What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected বাংলা গল্প (সংগৃহিত) (1 Viewer)

bidushi

Member
Joined
Mar 7, 2018
Threads
10
Messages
144
Credits
3,945
তেলাকুচার সিন্দুর রং


লেখক: শাহাব আহমেদ

সমস্যা ভাবলেই সমস্যা, না ভাবলে কিছুই নয়। তবে সমস্যাই হোক আর কিছুই না হোক, বিষয়টির সূচনা হয় এখান থেকেই। এক সন্ধ্যায় সাদেক মিয়া রিপনের মাকে তসলিমার মা বলে ডেকে ফেলে।


রিপনের মা বাইরে ছাগল দোহাচ্ছিল মনোযোগ দিয়ে আর ছাগলের বাচ্চাটা তিড়িং-বিড়িং করছিল পাশেই। মাথার ওপরে বরইগাছ থেকে ফুল ঝরছিল ঝুরঝুর আর কলাগাছের লম্বা পাতায় বাতাস খলবল করছিল। সেই বাতাসে আঁচল সরে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল তার বুকের কিছুটা ভরাট অংশ। দুই বাচ্চার দুধের জোগান দিতে হয়েছে বলে সেখানে কোনো আকর্ষণ অবশিষ্ট নেই তা বলা যাবে না। অন্তত সাদেক মিয়ার মতো একজন নয়, একাধিক পুরুষকে তুষ্ট রাখার মতো পর্যাপ্ত মধু সেই মৌচাকে এখনো আছে। আকাশে সাদা সাদা মেঘ হ্যাংলার মতোই তাকিয়ে ছিল তার দিকে। ছাগলের বাচ্চাটা পারে তো ওখানে এখনই মুখ ঢুকিয়ে দেয়।


সাদেক মিয়া দু-সপ্তাহ পরে ময়মনসিংহ থেকে এসেছে। দুপুরের খাবারের পরে সে ঘরে নিদ্রায় ছিল। খোয়াব দেখছিল কি না বলা মুশকিল।


‘তসলিমার মা গেলা কই?’


ডাকটা স্পষ্ট শুনতে পায় এবং বুকের ভেতরটায় ছ্যাঁৎ করে ওঠে। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। তার বড় ছেলের নাম রিপন আর ছোটটা রিটন। রিপনের বয়স সাড়ে চার, রিটনের আড়াই। তার নিজের বয়স পঁচিশ অতিক্রম করেনি। তসলিমা বলে কোনোকালে তার কোনো মেয়ে ছিল না।


‘কি, আপনে এইডা কী কইলেন?’


সাদেক মিয়া আসলে খোয়াব দেখছিল না। জেগে সে রিপনের মাকেই ডেকেছে কিন্তু মুখের ব্যালান্স ঠিক রাখতে পারেনি।


‘কই? কইলাম তো রিপনের মা তুমি কই গেলা?’


‘না, আপনে রিপনের মা কন নাই, কইছেন তসলিমার মা?’


‘তুমি ভুল শুনছ। আমার পোলার নাম রিপন, আমি তসলিমার মা কমু ক্যান?’


তসলিমার মা সে কেন বলবে তার উত্তর রিপনের মা জানে না। জানে সে কান্নাকাটি করতে। সে নাকি কেঁদে বলে, ‘আপনে মিছা কথা কইতাছেন। আপনে আর একটা বিয়া করছেন।’





মিথ্যা কথা বলার অভিযোগটা রশিদ মিয়া সহ্য করতে পারে না। হাজার হলেও সে পুরুষ মানুষ এবং পুরুষের মানমর্যাদা ও ইগো বলে কথা আছে। সে রিপনের মা-ই হোক বা তসলিমার মা-ই হোক ছোট মুখে বড় কথা বলতে পারে না। সাদেক মিয়া তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। রিপনের মারই যত্ন করে সাজিয়ে রাখা লাকড়ি হাতে নিয়ে আচ্ছা করে ধোলাই দেয়। চিৎকার-চেঁচামেচি, চোখের জল, নাকের জল মিলে পাড়ার থ্যাবড়া নাকের বহু লোকজন জড়ো হয়ে যায়। সাদেক মিয়া গজগজ করে সবাইকে অশ্রাব্য গালাগাল করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।


চলে যায় ময়মনসিংহে।


ময়মনসিংহ তখন অনেক দূরে। সেখানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের তুলনায় শান্তি অনেক বেশি। মানুষগুলোও ভালো।


সে অনেকদিন আগের কথা।


শায়েস্তা খান, সিরাজউদ্দৌলা খান ও ইয়াহিয়া খানের আমল শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও খানে খানে খানখান বাংলায় মজুদদারি ও কালোবাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ক্ষমতা আইন সবে চালু হয়েছে। ১৯৭৪-৭৫ সাল। আলুর নিচে লুকিয়ে কালো মার্কেটে হুইল সাবান বিক্রি করত সাদেক মিয়া। প্রথমদিকে তাতে লাভ হলেও আস্তে আস্তে লাভ কমে আসে। রক্ষীবাহিনী পদে পদে ঘনঘন চেক করে তার ব্যবসার নিরাপত্তায় যারপরনাই ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। সে তখন হুইল সাবান ছেড়ে চকবাজার ইসলামপুর থেকে চোরাই চায়নিজ ঘড়ি কিনে বিক্রি করা শুরু করে।


একসময় টের পায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে ঘড়ি বিক্রিতে যা লাভ হয়, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া, ফুলপুর, তারাকান্দা, হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া এলাকায় লাভ হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। ময়মনসিংহের লোকগুলো চালাক কম। বর্ডারের ওপারের লোকগুলোও। তার চকচকে ঘড়িগুলোর চাহিদা সেখানে বেশ।


সে নিয়মিত ঢাকা-ময়মনসিংহ যাতায়াত শুরু করে। সারাদিন লাগে যেতে। হেলপার বাসের পিঠ চাপড়ায়, ‘ওঠেন, ওঠেন এক্কেরে খালি গাড়ি।’ গাড়ি আসলে খালি নয়। ওটা হেলপারের চাকরির অংশ। ওদের সারাদিনে মিছে কথা বলার যে লিমিট বা কোটা ধরে দেওয়া হয়, তার ওপর ভিত্তি করে বেতন। যতক্ষণ পর্যন্ত বাস মুরগির খোঁয়াড় না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত নিস্তার নেই। বাসের ভিড় আর গরমে হাই তুলতে তুলতে সাদেক মিয়া দোল খায়। দুলতে দুলতে ঘুমায়। ঘুমাতে ঘুমাতে খোয়াব দেখে। খোয়াবের কোনো ইয়ত্তা নেই, মুখ-পাছা নেই। লোকজন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলে। পেছনের সিটে বসে সামনের সিটের কারো সঙ্গে খেজুরে আলাপ জুড়ে দেয়। কেউ ড্রাইভারের সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে কলহ করার মতো করে গল্প করে। সাদেক মিয়ার ঘুমের কোনো ব্যাঘাত হয় না।


অজ্ঞান পার্টি তখনো অত সক্রিয় ছিল না। সাদেক মিয়ার বিপদ-আপদ তেমন হয়নি। খালি একবার মুড়ির টিনে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে বাঁ-হাতটা জানালার বাইরে চলে গিয়েছিল। পাশ দিয়ে একটা ট্রাক যাওয়ার সময় সাইডের হুক দিয়ে বাঁ-বাহুর বেশ খানিকটা মাংস খাবলা মেরে নিয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এছাড়া সাদেক মিয়ার জীবন নির্ঝঞ্ঝাট ঘটনাহীন জীবন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তাকে যুদ্ধ করতে হয়নি। গ্রামে গিয়ে তো মাছ ধরে, তো কামলা খেটে, তো কিছুই না করে বাদাইরার নয় মাস কেটে গেছে।


ময়মনসিংহে সে একদিন এখানে তো অন্যদিন অন্যখানে হাঁটে। বিত্ত-বেসাতিহীন খুচরা ব্যবসায়ী সে। ভালোমানুষের ভাগ্য কপালে হলেও সাদেক মিয়ার ভাগ্য পায়ে।


যত সে হাঁটে ভাগ্য তত মচমচ করে।


প্রথম প্রথম সে সপ্তাহের চার-পাঁচদিন কাটাত ব্যবসায়ের জন্য যাতায়াত করে। ফিরে আসত আগুনতপ্ত হয়ে। গরমে জলে ঝাঁপ দেওয়ার মতো রিপনের মা ছিল তার আগুন নেভানোর জল। সে তাকে একেবারেই বিশ্রাম দিতে চাইত না। রিপনের মায়েরও বয়স অল্প, স্বামীর কয়েকদিনের অবর্তমানের কষ্টটা ফিরে আসার পরের খাই খাই রোগের আবেগ ও আদরের অজচ্ছলতায় পুষিয়ে দিত। বলা চলে সে সুখীই ছিল। বাপ ও স্বামী হিসেবে সাদেক মিয়া খুবই মনোযোগী।


ছেলেদের জন্য খেলনা নিয়ে আসত আর রিপনের মায়ের জন্য কখনো শাড়ি, কখনো চুলের সুগন্ধি তেল, কখনো সাবান, কখনো আয়না-চিরুনি।


সেই সাদেক মিয়ার আস্তে আস্তে ব্যস্ততা বাড়ে। সে বেশি সময়ের জন্য চলে যায়। কখনো কখনো দু-সপ্তাহ পরে ফিরে আসে।


কিন্তু বিষয়টা পুষে যায়, সাদেক মিয়া টাকার মুখ দেখে।


নারায়ণগঞ্জের তল্লায় রেললাইন ঘেঁষে একটি বস্তি এলাকায় তার বাসা। দীর্ঘদিন ধরে সে এখানে আছে। ছোট ছোট ঘর, নোংরা রাস্তাঘাট, নেড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ, পায়খানার গন্ধ, রেলগাড়ির আওয়াজ যেন তার অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেছে।


এখানেই রিপনের মা জন্ম দিয়েছে তার দুই ছেলেকে। ভাগ্য ভালো তার কোনো মেয়ে নেই। মেয়ে হলো সংসারে খরচের খাত, দুর্ভাগ্য যার, মেয়ে হয় তার ঘরেই। টাকা হলেও তল্লা ছেড়ে যাওয়ার মানসিক সাবালকত্ব সাদেক মিয়ার অর্জন হয়নি।


কিন্তু একটা ব্যাপার রিপনের মা লক্ষ করে। সাদেক মিয়ার খাইখাই ভাবটা আগের মতো নেই।


আঠার ভাবটা কম।


আগের মতো কামান কাঁধে নিয়ে হাঁটে না।


সে মেয়েমানুষ, এসব কথা জিজ্ঞেসও করতে পারে না।


কিন্তু সাধ-আহ্লাদ তারও আছে, স্বামীর দীর্ঘ অবর্তমানে তারও শরীরটা চৈত মাসের শুকনা পুকুরের মতো হয়ে থাকে।


ভাবে, মানুষটা কাজ করতে করতে ক্লান্ত।


সে নিজ থেকেই যত্নের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। সাদেক মিয়া কলাগাছ নয়, বউয়ের মহব্বতে অসাড় থাকে না।


রিপনের মা বুঝতে পারে শুরুর প্রক্রিয়াটা তার নিজ থেকে আসতে হবে, অবশ্য সাবধানে। রিপনের বাপ যাতে না ভাবে সে বেলাহাজ ও নষ্ট এবং তার মধ্যে খাঁইখাঁই চুলকানি বেশি।


সেই স্বামী আজ বাড়ি ছেড়ে গেছে তাকে মারধর করে। কেমন প্রাণ পোড়ায়। মনে হয় কাজটা সে ভালো করেনি। মানুষটা হয়তো কোনোই দোষ করেনি। সে-ই খালি খালি সন্দেহ করে তার মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে। মানুষটা যে পটু ধুনকরের মতো তার গায়ে হাত চালিয়ে গেছে তা সে ভুলে যায় অথবা মারটা তার প্রাপ্য বলেই মনে হয়। পুরুষ মানুষ একটু-আধটু মারধর করতেই পারে। এটা বিরাট কোনো ব্যাপার নয়। অপরাধটা নিশ্চিত তারই। ‘তসলিমার মা’ ডাকটা হয়তো সে আসলেই শোনেনি।


তার মনের ভুল ছিল।


মাসখানেক তার বড় কষ্টে কাটে। স্বামীর জন্য মনটা চাতক পাখিতে পরিণত হয়ে যায়। গাছে যখন কাঠঠোকরা ঠোকরায়, ঠোকরটা যেন তার বুকে গিয়ে লাগে। মাছরাঙা যখন জলে ঝাঁপ দেয়, সেভাবে তার স্বামীর বুকে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে। রাতে যখন হুতুমপেঁচা ডাকে মনে হয় যেন দূর থেকে সাদেক মিয়া ডাকছে। আকাশভরা তারা অথচ তার গৃহে ঘুটঘুটে অন্ধকার।


সে তখন জীবনে যা সাহস করেনি তাই করে। ছোট দুটি বাচ্চা নিয়ে চড়ে বসে ময়মনসিংহের বাসে। বাস হেলতে হেলতে, দুলতে দুলতে, কত ধানক্ষেত, কত হাতির কানের মতো কচুর পাতা, সরিষার ফুল, ছোট ছোট বাড়ি, ঝোপঝাড় পার হয়ে যায়। রিপনের মা কবি নয়, মধ্যবিত্ত বা বড়লোক নয়। তার মনে এসব দৃশ্যে কোনো কবিতার জন্ম হয় না। কোনো সোনার বা রুপোর বা পিতলের বাংলার অ্যাবস্ট্রাক্ট ভাবাবেগ সৃষ্টি হয় না। এমনকি কোনো ফাঁপা শোলার বাংলারও না। শুধু একটাই ভাবনা তার মনে, সে রিপনের বাপকে খুঁজে পাবে, তার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাফ চাইবে। তার বিশ্বাস স্বামী তাকে ক্ষমা করবে এবং সব মিটমাট হয়ে যাবে।যেটুকু তথ্য তার কাছে ছিল তাই নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে সে উপস্থিত হয় ময়মনসিংহে সাদেক মিয়ার আশ্রয়ে। দুরুদুরু বুকে কড়া নাড়ে।


দরজার আড়ালে একটা নারীকণ্ঠ নড়ে ওঠে : ‘ক্যাডায়?’ রিপনের মা ভাবে সে ভুল দরজায় এসেছে। আবছা দেখতে পায় ঘোমটা পরা তার চেয়ে কম বয়সের এক নারী। মুখটা তার ভারি সুন্দর। আর পরনের শাড়িটা অবিকল তারই শাড়ির মতো।তার হাত-পা জমে যায়।গলা শুকিয়ে আসে।


ভয়ে ভয়ে বলে, ‘আমি রিপনের বাপরে খুঁজতে আছি, সাদেক মিয়া তার নাম। তেনায় এহানে থাকেন?’


সাদেক মিয়া এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।


সাদেক মিয়া! তার স্বামী, যার পায়ে পড়ে সে মাফ চাইতে এসেছে।


আবার শুরু হয় কান্নাকাটি, ফোঁপানি ও চিৎকার।


রিপনের মা নিজেকে হারায়। ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘোমটা দেওয়া মহিলার ওপরে, যদিও মহিলা জানেই না কে এই দজ্জাল নারী এবং কি-ই তার দোষ। তার পেছনে চিৎকার করতে থাকে সুন্দর চাঁদের মতো ফুটফুটে একটা মেয়ে, বছর-দেড় বয়েস। সাদেক মিয়া মেয়েটাকে কোলে নিয়ে দুই নারীর মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। সে কাউকে কিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করে না। দুই ছেলে দৌড়ে যায় বাপের কাছে। এখন সাদেক মিয়াকে সুন্দর ফলবন্ত একটি কাঁঠালগাছের মতো মনে হয়। তার দুই কোলে দুই শিশু এবং একজন তাকে জড়িয়ে ঝোলে। দৃষ্টিজুড়ানো একজন চমৎকার পিতা আর তার দুপাশে দুজন রোরুদ্যমান বাংলা।


সাদেক মিয়া তসলিমার মাকে কোনো রকমের কোনো কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। বরং তড়িঘড়ি করে রিপনের মা ও দুই ছেলেকে নিয়ে বাসস্টেশনে গিয়ে বাসে উঠে বসে। লেডিস সিটে বসে সারারাস্তা কাঁদে রিপনের মা। দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা ঘনায়। তারপর রাত বাড়ে পোয়াতি নারীর তলপেটের মতো করে। আকাশে তারার বুনন বোনে অন্ধকারে বসে কেউ। কিন্তু বাসের দুলুনিতেও তার দুই চোখের পাতা এক হয়ে আসে না।


বাচ্চা দুটি থাকে সাদেক মিয়ার সঙ্গে। সে তাদের তো লাঠি-বিস্কুট, তো মুরলি ভাজা, তো আমড়া কিনে খাওয়ায়।


মাথায় নাক রেখে তাদের চুলের গন্ধ শোঁকে। অপত্য স্নেহে বুকটা ভরে ওঠে তার। বাপ হিসেবে সাদেক মিয়াকে কেউ কোনোদিন মন্দ বলতে পারবে না, অথচ ওদেরই মায়ের প্রতি যে সে একটা ভীষণ অন্যায় করেছে তা তাকে কোনোভাবে বিচলিত করে না।


যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে সে রিপনের মায়ের কাছে আমড়া নিয়ে যায়। কিন্তু তার হাত থেকে কিছুই না নেওয়ার পণ করেছে যেন সে। টাঙ্গাইলে পৌঁছে গরম ধোঁয়া-ওঠা চা কিনে এনে সাধাসাধি করে কিন্তু রিপনের মা চা খেতেও অস্বীকার করে।


শুধু বারদুই বাস থামলে সাদেক মিয়ার ডাকে বাইরে যায় পেশাব করার জন্য। কোনো কথা কয় না। স্বামীকে তার পর মনে হয়। মনে হয় সে যেন তার মাংস কেটে লবণ ছিটিয়ে দিয়েছে।


সেই যে ‘তসলিমার মা’ ডাক শোনার পরে তার মনে হয়েছিল রিপনের বাপ তাকে রেখে আর একটি বিয়ে করেছে তা আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অথচ সে ভেবেছিল এটা তার ভুল। সে এখন কী করবে জানে না। গলায় ফাঁস দিলেও যদি শান্তি হয় সে আপত্তি করবে না। তবু এই জানোয়ারটাকে, (হ্যাঁ, ঠিক জানোয়ারই মনে হয়) সে আর নিজেকে স্পর্শ করতে দেবে না। এসব আকাশ-কুসুম চিন্তা তার মাথায় আসে, যদিও তা বাস্তবিক আকাশ-কুসুম নয় বরং অমাবস্যার চাঁদের মতোই আঁধারের বিলাপ। সাদেক মিয়া ছাড়া তার যে জীবনের কানাকড়ি দাম নেই এবং তার বাঁচার পথ যে কেউটের বিষ্ঠায় ভরা – এ-কথা সে বেমালুম ভুলে যায় ওর বেইমানির বিহ্বলতায়।


বাচ্চারা বাসে বাবার কোলে দুলে দুলে ঘুমায়। বাইরে রাত ঘুটঘুট করে। অন্ধকারে গাছগুলো ছাতা মাথায় ভূতের মতো হাঁটে। দূরে টিম টিম করে হারিকেন বা কুপির আলো। সাদেক মিয়ারও দুই চোখ বুজে আসে এবং সে ঘুমোতে ঘুমোতে খোয়াব দেখে।


শুধু ঘুমায় না রিপনের মা।


ভোরে এসে বাড়ি পৌঁছায়।


দুই ছেলেকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রিপনের মা চলে যায় গলাচিপায় তার খালাত ভাশুরের বাসায়। বলা চলে গৈর দিয়ে পড়ে। ভাশুর রাগী ও মানী মানুষ। চাঁছাছোলা কথা বলে সবাইকে মুখ দিয়ে ধুয়ে ফেলে। কিন্তু বিপদে-আপদে সে-ই সবার মুরব্বি।


‘বেতাইয়া এই হারামির পাউল্লার চামড়া তুইল্যা নেওয়া দরকার’, সে গর্জন করে ওঠে। সাদেক মিয়ার নিতম্বের চামড়া তুলে নেওয়ার হুংকারে রিপনের মায়ের অসহায় অবস্থায় কোনো ইতর-বিশেষ হয় না। সাতদিন চলে যায়, সাদেক মিয়া বউয়ের খোঁজ নিতে আসে না। রিপনের মাও বাড়ি যাবে না গোঁ-ধরে থাকে।


বিকেলের সূর্য পশ্চিমে নেমেছে। বড় জা রিপনের মায়ের পেছনে বসে তার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে আর দুই নখের মাঝখানে পটাস পটাস উকুন মারছে।


সে তাকে বোঝায়, ‘বইন কী করবা। মাইয়ালোক হইয়া জন্ম লইছ, স্বামীর ঘর তো করতে অইব। আল্লা তা’আলা স্বামীর পায়ের তলায়ই আমাগো বেহেশত বাইন্দা দিছে।’


রিপনের মা ফোঁস করে ওঠে, ‘ভাবি তুমি কি কইতাছ? অর পায়ের নিচে আমার বেহেশত? ও যদি দোজখে যায়, ও কি লাত্থি দিয়া আমারে বেহেশতে ফালাইয়া যাইব, না সাথে লইয়া যাইব?’


বড় জা অশিক্ষিত মানুষ।


এ-প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। সে জানে, সাদেক মিয়া নামাজ কামাই করে না। যে নামাজ কামাই করে না, সে কেন দোজখে যাবে সেটা তার কাছে পরিষ্কার নয়। চারটা বিয়া যেখানে করা যায় সেখানে একটা কম বা একটা বেশি বিয়ে করায় বেহেশত বাদ যাবে কেন?


পশ্চিমের আকাশে সিন্দুরে মেঘে মানুষের মুখের মতো অনেকগুলো মুখ। কারো নাক উঁচা, কারো গাল ভারী, কারো চোখ ট্যাড়া, কারো কোনো অবয়ব নেই। উঠানের পাশে কলাগাছের শরীরে শাড়ির মতো জড়িয়ে অনেকগুলো তেলাকুচা লতা। অনর্থের অর্থবাহী আগাছা এসব। অথচ তাদেরই সবুজ পাতার আড়ালে টিলডা পটোলের মতো সিন্দুর-রঙের পাকা পাকা সুন্দর তেলাকুচা উঁকি মারছে। দরজার আড়াল থেকে মাত্র কদিন আগেই উঁকি মেরেছিল তসলিমার মা নামের সুন্দর চেহারার একজন নারী, যে রিপনের মার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে।


সেই রিপনের মার বুকে ভারি একটা দীর্ঘশ্বাসে ফুলে ওঠে।


বিশাল সমুদ্র-ঢেউয়ের মতো দীর্ঘশ্বাস।


সে জানে না যে শুধুই তার কষ্ট নয়, তসলিমার মা নামের সেই প্রাণীটির কষ্ট আর তার বড় জায়ের নির্বোধ বিশ্বাসের জঞ্জালে জর্জরিত মানবিক কষ্টগুলো সব একাকার হয়ে গেছে।
 
Last edited by a moderator:
রামবিলাসের একেকটি দিন


লেখক: সাত্যকি হালদার

সকাল দশটা বা সাড়ে দশটা হবে। ধু-ধু লাল মাটি। ডানদিকে ফসল উঠে যাওয়া মাঠ। বাঁদিকেও তাই। মাঝখানে টানটান রেললাইন। স্টেশন ছাড়িয়ে রেলপথ চলে গেছে চোখের শেষ সীমা পর্যন্ত। এ-পথের দুধারেই খানিক খানিক জুড়ে ছোটমাথা ঝাঁকড়া গাছ। মহুয়া, নিম, বনসৃজনের ইউক্যালিপ্টাস। রেলপথের সে-জায়গাগুলো ছায়া-ছায়া। রোদ আর ছায়ার মাখামাখি। এর বাইরে গাছ ছাড়িয়ে লাইন কোথাও একেবারেই ফাঁকা। তখন দুপাশে রোদের মাঠ আর মাঝে রেললাইন। কংক্রিটে শুয়ে থাকা দুসারি ইস্পাত।


এ-ইস্পাত ধরে প্রতিদিন একটি ছাতা আসে। প্রায় একই সময়ে।


বিষ্ণুপুরের দিক থেকে সে হেঁটে আসে। সিøপারের পর সিøপারে পা রেখে রেখে।


টায়ারের চপ্পলে তার চলার ভঙ্গিটি ধীর নয়। আবার দ্রুতও নয়। একটি নির্দিষ্ট গতিতেই এগিয়ে যায় ছাতা। ছাতা কখনো বাঁকে না। পাশে তাকায় না। ওপরে নয়, অকারণে দূরেও নয়। যেন শুধু পায়ের কাছেই চোখ। কখনো কখনো ছাতাটি দাঁড়িয়ে যায়। নিরীক্ষণ। তখন কংক্রিট আর রেলপাতের লোহার গোঁজে ভারী হাতুড়ির বাড়ি পড়ে কবার। ঘটাং ঘট ঘটাং। লোহা থেকে ধুলো উড়ে যায়। লাল ধুলো, খয়েরি ধুলো। তারপর আবার ছাতা চলতে শুরু করে দিগন্তের দিকে।


মোটামুটি নির্দিষ্ট সময়ে হেঁটে যাওয়া এই ছাতা, অনেকের তাই চেনা। স্টেশনে, নিচু প্ল্যাটফর্মে, মাঠে কাজ করে যারা। কিন্তু ছাতা চেনে খুবই কম। বিষ্ণুপুর থেকে ওন্দাগ্রাম – এই চোদ্দো কিমি পথে তার তো মুখ তোলা হয় না, থামা হয় কয়েকটি মাত্র জায়গায়। ফলে সে পথ চেনে। দুধার খুবই কম।


যেমন মাঝখানের স্টেশন রামসাগর, সে দাঁড়ায় না। দুপুরের প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরার জন্য যারা আগেভাগে এসে প্ল্যাটফর্মের বাঁধানো শালগাছের গোড়ায় ঝিমোয়, বা স্টেশন চত্বরের ভবঘুরে, তারা ছাতার চলে যাওয়াই দেখে। স্টেশন পার করে গিয়ে যে-লেভেলক্রসিং, প্রায় মাঠের মাঝে, সেখানে ছাতা থামে কিছুক্ষণ। লেভেলক্রসিং-লাগোয়া ঘুপচিঘরে বউ নিয়ে থাকে বিষেণলাল। বিষেণলাল রেলের খবরমতো গেট নামায় আর ওঠায়। তার ঘরের সামনে এসে রংচটা কালো ছাতাটি প্রতিদিন একবার ভাঁজ হয়। ছাতার তলা থেকে বেরিয়ে আসে রেলের খাকি প্যান্ট আর ঢোলা গেরুয়া জামার মানুষ। কথা শুরু হয় দুয়ারে। রাম রাম … বিষেণলালের বয়সও ছাতা ভেঙে বেরিয়ে আসা লোকটিরই মতো। বুড়োটে চেহারা, পাকা গোঁফ। লম্বা ঘোমটা দিয়ে থাকা তার বউ এক ঘটি ঠান্ডা জল আগেই রেখে দেয় দরজার মুখে। মুখে জল ছিটিয়ে, বাকি জল খেয়ে কোনো এক শীতকালে কথা শুরু হয় দুজনের।


– জাড় বহুত হঁয় না অজ …


– রামজি দেতা হঁয় জ্যায়সে …


– দেশো কা ইধারউধার পর খবর …


– মালুম নাহি। খবরো সে কেয়া জরুরত!


– হঁয়। খবর নেহি হোনাই তো অচ্ছা হঁয় …


বুড়োটে দুই রেল-মানুষের সংক্ষিপ্ত কিছু কথা। প্রতিদিন প্রায় একরকম। বিষেণলালের বাইরের সঙ্গে কোনো যোগ নেই। তার ঘরে টুলের ওপর একটি পুরনো কালো ভারী ফোন। তাতে শুধু ট্রেন পাস হওয়ার নির্দেশ আসে। এছাড়া পৃথিবীর সঙ্গে তার কথা নেই। ফলে সে বাইরে থেকে হেঁটে আসা ছাতামাথায় লাইন্সম্যান রামবিলাসের জন্য অপেক্ষা করে। বাইরের দু-একটি কথা শোনা যায় রামবিলাসের মুখে। শীত-গ্রীষ্মের খবর। বিষ্ণুপুরে সার্কাস। যদিও প্রতিদিন লাইন ধরে হেঁটে যাওয়া রামবিলাসেরই বা জানা থাকে কতটুকু! জীবনের বিশ বছর তো সে মাথা নামিয়ে এই চোদ্দো কিলোমিটারই হেঁটেছে।


ছাপরা ডিসটিক থেকে রেলে কাজ পেয়ে যখন সে হাঁটতে শুরু করেছিল সে-সময় রেলের পুরোটাই প্রায় কাঠের সিøপার। কাঠের সিøপারে হাতুড়ির কাজ কম। ভারী রেঞ্জের কাজ বেশি। ফলে সেই সময় সে হপ্তায় চারদিন বেরোত বড়সড় একটি রেঞ্জ কাঁধের ওপর ফেলে। অন্য দুদিন হাতুড়ি। একদিন ছুটি। এখন কাঠের সিøপার আর নেই। সবটাই কংক্রিট। বয়স হয়ে যাওয়া রামবিলাসের কাঁধে এখন ছ-দিনই হাতুড়ি।


কংক্রিট কাঠ হলো যেমন, রেঞ্জের বদলে হাতুড়ি, তেমনি কুড়ি বছরে আরো কত বদলাল চারপাশ। বিষ্ণুপুর স্টেশনের বড় কাঁঠালগাছটা কেটে অ্যাসবেস্টসের শেড হলো, স্টলের মাটির ভাঁড় বদলে কাগজ আর প্লাস্টিকের কাপ। আগে সকাল-বিকেল দুটি মাত্র এক্সপ্রেস আসত কলকাতা আর আদ্রা-আসানসোল লাইনে, এখন ছটি। কত মানুষ প্রতিদিন কলকাতা যায়। শহরে যাওয়ার দরকার কত বেড়ে উঠল লোকজনের। আগে পরব দেখা মানে ছিল বিষ্টুপুরে রাস, উলটোরথ আর পাশের গাঁ কুচিয়াকোলের রথ। এখন মানুষ পরব বুঝতে কলকাতায় ঠাকুর দেখতে যায়। কালীপুজোয় আরামবাগ ছোটে। আর সেসবের অনেকটাই হয় এই রেলপথ আর কংক্রিটের সিøপার বরাবর। রামবিলাস যা ঠুকেঠুকে ঠিক রাখে।


বিষেণলাল একেকদিন বলে, ‘আউরো কিতনে সাল নোকরি হঁয় আপকো!’


‘উঅ জানতা হঁয় খড়গপুর টিশন কো ক্লার্কবাবু …’ রামবিলাস কাঁধে হাতুড়ি ফেলে ছাতা খুলে হাঁটতে শুরু করে দেয়। পেছনে পড়ে থাকে উত্তর।


আবার ও-ও একেকদিন এমন প্রশ্ন করে। বিষেণলাল একই ধাঁচের জবাব দেয়। আসলে এদের কাজে ঢোকার কাগজেই জন্ম-বয়সের ঠিকানা ছিল না। তাই চাকরি ফুরানোরও পাথরগাছ নেই।


তারপর আবার রোদে বা শীতের বাতাসে হাঁটা শুরু করে রামবিলাস। লেভেলক্রসিংয়ের গেট পেছনে ছেড়ে এগিয়ে যায় ছাতা আর টায়ারের চপ্পল। বিষেণলাল তাকে দূরের বাঁকে হারিয়ে যেতে দেখে।


রামবিলাস কাজে ঢুকল যে-বছর, সে-বছর ওর মনে আছে পুরো এলাকায় খরা হলো। বৃষ্টির টাইমে বৃষ্টি হয়নি, ফলে খরায় পুড়ে গেল ধান। চাষ হয়নি যেখানে, সেসব জায়গায় লাইনধারের জমি রোদে ফেটে ফাঁক-ফাঁক। কোনো আশা নেই, তবু রেলপথের ধারের গাছতলায় এসে সারাদিন বসে থাকত মানুষ। দূরগাঁয়ের মানুষ। রামবিলাস যখন পার হয়ে যেত, তখন কারা যেন কথা বলত পাশ থেকে। বউরা বলত, পরে একসময় বাচ্চারাও। ‘… রিলিফের গাড়ি উদিকের টাউনে আঁইছে কি? তুমি তো রোজ রেতে বিষ্টুপুর ফের, মোদের কথাগুলাটুকু জানাই দিও সরকারকে …।’ রামবিলাস ওদের চোখে একমাত্র সরকারি লোক। আর্জি জানানোর জায়গা। কিন্তু তার তো কাঠের সিøপারে চোখ। সে কানে শুনত আর নির্বিকার হেঁটে পার হয়ে যেত।


তারপর দিল্লি থেকে নেতা এলো একদিন। ওন্দা ইস্টিশানের পাশের মাঠটায়। রামবিলাস মাথা নামিয়ে যেতে যেতে বক্তৃতা শুনেছিল। ‘… মেরে ভাইয়ো অউর বহিনো …।’ খরা হোক, বন্যা হোক যুদ্ধ কিংবা ভোট, সারা ভারতবর্ষের বক্তৃতার শুরুয়াত একটাই – ‘ভাইয়ো অউর বহিনো।’ রামবিলাস মুলুকেও শুনেছে। সেদিন সে দূরে যেতে যেতে শুনল, ‘কৃষিঋণ মুকুব করা হবে’, ‘ঘর ঘর মে সিকি পয়সা কিলো চাল’, তারপর আরো কত কী, রামবিলাস তখন অনেক দূরে, ওর কানে অস্পষ্ট। ‘কাম মিলেগা ভাই কাম … হর হাত মে। ভোট হোনে কা বাদ।’


আবার রামবিলাস রেলপথে অবরোধও দেখেছে। সরাসরি তার পথজুড়ে বসে থাকা মানুষ। সেদিন তো না দেখে উপায় নেই। তার গতি থমকে গিয়েছে ভিড়ে। পথ ঢেকে গেছে ঝাণ্ডায়। মাইকে গলার রগ ফোলানো চিৎকার। ‘… এ-রাজ্যের মানুষ, এ-রাজ্যের খেটে খাওয়া মানুষ, আমার শ্রমিক কৃষক ভাইবোন, তাদের স্বার্থে আজ এই বারো ঘণ্টার রেল অবরোধ। আমাদের তিন দফা দাবি না মানা হলে ভবিষ্যতে দেশজুড়ে চব্বিশ ঘণ্টার অবরোধে নামব আমরা। এবং আগামী বিধানসভা ভোটে আপনাদের বুঝিয়ে দিতে হবে …’ রামবিলাস দিশেহারা। কী করে সে। ভিড়টা পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়। তারপর বাকি পথ চেকিং। কিন্তু তাতে যে বিশ-তিরিশ হাত জায়গা বাকি রয়ে যায়!


রামবিলাস সেদিন জনতায় মিশে গিয়েছিল। রেলের গেরুয়া জামা ব্যাগে পুরে ঢুকে গিয়েছিল ভিড়ের ভেতর। হাতুড়ি রেখে এসেছিল সামনে। তারপর ঘুরল নেতা আর অবরোধ করা লোকদের গায়ে-গায়ে। এলোমেলো দেখে নিল সিøপার আর রেলপাত। তার চারপাশে তখন কান-ফাটানো চিৎকার। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ। আমাদের সংগ্রাম…’ রামবিলাস উবু হয়ে বসে সিøপারের গোঁজ টেনে টেনে দেখছে। নড়বড়ে মনে হলে সেদিনের মতো হাতের চাপে ঠেসে দিয়ে যাচ্ছে। তিরিশ হাত জায়গা বাকি রয়ে গেলে রাতভর ঘুম হবে না তার। মাঝরাতে চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার তো টেনে বেরিয়ে যায়!


সেই জায়গাটায় এলে এখনো রামবিলাসের বহু বছর আগের অবরোধের ছবিটা মনে হয়। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ। আমাদের সংগ্রাম …।’ কোথায় গেল তারা সবাই! নতুন উঠে আসা দলে মিশে গেল নাকি! বেলা পড়ে আসে। নির্জন রেলপথ টায়ারের চটির ছপর ছপর শব্দে পার হয়ে যায়।


ওন্দা ইস্টিশান আসতে যখন দেড় কিলোমিটার, রোদ ঘুরে গেছে, রামবিলাস দেখতে পায় ডিউটি প্রায় শেষ। এরপর সন্ধের প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে বিষ্টুপুর ফিরে যাওয়া। ও শেষবারের মতো থামে ফুলডাঙ গ্রামটা ছাড়িয়ে, যেখানে দ্বারকেশ্বর নদী রেললাইনের কাছে চলে এসেছে। সেখানে রেলের কোনো ক্রসিং নেই, ছোট অফিস বা কিছু নেই, শুধু লাইন আর নদীর মাঝে কয়েকটি মাটির ঘর। তার একটি ঘর গুলাবির। রামবিলাস নেমে গুলাবির মাটির দাওয়াটিতে বসে।


তার চেহারায় তখন খানিকটা ক্লান্তি। একটু ঝিমোনো ভাব। সকালবেলা যে-হাতুড়িটা কাঁধে গদার মতো থাকত সেটাই যেন বেশ ভার। সেভাবেই সেটাকে কাঁধ থেকে নামায়। ছাতাখানা ভাঁজ করে রাখে হাতুড়ির পাশে। তখন সে আরেকবার বলে, রাম রাম, বল রে গুলাবি!


নদীর ধারের ছোট্ট এই গ্রামের লোকেরা নানা কাজে ঘুরে বেড়ায়। কেউ নিচু জমিতে কুমড়ো আর বরবটি লাগায়। কেউ তিনটে কাঁড়া নিয়ে চরাতে চলে যায় দূরে, যেখানে লম্বা ঘাস হয় সেদিকে। কেউ সাইকেল হাঁটিয়ে শীতের নদী পার হয়ে চলে যায় বাঁকুড়া শহরের কেঁদুয়াডিহিতে, হকারি করবে বলে। গাঁয়ে থাকে যারা তারা সবাই চেনে রামবিলাসকে। কুড়ি বছর ধরে তাদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া, শেষ বিকেলে একটু বসে যাওয়া গুলাবির দাওয়ায়, সবার জানা। তারাও দেখা হলে তারই অনুকরণে বলে, রাম রাম।


গুলাবি প্রথমে এক গ্লাস জল দেয়। দুটে বাতাসা। শেষে রওনা হওয়ার আগে এক পাত্তর মহুয়া। ওটুকু দু-তিন টানে খেয়ে বুড়োটে মানুষটা কিছুক্ষণ বুকে চিবুক ছুঁইয়ে চুপ থাকে, এলোমেলো দু-একটা কথা বলে। শেষে ছাতা আর হাতুড়ি তুলে নিয়ে রওনা হয়ে যায়।


গুলাবির মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বছর তিন-চার। মেয়ের ঘরে নাতি। তবু আঠারো বা বিশ বছর বয়সে বিয়ে হওয়া গুলাবির চেহারায় সেরকম বয়স আসেনি। রামবিলাসের সঙ্গে তো তার প্রায় ততদিনেরই আলাপ সেই যবে থেকে রামবিলাস এই পথে হাঁটছে। তখন বিহার থেকে আসা কেমন পেটা চেহারা ছিল মানুষটার। রেললাইনের ধারে গাছতলায় একটুখানি বসত। কথা বলত কম কম। সেই তখন গুলাবির সঙ্গে চেনাজানা। গুলাবি দিনরাত্তির মাতাল হয়ে থাকা স্বামীর মহুয়ার চোঙা বোতল থেকে খানিকটা করে সরাতে শুরু করেছিল। একদিন দিলো রামবিলাসকে। রামবিলাস দেখল। ওর নেশার সেই শুরু। মহুয়া আর গুলাবির দাওয়ার টানে এখনো রামবিলাসের বিকেল শেষ হয়।


‘নোকরি সে রিটায়ার বাদ কেয়া করেগা!’ বুড়োটে মানুষটা উঠতে থাকলে গুলাবি কোনো কোনো দিন করে ফেলে প্রশ্নটা।


‘মুলুক। ছাপরা ডিসটিক। গঙ্গা মাইয়া কী পাশ।’ রামবিলাস টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায়।


‘হাম কো ভি লেনা চাইয়ে …।’ গুলাবি বলে। তার এখন মেয়ে-জামাই ছাড়া জীবনে আর পিছু টান নেই। কপালের পাশে চুল সবে দুটি পেকেছে।


‘পাগলা চিড়িয়া …।’ রামবিলাস রেললাইনে উঠে যায়।


গুলাবি পেছনে বলে, ‘গঙ্গার দেশে না লিবে তো ক্যানে ইখনও মউল খাওয়াই তুমায়! তখন খাওয়াইছি এক কারণে, ইখন কারণ অইন্য। ইখন মোর গঙ্গার দেশে মইরবার বড় শখ …।’


রামবিলাস শেষ দেড় মাইলের দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়। ফিরে আসে পরদিন বিকেলে। সেই ক্লান্তি টেনেটেনে আসা। তখন বলে যে, রিটায়ার পর্যন্ত যদি বাঁচে তো গুলাবিকে গঙ্গার মুলুকে নেবে ও। যেভাবে হোক নিয়ে যাবে। ছাপরা ডিসটিক। রামজি ভরওসা …


এভাবে কথার ভাঙাগড়ায় আবার একটা বিকেল শেষ হয়ে যায়।


ওন্দা ইস্টিশানে প্যাসেঞ্জার ট্রেন আসে সন্ধের পর। রামবিলাস তার আগে জল খায়, ছাতু খায়, নেশা কাটাতে মুখে-চোখে জল দেয়। কিন্তু মহুয়ার নেশা কি সহজে কাটে! তাছাড়া রামবিলাসও কি জীবনের ওই বিষটুকু থেকে বাইরে যেতে চায়!


প্যাসেঞ্জার ট্রেনে কম আলো। ফাঁকা সিট। রামবিলাস ঝিমোতে ঝিমোতে বিষ্টুপুরের এক কামরার রেল-কোয়ার্টারে ফিরে আসে। টিভি সিরিয়ালের ঝাঁজালো শব্দের ভেতর থেকে ওর ভারী চেহারার বউ উঠে এসে তখন ছিটকিনি খুলে দেয়।
 
দুটো আলাদা আলাদা গল্প, দুইটা থ্রেডে পোস্ট করলে ভালো হত।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top