দুঃখজনক। আরো অনেক অনেক বিষয় আছে যেগুলি লিখে দীর্ঘায়িত করলাম না, শুধু বলব আরো সচেতন থাকলে আমরা আরো সুন্দর কিছু পেতাম।
সম্পাদনাঃ
টাইটেল কার্ড ভাল লেগেছে। কিছু কিছু জায়গায় আইরিন এর লিপসিঙ্ক (Lip Sync) ঠিক ছিলনা। একজন সচেতন সম্পাদক অনেক ত্রুটি সংশোধন করে সিনেমাকে আরো দৃষ্টিনন্দন করতে পারেন। সম্পাদকের অনজ্ঞিতা লক্ষ্য করা গেছে। সম্পাদনায় আরো একটু সচেতন হলে সিনেমাটি আরো দৃষ্টিনন্দন হতো।
কালার গ্রেডিং:
কালার গ্রেডিং মোটামুটি ভাল হয়েছে। তবে আরেকটু সচেতন হলে ভাল হতো।
পরিচালনাঃ
তরুন পরিচালক ‘দেবাশীষ বিশ্বাস’ এর কাছে প্রত্যাশা আরো বেশী ছিল। আমার জানামতে তার রসবোধ যথেষ্ট ভাল কিন্তু সেটার প্রতিফলন প্রত্যশা অনুযায়ী কম ছিল। ভবিষ্যতে পরিচালনায় আরো পরিপক্ততা অর্জন করে আমাদের আরো সুন্দর, মৌলিক সিনেমা উপহার দেবেন সেই প্রত্যাশা করছি। অপ্রাসঙ্গিক হলেও আরেকটি কথা বলব, সম্প্রতি ফেসবুকে এই সিনেমা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনায় ভক্তদের সাথে তার আচরন আমার কাছে শোভন মনে হয়নি এবং তা কখনই কোন পরিচালকের কাছ থেকে কাম্য নয়।
পরিশিষ্টঃ
অনেক ত্রুটিবিচ্যুতির পরও এই সিনেমায় আরেফিন শুভ যথেষ্ট বিনোদন দিয়েছেন। সবশেষে বলা যায় “ভালবাসা জিন্দাবাদ’’ নাচ, গান ও এ্যাকশনে ভরপুর এমন এক চলচ্চিত্র যাতে আরেফিন শুভ’র জ্যোতির্ময় অভিষেক হয়েছে।