বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে আছে বেলারুশ। লাখো মানুষের ঢল নেমেছে রাজপথে—সকল প্রকার সরকারি হুমকিকে অগ্রাহ্য করা উত্তাল জনতা ফিরিয়ে আনতে চায় গণতন্ত্র। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে চলতি আগস্ট মাসের ১৬ তারিখে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে একটি ছোট সমাবেশ থেকেই লাখো মানুষের সমাগম ঘটে; যা এর আগে কখনো বেলারুশে দেখা যায়নি।
বেলারুশের পূর্বে রাশিয়া এবং দক্ষিণে ইউক্রেন, এছাড়া উত্তর ও পশ্চিমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সদস্য লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ডের অবস্থান। প্রায় সাড়ে ৯ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটি ইউক্রেনের মতো পশ্চিমা বিশ্বের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্বের ঠিক মাঝামাঝি একটি স্থানে অবস্থান করছে।
আন্দোলনের পটভূমি
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে সৃষ্ট একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশের মাঝে ১৯৯৪ সালে বেলারুশের ক্ষমতায় আসেন আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। ইউরোপের সর্বশেষ স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিত এই প্রেসিডেন্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্টবাদী মূলতন্ত্র সংরক্ষণের চেষ্টা করে আসছিলেন।
বেলারুশের বেশীরভাগ উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে, এমনকি দেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলোকেও বাধ্য করা হয়েছে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে। বেলারুশের স্বৈরতন্ত্রের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে যাওয়া পুলিশ বাহিনীকে এখনো কেজিবি নামে আখ্যায়িত করা হয়। মূলত প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো দেশটিকে বিদেশী প্রভাব মুক্ত রেখে একটি স্থিতিশীল জাতীয়তাবাদী দেশের মতো করে নিজস্ব একটি শাসনব্যবস্থা কায়েম করে রাখার চেষ্টা করেছিলেন।
Photo: OperationWorld
বিদেশী প্রভাব মুক্ত জাতীয়তাবাদী প্রচেষ্টার কারণেই তিনি মূলত এতদিন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সমর্থন পেয়েছেন। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে চলা এই গণবিপ্লবের সময়েও কিছু সংখ্যক মানুষ তাকে ঠিক এই কারণগুলোর জন্য এখনো সমর্থন করছেন।
লুকাশেঙ্কোর অধীনে এ যাবত কালে যতগুলো নির্বাচন সংগঠিত হয়েছে তার সবগুলোই ছিল অনিরপেক্ষ এবং অগণতান্ত্রিক। এটি বেলারুশবাসীর অজানা নয়। তবে বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছিল। দুর্নীতি, দারিদ্ররতা, কর্মসংস্থানের অভাব এমন নানা রকম কারণে লুকাশেঙ্কোর জনপ্রিয়তা দিন দিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে জনগণ নেমে আসে রাজপথে। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই ছোট সমাবেশ থেকে এটি রুপ নেয় গণআন্দোলনে।
বিগত ২৬ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে লুকাশেঙ্কো দেশীয় অর্থনীতি’র বেশীরভাগ অংশ রাষ্ট্রের অধীনে রাখার পাশাপাশি বিরোধীদের তার কেজিবি খ্যাত পুলিশ বাহিনী দিয়ে দমন করে রেখেছিলেন। এক প্রকার স্বৈরশাসনের অধীনে থাকা জনতা অবশেষে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবীতে একজোট হয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। বিরোধীদের বক্তব্য বিগত ৯ই আগস্টের নির্বাচনে বরাবরের মতোই তিনি নিজস্ব ক্ষমতাবলে একপেশে নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করেছেন। অপরদিকে তার অনুসারীদের বক্তব্য হল লুকাশেঙ্কোর কঠোর শাসনের ফলেই দেশটি এখনো বিদেশী প্রভাব মুক্ত থেকেও স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে, তাই দেশের স্বার্থে তার ক্ষমতা থেকে তার সরে যাওয়া সঠিক হবে না।
বিগত নির্বাচনে বিরোধী দুই প্রার্থীকে কারাগারে প্রেরণ এবং অন্য একজনকে দেশ ছেলে চলে যেতে বাধ্য করার ফলে বর্তমানে লুকাশেঙ্কোর বিরোধী শক্তিরা একজোট হয়ে একটি তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত আছে। সেই সাথে জনগণও এখন তার বিরুদ্ধে।
নির্বাচনে কারচুপি
একটু আগেই যে তিনজন প্রার্থীর কথা বলছিলাম তাদের একজন স্ব্বেতলানা তিখনোভস্কায়া। তিনি তার স্বামী সের্গেই তিকানোভস্কির জায়গায় প্রার্থী হিসাবে নিবন্ধিত হন, কেননা তার স্বামী কারাবদ্ধ ছিলেন। ৩৭ বছর বয়স্ক এই শিক্ষিকা তার দুই সহযোগীকে নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে হতাশ জনগণের মাঝে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন।
সকলেই মোটামুটি ধারণা করে নিয়েছিলেন এই নির্বাচনটিও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে না। নির্বাচনে কোন স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষককে আমন্ত্রিত করা হয়নি। এছাড়া আরো অসংখ্য অনিয়ম যেন একটি একপেশে নির্বাচনের দিকেই ইঙ্গিত করছিল। আর সেই আশংকা দৃঢ়ভাবে সত্য প্রমাণিত হয় যখন বেশ কয়েকদিন ধরে জনসাধারণের জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল।
ভোট গ্রহণ সমাপ্ত হলে ফলাফল প্রকাশিত হয় যে, প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো প্রায় শতকরা আশি ভাগ ভোটে জয়লাভ করেছেন এবং অপরদিকে মিসেস তিখানোভস্কায়া পেয়েছেন মাত্র ১০% ভোট। কর্তৃপক্ষ এই ফলাফল প্রকাশ করলেও প্রধান বিরোধী দলের দাবী ছিল, এই নির্বাচনে ভোট গণনা নিয়ে বিশাল জালিয়াতি করা হয়েছে। সমস্ত ভোট কেন্দ্রগুলোতেই তারা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন।
বিরোধী দলীয় সকলেই প্রবলভাবে এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা শুরু করে। এমনকি রাস্তায় মিছিলও করে। তবে প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর বিখ্যাত পুলিশ বাহিনী এই আন্দোলনে বর্বরোচিত হামলা করে। প্রায় তিন হাজার জনকে নির্বাচনের পরের দিন গ্রেফতার করে পুলিশ বাহিনী। তারও পরদিন সারা দেশব্যাপী প্রায় ৩৭০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
নির্বাচনের পরদিন মিসেস তিখানোভস্কায়া নির্বাচন কর্তৃপক্ষের কাছে ফলাফলের মিথ্যাচারের বিষয়ে অভিযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন। ফলাফল স্বরূপ তাকে প্রায় সাত ঘণ্টার মতো আটকে রাখা হয় এবং পার্শ্ববর্তী দেশ লিথুয়ানিয়ায় চলে যেতে বাধ্য করা হয়। তিনি যাওয়ার সময় সমর্থকদের উদ্দেশ্যে একটি আবেগ-ঘন ভিডিও বার্তায় বলেন, তার অসহায়ত্ব এবং সন্তানদের নিরাপত্তার কারণে তাকে চলে যেতে হচ্ছে।
১৭ আগস্ট তিনি আরেকটি ভিডিও বার্তায় সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তিনি বেলারুশকে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। এই অবৈধ নির্বাচনকে স্থগিত রাখার জন্য এবং নিরাপত্তা কর্মীদের ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি। এই ভিডিও বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি কাউন্সিল গঠন করা হয় এবং লুকাশেঙ্কোর সাথে আলোচনার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু লুকাশেঙ্কো বেশ নির্মমভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং কাউন্সিলের সাথে আলোচনা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কাউন্সিলের সদস্যদের কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
প্রতিবাদ ও গণজাগরণের সূচনা
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অত্যাচারের শিকার হওয়া অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন ছবি পোস্ট করা শুরু করেন। এই নির্মম অত্যাচারের প্রতিচ্ছবি যখন সকলের কাছে ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে আসছিল, তখন একটি বিক্ষোভ যেন দানা বেঁধে উঠছিল সকলের মনে। অত্যাচারের শিকার হওয়া অনেকের আত্মীয়-স্বজন সাদা শাড়ি পরে গোলাপ হাতে একটি প্রতীকী বিক্ষোভের মিছিল শুরু করে। পুরো দেশব্যাপী রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীরাও এমন বর্বরোচিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ধর্মঘটের ডাক দিয়ে এই বিক্ষোভে যোগ দেয়।
এরপর দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন করলে আন্দোলনকারীরা যেন আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এমনকি ১৭ আগস্ট জাতীয় টিভি চ্যানেলের কর্মীরা পর্যন্ত লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগদান করে। তাৎক্ষনিকভাবে বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার পদত্যাগ এই বিক্ষোভের বারুদে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটিয়ে দেয়।