ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করি। ভীষণ সেনসিটিভ একটা ইস্যুর সাথে সম্পর্কিত একটা ঘটনা। প্রায় এক যুগ আগের একটা সুন্দর দিনের ঘটনা। আমি বাসে করে ভার্সিটি যাচ্ছিলাম। এ সময় বাসে এক বিহারি বৃদ্ধ ও তার ১২-১৩ বছরের নাতি নিজেদের মাতৃভাষায় অনর্গল কথা বলছিল।
তাদের এই ভাষা সম্ভবত বাসে থাকা কয়েকজন বাঙালি ভদ্রলোকের অনুভূতিতে আঘাত হানে। হঠাৎ তারা চিৎকার করে বৃদ্ধ আর তার নাতিকে চুপ হতে বলে এবং বাংলাদেশে থেকে উর্দুতে কথা বলার সাহস তারা কোথায় পেয়েছে- তার জবাবদিহি চায়। বৃদ্ধ অপমানে মাথা নীচু করে চুপ হয়ে যায়। কিন্তু তার অল্প বয়সী নাতি যেন প্রতিবাদ করতে চায়! ছেলেটার সাহস দেখে বাঙালি ভদ্রমহোদয়রা আরো জোরে চিৎকার করে তার দিকে তেড়ে আসে! ছেলেটা এবার ভয়ে কেঁপে ওঠে এবং মাথা নীচু করে। তারপর গলার স্বর বেশ খানিকটা নীচু করে বৃদ্ধর সাথে নিজ ভাষায় কথা বলে যায়। তার কণ্ঠস্বরে চাপা কষ্ট তখনো স্পষ্ট। অপমানে তার ছোট্ট মুখটা রক্তিম হয়ে আছে।
আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল সেদিন। ছোট্ট এই ছেলেটার অপমানিত মুখ, কণ্ঠস্বর আমার কোমল অন্তরে কঠিন আঘাত দিয়েছিল। আমার বাঙালি অনুভূতির উপরে যে মানবিক অনুভুতি— তাতে আঘাত লেগেছিল সেদিন। কিন্তু সে কথা বলার জো ছিল না। আজও এক প্রকার ভয়ে ভয়েই এই গল্পটা লিখছি। জানি না কে কীভাবে নেবে!
অবশ্যই আমি মনে করি, বাসের ঐ ভদ্রমহোদয়রা সমস্ত বাঙালি সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন না। বাঙালি মানবিকবোধের দিক থেকে অনেক বেশি উন্নত একটি জাতি। কিন্তু বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যকার জটিল সম্পর্কের কারণে অনেক সময়ই অনেক অমানবিক বিপর্যয় ঘটে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দ্বন্দ্ব এবং তা থেকে তৈরি হৃদয়ের ক্ষত তো সহজে শুকানোর নয়! সুতরাং বাঙালির আবেগ এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
অন্যদিকে; নতুন প্রজন্মের বিহারি জনগোষ্ঠীর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এই বাংলাদেশেই। অনেকের বাবার জন্মও এই বাংলাদেশে। কিন্তু পূর্বপুরুষের পাকিস্তানি পরিচয়ের বেড়াজালে আটকা পড়ে তাদের জীবন হয়েছে দুর্বিষহ। পূর্বপুরুষের কলঙ্কের ভারে (?) চাপা পড়েছে তাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ!
বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারি জনগোষ্ঠীর মানবিক সংকট নিয়ে কথা বলাটা সহজ নয় – যেহেতু বিষয়টি ভীষণ সেনসিটিভ এবং এর সাথে বাঙালি কিংবা বাংলাদেশিদের ভাবাবেগ জড়িত রয়েছে। তাই বাংলাদেশের নাটক-সিনেমায় এই বিষয়টি খুব একটা উঠে আসেনা।
বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের মানবিক সংকট নিয়ে প্রশংসিত নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল বানিয়েছিলেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র- স্বপ্নভূমি / দ্য প্রমিস্ড ল্যান্ড (২০০৭)। বহির্বিশ্বে ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা পেলেও বাংলাদেশে ছবিটি বিতর্কিত হয়।
হইচই–এর নতুন সিরিজ ‘রিফিউজি’ অবশ্য বিহারিদের মানবিক সংকটকে তুলে ধরার পাশাপাশি বাঙালি ভাবাবেগকেও সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। নির্মাতা এখানে মূলত বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যকার জটিল সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরেছেন। একদিকে আমরা দেখি, বিহারিদের আত্মপরিচয়ের সংকট এবং তা থেকে সৃষ্ট মানবিক সংকট; অন্যদিকে বাঙালিদের ভাবাবেগের পাশাপাশি নিরাপত্তা সংকট। দুইপক্ষই এখানে পারস্পরিক অবিশ্বাস দ্বারা সৃষ্ট এক জটিল সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সিরিজের গল্পে একদিকে আমরা দেখি– বিহারি ক্যাম্পে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের অস্তিত্ব সংকট এবং তা থেকে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ার নানা ঘটনা; অন্যদিকে সমান্তরালে দেখি- বাঙালির নিরাপত্তা সংকট এবং ভাবাবেগের নানা দিক।
সিরিজের মুখ্য চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন সোহেল মণ্ডল, জাকিয়া বারী মম, শরীফ সিরাজ ও আফজাল হোসেন।
নতুন প্রজন্মের বিহারি যুবক চরিত্রে ছিলেন সোহেল মণ্ডল ও শরীফ সিরাজ। একদিকে তাদের জন্মস্থান বাংলাদেশ এবং অন্যদিকে তাদের পৈতৃকসূত্রে পাওয়া পাকিস্তানি পরিচয়; এই দুই বিপরীতমুখী সত্তা তাদের ভিতরে যে অস্তিত্বের সংকট তৈরি করে- তা সিরিজে স্পষ্টভাবে এসেছে। পাশাপাশি; কীভাবে তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে- তাও আমরা দেখি।
সোহেল মণ্ডল তার চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। যদিও ভাষাগত দিক থেকে তার কিছু দুর্বলতা চোখে পড়েছে (যেহেতু বেশির ভাগ সংলাপ ছিলো বিহারি ভাষায়); তবে তার লুক, এক্সপ্রেশন, বডি ল্যাংগুয়েজ অর্থাৎ সার্বিক অভিনয় ছিলো বেশ সাবলীল। শরীফ সিরাজের চরিত্র সোহেল মণ্ডলের চরিত্রের চেয়ে খানিকটা কম স্পেস পেলেও অভিনয়ে তিনি সোহেল মণ্ডলের চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে ছিলেন না; বরং বিহারি ভাষায় সংলাপ বলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যদের থেকে অনেক বেশি সাবলীল। তার চরিত্রটাও গুরুত্বের দিক থেকে সিরিজের অন্যতম সেরা চরিত্র।
জাকিয়া বারী মম একজন কঠিন স্বভাবের পুলিশ অফিসার চরিত্রে দারুণ মানিয়ে গেছেন। মম ভীষণ ভালো অভিনেত্রী এবং তিনি বরাবরই চমৎকার অভিনয় করেন।
অন্যদিকে আফজাল হোসেন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করেছেন এবং তিনি তার চরিত্রে ঠিকঠাকই ছিলেন। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চরিত্রে মনির খান শিমুল (পুলিশ অফিসার) বা আরো যারা ছিলেন – সবাই নিজ নিজ চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন।
সিরিজটি লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন ইমতিয়াজ হোসেন। বিতর্কিত একটি ইস্যুকে বেশ যৌক্তিকভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন তিনি। দুইপক্ষের সংকট কিংবা ভাবাবেগই সমান্তরালে উঠে এসেছে গল্পে; যা বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে।
ক্রিয়েটিভ প্রডিউসার হিসেবে ইমতিয়াজ হোসেনের পাশাপাশি নাম আছে আদনান হাবীব এবং আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ দেখার পর স্বভাবতই সাদের কাজের প্রতি আগ্রহটা খুব বেশি আমার। তার নাম থাকলে যে কোন কাজ দেখার প্রতি আগ্রহটা অনেকখানিক বেড়ে যায় আজকাল। ‘রিফিউজি’ তার নামের প্রতি সুবিচার করেছে বলা যায়।
সিরিজটির ভালো একটি দিক ছিল গল্পের বিষয়বস্তু অনুযায়ী কালার টোন। কালারিস্ট চিন্ময় রয় অবশ্যই তার কাজের জন্য বিশেষ প্রশংসা পাবেন। ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি, তুহিন তমিজুল দারুণ কাজ করেছেন। তার আগের কাজ যেহেতু ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সেহেতু তার কাজের মান নিয়ে সন্দেহও থাকার কথা না। রিফিউজি তার ফিল্মোগ্রাফিকে সমৃদ্ধই করবে। আনিস মাসুদের সম্পাদনাও মেদহীন মসৃণ।
সবমিলিয়ে, হইচই-এর নতুন সিরিজ ‘রিফিউজি’ ভাষাগত কিছু সমস্যা বাদ দিলে বেশ অর্থবহ ও মানসম্মত একটি সিরিজ হয়েছে। এ ধরণের অর্থবহ ও মানসম্মত সিরিজই আসলে দর্শক হিসেবে আমি সবসময় প্রত্যাশা করি।
* লিখেছেন: এমডি রমিজ