একটা দোটানা অনুভুতির ভেতর দিয়ে সময় পার করছি।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মে-র শেষ পর্যন্ত একটা দুর্বিসহ সময় পার করেছি। সে অভিজ্ঞতাটা আর শেয়ার নাইই বা করলাম। জুনের পহেলা তারিখ থেকে কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও বাড়তি উদ্বেগ তাড়া করে ফিরেছে। যা চরম সীমায় পৌঁছেছিল অক্টোবরের শেষে, অনেকে নোটিশ করেছেন, চেহারায় নাকি তার ছাপ আছে। নভেম্বরের শুরু থেকেই বাড়তি চাপ ছিল অন্তত দুটি বছরের জন্য কোথাও থামতে হবে বা থিতু হতে হবে। ভাসমান মানুষ আমরা, থিতু হওয়া কি চাট্টিখানি কথা! গুডগুডির মার চাওয়া সর্বদা আমার সাথে থাকা, সে আমি যেখানেই থাকি না কেন, আর গুডগুডির কথা আমি কবে ইশকুলে যাব "ও বাবা!"? তাহলে বাসা ইশকুলের কাছে হতে হবে আর ইশকুল অফিসের কাছে। আসলে একটা সময় এমনই ছিল তাই তাদের ধারনা সব ক্ষেত্রে মনেহয় এমনই হয়। ইশকুল ছিল অফিসের কাছেই আর বাসা ছিল অফিসের ভেতরে। মানে আমরা আমরাই। এখন গুডগুডির সাথে বুবুন যোগ হয়েছে, সময় নাকি আরো বেশি দিতে হবে তাদেরকে, কি বাড়তি চাপ না!
আলহামদুলিল্লাহ্! মহান আল্লাহ তার বান্দাকে কখনও নিরাশ করেন না।
একটা বাস্তব গল্প বলে শেষ করিঃ
রুমি (গল্পকারে বলার জন্য নামটি ছোট করে নিলাম) উঠতি বয়সের তরুন। কোন বদ গুনাবলি নেই, নামাজ কালাম পড়া থেকে সৎ গুনাবলি বেশ চোখে পড়ার মত। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, তবে আদরের বলা যাবে না। অন্য গল্পের মত এখানে সন্তান বিপথে যায়নি বরং বাবা-মা-ই অনেকটা করেন, কারনটা রুমি উদ্ধার করতে পারেনি। হ্যাঁ অপরাধ একটা রুমির আছে আর সেটা হল সে একটা মেয়েকে ভালবাসে, আর মেয়েটা রুমিদের থেকেও দরিদ্র। আহামরি সুন্দরী না হলেও লাবন্যতা রুমিকে মুগ্ধ করার কারনেই তাদের প্রনয়। রুমি কম্পিউটার ইঙ্গিনিয়ারিং এ গ্রাজুয়েশন শেষের পথে। এরই মাঝে সদ্য ঈন্টার মিডিয়েট পড়া মেয়েকে অন্য যায়গায় বিয়ের হাত থেকে বাঁচাতে বিয়ে করে বসে। রুমির বাবা মা রুমিকে সরাসরি বাড়ী থেকে বের করে দেয়। বুঝতেই পারছেন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে সামান্য একজন কম্পইউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তেমন কিছু করে খাওয়ার দুর্গতি যে কত তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে। নিজেরকাছে সে কনফিডেন্ট সে ভাল কোডিং করতে পারে কিন্তু প্রমান দেবার জায়গার বড় অভাব। তার উপর মেয়ের পরিবার থেকে মাত্র দুই মাসের সময় বেঁধে দিয়েছে। তারপর তারা আর তাদের মেয়েকে তাদের বাড়ীতে থাকতে দেবেন না। উভয় সংকট। কিভাবে যেন সেই দুইমাস চলে গেল। এখনও কোন কুল কিনারা হয়নি। অনেক জায়গায় সিভি বানিয়ে পাঠিয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। বিডিজবস এ অনেক আবেদন করেছে সেখান থেকেও কোন সাড়া নেই। উত্তরাতে কিভাবে যেন একটা চাকরি পেয়ে গেল মাত্র ১২০০০ টাকা বেতনে। সারাদিন হাজারো কাজ করে কিন্তু কোডিং এর কিছু করতে হয়না। সকাল নয়টায়ঢুকে রাত আটটার আগে কোন্দিনই বেরুতে পারেন না। তারপরেও সৃস্টিকর্তাকে ভোলেনা। শুকরিয়া আদায় করে স্বামী স্ত্রী দুজন মিলেই। উত্তরার একটা ঝুপড়িতে ঠিকানা হয়েছে। শুধুমাত্র ভালবাসাতেই টিকে আছে সংসার অর্থে ন। একদিন একটা ফোন পেল ইন্টার্ভিউয়ের, কিন্তু যাবে কিভাবে। আর যদি চাকুরীটা না হয় তাহলে তো এটাও হারাতে হবে। অনেক সাহস সঞ্চয় করে বসের কাছে ছুটির কথা বলার সাথে সাথেই চাকুরীটা চলে গেল। উপর উয়ালার পরিক্ষা নেয়া হয় তো চলছে এই বুঝ নিজেকে দিয়েই পরেরদিন নতুন যায়গায় চাকুরীটা হয়েই গেল মাসে মায়নে ২২০০০ টাকা। এবার বোধহয় সংসার কিছুটা সাজানো যাবে। দুয়েক বছর পর একটা ভাল বাসাও হয়তো নেয়া যাবে। কিন্তু বিধি বাম। বিয়ের ৫ মাসের মাথায় জানা গেল বউ সন্তান সম্ভবা। এখন কি করা, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই দুজনার। কাজেখুব বেহি মননিবেশ করতে পারে না, দিনদিন বউয়ের শরীর কেমন যেনখারাপ হয়ে যাচ্ছে, ডাক্তারের কাছে গেলে খরচ পোষাতে পারবে কিনা তাই ভয়ে কেওইই ডাক্তারের কাছে যেতে চায়না। কিন্তু অবস্থা খারাপ হওয়ায় অগত্যা ডাক্তারের শরণাপন্ন হতেই হয়। কিন্তু ডাক্তার ভালখবর দিলেও রুমির জন্য মোটেও তা ভাল বলে মনে হচ্ছে না। কারন পেটে জমজবাচ্ছাআছে। এখন থেকেই পুস্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। প্রতি মাসে অন্তত একবার চেক আপ করাতে হবে। আর বাচ্চা জন্মানোর সময়ের জন্য অন্তত ২,০০,০০০ টাকা হাতে রাখতে হবে। সমস্যা মনে হলেই সিজার করে ফেলতে হতে পারে। রুমি নিরাশ হয়না কিন্তু তার সামনের সব কিছু অন্ধকার মনেহয়। রাতে দুজন অনেক কান্নাকাটি করে, জায়নামাজে বসেও কান্নাকাটি করে। দেখতে দেখতে ১৫ দিন কিভাবে যেন চলে গেছে আগামী পনের দিন পর আবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এবার টেস্ট গুলি করালেই জমানো সম্পদ সব শেষ। পরেরবার কি হবে। বউকে খাওয়াবে কি?
অফিস থেকে রুমি ইদানিং একটু দেরি করে বাসায় আসে। পথে নানা জিনিস মাথায় আসে। রাতে কুলির কাজ করা যায় কিনা! রিক্সা চালাবে কিনা! বাসায় এসে আর আগের মত কথার ঝুড়ি খোলে না দুজনের কারোই। বাদ যায় না শুধু পাশাপাশি জায়নামাজে বসে দু হাত উপুরে তুলে দেয়া। অফিসে অন্যমনস্ক ভাবে বসে ছিল অফিসে, কমদামী মোবাইলটা বাজার কারনে চমকে উঠেছে রুমি। অপরিচিত নাম্বার। বার তের টা নাম্বার সেভ করা আছে তার বেশির ভাগই এই অফিসের। পরিবারের কেও ফোন দেবে না। মনটা দুরু দুরু করছে বউয়ের কোন সমস্যা নয়তো, কারো নাম্বার থেকে ফোন দেয়নিতো কেও? হাজারো চিন্তার ঝড়ের মাঝেই ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই একজন ভারী কন্ঠের পুরষ জিজ্ঞাসা করল "রুমি বলছেন?" হ্যাঁ বলছি। আমরা আপনাকে একটা ইন্টার্ভিউয়ের জন্য ডাকছি, আপনি কি আজ লাঞ্চের পর একবার আসতে পারবেন? কোথায়? গুলশানে। কিসের অফিস? সেটা নাহয় এলেই দেখবেন আপনাকে একটা এড্রেস পাঠানো হচ্ছে, ৩ টা থেকে ৪ টার ভেতরে আসার চেস্টা করবেন।
আবারো আকাশ পাতাল ভাবনার জালে ফেসে যায় রুমি। তারপরেও কোন রকমে ম্যানেজ করে ফেলে অফিস কে। লাঞ্চের আগেই রওনা হয় গুলশানের উদ্দ্যেশে। ঠিকানা মতে পূঈছে কোন অফিসের সাইনবোর্ড নজরে না আশায় বেশ নিরাস হতে হয়। পুরোনো একটা বাড়ি, হয়তো টাকার অভাবে এই পুরোনো বাড়ী ভাড়া করেছে। ভেতরটা অবশ্য বেশ ছিমছাম। কেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া। বসে আছে রিসেপশনে। মিনিট পনের অপেক্ষা করার পর একজন এসে দেরি করানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। আর নিয়ে গেলেন ইন্টার্ভিউয়ের জন্য। ইন্টারভিউ ভালই হল, কিন্তু সাহস করে আর জিজ্ঞাসা করা হল না কিসের অফিস। মাথায় একনও তার স্ত্রীর অপারেশনের টাকার চিন্তা বুধ করে রেখেছে। যেমন নিরবে এসেছিল তেমপ্নই নিরবে বের হয়ে আসল পুরোনো এই বাড়ী থেকে যেন কেও দেখে ফেললে লজ্জা পাবে ভেবে।
৩ দিন পর সেই আগের নাম্বার থেকে আবারো ফোন। বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন আজকে একবার দুপুরের পর আসতে পারবেন? চাকুরী যাবার ভয়ে মনে হচ্ছিল বলেই দেয় পারব না। কি ভেবে জিজ্ঞাসা করে বসল, না গেলে হয় না। এখান থেকে বার বার ছুটি চাইতে লজ্জা করে। উনি আবারো বিনয়ের সাথে বললেন আজকে নাহয় আরেকবার রিকুএস্ট করে আধাবেলা ছুটি নেন। অনেকগুলি তিক্ত কথা শুনে অফিস থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে মেইন রোডের দিকে। শেষের কথাটা মাথার ভেতর হাতুড়ির বাড়ি দিচ্ছে, কালকে থেকে না আসলে খুশি হব।
সেই আগের পুরোনো বাড়ী, নিরবতা যেন বড় অসহ্য ভাবে গায়ে লাগছে। রিসেপশনের মেয়েটি একটা হাসি উপহার দিয়ে বসতে বলল। সেই আগের লোকটিই এল আর আগের বারের কথা পুনরার্বিত্তি করতে করতে। যাদের কাছে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম তাদের সাথে আরো একজন জাপানী লোক বসে আছেন। ভাবলাম আবারো কি ইন্টারভিউ নিবেন কিনা! উনারাই কথা শুরু করে বললেন আপনি কবে জয়েন করতে পারবেন? কিছুই বুঝতে পারছে না, কি বলবে! বোকার মত জিজ্ঞাসা করল "এটা কিসের কোম্পানী?" একজন বেশ আশ্চর্য হয়ে বল আপনি জাইকা বাংলাদেশ এ বসে আছেন। শুধু বলুন আপনি কবে জয়েন করতে পারবেন? আজ ২২ তারিখ আপনি আগামী এক তারিখে আমাদের সাথে জয়েন করুন। কোনরকমে মাথা হেলিয়ে হা বলে দিল, কি বলবে এক প্রশ্ন করে বোকা বনেছে আর বোকা হতে চাচ্ছে না। আপনি রিসেপশনে বসুন একজন আপনাকে গাইড করবেন। আমাদের কিছু ফর্মালিটিজ আছে সেগুলি পুরন করে যাবেন।
সন্ধার আগদিয়ে যখন জাইকা ছেড়ে বাসার পথে রওনা হল তখন মাথা তার ঝুকে গেছে বুক পর্যন্ত। বার বার মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছে। বাসায় গিয়েই শুকরানা নামাজ আদায় করবে দুজন মিলে। হাতে একটা খাম ভেতরে একমাসের বেতন আছে। জানে না কত, জানে সেখানে একটা ব্যাংকের চেক আছে। বেতন নাকি ডলারে হবে। জল্ভরা ঝাপ্সহা চোখে কোথায় যেন লেখা দেখেছিল ২০০০। চাকরিটা নাকি এনালিস্টের, ছয়মাসের প্রবেশন পিরিয়ড, তারপর বেতন নির্ধারন হবে। আগুনে ঝলসে যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বাসার পথে রওনা হয়ে গেল রুমি নামের এক পরিক্ষার্থী, হয়তো অনেকগুলি পরিক্ষায় পাস করে ফেলেছে। অথবা গর্ভবতী কোন নারীর দোয়া আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন।
আমি আর আপনি অপেক্ষায় আছি আমাদের পরিক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার আশায়।