২০১৮ সাল বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য খুব বেশি সুখকর নয়। মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা যেমন কমেছে, সুপারহিট কিংবা হিট ছবির সংখ্যাও তেমন কমেছে। মধ্যমমানের আর ফ্লপ ছবি দিয়ে বছর শেষ করতে হয়েছে।
এই বছর মুক্তি পেয়েছে মোট ৫৭টি ছবি, যার ১২টি আমদানি করা ও ৩টি যৌথ প্রযোজনার। ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রগুলো হল ‘দেবী’, ‘পোড়ামন ২’, ‘দহন’, ‘সুপার হিরো’ ও ‘চিটাগাইংয়া পোয়া নোয়াখাইল্যা মাইয়া’। তবে অন্যান্য বছরের মত এই বছরও কিছু সম্ভাবনাময় নবীনের সন্ধান পেয়েছে ঢালিউড। অন্যদিকে হারিয়েছে কয়েকজন কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্বদের।
এক.
দেশে ও দেশের বাইরে ২০১৮ সালের সবচেয়ে আলোচিত ছবি ‘দেবী’। প্রথমত, জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলী সিরিজ থেকে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র। তাও আবার সরকারি অনুদানে। দ্বিতীয়ত, ছবির সহ-প্রযোজক দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সি-তে সিনেমার ব্যানারে ছবিটি নির্মাণ করেছেন অনম বিশ্বাস, যিনি হিট সিনেমা ‘আয়নাবাজি’র চিত্রনাট্যকার। তাছাড়া জয়া আহসান-চঞ্চল চৌধুরী–শবনম ফারিয়াসহ চমৎকার সব কুশীলব। যদিও মিসির আলী হিসেবে পুরো নাম্বার পাননি চঞ্চল। সিনেমাটিও মূল উপন্যাসের সুর ধরে রাখতে পারেনি।
প্রিয় লেখকের প্রিয় উপন্যাস থেকে নির্মিত ছবি দেখতে দর্শকও ভিড় করেছেন এবং এখনো দেশে-বিদেশে ভিড় করছেন। ২০১৮-এর ডিসেম্বর অবধি ছবিটি দেশের বাইরে থেকে সর্বোচ্চ উপার্জনকারী চলচ্চিত্র হয়ে দাড়িয়েছে। এই অঙ্ক এক লাখ ডলারের বেশি।
‘দেবী’র পরপরই সর্বাধিক আলোচনায় এসেছে জাজ মাল্টিমিডিয়া থেকে নির্মিত রায়হান রাফীর ‘পোড়ামন ২’ ও ‘দহন’। ঈদুল ফিতরে মাত্র ২২টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পোড়ামন ২’ পরবর্তী একাধিক সপ্তাহ শতাধিক প্রেক্ষাগৃহে চলেছে এবং ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করেছে। রাজনৈতিক গল্পের ‘দহন’ নভেম্বরে মুক্তি পায়। মুক্তির আগে থেকেই এর একটি গানের কথা এবং কয়েকবার তারিখ পরিবর্তনের জন্য আলোচনায় ছিল। আরও প্রচার করা হয় মুক্তির আগে সিনেমাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখবেন। তবে মুক্তির পর ছবিটি দর্শক গ্রহণ করেছে।
ঈদুল ফিতরের ‘সুপার হিরো’ মুক্তি নিয়ে নানা কাণ্ডের পর ছবিটি মুক্তি পেলে দর্শক লুফে নেয়। শাকিব খানের অভিনয় ও জনপ্রিয়তা আর আশিকুর রহমানের সফিস্টিকেটেড নির্মাণ ছবিটিকে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। শাকিব খানের অপর দুটি ছবি ‘ক্যাপ্টেন খান’ ও ‘চিটাগাইংয়া পোয়া নোয়াখাইল্যা মাইয়া’ (চিপোনোমা) দর্শকদের বিনোদন দিতে সক্ষম হয়। তবে চিপোনোমার গল্প বাকিগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে দুর্বল।
দুই.
বছরের শুরু থেকে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নজাল’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এপ্রিলে মুক্তির পর ছবিটি নান্দনিক উপস্থাপনা, রোম্যান্স, বিচ্ছেদ ও সমাজ বাস্তবতার জন্য প্রশংসিত হলেও ব্যবসায়িকভাবে সফল নয়। জঙ্গীবাদ নিয়ে মুক্তি পায় মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘জান্নাত’ ও আবু আখতারুল ইমানের ‘মিস্টার বাংলাদেশ’। ‘জান্নাত’ মধ্যমমানের ব্যবসা করলেও ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ এর দুর্বল চিত্রনাট্য ও ভিজ্যুয়ালের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে।
বিদেশে আলোচিত ইমতিয়াজ আহমেদ বিজনের ‘মাটির প্রজার দেশে’ মুক্তি পেয়েছে মার্চে। তবে নামমাত্র মুক্তি ও সীমিত প্রচারণার কারণে আলোচনা হয়নি খুব একটা। এছাড়া বাণিজ্যিক ছবির বাইরে আলোচিত হয় অরুণ চৌধুরীর ‘আলতা বানু’, নূর ইমরান মিঠুর ‘কমলা রকেট’, অন্তু আজাদের ‘আহত ফুলের গল্প’, মাসুম আজিজের ‘সনাতন গল্প’, ফয়সাল রদ্দি ও আসিফ ইসলামের ‘পাঠশালা’। এছাড়া আলোচনা-সমালোচনায় ছিল রাশান নূরের ‘বেঙলি বিউটি’। ছবিটি কখনো দেশে অধিক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রে আয়ের রেকর্ড ভঙ্গ কিংবা চীনে হাজারখানেক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি- এসব সংবাদ দিয়ে আলোচনায় ছিল। বছর শেষে কোন প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই মুক্তি পায় শাহরিয়ার নাজিম জয় রচিত ও পরিচালিত ‘অর্পিতা’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোনের সাক্ষাৎকার নিয়ে পিপলু আর খানের ‘হাসিনা: অ্যা ডটার্স টেল’ প্রামাণ্যচিত্রটি বছরের শেষে আলোচনায় ওঠে আসে।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনী নির্ভর ‘বিজলী’ দিয়ে আলোচনায় আসেন চিত্রনায়িকা ববি। এই জঁরার সম্ভাবনাময় ছবি হিসেবে দর্শক ছবিটিকে গ্রহণ করে তবে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট নয়। আর সিনেমার মাধ্যমে প্রযোজক হিসেবে ববির অভিষেক হয় ঢালিউডে।
বেশ কয়েক বছর আগে কাজ শুরু হলেও ২০১৮ সালে এসে নামমাত্র হলে মুক্তিপ্রাপ্ত দিলশাদুল হক শিমুলের ‘লিডার’ ছবিটি মুক্তির আগে প্রধান দুই অভিনয়শিল্পী ছবিটির কাজ নিয়ে অভিযোগ করায় আলোচনায় আসে। বছর শেষে তানিম রহমান অংশুর ভৌতিক-থ্রিলার জঁরার ‘স্বপ্নের ঘর’ ছবিটি এই জঁরা একটি সফল ছবি হিসেবে ধরা হয়, তবে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে মাত্র পাঁচটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটির ব্যবসায়িক সফলতা প্রশ্নবিদ্ধ।
২০১৮ সালে ১২টি ছবি আমদানি করা হয়েছে। সেই ছবিগুলো হলো ‘জিও পাগলা’, ‘ইন্সপেক্টর নটিকে’, ‘ভাইজান এলো রে’, ‘সুলতান’, ‘ফিদা’, ‘পিয়া রে’, ‘নাকাব’, ‘আমি শুধু তোর হলাম’, ‘গার্লফ্রেন্ড’, ‘চালবাজ’, ‘তুই শুধু আমার’ ও ‘ভিলেন’। এদের মধ্যে শুধু ‘ভাইজান এলো রে’ ছবিটি দর্শক পছন্দ করেছে এবং ‘সুলতান’ প্রেক্ষাগৃহে মোটামুটি চলেছে।
যৌথ প্রযোজনার নতুন নীতিমালার কারণে এ বছর বেকায়দায় ছিলেন যৌথ প্রযোজনা ব্যবসায়ীরা। এ কারণে বেশ কিছু নিয়ম না মেনে নির্মিত সিনেমা সাফটা বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ভারতীয় প্রযোজনা হিসেবে মুক্তি পায়। কিন্তু একমাত্র ‘ভাইজান এলো রে’ ছাড়া এ জাতীয় কোন সিনেমা ভালো ব্যবসা করেনি। শাকিবের ‘চালবাজ’, ‘নাকাব’ও ব্যর্থ হয়। আলোচনায় ছিল জাজ মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে কলকাতার এসকে মুভিজের সম্পর্কের অবনতি। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার অশোক ধানুকা সরাসরি আব্দুল আজিজ ও শাকিব খানকে দায়ী করে বিবৃতি দেন। পরে অবশ্য উল্টো কথা বলেন। তবে বছর শেষে কলকাতায় শুরু হয় ‘ডেব্রি অব ডিজায়ার’ নামের যৌথ প্রযোজনার সিনেমা। এ ছাড়া অরিন্দম শীলের পরিচালনায় ‘বালিঘর’ নির্মাণের কথা থাকলেও বছর শেষে নির্মাতা জানান সিনেমাটি হচ্ছে না। এর জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতাকে দায়ী করেন।আদালতের একটি রায়ও এ বছর বেশ আলোচনা তৈরি করে। যা স্থানীয় নির্মাতাদের মাঝে স্বস্তি নিয়ে আসে। আদালত রায় দেয় ঈদ, পূজা বা পয়লা বৈশাখের মতো স্থানীয় উৎসবে আমদানি করা বিদেশি ছবি হলে প্রদর্শন করা যাবে না। এ কারণে একাধিক সিনেমা আটকে যায়। বিশেষ করে শাকিবের দুটি ছবি কলকাতার সঙ্গে একইদিন বাংলাদেশে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি।
মোটামুটি আলোচনায় ছিল ইস্পাহানী–আরিফ জাহানের ‘নায়ক’, এম সাখাওয়াৎ হোসেনের ‘আসমানী’, শাহীন–সুমনের ‘মাতাল’, মিনহাজুল ইসলামের ‘মেঘ কন্যা’, জাকির হোসেন রাজুর ‘ভালো থেকো’, ও আলমগীরের ‘একটি সিনেমার গল্প’। হতাশায় ডুবিয়েছে যেসব চলচ্চিত্র সেগুলো হল উত্তম আকাশের ‘আমি নেতা হবো’, শাহনেওয়াজ শানুর ‘পলকে পলকে তোমাকে চাই’, ওয়াজেদ আলী সুমনের ‘মনে রেখো’, এবং এ কে সোহেলের ‘পবিত্র ভালোবাসা’।
আরও পড়ুন
২০১৮ সালের সেরা ছবিগুলো
তিন.
পরীক্ষিত অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে শাকিব খান সর্বাধিক আটটি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। তার ‘সুপার হিরো’ ও ‘চিপোনোমা’ ব্যবসাসফল হয়। এছাড়া তার অন্যান্য ছবিগুলো হল ‘ক্যাপ্টেন খান’, ‘পাংকু জামাই’, ও ‘আমি নেতা হবো’ এবং আমদানি করা ‘চালবাজ’, ‘ভাইজান এলো রে’, ও ‘নাকাব’। ‘সুপার হিরো’, ‘চিপোনোমা’ ও ‘ক্যাপ্টেন খান’ ছবি তিনটিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন শবনম বুবলী। প্রিয়দর্শিনী মৌসুমীকে ‘আমি নেতা হবো’, ‘নায়ক’, ‘পবিত্র ভালোবাসা’, ‘লিডার’ ও ‘পোস্টমাস্টার ৭১’ ছবিতে দেখা যায়। তবে কোনটিই সফলতার মুখ দেখেনি। জাকিয়া বারী মম’র ‘আলতা বানু’, ‘দহন’ ও ‘স্বপ্নের ঘর’ তিনটি ছবিই প্রশংসিত হয়। অভিনেতা আলমগীর দীর্ঘ ২২ বছর পর ‘একটি সিনেমার গল্প’ দিয়ে পরিচালনায় ফিরেন। কিন্তু ছবিটি দুর্বল গল্পের জন্য সমালোচিত হয়।
গত বছর ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর মত হিট ছবির নায়ক আরিফিন শুভকে এই বছর মাত্র দুটি ছবিতে দেখা যায়। ‘ভালো থেকো’ ও ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবি দুটিই ব্যর্থ হয়। ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর আরেক অভিনয়শিল্পী মাহিয়া মাহীর ‘জান্নাত’ কিছুটা আলোচিত হলেও ‘মনে রেখো’, ‘পলকে পলকে তোমাকে চাই’, ও পবিত্র ভালোবাসা’ তাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। ঢালিউডের সুলতান হিসেবে পরিচিত বাপ্পী চৌধুরী ‘পলকে পলকে তোমাকে চাই’, ‘নায়ক’ ও ‘আসমানী’ ছবিগুলো নিম্ন থেকে মধ্যম মানের ব্যবসা করে। সাইমন সাদিককে ‘জান্নাত’ ও ‘মাতাল’ ছবি দুটিতে দেখা যায়। জঙ্গীবাদ নিয়ে নির্মিত প্রথম ছবিটি আলোচিত হলে, পরেরটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া লাভ করে। বিদ্যা সিনহা মীমকে ‘আমি নেতা হবো’, ‘পাষাণ’ ও ‘সুলতান’ ছবিতে দেখা যায়। ছবি তিনটি মোটামুটি ব্যবসা করে।
তবে ‘দেবী’ দিয়ে বাজিমাত করেছেন জয়া আহসান ও চঞ্চল। বছরের শুরুতে জয়া অভিনীত বেশ আগের ছবি ‘পুত্র’ সরকারি সহায়তায় শ’খানেক হলে মুক্তি পেলে সাড়া পায়নি। এ সিনেমা পরিচালনা করে টিভি পর্দার সাইফুল ইসলাম মান্নু।
২০১৭ সালের শেষদিকে ‘অন্তর জ্বালা’র অভিনয় দিয়ে নজর কাড়েন পরী মনি। চলতি বছরের ‘স্বপ্নজাল’ তাকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যায়। ছবি যেমনই করুক বক্স অফিসে সবাই পরীর প্রশংসা করেছেন।
চার.
২০১৮ সালে চলচ্চিত্রে আগত নবীনদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পূজা চেরি। যদিও শিশুশিল্পী হিসেবে পূজা পূর্বে কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, তবে প্রধান চরিত্রে যৌথ প্রযোজনার ‘নূর জাহান’ দিয়ে তার আগমন ছিল দুর্দান্ত। মারাঠি ভাষার ‘সৈরাট’ ছবির অনুকরণে নির্মিত ছবিটিতে তার অভিনয় প্রশংসনীয়। এই বছর ‘নূর জাহান’ ছাড়াও ‘পোড়ামন ২’ ও ‘দহন’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। পরের দুটি ছবিতেও তিনি সমান্তরালে অভিনয় করে গেছেন। বলা যেতে পারে, বাণিজ্যিক ছবিতে শাবনূর পরবর্তী অন্যতম সেরা ও স্বতঃস্ফুর্ত অভিনেত্রী পেল ঢালিউড।
পূজার পরবর্তী দুই ছবির প্রধান নায়ক চরিত্রে অভিষেক হয় অভিনেতা সিয়াম আহমেদের। সিয়াম ছোট পর্দার পরিচিত মুখ, অভিনয় করেছেন টেলিভিশন নাটকে ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে। বড়পর্দায় তার অভিনয় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং দর্শক পছন্দ করেছে। কিছু অংশে তার কাজ সুন্দর-পরিপাটি আবার কিছু অংশে অতি-অভিনয়ও পরিলক্ষিত হয়েছে। যেহেতু কাজের প্রতি ডেডিকেশন আছে ও গল্প নির্বাচন ভালো, নায়ক হিসেবে তিনি টিকে যাবেন।
সিয়ামের মতই ‘পোড়ামন ২’ ও ‘দহন’ দিয়ে এই বছর আলোচনায় ছিলেন পরিচালক রায়হান রাফী। প্রথম দুটি কাজই ছিল টাফ বিষয়বস্তুর উপর, প্রথমটি ধর্ম নিয়ে ও পরেরটি রাজনীতি নিয়ে। সাথে পেয়েছেন একটি বড় প্রযোজনা সংস্থার ছায়া। ছায়া এক্সপেরিমেন্টাল এই দুই কাজে তিনি মোটের উপর সফলই বলা চলে, দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছেন। দুটি ছবির ব্যবসায়িক দিক থেকে সফল। তবে তার গল্প বলার ঢঙ অতি-বর্ণনামূলক এবং ছবিগুলো যেন শেষ হবে হবে করে শেষ হচ্ছে না ধরনের। গল্পের মেদ কমাতে পারলে কাজগুলো আরও সুন্দর হত।
বছরের শেষে এসে অভিষেক হয় আরেক পরিচালক তানিম রহমান অংশুর। ভৌতিক-থ্রিলার জঁরার ‘স্বপ্নের ঘর’ ছবিটি মাত্র ৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলেও তার পরিচালনা প্রশংসার দাবীদার। ডিজিটাল যুগে তিনিই প্রথম এই জঁরাকে মানসম্মতভাবে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া রাজনৈতিক গল্পের ‘লিডার’ ছবি দিয়ে পরিচালনায় অভিষেক হয় দিলশাদুল হক শিমুলের।
এক যুগের অধিক সময় ধরে টেলিভিশন পর্দায় কাজ করেছেন দীপা খন্দকার ও গোলাম ফরিদা ছন্দা। ২০১৮ সালে এসে তাদের দুজনের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে, ‘ভাইজান এলো রে’ দিয়ে দীপার এবং ‘অর্পিতা’ দিয়ে ছন্দার। শাকিব খানের চরিত্রের বোনের ভূমিকায় দীপা চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করা যেকোন পার্শ্ব অভিনেত্রীর চেয়ে অনেক ভালো কাজ করেছেন। তার কাজ অনেক প্রাণবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী। অন্যদিকে বছরের শেষে মাত্র দুটি হলে মুক্তি পেয়েছে ছন্দার ‘অর্পিতা’। ট্রেলারে তিনি কিছুটা মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন।
টেলিভিশন পর্দা থেকে চলচ্চিত্রে আসা আরও দুই অভিনেত্রী হলেন শবনম ফারিয়া ও মুমতাহিনা টয়া। ফারিয়া নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’ উপন্যাস অবলম্বনে অনম বিশ্বাস নির্মিত ‘দেবী’ চলচ্চিত্রে জয়া আহসান-চঞ্চল চৌধুরীদের সাথে সমান্তরালে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। অভিষেক হয় অনম বিশ্বাসেরও। টয়া অভিনীত রাশান নূরের ‘বেঙলি বিউটি’ ছবিটি বছরের বড় একটা অংশ জুড়ে আলোচনায় ছিল। তবে টয়ার অভিনয় দর্শকেরা পছন্দ করেছেন।
এ বছর ছবি মুক্তির আগে অল্প-বিস্তর আলোচনায় থাকলেও হতাশায় ডুবিয়েছেন রোকন উদ্দিন। মাহীর বিপরীতে ‘পবিত্র ভালোবাসা’ দিয়ে অভিষেক হওয়া রোকনের দুর্বল অভিনয় ও চলচ্চিত্রের দুর্বল গল্প মোটেই সুখকর ছিল না।
‘স্বপ্নজাল’-এর নায়ক হিসেবে মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন ইয়াশ রোহান। ‘নায়ক’ ও ‘মাতাল’ পর পর দুই সিনেমার মাধ্যমে আলোচনা তুলেন নতুন নায়িকা অধরা খান। ‘আসমানী’ দিয়ে চলচ্চিত্রে আগমন করে আরেক নবাগত সুস্মি রহমান।
‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমার নায়িকা অঞ্জু ঘোষের ২২ বছর পর দেশে আসা ছিল ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম আলোচিত ঘটনা। তাকে নিয়ে চর্চা হয়েছে সারাদেশে। এ নায়িকা কথা দেন আবার দেশে ফিরবেন, চলচ্চিত্রে নিয়মিত হবেন। নতুন বছরের শুরুতে ‘মধুর ক্যান্টিন’ সিনেমার শুটিংয়ে অংশ নেওয়ার জন্য তার ঢাকায় আসার কথা রয়েছে।
পাঁচ.
বছরের শুরু ও শেষটাতে ছিল হারানোর বেদনা। বিশেষ করে ডিসেম্বরে এসে চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি কয়েকজন ব্যক্তি পরলোকগত হন।
ঢালিউডের শুরুর সময় থেকে লেখনী, অভিনয় ও পরিচালনা দিয়ে চলচ্চিত্রের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন আমজাদ হোসেন, হয়ে ওঠেছিলেন একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তাঁকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ‘ভালো থেকো’ (২০১৮)-এ। তার উল্লেখযোগ্য কাজ হল ‘নয়নমনি’ (১৯৭৬), ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ (১৯৭৮), ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ (১৯৮১), ‘ভাত দে’ (১৯৮৪)। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য পেয়েছেন ছয়টি ভিন্ন বিভাগে ১২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। নভেম্বরের শুরুতে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। ১৪ই ডিসেম্বর ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা।
একই মাসে মৃত্যুবরণ করেন দেশে-বিদেশে বহুল প্রশংসিত ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রের দুই পুরোধা ব্যক্তিত্ব, চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন (১ ডিসেম্বর) ও চিত্রসম্পাদক সাইদুল আনাম টুটুল (১৮ ডিসেম্বর)। আনোয়ার হোসেন ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ (১৯৭৯), ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ (১৯৮০), ‘পুরস্কার’ (১৯৮৩), ‘অন্য জীবন’ (১৯৯৫) ও ‘লালসালু’ (২০০১) চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের জন্য পাঁচটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ১ ডিসেম্বর রাজধানীর এক আবাসিক হোটেল থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে টুটুল ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রের চিত্রসম্পাদনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি বাংলাদেশ সরকারের অনুদান-প্রাপ্ত ‘কালবেলা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের শক্তিমান পার্শ্ব অভিনেতা সিরাজ হায়দার ১১ই জানুয়ারি মারা যান। তাঁকে সর্বশেষ ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আসমানী’ ছবিতে দেখা যায়। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী সঙ্গীতশিল্পী শাম্মী আখতার দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে ১৬ জানুয়ারি মারা যান। তিনি ‘ভালোবাসলেই ঘর বাধা যায় না’ (২০১০) চলচ্চিত্রের শিরোনাম গানে কণ্ঠ দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। নন্দিত গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার কাজী আজিজ আহমেদ মারা যান ৩০শে জানুয়ারি। তিনি লোকসাহিত্য নির্ভর ‘গুনাই বিবি’ (১৯৬৬), কমেডিধর্মী ‘ক খ গ ঘ ঙ’ (১৯৭০), রোম্যান্টিক ‘অনন্ত প্রেম’ (১৯৭৭) ছবির লেখক এবং ‘চোখ যে মনে কথা বলে’ গানের গীতিকার।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে ৭ জুলাই মারা যান প্রবীণ অভিনেত্রী রানী সরকার। উর্দু ভাষার ‘চান্দা’ দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করা রানী সরকারকে সর্বশেষ ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গ্রাস’ ও ‘খাঁচা’ ছবিতে দেখা যায়। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা লাভ করেন। আইয়ুব বাচ্চু জনপ্রিয় ব্যান্ড শিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেও কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানে তার কণ্ঠ শোনা যায়। তাঁর কণ্ঠে ‘আম্মাজান’ গানটি বাংলা চলচ্চিত্রের বহুল জনপ্রিয় গানের একটি। এই নন্দিত সঙ্গীতশিল্পী ১৮ই অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।
সবশেষে : এই বছরের প্রধান প্রবণতা হলো অভিনয়শিল্পীর পাশাপাশি গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় গল্প ও উপস্থাপনের দিকে দর্শকের নজর ছিল বেশি। আবার প্রচারণা যত অভিনব ছিল দর্শকের সঙ্গে সংযোগও ঘটেছে বেশি। বলা যায়, গতানুগতিক ধারার সিনেমার বাজার আরও সংকুচিত হয়েছে। নতুন নতুন আইডিয়াকে লুফে নেওয়ার জন্য দর্শক অনেকটাই তৈরি। তবে এটা ইন্ডাস্ট্রিকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যাবে তা নির্ভর করছে আগামীতে প্রযোজক-পরিচালকরা কতটা নতুন আইডিয়া নিয়ে আসবেন তার ওপর।