আপন সম্প্রদায়ের চরম দুর্ব্যবহারের মুখেও রাসুলে করিম (সা.) তাদের সৎ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মন্দ থেকে নিষ্কৃতির জন্য প্রচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একদিকে আল্লাহ তাদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করলেন, অন্যদিকে তাঁর ধর্মে নবাগতদের তারা হুঁশিয়ার করে চলল।
আত-তুফায়ল প্রায়ই বলতেন, তিনি যখন মক্কায় আসেন, রাসুলে করিম (সা.) তখন ওখানে ছিলেন এবং কিছু কোরাইশ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। (তিনি একজন উঁচু দরের কবি ও খুব বুদ্ধিমান লোক ছিলেন।) তারা বলল, ‘এই লোকটা তাদের বিস্তর ক্ষতি করেছে। তাদের সম্প্রদায়কে ভেঙে টুকরা টুকরা করেছে, তাদের একতা ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে লোকটা জাদুকরের মতো কথা বলে, সেই কথায় বাপ, মা, ভাই, স্ত্রী থেকে মানুষ আলাদা হয়ে যায়। আপনি ও আপনার লোকজনের ওপরও তাঁর কথার পরিণাম এই রকম হবে বলে আমাদের ভয় হচ্ছে। কাজেই তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন না, তাঁর কথা শুনবেন না।’
ওরা এ রকম জিদ করল যে আমি ঠিক করলাম, আমি তাঁর কথা শুনব না, তাঁর সঙ্গে কথা বলবও না। মসজিদে যাওয়ার সময় দৈবাৎ যদি তাঁর একটা কি দুটি কথা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার কানে চলে আসে, সেই ভয়ে আমি একেবারে কানে তুলা গুঁজে দিলাম। মসজিদের কাছাকাছি গিয়ে দেখি কাবার পাশে নামাজে দাঁড়িয়েছেন আল্লাহর রাসুল (সা.)। আমি তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আল্লাহর বিধান ছিল, আমাকে তাঁর কিছু কথা শুনতে হবে এবং আমি এক সুন্দর কথা শুনে ফেললাম। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহ, আমার প্রতি রহম করুন! এই আমি একজন কবি, একজন বুদ্ধিমান মানুষ, যে ভালো-মন্দের ফারাক বোঝে, কাজেই লোকটা কী বলছে আমি কেন শুনব না? তাঁর কথা যদি ভালো হয়, আমি তা গ্রহণ করব। বর্জন করব, যদি তা মন্দ হয়।
যতক্ষণ রাসুলে করিম (সা.) ওখানে ছিলেন, আমিও সেখানে ছিলাম। তারপর রাসুল (সা.) বাড়িতে গেলেন। আমি গেলাম তাঁর পেছনে পেছনে। তাঁর সঙ্গে আমি তাঁর ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলাম। সবাই কী বলেছে আমাকে তাঁর সম্পর্কে, আমি তাঁকে তা বললাম। বললাম, আমি এত ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে আমি কানে তুলা দিয়ে গিয়েছিলাম, যাতে তাঁর কোনো কথা আমাকে শুনতে না হয়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না যে আমি বধির থাকি। এক অপূর্ব সুন্দর বচন আমার কানে চলে এসেছে। বললাম, ‘আমার কাছে সব খুলে বলুন।’
রাসুলে করিম (সা.) আমার কাছে ইসলামের বিষয়ে সমস্ত কথা পরিষ্কার করে বললেন, আবৃত্তি করলেন কোরআন শরিফ। আল্লাহর শপথ, এমন সুন্দর, এমন সংগত কথা আমি আগে আর কোনো দিন শুনিনি। আমি তৎক্ষণাৎ মুসলমান হয়ে গেলাম, সত্যিকার সাক্ষ্য দিয়ে ইমান আনলাম। আমি বললাম, ‘রাসুলুল্লাহ, আমার লোকজনের মধ্যে আমার যথেষ্ট ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি। আমি যখন তাদের কাছে যাব, গিয়ে ইসলামের দিকে তাদের আহ্বান করব, তখন আমার হাতে একটা আলামত থাকলে ভালো হয়। তাতে তাদের কাছে প্রচারে আমার সাহায্য হবে, এমন একটা আলামত আমাকে দেওয়ার জন্য আপনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন।’
রাসুলে করিম (সা.) বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ, একে একটা আলামত দিন।’
আমি ফিরে গেলাম আমার লোকজনের কাছে। আমার বাড়ি যাওয়ার পথে আমি গিরিপথটি অতিক্রম করে ঢালুতে যখন নামছিলাম, দেখলাম প্রদীপের মতো একটা আলো জ্বলে আছে আমার দুই চোখের মধ্যখানে।
আমি বললাম, ‘ইয়া আল্লাহ, আমার মুখে নয়! ওরা তাহলে মনে করবে—আমি তাদের ধর্ম ত্যাগ করেছি বলে এটা নিদারুণ এক শাস্তি।’
তখন সেই আলো বিন্দু নড়ে উঠল, নড়েচড়ে বসল এসে আমার চাবুক-দণ্ডের মাথায়। আমি নেমে আসছি, চাবুক-দণ্ডের মাথায় মোমবাতির শিখার মতো সেই আলোর বিন্দুর দিকে তাকিয়ে রইল আমার সমস্ত লোক।
আমি নিচে নামলাম। আমার পিতা এলেন আমার কাছে। খুব বুড়ো মানুষ তিনি। আমি বললাম, ‘আমার কাছ থেকে একটু দূরে থাকুন, পিতা। আপনার সঙ্গে আমার আর আমার সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই।’
তিনি বললেন, ‘কেন, কী হয়েছে, বাছা?’
আমি বললাম, ‘আমি মুসলমান হয়েছি, আমি মুহাম্মদের ধর্ম মানি।’
তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে আমার ধর্মও তোমার ধর্ম, বৎস।’
আমি তখন বললাম, ‘তাহলে আপনি গোসল করে পাক-সাফ হোন, কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করুন। এরপর আসুন, আমি যা শিখেছি, তা-ই আপনাকে শিখিয়ে দেব।’
তিনি, যা যা বললাম, তার সব করে এলেন। তাঁর কাছে আমি ইসলাম ধর্মের কথা বুঝিয়ে বললাম। তিনি মুসলমান হলেন। এরপর আমার কাছে এলেন আমার স্ত্রী। আমি বললাম, ‘তফাত যাও, তোমার সঙ্গে আমার আর আমার সঙ্গে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
সে বলল, ‘কেন, কেন? আমার বাবা-মা মুক্তিপণ দিয়েছেন আপনাকে!’
আমি বললাম, ‘তা নয়, ইসলাম আমাদের দুই ভাগ করে ফেলেছে। আমি মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করেছি।’
সে বলল, ‘তাহলে তোমার ধর্মই আমার ধর্ম। আমি বললাম, তাহলে জুল শারার হিনায় (পবিত্র অঙ্গন!) যাও, ওখানে নিজেকে পাক করে এসো।’
জুল শারা হলো এক দাউসের প্রতিমা আর হিনা হলো তার এক অঙ্গন, যা ওরা পবিত্র বলে গ্রহণ করেছিল। ওখানে পাহাড় থেকে বেয়ে আসা এক ক্ষীণধারা নদীরেখা ছিল।
ভয়ার্ত কণ্ঠে ও জিজ্ঞেস করল, ‘জুল শারার থেকে আমার জন্য তোমার কোনো অমঙ্গলের কারণ ঘটেছে কী?’
আমি বললাম, ‘না, তা নয়, তার জন্য আমি জামিন আছি।’
সে চলে গেল। পাক-সাফ হয়ে ফিরে এল। আমি তাকে ইসলাম কী বুঝিয়ে দিলাম। সে মুসলমান হলো।
আমি এরপর দাউসের কাছে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করলাম। কিন্তু ওরা কেউ আমার কথায় কর্ণপাত করল না। মক্কায় আমি রাসুলে করিম (সা.)–এর কাছে ফিরে গেলাম। তাঁকে বললাম, ‘হে রাসুলুল্লাহ (সা.), দাউসের সঙ্গে হালকা কার্যকলাপে আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। ওদের আপনি অভিশাপ দিন।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন, ‘দাউসকে হেদায়েত করুন, হে আল্লাহ! আপনি আপনার লোকজনের কাছে ফিরে যান, গিয়ে তাদের কাছে আস্তে আস্তে প্রচার করুন।’
আমি দাউসের দেশে সবাইকে ইসলামের দিকে আহ্বান করতে লাগলাম। এর মধ্যে রাসুলে করিম (সা.) মদিনায় হিজরত করলেন। বদর, উহুদ আর খন্দকের যুদ্ধ পার হয়ে গেল। রাসুলে করিম (সা.) যখন খায়বরে, আমি আমার ধর্মান্তরিত নব্য মুসলমানদের নিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। দাউসের সত্তর–আশিটি পরিবার নিয়ে আমি মদিনায় হাজির হলাম; খায়বরে রাসুলে করিম (সা.)–এর সঙ্গে যোগদান করলাম। তিনি অন্যান্য মুসলমানের মতো যুদ্ধে আহরিত সামগ্রীর সমান ভাগ আমাদের দিলেন।
আমি রাসুলে করিম (সা.)–এর সঙ্গে থেকে গেলাম। ছিলাম আল্লাহর রাসুলের (সা.) কাছে মক্কা বিজয় পর্যন্ত। আমর ইবনে হুমামার প্রতিমা বুল কাফায়নকে পুড়িয়ে ছাই করার অনুমতি চাইলাম আমি তাঁর কাছে। তিনি আগুন জ্বালিয়ে বললেন:
আমি তোমার ভৃত্যদের কেউ নই জুল-কাফায়ন
তোমার চেয়ে প্রাচীনতর আমাদের জন্ম
তোমার বুকে এই আগুন ঢোকানো আমার একান্ত বাসনা।
এরপর তিনি ফিরে এলেন মদিনায়। আল্লাহ তাকে গ্রহণ করা পর্যন্ত রাসুলে করিম (সা.)–এর সঙ্গে তিনি ছিলেন। আরবরা বিদ্রোহ করলে তিনি মুসলমানদের পক্ষ নেন, তাঁদের হয়ে যুদ্ধ করেন। তুলায়হা ও সমস্ত নেজদ পরিষ্কার করা পর্যন্ত তিনি তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। এরপর তিনি ছেলে আমরসহ মুসলমানদের সঙ্গে ইয়ামামা গমন করেন।
যাওয়ার পথে তিনি এক অলৌকিক দৃশ্য অবলোকন করেন এবং ব্যাখ্যার জন্য তা সঙ্গীদের কাছে ব্যক্ত করেন, ‘আমি দেখলাম, আমার মাথা মুণ্ডন করা হয়েছে, আমার মুখ থেকে একটা পাখি বের হয়ে আসছে, এক নারী এসে আমাকে তার জঠরের ভেতরে ভরে ফেলল এবং আমার ছেলে উদ্বিগ্ন হয়ে খুঁজছে আমাকে। এরপর দেখলাম, ছেলে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেল।’
সবাই বলল, এটা ভালো স্বপ্ন, এর ইঙ্গিত শুভ। কিন্তু তিনি বললেন, তিনি নিজেই তাঁর ব্যাখ্যা প্রদান করবেন। মাথা মুণ্ডন মানে, মাথা তিনি নিচে নামিয়ে ফেলবেন, মুখ থেকে নির্গত পাখি হলো তাঁর আত্মা, যে নারী তার জঠরে নিল তাকে, সে হলো ধরণি, ধরণি খুলে যাবে এবং তার ভেতরে তাঁকে লুকিয়ে রাখা হবে। তাঁকে ছেলের বৃথা অনুসন্ধান মানে তিনি নিজে যে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন, তা লাভ করার জন্য চেষ্টা করবে সে।
আল-ইয়ামামায় তিনি শহীদ হন। তাঁর ছেলে মারাত্মকভাবে জখম হন, পরে অবশ্য তিনি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি উমরের (রা.) আমলে ইয়ারমুকের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।
* ইবনে ইসহাক: ইবনে ইসহাকের পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বিন ইয়াসার। জন্ম ৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায়। তাঁর জীবনের সাধনা ছিল মহানবী (সা.)–এর জীবনী এবং তাঁর জীবৎকালে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ঘটনার তথ্য সংগ্রহ ও সংকলন। সেই সাধনার ফসল তাঁর লিখিত গ্রন্থ ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’। এই লেখাটি এই গ্রন্থেরই আলফ্রেড গিয়োমের ইংরেজি অনুবাদ থেকে শহীদ আখন্দের অনুবাদকৃত। বাংলায় অনূদিত বইটির প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন।