প্রায় তিন ঘণ্টা জার্নি শেষে আমরা বেলগ্রেডে পৌঁছালাম।
বেলগ্রেডের লোমিনা স্ট্রিটে এয়ার বিএনবির মাধ্যমে আগে থেকে থাকার জায়গা ঠিক করে রেখেছিলাম। বেলগ্রেডে দুই রাত থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। লোমিনা স্ট্রিটের ৪৭ নম্বর বাসার নিচতলায় লাজার নামের এক ভদ্রলোক বসবাস করতেন তাঁর ছেলে স্টেভানকে নিয়ে। বেলগ্রেডে দুই রাত তাঁর বাসায় থেকে গেলাম।
বেলগ্রেড, ১৬৮৪, ছবি: উইকিপিডিয়া
লাজার অত্যন্ত দায়িত্বশীল মানুষ। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। সারা দিনের ঘোরাঘুরির পর শরীর একেবারে ক্লান্ত। তাই কোনো রকম তাঁর কাছ থেকে রুমটা বুঝে নিয়ে হালকা ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতে দেখি, মিস্টার লাজার আমার জন্য নাশতা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। একসঙ্গে তাই নাশতা সেরে নিলাম। লাজারের বয়স প্রায় ষাট, তাঁর ছেলে স্টিভানের বয়স ২২ বছর। স্ত্রীর সঙ্গে লাজার সাহেবের অনেক আগে ডিভোর্স হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে স্টেভান তখন বেলগ্রেডের একটি টেকনিক্যাল স্কুলে পড়াশোনা করছেন।
মিস্টার লাজার আমাকে বেলগ্রেড সম্পর্কে ধারণা দিলেন। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলোতে কীভাবে পৌঁছানো যায়, সে সম্পর্কে বলে দিলেন। বাংলাদেশ ও যুগোস্লাভিয়ার মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও তিনি আমার সঙ্গে আলোচনা করলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের প্রতি যুগোস্লাভিয়ার সমর্থনের কথাও তাঁর আলোচনায় উঠে আসছিল। তিনি একটি কথা বারবার বলছিলেন, মার্শাল টিটো সব সময় সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশগুলোকে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে মৃত্যুর আ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে মার্শাল টিটো বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও বাংলাদেশের সঙ্গে যুগোস্লাভিয়ার সম্পর্ক একই রকম ছিল বলে জানালেন লাজার।
মধ্য বেলগ্রড, ছবি: উইকিপিডিয়া
স্লোভেনিয়ার বেশির ভাগ মানুষের চোখে মার্শাল টিটো ছিলেন একজন স্বৈরশাসক। তবে সার্বিয়াতে আজও তাঁর নাম মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে সার্বিয়ার নেতৃত্বে যুগোস্লাভিয়া গঠিত হয় বেলগ্রেডকে রাজধানী করে। কোনো শহরকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে যে ধরনের অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়, তা বেলগ্রেড ছাড়া গোটা যুগোস্লাভিয়ার অন্য কোনো শহরে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যেত না। যুগোস্লাভিয়া গঠনের পর তাই সার্বিয়ানরাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়।
অনেকে বলে থাকেন, কোনো দেশ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে হলে দেশটির রাজধানীকে সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের এ দাবির সত্যতা রয়েছে। সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে আসার পর আমার কাছে তেমনটি মনে হয়েছে। সত্যি কথা বলতে, হাঙ্গেরি থেকে যখন আমি সুবোটিচাতে প্রবেশ করি, তখন সার্বিয়া সম্পর্কে আমার যে ধরনের ধারণা তৈরি হয়েছিল নিশ ও বেলগ্রেডে আসার পর সে ধারণা অনেকটাই দূর হয়। মোটামুটি সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা বাদ দিলে অবকাঠামোগত দিক থেকে সার্বিয়া যে পিছিয়ে, এমনটি বলা যাবে না।
১৫৭৫ সালে নির্মিত বায়রাকলি চামি, বর্তমানে এটি বেলগ্রেডের একমাত্র অফিশিয়াল মসজিদ
সার্বিয়ার রাস্তাঘাট গুণগত দিক থেকে হাঙ্গেরির চেয়েও ভালো কোনো কোনো ক্ষেত্রে। দেশটির হাইওয়ে আসলে উন্নত, অবশ্য এসব হাইওয়ের বেশির ভাগই যুগোস্লাভিয়া শাসনামলে তৈরি করা। একটি প্রধান হাইওয়ে দেশটির পুরো অংশকে সরলরৈখিকভাবে একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে কেবল এ হাইওয়ে ধরে আপনি সার্বিয়ার উত্তর থেকে দক্ষিণ—বারবার যেকোনো শহরে যাতায়াত করতে পারবেন।
বেলগ্রেড, নিশ, নোভি সাদসহ দেশটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরের অবস্থান একে অন্যের সাপেক্ষে সরলরৈখিক। বিষয়টি আমার কাছে একটু আশ্চর্য লেগেছে। নিশের মতো বেলগ্রেডেরও বেশির ভাগ ভবন কমিউনিস্ট শাসনামলে নির্মিত। এসব ভবনের বাইরের দিকটা হলুদ কিংবা বাদামি রঙের হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ভবনই তিন থেকে চারতলা।
আমাদের দেশের শহরগুলোতে রাস্তার দুই ধারে যেমন ঘন ঘন দোকানের দেখা মেলে, সার্বিয়াতেও দেখলাম অনেকটা সে রকম অবস্থা।
নিশ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা যতটা ইতিবাচক, বেলগ্রেড সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা ততটা ইতিবাচক নয়; বরং বেলগ্রেড আমাকে হতাশ করেছে।
বেলগ্রেডের সেন্ট মার্ক অর্থোডক্স চার্চের সামনে লেখক, ছবি: সংগৃহীত
বেলগ্রেডে প্রতি পদক্ষেপ আমাকে বারবার সাস্কার সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সত্যি বেলগ্রেডকে আমাদের ঢাকা শহরের ইউরোপিয়ান সংস্করণ বললে ভুল হবে না। ঢাকার মতো বেলগ্রেডেও রোকজন ট্রাফিক আইনের খুব একটা তোয়াক্কা করেন না। যে যাঁর মতো পারছেন গাড়ি ড্রাইভ করছেন, ট্রাফিক সিগন্যালের দিকে কেউ তেমন একটা ভ্রুক্ষেপও করছেন না। রাস্তা পারাপারের সময়ও দেখলাম পথচারীরাও ট্রাফিক সিগন্যাল কিংবা জেব্রা ক্রসিং, কোনো কিছুর ধার ধারছেন না। পারলে অনেকে এর মধ্যে ফুটপাতের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেন। সেই সঙ্গে জনকোলাহল কিংবা গাড়ির হর্নের শব্দ তো আছেই। বলকান দেশগুলোর মানুষের কাছে এগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়েও কারও তেমন কোনো বালাই নেই। স্থানীয় জনগণকে হরহামেশা রাস্তাঘাটের যেখানে–সেখানে ময়লা–আবর্জনা ফেলতে দেখলাম। আমাদের উপমহাদেশের মতো সার্বিয়া বা বলকান অন্য দেশগুলোতে খোলাবাজারের প্রচলন দেখা যায়।
বেলগ্রেড ভ্রমণের সময় সবাইকে আরও একটি বিষয়ের দিকে নজর রাখতে বলব। মিস্টার লাজারও আমাকে এ বিষয়ে কয়েকবার সতর্ক করেছিলেন। বেলগ্রেডের নিরাপত্তাব্যবস্থা ইউরোপের অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেকটা দুর্বল। এ কারণে পকেটমার কিংবা ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা বেলগ্রেডে অস্বাভাবিক নয়। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে উদ্বাস্তু সমস্যা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে অবৈধ অনুপ্রবেশের লক্ষ্যে এখন সার্বিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন অভিবাসীরা।
সেন্ট মার্ক অর্থোডক্স চার্চের ভেতরের একটি অংশ
লোমিনা স্ট্রিটের অবস্থান ছিল বেলগ্রেড সিটি সেন্টারের একদম কাছে। তাই মোটামুটিভাবে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা ছিল পায়ে হাঁটার দূরত্বে।
আগে থেকেই ফোনে অফলাইন ম্যাপ ডাউনলোড করে রেখেছিলাম। মিলানের দেখানো পথে চার্চ পরিদর্শনের মধ্য দিয়েই বেলগ্রেড ডায়েরির পাতা খুললাম। বেলগ্রেডে সবার প্রথমে আমার গন্তব্য ছিল সেন্ট মার্ক অর্থোডক্স চার্চ। এটি দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বড় অর্থোডক্স চার্চগুলোর মধ্যে একটি। ১৮৩৫ সালে চার্চটি নির্মাণ করা হয়। সে সময় এটি ছিল সম্পূর্ণভাবে কাঠের তৈরি স্থাপনা। সার্বিয়ার সাবেক রাজা আলেক্সান্ডার অবরেনোভিচ এবং রানি দ্রাগা অবরেনোভিচকে এখানে সমাহিত করা হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীর হামলায় চার্চটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদিও ১৯১৭ সালে চার্চটি সংস্কার করা হয়। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনীর নিক্ষেপ করা বোমার আঘাতে চার্চটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বেলগ্রেডকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সময় শহরটির জনবসতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে নতুন করে চার্চটিকে পুনর্নির্মাণ করতে হয়। এ সময় চার্চটিকে আয়তনে সম্প্রসারিত করা হয়। সার্বো-বাইজেনটাইন স্থাপত্যকলার অনুসারে নতুনভাবে এ চার্চের নকশা প্রণয়ন করা হয়।
সেন্ট মার্ক অর্থোডক্স চার্চের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আধা মাইল দূরে রয়েছে সার্বিয়ার ন্যাশনাল পার্লামেন্টের
সেন্ট মার্ক অর্থোডক্স চার্চ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিক বরাবর আধা মাইল হাঁটলে দেখা মিলবে সার্বিয়ার ন্যাশনাল পার্লামেন্টের। ইউরোপের দৃষ্টিনন্দন সংসদ ভবনের মধ্যে সার্বিয়ার ন্যাশনাল পার্লামেন্টকে একটি হিসেবে ধরা হয়। যদিও সার্বিয়া বলকান উপদ্বীপের একটি দেশ, তবে বেলগ্রেডের বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের স্থাপত্যকলার অনুকরণে বানানো। স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে তাই সার্বিয়ার ন্যাশনাল পার্লামেন্টের সঙ্গে হাঙ্গেরির ন্যাশনাল পার্লামেন্ট কিংবা অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে অবস্থিত বেলভেদরে প্যালেস কিংবা হফবুর্গ প্যালেসের স্থাপত্যশৈলীর আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
পার্লামেন্ট ভবন থেকে এরপর সরাসরি চলে গেলাম সার্বিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ অর্থোডক্স চার্চ টেম্পল অব সেন্ট সাভাতে। সার্বিয়ান ধর্মযাজক সেন্ট সাভার নামানুসারে এ অর্থোডক্স চার্চের নাম রাখা হয়েছে। পার্লামেন্ট ভবনের সামনে থেকে ২৯ নম্বর বাসে সরাসরি টেম্পল অব সেন্ট সাভায় পৌঁছানো যায়। প্রতিবার বাসভ্রমণের ক্ষেত্রে ৮৯ সার্বিয়ান দিনারের প্রয়োজন হয়। গুরু নানককে বলা হয় শিখ ধর্মের প্রবক্তা, একইভাবে সেন্ট সাভাকেও সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চের প্রবক্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়ার সঙ্গে টেম্পল অব সেন্ট সাভার গঠনগত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে যেভাবে ভ্যাটিকান পবিত্র তীর্থভূমি হিসেবে বিবেচিত, ঠিক একইভাবে সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চে বিশ্বাসী মানুষদের কাছেও টেম্পল অব সেন্ট সাভা পবিত্র তীর্থভূমি হিসেবে পরিগণিত হয়। চার্চটির বাইরের দিকটা সাদা রঙের আর ওপরের গম্বুজগুলো ধূসর রঙের। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যখন আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করার ঘোষণা দেন, ঠিক সে সময় সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার ভুচিচের পক্ষ থেকে টেম্পল অব সেন্ট সাভাকে দ্বিতীয় আয়া সোফিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ঘোষণা আসে।
সার্বিয়ার আয়া সোফিয়া খ্যাত টেম্পল অব সেন্ট সাভা
সেন্ট মার্ক অর্থোডক্স চার্চের মতো টেম্পল অব সেন্ট সাভার ভেতরেও তৈলচিত্রের প্রাধান্য লক্ষ করলাম। যিশুখ্রিষ্ট থেকে শুরু করে মা মেরি কিংবা অর্থোডক্স চার্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মযাজকের ছবি তৈলচিত্রের মাধ্যমে ভেতরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ক্যাথলিক চার্চগুলোর তুলনায় অর্থোডক্স চার্চের ইন্টেরিয়র আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। ক্যাথলিক চার্চগুলো ধর্মীয় সাধনার ক্ষেত্রে লাতিন ভাষাকে অধিক গুরুত্ব দেয় তবে অর্থোডক্স চার্চগুলো দেখলাম ধর্মচর্চার কাজে কোনো নির্দিষ্ট ভাষার পরিবর্তে সরাসরি নিজেদের ভাষাকে ব্যবহার করে।
লেখক: রাকিব হাসান | শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা