devilsdong
Member
জহিরের সকাল থেকে বেশ মন খারাপ। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছিলো। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আকাশ পরিস্কার হয়ে এলো। কিন্তু জহিরের মনটা তাও ঠিক হলো না। সে তার বাম হাতে পরা দামি পাথরের ব্রেসলেটটার দিকে মন খারাপ করে চেয়ে রইলো। মন খারাপের সাথে এই ব্রেসলেটটার একটা সম্পর্ক আছে। সম্পর্ক আছে তার পরা টিশার্টের সাথেও। টিশার্টের বুকে বড় বড় করে লেখা, 'বিয়িং হিউম্যান।'
জহিরের ফোনে খুব দুঃখের একটা গান বাজছে। রাহাত ফতেহ আলী খান তার সুরেলা কণ্ঠের সমস্ত বিষন্নতা ঢেলে দিয়ে গাইছে, 'তেরি মেরি মেরি তেরি, প্রেম কাহানী হে মুশকিল...!'
.
জহিরের বাড়ি যশোর বেনাপোল গ্রামের পাশেই। শার্শা উপজেলায়। সে ভারতীয় সুপারস্টার সালমান খানের খুব বড় ফ্যান। তার প্রিয় সিনেমা দাবাং। প্রিয় গান, লে লে লে সেলফি লে লে রে।
জহির খুব বেশি পড়ালেখা করেনি। বাবার একমাত্র ছেলে বলে খুব একটা ঝামেলাও হয়নি। বাড়ির সামনেই বড় স্টেশনারির দোকান দিয়েছে। বেচা বিক্রি ভালোই। দোকানে বসে টিভিতে সারাদিন সালমান খানের সিনেমা দেখে। তার বড্ড ভালো লাগে। আজ সকালেও রাধে সিনেমাটা দেখছিলো চতুর্থবারের মত। ভাইয়ের দূর্দান্ত একশান দেখে গায়ের লোম দাড়িয়ে যাচ্ছিলো। এমন সময় এলাকার এক ছেলে দোকানে আসে কোকাকোলা কিনতে। দোকানে কোকাকোলা থাকতেও জহির ছেলেটাকে বলে যে, কোক নাই। পেপসি নিয়ে যান৷
কারণ পেপসির বিজ্ঞাপন করে সালমান ভাইজান।
.
ছেলেটা পেপসি কিনতে রাজি হয়। দাম দেয়ার সময় টিভিতে চলা রাধে সিনেমার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে একটা কথা বলে। সেই কথার সূত্র ধরেই সারাদিন মন খারাপ জহিরের।
.
ছেলেটা বলেছিলো, 'সালমান খান ফ্যানদের আইকিউ কম হয়!'
.
তারপর থেকেই জহির চুপচাপ বসে আছে। চোখ ফেটে জল আসছে তার। ভাইজানকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসার জন্য আর কত কটু কথা শুনবে সে৷ এই নেটফ্লিক্স এমাজনের কুল জগতে তার মত ভাইয়ের ফ্যানরা কি এভাবেই নিগৃহীত হবে সকলের অগোচরে? এতো অপমান যে মেনে নেয়া যায় না আর। কেউ কি কিছু বলার নেই?
আজ ভাইজান যদি জানতো তার এক ফ্যান তাকে ভালোবাসার জন্য মানুষের কটু কথা শুনছে, তাহলে কত কষ্টই না পেত মানুষটা। দেহটা কঠিন হলেও ভাইজানের মনটা যে বড্ড নরম।
.
হাইরে নিষ্ঠুর পৃথিবী! জহির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছে নিলো। ভাইজান ফ্যানদের চোখের জল শোভা পায় না। সে দোকানের সামনের বয়াম থেকে একটা কেক বের করে খেতে লাগলো। এমন সময়, বাচ্চা মেয়েটাকে দেখলো জহির।
.
ছয় সাত বছর বয়স হবে৷ বড়জোর আট। পরনে একটা সবুজ রঙের টিশার্ট এবং কমলা রঙের স্কার্ট৷ মেয়েটার চোখে রাজ্যের ভয় ক্ষুধা আর অসহায়ত্ব। সে একদৃষ্টিতে জহিরের হাতের কেকটার দিকে চেয়ে রয়েছে।
জহির মেয়েটাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। মেয়েটা আসলো না। জহির দোকান থেকে বের হয়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কেক খাবে?'
মেয়েটা তাও কথা বললো না।
বেশ কিছুক্ষণ প্রশ্ন করার পর জহির বুঝতে পারলো মেয়েটা একটু অন্যরকম৷ স্পেশাল চাইল্ড। বলা যায় মানসিক ভারসাম্যহীন।
মেয়েটার হাতে কেকের টুকরো ধরিয়ে দিতেই গপগপ করে খেয়ে ফেললো। বোঝা যাচ্ছে খুব অভুক্ত। আহারে! কার যে বাচ্চা এটা। কোথা থেকে এসেছে। কতদিন কিছু খায় না৷ জহিরের এতো মায়া লাগলো। সে মেয়েটার হাত ধরে দোকানের ভেতরে এনে বিস্কুট, কলা, মিষ্টি আর পানি খেতে দিলো। মেয়েটা সেগুলোও গপগপ করে খেয়ে ফেললো।
.
তারপর জহির বেশ অনেক্ষণ মেয়েটাকে নানাভাবে ইশারা ইঙ্গিতে তার পরিচয় জানতে চেষ্টা করলো। কিন্তু মেয়েটা কি বলে কিছু বোঝা যায় না৷ এমনকি নিজের নামটাও বলতে পারলো না। কোথা থেকে এসেছে তা বলা তো দূরের কথা।
.
বহুক্ষণ পর জহির কিছু একটা ভাবলো। তারপর মেয়েটার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বললো, 'শোন, আজ থেকে আমি তোকে মুন্নী বলে ডাকবো। আর তুই ভালোভাবে কথা শিখলে আমাকে মামা ডাকিস? ঠিকাছে?'
.
উত্তরে মেয়েটা আউ আউ করে কি বললো, জহির ঠিক বুঝলো না।
.
আধাঘন্টা পর দোকান বন্ধ করে জহির মেয়েটাকে নিয়ে তার বন্ধু আজিজের বাসায় গেল। আজিজ বাসাতে একা থাকে। তার বউ ঈদ করতে বাপের বাড়ি গেছে। আজিজকে সব খুলে বললো জহির। সাথে যোগ করলো, 'আমি এই অসহায় মেয়েটাকে তার বাড়ি পৌছে দিতে চাই।'
জহির কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, 'কিন্তু তারজন্য এই মেয়ের বাড়ি কোথায় সেটা জানা দরকার।'
- কিন্তু সে তো ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না। প্রতিবন্ধী!
- তাহলে উপায়?
- উপায় একটা আছে।
- কি?
- আমার ধারণা মেয়েটা ইন্ডিয়ান। ভারত থেকে কোনোভাবে বেনাপোল বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে চলে এসেছে।
.
আজিজ অবাক হয়ে বললো, 'তুই কিভাবে শিওর হচ্ছিস?'
জহির মাথা নাড়লো, 'এখনো শিওর না। তবে ধারণা করছি এরকমই। শিওর হওয়ার জন্য কিছু পরীক্ষা করা লাগবে।'
- কি পরীক্ষা?
- দাঁড়া দেখাই!
.
জহির ফ্রিজ খুলে একপিস মুরগীর মাংস এনে দিলো। বললো, 'মুন্নী খা।'
মেয়েটা খেলো না। এমনকি হাতে ধরায় দেয়ার পরও রেখে দিলো।
জহির হাতে কিল দিলো, 'ইয়েস!'
আজিজ জিজ্ঞেস করলো, 'কি হয়েছে?'
জহির সবজান্তার হাসি হেসে বললো, 'দেখ, মুরগী খায় না। তারমানে নিশ্চয় ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণরা মাছ মাংস কিছুই খায় না।'
আজিজ মাথা চুলকে বললো, 'কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে তুই একটু আগেই কেক বিস্কুট কলা এসব খাওয়ালি সেজন্য আর খিদে নেই?'
- আরে নাহ ধুর, শিওর ব্রাহ্মণ। দেখ কত ফর্সা। ব্রাহ্মণরা ফর্সা হয়।
.
আজিজ হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। জহির বললো, 'আমাদের এদিকে হিন্দু ঘর তেমন নাই। যারা আছে সবাই পরিচিত৷ এই মেয়ে অবশ্যই বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া থেকে এসেছে। দাঁড়া দুই নাম্বার পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে।'
তারপর জহির আজিজের অবাক চোখের সামনে স্মার্ট টিভিতে ইউটিউব অন করে ইন্ডিয়া আর অস্ট্রেলিয়ার পুরাতন ক্রিকেট খেলা চালু করলো।
.
মেয়েটা টিভির দিকে চেয়েই খুশি হয়ে উঠলো। হাত তালি দিলো ছোট্ট করে।
লাফিয়ে উঠলো জহির। চিৎকার দিয়ে বললো, 'দেখ, বলেছিলাম না? ইন্ডিয়ার খেলা দেখে খুশি, মানে অবশ্যই ইন্ডিয়ান।'
আজিজ আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলো যে, 'ছোট বাচ্চা হয়তো টিভি দেখেই খুশি হয়েছে। কিন্তু জহিরের কনফিডেন্সের সামনে সেকথা ধোপেই টিকলো না।'
জহির বললো, 'আরেকটা প্রমাণও আছে।'
- কি প্রমাণ?
- মেয়েটার গায়ে সবুজ আর কমলা রঙের জামাকাপড়। এই দুটো রঙ কোথায় থাকে জানিস?
- কোথায় থাকে?
- ভারতের পতাকায়!
.
তারপর জহির উঠে দাঁড়িয়ে আবেগী গলায় বললো, 'আমার কাছে হয়তো ভিসা নেই, পাসপোর্ট নেই। কিন্তু তারপরও আমি মুন্নিকে যেকোনোভাবে ওর দেশে পৌছে দিয়ে আসবোই!'
- আজিজ অবাক হয়ে বললো, 'কিন্তু তোর কাছে তো ইন্ডিয়ার ভিসা পাসপোর্ট সবই আছে। গত সপ্তাহেই না তুই কোলকাতা গেলি হারবালের ডাক্তার দেখাতে?'
- আরে ধুর, এটা তো কথার কথা৷ দিলি তো ডায়ালগটার বাশটা মেরে!
.
জহির বাড়িতে বললো সে আজ রাতে বন্ধুর বাসায় থাকবে। তারপর তার দীর্ঘদিনের জমানো সব টাকা একজায়গায় করলো। কয়েকজনের কাছ থেকে কিছু ধারও নিলো। তারপর এক দালালকে টাকাপয়সা দিয়ে সিস্টেম করে গভীর রাতে মুন্নিকে নিয়ে ইন্ডিয়ার পথে পাড়ি জমালো।
.
ইন্ডিয়া গিয়ে অকুল পাথারে পড়লো ও। কাউকে চেনেনা, কারো নাম জানেনা, কোনো ঠিকানা নেই। কিভাবে মুন্নির বাবা মা-কে খুজে বের করবে ও? ভাবতে ভাবতেই দুপুর পার হয়ে গেল৷ বিকালের দিকে আরেকটা বুদ্ধি আসলো। একটা ক্যালেন্ডারের দোকান থেকে বিভিন্ন ইন্ডিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি সম্বলিত ক্যালেন্ডার কিনলো। তারপর ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো দেখালো মুন্নিকে। মুন্নি নিরাসক্তভাবে ছবিগুলো দেখলো৷ কোনো রিয়্যাক্ট ই করলো না। একদম শেষের দিকে যেয়ে একটা উটের ছবি দেখে খুশি হয়ে উঠলো। হাত দিয়ে ছবিটা ধরতে চাইলো।
.
তাতেই যা বোঝার বুঝে নিলো জহির৷ মুন্নিকে নিয়ে রওয়ানা হলো মরুভূমির রাজ্য রাজস্থান। এদিকে ওর হাতে সময়ও নেই। বাসা থেকে রাগ করবে। একদিনের কথা বলে এসেছে। রাজস্থানের একটা স্বেচ্ছাসেবী আশ্রমে গিয়ে সব খুলে বললো জহির। আশ্রমের লোকজন খুব খুশি হলো পুরোটা শুনে। বললো, 'আপনি আমাদের দেশের একটা বাচ্চাকে তার ঘরে ফেরানোর জন্য এতো কষ্ট করেছেন? আপনার মত লোক আজও আছে পৃথিবীতে।'
জহির গর্বিত গলায় বললো, 'ভাইজান ফ্যানদের আইকিউ কম হতে পারে, কিন্তু তাদের মনটা তাদের প্রিয় নায়কের মতই বিশাল বড়!'
.
আশ্রমের লোকজন কথা দিলো তারা মুন্নির বাসা খুজে বের করার চেষ্টা চালাবে৷ তাদের ভরসায় সেখানে মেয়েটাকে রেখে সেদিন রাতেই বাংলাদেশে ফিরে আসলো জহির৷ ঠিক করলো সপ্তাহখানেক পর আবার যাবে খোঁজ নিতে। সেবার হাতে টাইম নিয়ে যাবে।
.
বাসায় আসতেই বাবা মায়ের জেরার মুখে পড়লো। এই দুই- তিনদিন কোথায় ছিলো, কেন খোঁজ ছিলো না জানতে চায়। জহির কোনোমতে বন্ধুর সাথে বেড়াতে গিয়েছিলো বলে পার পেলো। তবে এর আগেও ও কয়েকবার কাউকে না বলে বাসা থেকে বেড়াতে চলে গিয়েছিলো বলে বাবা মা খুব বেশি টেনশন করেনি। জানে তাদের ছেলের ধারাই এমন।
.
দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে ক্লান্ত জহির বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মাথায় রাজ্যের চিন্তা। মুন্নি কি তার পরিবার ফিরে পাবে! সে কি তার ভাইজানের মুখ রক্ষা করতে পারবে! তবে যাই হোক, হাল ছাড়বে না জহির কোনোভাবেই না। ভাবতে ভাবতে ওর ঘুম এসে গেল। ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখলো, 'মরুভূমির ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে মুন্নি৷ ওদিক থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে মুন্নির মা। দুজনের পায়ে লেগে বালি উড়ছে।
মুন্নি আধো আধো বোলে, মা মা করছে।
মুন্নির মা মেয়েকে ফিরে পেয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।
ঘুমের মধ্যেই জহিরের নিজেকে অনেক বড় কেউ মনে হলো। মনে হলো ও যেন মহামানব। মনে হলো সালমান খান এসে ওর কাধে হাত রেখে বলছে, 'শোন বোকা, দুনিয়াতে আইকিউ দিয়ে কি হবে। মনটাই আসল।'
.
কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল জহিরের। মনে হলো ওদের বাড়ির সামনে থেকে শব্দ আসছে। জহির ওর মা-কে জিজ্ঞেস করলো, 'বাইরে কে শব্দ করে?'
জহিরের মা বিষন্ন গলায় বললো, 'আর বলিস না বাবা। আমাদের পাশের বাসার নতুন ভাড়াটিয়ার প্রতিবন্ধী মেয়েটাকে গত তিনদিন ধরে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। বাসা থেকে বের হয়েছিলো কাউকে না বলে তারপর থেকেই নিঁখোজ। ওর মা টা কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে গেল। আহারে!'
.
.
পরিশিষ্টঃ মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য পরদিন তড়িঘড়ি করে রাজস্থান গেল জহির। কিন্তু সেই আশ্রমে গিয়ে মুন্নিকে খুঁজে পেল না। লোকজনের কাছে জানতে পারলো, ঐ আশ্রমে এক সালমান খানের ফ্যান ছিলো। সে মুন্নিকে নিয়ে রাতের আধারে বর্ডার ক্রস করে নেপালের দিকে চলে গেছে৷ লক্ষণ বিচার করে তার ধারণা হয়েছে মেয়েটা বৌদ্ধ!
জহিরের ফোনে খুব দুঃখের একটা গান বাজছে। রাহাত ফতেহ আলী খান তার সুরেলা কণ্ঠের সমস্ত বিষন্নতা ঢেলে দিয়ে গাইছে, 'তেরি মেরি মেরি তেরি, প্রেম কাহানী হে মুশকিল...!'
.
জহিরের বাড়ি যশোর বেনাপোল গ্রামের পাশেই। শার্শা উপজেলায়। সে ভারতীয় সুপারস্টার সালমান খানের খুব বড় ফ্যান। তার প্রিয় সিনেমা দাবাং। প্রিয় গান, লে লে লে সেলফি লে লে রে।
জহির খুব বেশি পড়ালেখা করেনি। বাবার একমাত্র ছেলে বলে খুব একটা ঝামেলাও হয়নি। বাড়ির সামনেই বড় স্টেশনারির দোকান দিয়েছে। বেচা বিক্রি ভালোই। দোকানে বসে টিভিতে সারাদিন সালমান খানের সিনেমা দেখে। তার বড্ড ভালো লাগে। আজ সকালেও রাধে সিনেমাটা দেখছিলো চতুর্থবারের মত। ভাইয়ের দূর্দান্ত একশান দেখে গায়ের লোম দাড়িয়ে যাচ্ছিলো। এমন সময় এলাকার এক ছেলে দোকানে আসে কোকাকোলা কিনতে। দোকানে কোকাকোলা থাকতেও জহির ছেলেটাকে বলে যে, কোক নাই। পেপসি নিয়ে যান৷
কারণ পেপসির বিজ্ঞাপন করে সালমান ভাইজান।
.
ছেলেটা পেপসি কিনতে রাজি হয়। দাম দেয়ার সময় টিভিতে চলা রাধে সিনেমার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে একটা কথা বলে। সেই কথার সূত্র ধরেই সারাদিন মন খারাপ জহিরের।
.
ছেলেটা বলেছিলো, 'সালমান খান ফ্যানদের আইকিউ কম হয়!'
.
তারপর থেকেই জহির চুপচাপ বসে আছে। চোখ ফেটে জল আসছে তার। ভাইজানকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসার জন্য আর কত কটু কথা শুনবে সে৷ এই নেটফ্লিক্স এমাজনের কুল জগতে তার মত ভাইয়ের ফ্যানরা কি এভাবেই নিগৃহীত হবে সকলের অগোচরে? এতো অপমান যে মেনে নেয়া যায় না আর। কেউ কি কিছু বলার নেই?
আজ ভাইজান যদি জানতো তার এক ফ্যান তাকে ভালোবাসার জন্য মানুষের কটু কথা শুনছে, তাহলে কত কষ্টই না পেত মানুষটা। দেহটা কঠিন হলেও ভাইজানের মনটা যে বড্ড নরম।
.
হাইরে নিষ্ঠুর পৃথিবী! জহির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছে নিলো। ভাইজান ফ্যানদের চোখের জল শোভা পায় না। সে দোকানের সামনের বয়াম থেকে একটা কেক বের করে খেতে লাগলো। এমন সময়, বাচ্চা মেয়েটাকে দেখলো জহির।
.
ছয় সাত বছর বয়স হবে৷ বড়জোর আট। পরনে একটা সবুজ রঙের টিশার্ট এবং কমলা রঙের স্কার্ট৷ মেয়েটার চোখে রাজ্যের ভয় ক্ষুধা আর অসহায়ত্ব। সে একদৃষ্টিতে জহিরের হাতের কেকটার দিকে চেয়ে রয়েছে।
জহির মেয়েটাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। মেয়েটা আসলো না। জহির দোকান থেকে বের হয়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কেক খাবে?'
মেয়েটা তাও কথা বললো না।
বেশ কিছুক্ষণ প্রশ্ন করার পর জহির বুঝতে পারলো মেয়েটা একটু অন্যরকম৷ স্পেশাল চাইল্ড। বলা যায় মানসিক ভারসাম্যহীন।
মেয়েটার হাতে কেকের টুকরো ধরিয়ে দিতেই গপগপ করে খেয়ে ফেললো। বোঝা যাচ্ছে খুব অভুক্ত। আহারে! কার যে বাচ্চা এটা। কোথা থেকে এসেছে। কতদিন কিছু খায় না৷ জহিরের এতো মায়া লাগলো। সে মেয়েটার হাত ধরে দোকানের ভেতরে এনে বিস্কুট, কলা, মিষ্টি আর পানি খেতে দিলো। মেয়েটা সেগুলোও গপগপ করে খেয়ে ফেললো।
.
তারপর জহির বেশ অনেক্ষণ মেয়েটাকে নানাভাবে ইশারা ইঙ্গিতে তার পরিচয় জানতে চেষ্টা করলো। কিন্তু মেয়েটা কি বলে কিছু বোঝা যায় না৷ এমনকি নিজের নামটাও বলতে পারলো না। কোথা থেকে এসেছে তা বলা তো দূরের কথা।
.
বহুক্ষণ পর জহির কিছু একটা ভাবলো। তারপর মেয়েটার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বললো, 'শোন, আজ থেকে আমি তোকে মুন্নী বলে ডাকবো। আর তুই ভালোভাবে কথা শিখলে আমাকে মামা ডাকিস? ঠিকাছে?'
.
উত্তরে মেয়েটা আউ আউ করে কি বললো, জহির ঠিক বুঝলো না।
.
আধাঘন্টা পর দোকান বন্ধ করে জহির মেয়েটাকে নিয়ে তার বন্ধু আজিজের বাসায় গেল। আজিজ বাসাতে একা থাকে। তার বউ ঈদ করতে বাপের বাড়ি গেছে। আজিজকে সব খুলে বললো জহির। সাথে যোগ করলো, 'আমি এই অসহায় মেয়েটাকে তার বাড়ি পৌছে দিতে চাই।'
জহির কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, 'কিন্তু তারজন্য এই মেয়ের বাড়ি কোথায় সেটা জানা দরকার।'
- কিন্তু সে তো ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না। প্রতিবন্ধী!
- তাহলে উপায়?
- উপায় একটা আছে।
- কি?
- আমার ধারণা মেয়েটা ইন্ডিয়ান। ভারত থেকে কোনোভাবে বেনাপোল বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে চলে এসেছে।
.
আজিজ অবাক হয়ে বললো, 'তুই কিভাবে শিওর হচ্ছিস?'
জহির মাথা নাড়লো, 'এখনো শিওর না। তবে ধারণা করছি এরকমই। শিওর হওয়ার জন্য কিছু পরীক্ষা করা লাগবে।'
- কি পরীক্ষা?
- দাঁড়া দেখাই!
.
জহির ফ্রিজ খুলে একপিস মুরগীর মাংস এনে দিলো। বললো, 'মুন্নী খা।'
মেয়েটা খেলো না। এমনকি হাতে ধরায় দেয়ার পরও রেখে দিলো।
জহির হাতে কিল দিলো, 'ইয়েস!'
আজিজ জিজ্ঞেস করলো, 'কি হয়েছে?'
জহির সবজান্তার হাসি হেসে বললো, 'দেখ, মুরগী খায় না। তারমানে নিশ্চয় ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণরা মাছ মাংস কিছুই খায় না।'
আজিজ মাথা চুলকে বললো, 'কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে তুই একটু আগেই কেক বিস্কুট কলা এসব খাওয়ালি সেজন্য আর খিদে নেই?'
- আরে নাহ ধুর, শিওর ব্রাহ্মণ। দেখ কত ফর্সা। ব্রাহ্মণরা ফর্সা হয়।
.
আজিজ হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। জহির বললো, 'আমাদের এদিকে হিন্দু ঘর তেমন নাই। যারা আছে সবাই পরিচিত৷ এই মেয়ে অবশ্যই বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া থেকে এসেছে। দাঁড়া দুই নাম্বার পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে।'
তারপর জহির আজিজের অবাক চোখের সামনে স্মার্ট টিভিতে ইউটিউব অন করে ইন্ডিয়া আর অস্ট্রেলিয়ার পুরাতন ক্রিকেট খেলা চালু করলো।
.
মেয়েটা টিভির দিকে চেয়েই খুশি হয়ে উঠলো। হাত তালি দিলো ছোট্ট করে।
লাফিয়ে উঠলো জহির। চিৎকার দিয়ে বললো, 'দেখ, বলেছিলাম না? ইন্ডিয়ার খেলা দেখে খুশি, মানে অবশ্যই ইন্ডিয়ান।'
আজিজ আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলো যে, 'ছোট বাচ্চা হয়তো টিভি দেখেই খুশি হয়েছে। কিন্তু জহিরের কনফিডেন্সের সামনে সেকথা ধোপেই টিকলো না।'
জহির বললো, 'আরেকটা প্রমাণও আছে।'
- কি প্রমাণ?
- মেয়েটার গায়ে সবুজ আর কমলা রঙের জামাকাপড়। এই দুটো রঙ কোথায় থাকে জানিস?
- কোথায় থাকে?
- ভারতের পতাকায়!
.
তারপর জহির উঠে দাঁড়িয়ে আবেগী গলায় বললো, 'আমার কাছে হয়তো ভিসা নেই, পাসপোর্ট নেই। কিন্তু তারপরও আমি মুন্নিকে যেকোনোভাবে ওর দেশে পৌছে দিয়ে আসবোই!'
- আজিজ অবাক হয়ে বললো, 'কিন্তু তোর কাছে তো ইন্ডিয়ার ভিসা পাসপোর্ট সবই আছে। গত সপ্তাহেই না তুই কোলকাতা গেলি হারবালের ডাক্তার দেখাতে?'
- আরে ধুর, এটা তো কথার কথা৷ দিলি তো ডায়ালগটার বাশটা মেরে!
.
জহির বাড়িতে বললো সে আজ রাতে বন্ধুর বাসায় থাকবে। তারপর তার দীর্ঘদিনের জমানো সব টাকা একজায়গায় করলো। কয়েকজনের কাছ থেকে কিছু ধারও নিলো। তারপর এক দালালকে টাকাপয়সা দিয়ে সিস্টেম করে গভীর রাতে মুন্নিকে নিয়ে ইন্ডিয়ার পথে পাড়ি জমালো।
.
ইন্ডিয়া গিয়ে অকুল পাথারে পড়লো ও। কাউকে চেনেনা, কারো নাম জানেনা, কোনো ঠিকানা নেই। কিভাবে মুন্নির বাবা মা-কে খুজে বের করবে ও? ভাবতে ভাবতেই দুপুর পার হয়ে গেল৷ বিকালের দিকে আরেকটা বুদ্ধি আসলো। একটা ক্যালেন্ডারের দোকান থেকে বিভিন্ন ইন্ডিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি সম্বলিত ক্যালেন্ডার কিনলো। তারপর ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো দেখালো মুন্নিকে। মুন্নি নিরাসক্তভাবে ছবিগুলো দেখলো৷ কোনো রিয়্যাক্ট ই করলো না। একদম শেষের দিকে যেয়ে একটা উটের ছবি দেখে খুশি হয়ে উঠলো। হাত দিয়ে ছবিটা ধরতে চাইলো।
.
তাতেই যা বোঝার বুঝে নিলো জহির৷ মুন্নিকে নিয়ে রওয়ানা হলো মরুভূমির রাজ্য রাজস্থান। এদিকে ওর হাতে সময়ও নেই। বাসা থেকে রাগ করবে। একদিনের কথা বলে এসেছে। রাজস্থানের একটা স্বেচ্ছাসেবী আশ্রমে গিয়ে সব খুলে বললো জহির। আশ্রমের লোকজন খুব খুশি হলো পুরোটা শুনে। বললো, 'আপনি আমাদের দেশের একটা বাচ্চাকে তার ঘরে ফেরানোর জন্য এতো কষ্ট করেছেন? আপনার মত লোক আজও আছে পৃথিবীতে।'
জহির গর্বিত গলায় বললো, 'ভাইজান ফ্যানদের আইকিউ কম হতে পারে, কিন্তু তাদের মনটা তাদের প্রিয় নায়কের মতই বিশাল বড়!'
.
আশ্রমের লোকজন কথা দিলো তারা মুন্নির বাসা খুজে বের করার চেষ্টা চালাবে৷ তাদের ভরসায় সেখানে মেয়েটাকে রেখে সেদিন রাতেই বাংলাদেশে ফিরে আসলো জহির৷ ঠিক করলো সপ্তাহখানেক পর আবার যাবে খোঁজ নিতে। সেবার হাতে টাইম নিয়ে যাবে।
.
বাসায় আসতেই বাবা মায়ের জেরার মুখে পড়লো। এই দুই- তিনদিন কোথায় ছিলো, কেন খোঁজ ছিলো না জানতে চায়। জহির কোনোমতে বন্ধুর সাথে বেড়াতে গিয়েছিলো বলে পার পেলো। তবে এর আগেও ও কয়েকবার কাউকে না বলে বাসা থেকে বেড়াতে চলে গিয়েছিলো বলে বাবা মা খুব বেশি টেনশন করেনি। জানে তাদের ছেলের ধারাই এমন।
.
দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে ক্লান্ত জহির বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মাথায় রাজ্যের চিন্তা। মুন্নি কি তার পরিবার ফিরে পাবে! সে কি তার ভাইজানের মুখ রক্ষা করতে পারবে! তবে যাই হোক, হাল ছাড়বে না জহির কোনোভাবেই না। ভাবতে ভাবতে ওর ঘুম এসে গেল। ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখলো, 'মরুভূমির ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে মুন্নি৷ ওদিক থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে মুন্নির মা। দুজনের পায়ে লেগে বালি উড়ছে।
মুন্নি আধো আধো বোলে, মা মা করছে।
মুন্নির মা মেয়েকে ফিরে পেয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।
ঘুমের মধ্যেই জহিরের নিজেকে অনেক বড় কেউ মনে হলো। মনে হলো ও যেন মহামানব। মনে হলো সালমান খান এসে ওর কাধে হাত রেখে বলছে, 'শোন বোকা, দুনিয়াতে আইকিউ দিয়ে কি হবে। মনটাই আসল।'
.
কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল জহিরের। মনে হলো ওদের বাড়ির সামনে থেকে শব্দ আসছে। জহির ওর মা-কে জিজ্ঞেস করলো, 'বাইরে কে শব্দ করে?'
জহিরের মা বিষন্ন গলায় বললো, 'আর বলিস না বাবা। আমাদের পাশের বাসার নতুন ভাড়াটিয়ার প্রতিবন্ধী মেয়েটাকে গত তিনদিন ধরে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। বাসা থেকে বের হয়েছিলো কাউকে না বলে তারপর থেকেই নিঁখোজ। ওর মা টা কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে গেল। আহারে!'
.
.
পরিশিষ্টঃ মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য পরদিন তড়িঘড়ি করে রাজস্থান গেল জহির। কিন্তু সেই আশ্রমে গিয়ে মুন্নিকে খুঁজে পেল না। লোকজনের কাছে জানতে পারলো, ঐ আশ্রমে এক সালমান খানের ফ্যান ছিলো। সে মুন্নিকে নিয়ে রাতের আধারে বর্ডার ক্রস করে নেপালের দিকে চলে গেছে৷ লক্ষণ বিচার করে তার ধারণা হয়েছে মেয়েটা বৌদ্ধ!