প্রথম পা রেখে মনে হয়েছে এ এক অন্য মহাদেশ। সে আমার কেবল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন নয়, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে যাত্রা। ‘প্রোগ্রাম ইভালুয়েশন’ বিষয়ে উচ্চতর একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়ে কানাডা গমন। উচ্ছ্বাসটা তাই বেশি ছিল। এ এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। কানাডার বাণিজ্যিক শহর টরন্টো ছেড়ে আরও দূরে রাজধানী অটোয়ায় গিয়ে নামলাম। কী ঝাঁ-চকচকে এয়ারপোর্ট! আমেরিকা তল্লাটে সে আমার প্রথম পা ফেলা। অটোয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যখন নামি, তখন রাত। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিলাম। আমার গন্তব্য ইউনিভার্সিটি অব অটোয়া। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১২টা পেরিয়েছে। ট্যাক্সি আমাকে জায়গামতো নামিয়ে দিল। না, আলাদা করে কোনো বৃহৎ তোরণ বা গেট নেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে, যেমনটি প্রায়ই দেখি আমাদের দেশে। সে যাকগে, মানবমন কেবল মিল খোঁজে।
অটোয়া ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে
অভ্যর্থনা ডেস্কে একজন নারী। মৌলিক কিছু নথিপত্র দেখে আমাকে একটি কার্ড ধরিয়ে দিল। বলল, প্রথমে ডানে, তারপর বাঁয়ে গেলে চারতলা লাল একটি বিল্ডিং। সেখানে প্রবেশের এ কার্ড, তারপর লিফট চেপে তিনতলায়। তিনতলায় পৌঁছে নিজ কক্ষে প্রবেশের আরেকটি গোপন পিন নম্বর দিল। একসঙ্গে এত এত ইংরেজিতে ইনস্ট্রাকশন, খানিক হিজিবিজি ঠেকল। কোনো দিকে জনমানব নেই। আমাদের দেশের মতো পিয়ন-চাপরাশির বালাই নেই। সব নিজেকে করতে হয় এখানে। শরীর যারপরনাই অবসন্ন। এক হাতে চেপে ধরলাম আমার বড় লাগেজটি, অন্য হাতে কেবিন লাগেজ। প্রতিটি ব্যাগেই মাত্র দুটি করে চাকা, তাই এগুলো হাঁটাতে বেশ গায়ের জোর খাটাতে হয়। চার চাকার ব্যাগ হলে টেনে নিতে কিছুটা আরাম হতো। রিসেপশন থেকে শুকনো খাবারের একটি প্যাকেটও ধরিয়ে দিল। হাঁটতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় ফেলছিল খাবারের এ প্যাকেট। কোন হাত দিয়ে ধরব এ প্যাকেট?
আমার থাকার ব্যবস্থা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে। আমার জন্য বরাদ্দ একটি কক্ষ। সময় এক মাস। ঘরে একটি খাট, একটি পড়ার টেবিল, এক কোনায় কাপড় ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা। এক কথায় অসাধারণ! ঘরের জানালা খুললেই এত বেশি গাছগাছালি, যেন ফরেস্ট দেখছি। সব দেখে আমার ক্লান্তি ক্রমে কমতে শুরু করেছে।
সকালে ঘুম ভাঙলে বিস্ময় আরও বাড়ে। ঘর থেকে তৈরি হয়ে বের হলাম নাশতা করব বলে। দেখি, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একদল কানাডিয়ান সৈনিক কুচকাওয়াজ করছে। তাদের পরনে লাল রঙের পোশাক, মাথায় ঐতিহ্যবাহী বাহারি চুলের টুপি। খানিক পর আরও শিহরিত হলাম এটা দেখে যে এই ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে পাথুরে একটি নদী।
উৎসবে উৎসুক দর্শনার্থী
ক্লাসরুম থেকে সর্বক্ষণ নদীর কলকল-ছলছল শব্দ শোনা যায়! আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম নদীর পাড়ে কানাডিয়ানরা তৈরি করে রেখেছে আমাদের মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্য। বড় আপন লাগল। খুব চেনা সে মুখ। এখন আর একা লাগছে না।
একদিন ক্লাস করতে গিয়ে ঘন কালো নোটিশ বোর্ডে সাদা রঙে লেখা একটা বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ল। দুটো অফার, কিন্তু বেছে নিতে হবে তার কেবল একটিকে। একটি হলো সামনের শনিবার শপিংয়ে নিয়ে যাওয়া হবে শিক্ষার্থীদের, আরেকটি হলো অটোয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত আদিবাসী ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার ব্যবস্থা। কেনাকাটায় আমার আগ্রহ কম। আমি যাব সামার সলস্টিক অ্যাবরিজিনাল ফেস্টিভ্যালে। সুনিশ্চিত। এ উৎসব অটোয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়।
দেশি-ভিনদেশি শত শত দর্শক একটি প্রকাণ্ড মাঠকে ঘিরে থাকে সকাল থেকে। মাঠের চার দিকের কেবল এক দিকে গ্যালারির মতো বসার ব্যবস্থা, বাকি তিন দিক সমতল। সবার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়! এখানে কেবল দুটি দল—একদল কানাডা এবং বাইরের অন্যান্য দেশ থেকে আসা আদিবাসী গোষ্ঠী, যারা এই উৎসবে পারফর্ম করবে, অর্থাৎ তাদের সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ প্রদর্শন করবে; আরেক দল হলো আমার মতো দর্শনার্থী। আদিবাসীরা সবুজ এ মাঠে প্রদর্শন করবে তাদের নিজস্ব সংগীত, নৃত্য, নানা কলাকৌশল, যার সবটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
উৎসবে দর্শনার্থীদের সতস্ফূর্ত উপস্থিতি
কিন্তু ভিনদেশি কিংবা ভিন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির প্রতি আমার আগ্রহ আর ভক্তি আমাকে এখানে এনেছে। আমি বেশ আরাম করে দাঁড়িয়েছি অন্যদের সঙ্গে। সূর্যের তীব্রতা আমার আরামে খানিকটা ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল বৈকি। কখনো কোনো দল হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছে, কোনো দল নাচতে নাচতে মাঠে ঘুরছে, কোনো দল গাইতে গাইতে। সে ভাষা আমি বুঝিনি, কিন্তু অনুভব করেছি তাদের সংস্কৃতি, আচার আর নানাবিধ চর্চার শক্তি ও স্বাতন্ত্র্য। হয়তো আমার দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের মতো গাইছিল...‘পিন্দারে পলাশের বন’। না, কোনো আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের প্রবেশ নেই সেখানে। নানা জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি রক্ষায় কানাডার রাষ্ট্রব্যবস্থা বেশ সহায়ক শুনেছি, কিন্তু এ উৎসবের আয়োজন না দেখলে সে সহযোগিতার মাত্রা অজানা থেকে যেত।
একদল আদিবাসী মাথা ও পিঠে বেঁধেছে পালকের তৈরি অলংকারবিশেষ; সম্পূর্ণ পিঠ জড়িয়ে আছে তাতে। দেখতে আমাদের রাজরাজড়াদের ব্যবহৃত বৃহৎ হাতপাখার মতো, পিঠের ওপর নানা কায়দায় ছড়িয়ে। মাথায় নানা ঢঙের বাহারি পশমের অলংকার, অনেকটা টুপির মতো। গলার মালা গলাকে জড়িয়ে বুককে ছাপিয়ে নেমে গেছে উদর অবধি। কিছু কিছু আদিবাসীর পোশাক সম্পূর্ণ শরীরকে ঢেকেছে, কিছু কিছু অর্ধনগ্ন। আমার দেশের চাকমা পুরুষের ধুতি- লুঙ্গি আর চাকমা নারীর ‘পিনন’ ও ‘হাদি’ এখানে নেই। মুখের ওপর নানা রং দিয়ে এঁকেছে নানা কীর্তিকাহিনি। কারও কারও পায়ে আমাদের মতো নাচের ঘুঙুর। ওদের নিজস্ব জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে তুলে আনার এ প্রয়াসে আমার মাথা নত হয়। না, অংশগ্রহণকারীরা কেবল একটি বয়সেই সীমাবদ্ধ নয়, শিশু থেকে প্রৌঢ়, অর্থাৎ দু-তিন প্রজন্ম এ উৎসবে যোগ দিয়েছে। কানাডার গ্রীষ্মকাল। সূর্য ক্রমে তার উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। এ সূর্য আজ পৃথিবীর সব আদিবাসীর দেবতা।
উৎসবে অংশগ্রহণকারী ভূমিপুত্রের সঙ্গে
ভিনদেশের সবুজে বসে আমার কেবল মনে পড়ছিল আমার দেশের সাঁওতালদের দাসাই উৎসবের কথা, দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে যে উৎসব হয় শরৎকালে দুর্গাপূজার সময়। চাকমাদের চৈত্র মাসের বিজু আর তার পানিতে ভাসানো ফুল। ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বৈসাবি, যেখানে বয়স্করা ছোটদের করে আশীর্বাদ আর তরুণ-তরুণীরা বয়স্কদের করায় গোসল। মারমাদের সাংগ্রাই-বা কম কিসে, যেখানে হয় পানি-ছোড়াছুড়ি। আর মুরংদের চাংক্রান, যার অনুষঙ্গ পুষ্পনৃত্য। আহা! শুক্লা একাদশী তিথির করম উৎসব, সারা রাত ধরে ঝুমুরগান আর যৌথ নাচ! কেবল অবিবাহিত ও নববিবাহিতা নারীরা নাচতে পারে এ উৎসবে। তারা হাত ধরে অর্ধবৃত্তাকারে এক পা সামনে ফেলে, ফের আরেক পা পেছনে, পুরুষেরা বাঁশি আর ড্রাম বাজায়। পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডের বাহা উৎসব তো আছেই, বিশ্বনন্দিত।
আমার মন অটোয়ায় ফিরে আসে। সূর্য ঠিক মাথার ওপর, একেবারে ঠা ঠা রোদে যাকে বলে। অটোয়ার এই আদিবাসী উৎসবের এখানেই শেষ নয়; এখানে বসেছে মেলা, আগত আদিবাসী কর্তৃক প্রস্তুতকৃত নিজেদের পণ্যসামগ্রী বিক্রির ব্যবস্থা। তাদের অলংকারাদি, পোশাক, ব্যবহারের পণ্যসামগ্রী, কারুশিল্প, কী নেই তাতে। প্রতিটি পণ্য হাতের তৈরি, যন্ত্রের নয়। পৃথিবীর পরতে পরতে এত বিস্ময়? কী পরম মমতায় আর যত্নে আগলে রেখেছে নিজেদের অতীত। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে অন্য পর্যটকদের অনুরোধ করছি আমার ছবি তুলে দিতে, এর কিছু যদি সংরক্ষণে রাখা যায়!
মহাত্মা গান্ধীর মুর্তির পাশে
মানুষ ক্রমে একা হচ্ছে। প্রকৃতির মাঝখানে নিজ সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচার চর্চা জীবনের প্রাণস্পন্দন। আদিবাসীরা তাদের জনজীবনে সে প্রাণস্পন্দন নিয়ে তাদের স্বাতন্ত্র্যকে টিকিয়ে রেখেছে। কেবল প্রকৃতিই তাদের ঈশ্বর, প্রকৃতিকে তুষ্ট রাখায় যেন তাদের প্রধান ব্রত। শহুরে সংস্কৃতির সামনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আদিবাসী সংস্কৃতি। কানাডায় আদিবাসী বোঝাতে ইংরেজি ‘অ্যাবরিজিনাল’ ও ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে অটোয়ায় এই সামার সলিস্টিক ইন্ডিজেনাস ফেস্টিভ্যালটি অনুষ্ঠিত হয়। এই শিল্প উৎসবে একত্র হয় আদিবাসী শিল্পী, অভিনয়শিল্পী, শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী এবং কানাডার আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের সংস্কৃতি, জ্ঞান বিশ্বের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে। কিছুদিন ধরে এ উৎসব চলে, কিন্তু কানাডার আদিবাসী দিবস শেষ হয় ২১ জুনে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কানাডা মনে করে, ইনুইট, ফার্স্ট নেশনস এবং মাতিজ জনগণ কানাডার পক্ষে বৃহৎ অবদান রেখেছে। তারাই মূলত কানাডা তৈরি করেছে।
কানাডা সরকার আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য উদ্যাপনের জন্য ২১ জুনকে জাতীয় আদিবাসী দিবস মনোনীত করেছে। এটি নিছক একটি তারিখ নয়, এটি একধরনের স্বীকৃতি আদিবাসীদের জন্য। দিনটি বেছে নেওয়ার পেছনে আরেকটি তাৎপর্য আছে। বছরের সবচেয়ে দীর্ঘ দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে, যে দিনে সূর্য সর্বাধিক সময় আকাশে অবস্থান করে। প্রজন্ম ধরে, বহু আদিবাসী সম্প্রদায় বছরের এ সময়ে তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য উদ্যাপন করে চলছে। প্রতিবছর এ আয়োজনে ৪০ হাজারেরও বেশি দর্শনার্থীর ভিড় জমে অটোয়ায়। নগরবাসী আর আদিবাসী একাত্মা হয়। জয় হোক পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর। জয় হোক মানবতার।
স্রোতস্বীনির ধারে
সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে ফিরে গান্ধীজির কাছে গেলাম। তাঁর পায়ের কাছে বসে রইলাম খানিকক্ষণ। পাশে নদী বইছে। পানি আছড়ে পড়ছে নদীর পাথরে। সে শব্দ ভারি শ্রুতিমধুর!
* লেখক: মহুয়া রউফ | গবেষক ও পরিব্রাজক