রোমান সম্রাট ডাইওক্লিশিয়ান, তৃতীয় শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত শাসক ও ব্যক্তিত্ব। অন্য সব রাজা–বাদশাহর তুলনায় ডাইওক্লিশিয়ানের চিন্তা–চেতনায় বেশ ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। অ্যাড্রিয়াটিক সাগরতীরে, বর্তমানে ক্রোয়েশিয়ার স্প্লিট অঞ্চলে তিনি গড়ে তুলেছিন এক বিশাল প্রাসাদ। সেটাই এখন মূলত শহর। আর সেই শহরে ঘুরতে ঘুরতে স্পষ্ট হয় ডাইওক্লিশিয়ানের দূরদর্শিতা।
অ্যাড্রিয়াটিকের পাড়ে স্প্লিট শহর
আদি রোমানরা ছিলেন মূলত পেগান ধর্মাবলম্বী। এশিয়ার এদিকটায় যখন সনাতন ধর্মের জয়জয়কার, তখন ইউরোপের ওপাশটায় ছিল পেগান ধর্মের আধিপত্য। ডাইওক্লিশিয়ানও কট্টর পেগানি ছিলেন এবং তিনি নিজেকে স্বর্গীয় দেবদেবীদের প্রিয় সন্তান হিসেবে জাহির করতেন। এদিকে ক্রমবর্ধমান খ্রিষ্টধর্মের বিস্তার রোমান সম্রাটদের কাছে হুমকি হিসেবে প্রতীয়মান হয়। অন্যান্য রোমান সম্রাটের মতো ডাইওক্লিশিয়ানও বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারছিলেন না।
স্প্লিট শহরে লেখক
খোদাভীতি মানুষের মন থেকে রাজাভীতি সরিয়ে দেবে—এই আশঙ্কায় তিনি খ্রিষ্টানদের অমানুষিক অত্যাচার করতে থাকেন। প্রায় এক যুগ ধরে চলে এই খ্রিষ্টান নিধন। তাঁর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। দিনে দিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। ডাইওক্লিশিয়ানের প্রাসাদের পেগান উপাসনালয় সরিয়ে ক্যাথেড্রাল স্থাপন করা হয়, নির্মাণ করা হয় বেল টাওয়ার।
পাঁচ কুনা (৭০ টাকা) খরচ করে ঢুকে পড়লাম বেল টাওয়ারে। টাওয়ারে ওঠার সিঁড়িঘর এতই সরু ছিল যে কোনোমতে একজন উঠতে বা নামতে পারে, তা–ও একটু স্বাস্থ্যবান হলে দেয়ালে ঘষা লাগবেই। এভাবে কয়েক তলা ওঠার পর আরেকটা প্রসারিত চারকোনা টানেল আকৃতির সিঁড়িঘরে প্রবেশ করলাম। লৌহনির্মিত সিঁড়িগুলো টাওয়ারের দেয়ালের সঙ্গে আটকানো আর মাঝখানটা ফাঁকা। যাহোক, মরিচা ধরা সিঁড়িগুলো টপকে উঠে পড়লাম টাওয়ারের উঁচুতলায়।
বেল টাওয়ারের সরু সিঁড়িঘরে জিনাত
এই প্রথম যেন পুরো স্প্লিট শহরটা চোখের সামনে ধরা দিল। বিশাল জানালা দিয়ে দেখা যায় ছোট ছোট লাল রঙা ছাদের বিল্ডিংগুলো, কিছুটা দূরে সবুজ টিলা, তারও দূরে দেখা যায় পাহাড়ের বেষ্টনী আর অন্য পাশটায় মৃদু ঢেউয়ের অ্যাড্রিয়াটিক সাগর, সাগরের বুকে ছোট বড় দ্বীপ, ঘাটে নোঙর ফেলা বিভিন্ন আকারের বিলাসবহুল জাহাজ। সামনের দ্বীপগুলোতেও আছে মানুষের বসবাস। চাইলে ফেরিতে বা ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে ঘুরে আসা যায় দ্বীপগুলোতে।
বেল টাওয়ারের প্রবেশপথে দেখা মিলল একটি মিসরীয় কালো গ্রাফাইটের স্ফিংক্সের। ডাইওক্লিশিয়ান নাকি মিসর থেকে এ রকম ১২–১৩টি স্ফিংক্স নিয়ে এসেছিলেন স্প্লিটে। সময়ের পরিক্রমায় ও স্থানীয়দের আক্রোশের শিকার হয়ে কেবল এই একটি স্ফিংস এখনো টিকে আছে। তবে এটারও চোখ ও নাকে আঘাতের চিহ্ন আছে। এর পেছনে একটা ছোট ঘটনা আছে। সম্রাটের মৃত্যুর পর এলাকায় খ্রিষ্টধর্মের দ্রুত বিস্তার হয়। তারা তাদের বিগত অত্যাচারী পেগান শাসকের স্থাপনাগুলোর নানাভাবে ক্ষতি সাধন করতে থাকে; বিশেষ করে প্রাসাদ, স্ফিংক্স ও অন্য মূর্তিগুলোর।
কালের সাক্ষী সাড়ে তিন হাজার বছর বয়সী মিশরীয় স্ফিংস
অন্য পুশুর মূর্তি
হঠাৎই এলাকার লোকজন রোগশোক আক্রান্ত হতে থাকে। এমতাবস্থায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালানো বন্ধ রাখে। তারা ধারণা করে, ওই আপাতনির্জীব স্ফিংসটি তার দু-চোখ দিয়ে এলাকাবাসীর এসব কৃতকর্ম দেখে অভিশাপ দেওয়ায় তারা রোগাক্রান্ত হচ্ছে। অতঃপর তারা সেই স্ফিংসের গ্রাফাইটের চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে। সেই থেকে এভাবেই বেল টাওয়ারের পাদদেশে চুপটি করে বসে আছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর বয়সী কালের সাক্ষী এই স্ফিংক্স।
স্প্লিটের মূল শহর প্রাসাদের ভেতর থেকে প্রসারিত হয়ে বাইরে এসে দ্বিগুণ আয়তন ধারণ করছে। আড্রিয়াটিক সাগরের পাশে পাকা হাঁটার রাস্তা ধরে ঘুরে বেড়াতে যে কারও ভালো লাগবে। এখানে প্রায় সব ধরনের পর্যটক আসেন, হলিউডের সুপারস্টার থেকে স্কুল–কলেজে পড়ুয়া ব্যাকপ্যাকার—সবার জন্যই আনন্দের পসরা সাজিয়ে বসেছে স্প্লিট। প্রাসাদের বাইরের লোকালয় অনেকটাই ভিন্ন। রাস্তাগুলো কিছুটা প্রশস্ত, তবে বেশির ভাগ বাড়ি দ্বিতল আর একটার সঙ্গে আরেকটা গাঁ ঘেষে দাঁড়ানো।
প্রাসাদের বাইরে শহরের বর্ধিত অংশ
ব্যালকনিতে এরাও কাপড় শুকায়, ছাদে ডিশ অ্যান্টেনা লাগায়, রাস্তার পাশে দেয়ালে আঁকিবুঁকি করে। বোঝা যাচ্ছিল আমরা যে লোকালয়ে হাঁটছি, এটাতে মধ্যবিত্তদের বসবাস। প্রাসাদের জৌলুশ এখানে নেই, তবে সাগরটা এখান থেকেও উপভোগ করা যায়। আধুনিক যুগের সব উপকরণ এদের আছে, তবু কীভাবে যেন একটা পৌরাণিক ছাপ বিদ্যমান শহরজুড়ে, আর এই ব্যাপারটাই মন কেড়ে নেয় সবার।
মধ্যদুপুরে রোদের তাপ বাড়ছিল। আমরা ঠিক করলাম মধ্যাহ্নভোজ সেরে হোটেলে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলে বের হবো স্প্লিটের বাকি রহস্য উন্মোচনে। ফেরার পথে একটা গম্বুজ আকৃতির উঁচু মিনারের ভেতর জটলা দেখে থামলাম। জটলার কারণ, একদল যুবক সুরমিশ্রিত দরাজ কণ্ঠে গান গাইছে। আমরাও শ্রোতাদের দলে শরিক হয়ে জটলার আকার বাড়ালাম। ট্র্যাডিশনাল এই সংগীত, ক্লাপা সংগীত নামে পরিচিত। এটা ডালমাশিয়া অঞ্চলে বেশ বিখ্যাত।
গান গাইছেন ক্লাপা শিল্পীরা
ভেস্টিবিউলের ছাদের অংশটা ফাঁকা
ক্লাপা মানে একদল বন্ধু, অনেকটা আমাদের ব্যান্ড পার্টির মতো তবে ক্লাপা সংগীতে আমাদের ব্যান্ড পার্টির সংগীতের মতো বাদ্যযন্ত্রের আধিক্য নেই। যে গোলাকৃতির মিনারের নিচে দাঁড়িয়ে আমরা এই অদ্ভুত শ্রুতিমধুর সংগীত উপভোগ করছিলাম, সেটাকে ভেস্টিবিউল বলা হয়। ভেস্টিবিউলের ছাদের অংশটা ফাঁকা, নীল আকাশ উঁকি দিচ্ছিল ছাদের ওই বিশাল ফুটো দিয়ে। তবে ছাদের ওই অংশটা আগে থেকেই ফাঁকা ছিল, নাকি কালের বিবর্তনে ইট-সিমেন্ট খসে এমনটা হয়েছে, তা নিয়ে ইতিহাসবিদেরা আজও একক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।
বিকেলের দিকে হোটেলের নিচের এক কফি শপ থেকে দুজন দুই কাপ ক্রোয়েশিয়ান কফি পান করে বেরিয়ে পড়লাম। হালকা বিশ্রামের পর কফিটা পেটে গিয়ে শরীরে সতেজ ভাব নিয়ে এসেছে। বেল টাওয়ার থেকে একটা টিলার মতো পাহাড় চোখে পড়েছিল। ম্যাপে দেখলাম, ওটার ওপরে একটা পার্ক আছে, নাম মারিয়ান পার্ক।
আর মাত্র তিনশ চৌদ্দ ধাপ পেরুলেই মারিয়ানের চূড়া।
জিনাতকে জিজ্ঞেস করলাম, পাহাড় বাইতে পারবে কি না, সেও দৃঢ়তার সঙ্গে সায় দিল। আর দেরি কিসে, রওনা হয়ে গেলাম দুজন কাঁধে দুটো ব্যাগ চেপে। ওঠার পথটা পাকাপোক্ত, যার এক পাশে পাহাড় আর অন্য পাশে সিমেন্টের তৈরি রেলিং পেরোলেই সোজা অ্যাড্রিয়াটিক। উঁচু পথ পাড়ি দিতে গিয়ে যদি পা আর সায় না দেয়, একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য পাহাড়ের পাশটায় সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে লোহার চেয়ার। ইচ্ছে হলে রেলিংয়ের ওপরও বসে অবলোকন করা যায় অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের অপরূপ সৌন্দর্য।
মারিয়ান পার্ক মূলত একটা প্রাকৃতিক পাহাড়ি বন। এর ভেতরে রয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য বসার জায়গা, একটা চার্চ, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, গ্যালারিবেষ্টিত মুক্ত মঞ্চসহ আরও নানা আয়োজন।
শহর থেকে মারিয়ান পার্কে যাওয়ার রাস্তা
বনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামলাম, ফলকে লেখা দেখে জানলাম, এই সিঁড়ির উচ্চতা ৩১৪ ধাপ। দেড়–দুই হাজার ধাপ পাড়ি দিয়ে আসার পর এটাকে নিছক রসিকতা মনে হলো। আমাদের দুই জোড়া পা আর চলতে চাইছিল না। অতঃপর কিছুটা উঠে, কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে অনেকটা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে উঠে পড়লাম চূড়ায়।
মারিয়ান চূড়ায় এক মোহণীয় আগুনঝরা সূর্যাস্ত
এদিকে সূর্যটা প্রায় পশ্চিমে হেলে পড়েছে। শীতল বাতাসের ছোঁয়ায় নিমেষেই সব ক্লান্তি উবে গেল আমাদের। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামনে একটি চতুষ্কোণ মাঠ, যার চারপাশটায় সীমানা দেওয়া। এক কোনায় রয়েছে বিশাল এক ক্রস। ছটা ছটা মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মিগুলো তির্যক আকার ধারণ করেছে।
সূর্যের সোনালি আলো নাটকীয়ভাবে আগুন বর্ণে রূপান্তরিত হলো। মনে হচ্ছে যেন পুরো আকাশটায় আগুন লেগে গেছে। আহা, সেকি দৃশ্য! রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমরা অবলোকন করলাম আমাদের দেখা অন্যতম সুন্দর সূর্যাস্তের। আমাদের মুগ্ধতায় স্থবির করে দিয়ে সূর্য বিদায় নিল। সূর্যকে বিদায় দিয়ে যেই মুখ ফিরলাম, অমনি দেখি চাঁদটাও জ্বলজ্বল করছে। আজ কি পূর্ণিমা! আমাদের বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছেই না। আকাশ এবার অন্য সাজে সেজেছে, গাঢ়নীল আকাশের গায়ে লালচে আলোকছটা আর তার মাঝে মুচকি হাসছে আমাদের চাঁদমামা; যিনি বলতে গেলে সেই ছোটবেলা থেকেই আমাদের পিছু নিয়েছেন, আমরা যেদিকে যাই, সেদিকেই তার ছোটা লাগে।
রাতের আলোয় উদ্ভাসিত শহর
নামার পথে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি আমাদের, চাঁদের আলো তো ছিলই, সেই সঙ্গে কৃত্রিম রঙিন আলোয় আলোকিত ছিল পুরো স্প্লিট শহর। প্রাসাদ আঙিনায় ঢুকে চলে এলাম পেরিস্টাইল স্কয়ারে। এদিকে একটা পথ নেমে গেছে প্রাসাদের নিচে বেসমেন্টে। ওপরের সব কিছু দখল বেদখল বা ধ্বংস হয়ে গেলেও পাতালঘরটা এক আজব কারণে এখনো অনেকটাই অক্ষত। জানতে পারলাম, বছরের পর বছর পুরো শহরের বর্জ্য নিষ্কাশনের জায়গা ছিল এই পাতালঘর। সহস্র বছরের বর্জ্য কতটা হতে পারে, তা নিশ্চয় অনুমেয়। তাই হয়তো কারও রুচি হয়নি ওদিকটায় ভিটে গড়ার। গত শতাব্দীতে এটা পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাতালঘরে এখন রয়েছে জাদুঘর ও মার্কেট। টুকটাক এটা–ওটা নেড়েচেড়ে দেখে ডিনারটা সেরে নিলাম আমরা দুজন।
পেরিস্টাইলের নিচে পাতালঘরে নামার রাস্তা।
অ্যাড্রিয়াটিকের পাড়ে
রাতের অ্যাড্রিয়াটিকের পাড়ে কিছুক্ষণ ভ্রমণ করে ফিরে এলাম হোটেল। পরদিন সকালে আমরা রওনা দেব অন্য দেশের অন্য এক শহরের উদ্দেশে। তবে সঙ্গে নিয়ে যাব এখানকার ইতিহাস ও সংস্কৃতি আর আমাদের হৃদয়ে চিরজীবনের জন্য স্থান করে নেওয়া সেই অসম্ভব সুন্দর সূর্যাস্ত।
শেষ করছি এই শহরের জনক ডাইওক্লিশিয়ানের একটি উক্তি দিয়ে। তাঁর অবসরের পর রোমান সাম্রাজ্যে আবারও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তৎকালীন রাজা তাঁর সাহায্য চেয়ে সৈন্য পাঠান এই প্রাসাদে। তিনি সেই সৈনিককে বলেন: ‘আপনি যদি আপনার সম্রাটকে আমার হাতে ফলানো বাঁধাকপিটি দেখান, তিনি অবশ্যই এই পরামর্শ দেওয়ার সাহস করবেন না যে আমি এই জায়গার শান্তি এবং সুখকে কখনো সন্তুষ্ট হয় না এমন লোভের ঝড়ের সঙ্গে প্রতিস্থাপন করব।’
(শেষ)
* লেখক: চৌধুরী মিরাজ মাহমুদ ছগীর
অ্যাড্রিয়াটিকের পাড়ে স্প্লিট শহর
আদি রোমানরা ছিলেন মূলত পেগান ধর্মাবলম্বী। এশিয়ার এদিকটায় যখন সনাতন ধর্মের জয়জয়কার, তখন ইউরোপের ওপাশটায় ছিল পেগান ধর্মের আধিপত্য। ডাইওক্লিশিয়ানও কট্টর পেগানি ছিলেন এবং তিনি নিজেকে স্বর্গীয় দেবদেবীদের প্রিয় সন্তান হিসেবে জাহির করতেন। এদিকে ক্রমবর্ধমান খ্রিষ্টধর্মের বিস্তার রোমান সম্রাটদের কাছে হুমকি হিসেবে প্রতীয়মান হয়। অন্যান্য রোমান সম্রাটের মতো ডাইওক্লিশিয়ানও বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারছিলেন না।
স্প্লিট শহরে লেখক
খোদাভীতি মানুষের মন থেকে রাজাভীতি সরিয়ে দেবে—এই আশঙ্কায় তিনি খ্রিষ্টানদের অমানুষিক অত্যাচার করতে থাকেন। প্রায় এক যুগ ধরে চলে এই খ্রিষ্টান নিধন। তাঁর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। দিনে দিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। ডাইওক্লিশিয়ানের প্রাসাদের পেগান উপাসনালয় সরিয়ে ক্যাথেড্রাল স্থাপন করা হয়, নির্মাণ করা হয় বেল টাওয়ার।
পাঁচ কুনা (৭০ টাকা) খরচ করে ঢুকে পড়লাম বেল টাওয়ারে। টাওয়ারে ওঠার সিঁড়িঘর এতই সরু ছিল যে কোনোমতে একজন উঠতে বা নামতে পারে, তা–ও একটু স্বাস্থ্যবান হলে দেয়ালে ঘষা লাগবেই। এভাবে কয়েক তলা ওঠার পর আরেকটা প্রসারিত চারকোনা টানেল আকৃতির সিঁড়িঘরে প্রবেশ করলাম। লৌহনির্মিত সিঁড়িগুলো টাওয়ারের দেয়ালের সঙ্গে আটকানো আর মাঝখানটা ফাঁকা। যাহোক, মরিচা ধরা সিঁড়িগুলো টপকে উঠে পড়লাম টাওয়ারের উঁচুতলায়।
বেল টাওয়ারের সরু সিঁড়িঘরে জিনাত
এই প্রথম যেন পুরো স্প্লিট শহরটা চোখের সামনে ধরা দিল। বিশাল জানালা দিয়ে দেখা যায় ছোট ছোট লাল রঙা ছাদের বিল্ডিংগুলো, কিছুটা দূরে সবুজ টিলা, তারও দূরে দেখা যায় পাহাড়ের বেষ্টনী আর অন্য পাশটায় মৃদু ঢেউয়ের অ্যাড্রিয়াটিক সাগর, সাগরের বুকে ছোট বড় দ্বীপ, ঘাটে নোঙর ফেলা বিভিন্ন আকারের বিলাসবহুল জাহাজ। সামনের দ্বীপগুলোতেও আছে মানুষের বসবাস। চাইলে ফেরিতে বা ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে ঘুরে আসা যায় দ্বীপগুলোতে।
বেল টাওয়ারের প্রবেশপথে দেখা মিলল একটি মিসরীয় কালো গ্রাফাইটের স্ফিংক্সের। ডাইওক্লিশিয়ান নাকি মিসর থেকে এ রকম ১২–১৩টি স্ফিংক্স নিয়ে এসেছিলেন স্প্লিটে। সময়ের পরিক্রমায় ও স্থানীয়দের আক্রোশের শিকার হয়ে কেবল এই একটি স্ফিংস এখনো টিকে আছে। তবে এটারও চোখ ও নাকে আঘাতের চিহ্ন আছে। এর পেছনে একটা ছোট ঘটনা আছে। সম্রাটের মৃত্যুর পর এলাকায় খ্রিষ্টধর্মের দ্রুত বিস্তার হয়। তারা তাদের বিগত অত্যাচারী পেগান শাসকের স্থাপনাগুলোর নানাভাবে ক্ষতি সাধন করতে থাকে; বিশেষ করে প্রাসাদ, স্ফিংক্স ও অন্য মূর্তিগুলোর।
কালের সাক্ষী সাড়ে তিন হাজার বছর বয়সী মিশরীয় স্ফিংস
অন্য পুশুর মূর্তি
হঠাৎই এলাকার লোকজন রোগশোক আক্রান্ত হতে থাকে। এমতাবস্থায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালানো বন্ধ রাখে। তারা ধারণা করে, ওই আপাতনির্জীব স্ফিংসটি তার দু-চোখ দিয়ে এলাকাবাসীর এসব কৃতকর্ম দেখে অভিশাপ দেওয়ায় তারা রোগাক্রান্ত হচ্ছে। অতঃপর তারা সেই স্ফিংসের গ্রাফাইটের চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে। সেই থেকে এভাবেই বেল টাওয়ারের পাদদেশে চুপটি করে বসে আছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর বয়সী কালের সাক্ষী এই স্ফিংক্স।
স্প্লিটের মূল শহর প্রাসাদের ভেতর থেকে প্রসারিত হয়ে বাইরে এসে দ্বিগুণ আয়তন ধারণ করছে। আড্রিয়াটিক সাগরের পাশে পাকা হাঁটার রাস্তা ধরে ঘুরে বেড়াতে যে কারও ভালো লাগবে। এখানে প্রায় সব ধরনের পর্যটক আসেন, হলিউডের সুপারস্টার থেকে স্কুল–কলেজে পড়ুয়া ব্যাকপ্যাকার—সবার জন্যই আনন্দের পসরা সাজিয়ে বসেছে স্প্লিট। প্রাসাদের বাইরের লোকালয় অনেকটাই ভিন্ন। রাস্তাগুলো কিছুটা প্রশস্ত, তবে বেশির ভাগ বাড়ি দ্বিতল আর একটার সঙ্গে আরেকটা গাঁ ঘেষে দাঁড়ানো।
প্রাসাদের বাইরে শহরের বর্ধিত অংশ
ব্যালকনিতে এরাও কাপড় শুকায়, ছাদে ডিশ অ্যান্টেনা লাগায়, রাস্তার পাশে দেয়ালে আঁকিবুঁকি করে। বোঝা যাচ্ছিল আমরা যে লোকালয়ে হাঁটছি, এটাতে মধ্যবিত্তদের বসবাস। প্রাসাদের জৌলুশ এখানে নেই, তবে সাগরটা এখান থেকেও উপভোগ করা যায়। আধুনিক যুগের সব উপকরণ এদের আছে, তবু কীভাবে যেন একটা পৌরাণিক ছাপ বিদ্যমান শহরজুড়ে, আর এই ব্যাপারটাই মন কেড়ে নেয় সবার।
মধ্যদুপুরে রোদের তাপ বাড়ছিল। আমরা ঠিক করলাম মধ্যাহ্নভোজ সেরে হোটেলে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলে বের হবো স্প্লিটের বাকি রহস্য উন্মোচনে। ফেরার পথে একটা গম্বুজ আকৃতির উঁচু মিনারের ভেতর জটলা দেখে থামলাম। জটলার কারণ, একদল যুবক সুরমিশ্রিত দরাজ কণ্ঠে গান গাইছে। আমরাও শ্রোতাদের দলে শরিক হয়ে জটলার আকার বাড়ালাম। ট্র্যাডিশনাল এই সংগীত, ক্লাপা সংগীত নামে পরিচিত। এটা ডালমাশিয়া অঞ্চলে বেশ বিখ্যাত।
গান গাইছেন ক্লাপা শিল্পীরা
ভেস্টিবিউলের ছাদের অংশটা ফাঁকা
ক্লাপা মানে একদল বন্ধু, অনেকটা আমাদের ব্যান্ড পার্টির মতো তবে ক্লাপা সংগীতে আমাদের ব্যান্ড পার্টির সংগীতের মতো বাদ্যযন্ত্রের আধিক্য নেই। যে গোলাকৃতির মিনারের নিচে দাঁড়িয়ে আমরা এই অদ্ভুত শ্রুতিমধুর সংগীত উপভোগ করছিলাম, সেটাকে ভেস্টিবিউল বলা হয়। ভেস্টিবিউলের ছাদের অংশটা ফাঁকা, নীল আকাশ উঁকি দিচ্ছিল ছাদের ওই বিশাল ফুটো দিয়ে। তবে ছাদের ওই অংশটা আগে থেকেই ফাঁকা ছিল, নাকি কালের বিবর্তনে ইট-সিমেন্ট খসে এমনটা হয়েছে, তা নিয়ে ইতিহাসবিদেরা আজও একক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।
বিকেলের দিকে হোটেলের নিচের এক কফি শপ থেকে দুজন দুই কাপ ক্রোয়েশিয়ান কফি পান করে বেরিয়ে পড়লাম। হালকা বিশ্রামের পর কফিটা পেটে গিয়ে শরীরে সতেজ ভাব নিয়ে এসেছে। বেল টাওয়ার থেকে একটা টিলার মতো পাহাড় চোখে পড়েছিল। ম্যাপে দেখলাম, ওটার ওপরে একটা পার্ক আছে, নাম মারিয়ান পার্ক।
আর মাত্র তিনশ চৌদ্দ ধাপ পেরুলেই মারিয়ানের চূড়া।
জিনাতকে জিজ্ঞেস করলাম, পাহাড় বাইতে পারবে কি না, সেও দৃঢ়তার সঙ্গে সায় দিল। আর দেরি কিসে, রওনা হয়ে গেলাম দুজন কাঁধে দুটো ব্যাগ চেপে। ওঠার পথটা পাকাপোক্ত, যার এক পাশে পাহাড় আর অন্য পাশে সিমেন্টের তৈরি রেলিং পেরোলেই সোজা অ্যাড্রিয়াটিক। উঁচু পথ পাড়ি দিতে গিয়ে যদি পা আর সায় না দেয়, একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য পাহাড়ের পাশটায় সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে লোহার চেয়ার। ইচ্ছে হলে রেলিংয়ের ওপরও বসে অবলোকন করা যায় অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের অপরূপ সৌন্দর্য।
মারিয়ান পার্ক মূলত একটা প্রাকৃতিক পাহাড়ি বন। এর ভেতরে রয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য বসার জায়গা, একটা চার্চ, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, গ্যালারিবেষ্টিত মুক্ত মঞ্চসহ আরও নানা আয়োজন।
শহর থেকে মারিয়ান পার্কে যাওয়ার রাস্তা
বনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামলাম, ফলকে লেখা দেখে জানলাম, এই সিঁড়ির উচ্চতা ৩১৪ ধাপ। দেড়–দুই হাজার ধাপ পাড়ি দিয়ে আসার পর এটাকে নিছক রসিকতা মনে হলো। আমাদের দুই জোড়া পা আর চলতে চাইছিল না। অতঃপর কিছুটা উঠে, কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে অনেকটা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে উঠে পড়লাম চূড়ায়।
মারিয়ান চূড়ায় এক মোহণীয় আগুনঝরা সূর্যাস্ত
এদিকে সূর্যটা প্রায় পশ্চিমে হেলে পড়েছে। শীতল বাতাসের ছোঁয়ায় নিমেষেই সব ক্লান্তি উবে গেল আমাদের। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামনে একটি চতুষ্কোণ মাঠ, যার চারপাশটায় সীমানা দেওয়া। এক কোনায় রয়েছে বিশাল এক ক্রস। ছটা ছটা মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মিগুলো তির্যক আকার ধারণ করেছে।
সূর্যের সোনালি আলো নাটকীয়ভাবে আগুন বর্ণে রূপান্তরিত হলো। মনে হচ্ছে যেন পুরো আকাশটায় আগুন লেগে গেছে। আহা, সেকি দৃশ্য! রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমরা অবলোকন করলাম আমাদের দেখা অন্যতম সুন্দর সূর্যাস্তের। আমাদের মুগ্ধতায় স্থবির করে দিয়ে সূর্য বিদায় নিল। সূর্যকে বিদায় দিয়ে যেই মুখ ফিরলাম, অমনি দেখি চাঁদটাও জ্বলজ্বল করছে। আজ কি পূর্ণিমা! আমাদের বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছেই না। আকাশ এবার অন্য সাজে সেজেছে, গাঢ়নীল আকাশের গায়ে লালচে আলোকছটা আর তার মাঝে মুচকি হাসছে আমাদের চাঁদমামা; যিনি বলতে গেলে সেই ছোটবেলা থেকেই আমাদের পিছু নিয়েছেন, আমরা যেদিকে যাই, সেদিকেই তার ছোটা লাগে।
রাতের আলোয় উদ্ভাসিত শহর
নামার পথে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি আমাদের, চাঁদের আলো তো ছিলই, সেই সঙ্গে কৃত্রিম রঙিন আলোয় আলোকিত ছিল পুরো স্প্লিট শহর। প্রাসাদ আঙিনায় ঢুকে চলে এলাম পেরিস্টাইল স্কয়ারে। এদিকে একটা পথ নেমে গেছে প্রাসাদের নিচে বেসমেন্টে। ওপরের সব কিছু দখল বেদখল বা ধ্বংস হয়ে গেলেও পাতালঘরটা এক আজব কারণে এখনো অনেকটাই অক্ষত। জানতে পারলাম, বছরের পর বছর পুরো শহরের বর্জ্য নিষ্কাশনের জায়গা ছিল এই পাতালঘর। সহস্র বছরের বর্জ্য কতটা হতে পারে, তা নিশ্চয় অনুমেয়। তাই হয়তো কারও রুচি হয়নি ওদিকটায় ভিটে গড়ার। গত শতাব্দীতে এটা পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাতালঘরে এখন রয়েছে জাদুঘর ও মার্কেট। টুকটাক এটা–ওটা নেড়েচেড়ে দেখে ডিনারটা সেরে নিলাম আমরা দুজন।
পেরিস্টাইলের নিচে পাতালঘরে নামার রাস্তা।
অ্যাড্রিয়াটিকের পাড়ে
রাতের অ্যাড্রিয়াটিকের পাড়ে কিছুক্ষণ ভ্রমণ করে ফিরে এলাম হোটেল। পরদিন সকালে আমরা রওনা দেব অন্য দেশের অন্য এক শহরের উদ্দেশে। তবে সঙ্গে নিয়ে যাব এখানকার ইতিহাস ও সংস্কৃতি আর আমাদের হৃদয়ে চিরজীবনের জন্য স্থান করে নেওয়া সেই অসম্ভব সুন্দর সূর্যাস্ত।
শেষ করছি এই শহরের জনক ডাইওক্লিশিয়ানের একটি উক্তি দিয়ে। তাঁর অবসরের পর রোমান সাম্রাজ্যে আবারও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তৎকালীন রাজা তাঁর সাহায্য চেয়ে সৈন্য পাঠান এই প্রাসাদে। তিনি সেই সৈনিককে বলেন: ‘আপনি যদি আপনার সম্রাটকে আমার হাতে ফলানো বাঁধাকপিটি দেখান, তিনি অবশ্যই এই পরামর্শ দেওয়ার সাহস করবেন না যে আমি এই জায়গার শান্তি এবং সুখকে কখনো সন্তুষ্ট হয় না এমন লোভের ঝড়ের সঙ্গে প্রতিস্থাপন করব।’
(শেষ)
* লেখক: চৌধুরী মিরাজ মাহমুদ ছগীর