রোমান সম্রাট ডাইওক্লিশিয়ান, তৃতীয় শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত শাসক ও ব্যক্তিত্ব। অন্য সব রাজা বাদশাহর তুলনায় ডাইওক্লিশিয়ানের চিন্তা–চেতনায় বেশ ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন নিজের রাজ্যকে চার ভাগে ভাগ করে তিন ভাগের সর্বময় ক্ষমতা অন্যদের হস্তান্তর করা কিংবা মৃত্যুর আগেই স্বেচ্ছা–অবসরে যাওয়া—এ ধরনের কর্মসাধন ডাইওক্লিশিয়ানের আগে হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি।
ডাইওক্লিশিয়ান প্রাসাদের একাংশ
শুধু তা–ই নয়, অবসরের সময়টা কাটানোর জন্য তিনি অ্যাড্রিয়াটিক সাগরতীরে বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার স্প্লিট অঞ্চলে গড়ে তোলেন এক বিশাল প্রাসাদ। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ডাইওক্লিশিয়ান প্রাসাদ বর্তমানে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের এবারের গন্তব্য ক্রোয়েশিয়ার স্প্লিট শহর।
বরাবরের মতো জার্মানির হামবুর্গ এয়ারপোর্ট থেকে শুরু হয় আমাদের যাত্রা। যথারীতি ভ্রমণসঙ্গী আমার স্ত্রী জিনাত। ইউরো উইংসের উড়ানে পৌঁছে যাই আমাদের প্রথম গন্তব্য ক্রোয়েশিয়ার যাদার শহরে। দুদিন যাদার ও এর আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করে আমরা রওনা হই স্প্লিটের উদ্দেশে। এবারের বাহন বাস। দিনভর ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যায় যখন বাসে উঠলাম, তখন এমনিতেই ক্লান্ত লাগছিল। শরীরটা বাসের আরামদায়ক চেয়ারে রাখতেই যেন এলিয়ে পড়ল।
হামবুর্গ এয়ারপোর্ট, ছবি: উইকিপিডিয়া
জিনাতের হাজারো গুণের মধ্যে একটি হলো, যেকোনো বাহনের চাকা ঘুরতে না ঘুরতেই সে আমার কাঁধে মাথা রেখে টুপ করে ঘুমিয়ে যায়। এযাত্রা অবশ্য আমারও ঘুম পাচ্ছিল খুব। মাত্র দুই–আড়াই ঘণ্টার পথ তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। এদিকে বাইরে অন্ধকার নেমে আসায় জানালা দিয়েও তেমন কিছু দেখারও নেই। অগত্যা পকেটের মোবাইলটা বের করে দু ঘণ্টা পরের অ্যালার্ম সেট করে ঘুমিয়ে পড়লাম। এদিককার বাসগুলো কীভাবে যেন একদম সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না ঘটলে ঘড়ির কাঁটার খুব একটা হেরফের হয় না।
চোখ ভর্তি ঘুম নিয়ে আমরা যথাসময়ে স্প্লিট বাস টার্মিনালে নামি। নামতে না নামতেই ক্ষুধার্ত পেটের হুংকার কেড়ে নিল চোখের যত ঘুম। দ্বিধায় পড়ে গেলাম, টার্মিনালে ডিনারটা সেরে নেব, নাকি হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ–ট্রেস হয়ে বেরোব, এ নিয়ে। শেষমেশ টার্মিনালের পাশের একটা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার টেক অ্যাওয়ে করে হোটেলের দিকে হাঁটা দিলাম। বুকিং ডট কম থেকে বুক করার সময় টার্মিনালের কাছাকাছি হোটেল নিয়েছিলাম; কারণ, স্প্লিটে আসা ও যাওয়া—উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের বাস ব্যবহার করার প্ল্যান ছিল।
শুরুতে যেটা বলেছিলাম, এ শহরে সম্রাট ডাইওক্লেশিয়ানের প্রাসাদের অবস্থান, কিন্তু যা বলা হয়নি তা হলো এই সম্পূর্ণ শহরটা মূলত প্রাসাদের ভেতরেই গড়ে উঠেছে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এই অঞ্চলের বাসিন্দারা নিজ নিজ খেয়ালখুশিমতো প্রাসাদের বিভিন্ন অংশ দখল করে বানিয়ে নেয় বাড়িঘর, দোকানপাট ইত্যাদি। আজকাল সে রকম কিছু বাড়িঘর পর্যটকদের থাকার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। আমাদের হোটেলটাও তেমনই একটা বাড়ির মধ্যে। প্রাসাদ এলাকার ভেতর দশ মিনিটের মতো হাঁটতেই পেয়ে গেলাম আমাদের হোটেল। এক রোমান সম্রাটের গড়া প্রায় সতেরো শ বছরের পুরোনো প্রাসাদের একাংশে থাকতে যাচ্ছি ভাবতেই কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল। সেই অদ্ভুতুড়ে অনুভূতি নিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
প্রাসাদ এলাকায় লাইমস্টোন মার্বেল পাথরে তৈরি রাস্তার দু’পাশে আধুনিক শপিংমল, যা একসময় প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ করিডোর ছিলো
সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে মনে হলো হাজার বছরের পুরোনো কোনো এক দুনিয়ায় চলে এসেছি। যেদিকেই তাকাই, নিচের মেঝে, রাস্তা, আশপাশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাড়িঘরের দেয়াল—সবই লাইমস্টোন ও মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি। বিশেষ করে দেয়ালে ও মসৃণ পাথুরে রাস্তায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে পুরো প্রাসাদ এলাকায় এক অন্য রকম আবহ সৃষ্টি করছে। ভাবা যায়! যে সরু রাস্তা দিয়ে এখন হাঁটাহাঁটি করছে লোকজন, একসময় এগুলো প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ করিডর হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
তবে শত সহস্র বছর ধরে মানুষের পদভার সইতে সইতে দেবে গেছে বেশ কিছু জায়গায়। আশপাশের স্থাপনাগুলো হাজার বছরের পুরোনো হলেও এসবের খাঁজে ভাঁজে গড়ে ওঠা হোটেল, দোকানপাট, মানি এক্সচেঞ্জ, অফিস, ব্যাংক, এটিএম বুথ, ক্যাফে-রেস্টুরেন্ট—সবই অত্যাধুনিক। ধরুন, আমাদের দেশীয় সাজে শাড়ি পরা বৃদ্ধাকে কিংবা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধকে চোখে ঝকঝকে রোদচশমা, হাতে জ্বলজ্বলে ঘড়ি-ব্রেসলেট, পায়ে দামি ব্র্যান্ডের জুতা পরিয়ে দেওয়া হলে যেমন লাগবে, এসবও অনেকটা তেমনি দেখাচ্ছিল।
স্প্লিটের প্রতিচ্ছবি এই রাস্তা সোজা গিয়ে মিশেছে অ্যাড্রিয়াটিকে, এর একপাশে পৌরাণিক দেয়াল ও অন্যপাশে আধুনিক
স্প্লিটের প্রতিচ্ছবি এই রাস্তা সোজা গিয়ে মিশেছে অ্যাড্রিয়াটিকে, এর এক পাশে পৌরাণিক দেয়াল ও অন্য পাশে আধুনিক।
সকালের নাশতায় আমি নিয়েছিলাম কড মাছের ফিলে, সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর জিনাত নিয়েছিল এঞ্চোভি ফ্রাই। এই এঞ্চোভি ফ্রাইটা দেখতে ও খেতে একেবারে আমাদের দেশীয় ছোট মাছ যেমন পুঁটি বা কাঁচকি ভাজার মতো। ঘুরতে বেরোলে আমরা দুজন বেশির ভাগ সময়ই ভিন্ন মেনু নিয়ে ভাগাভাগি করে খাই, এতে একসঙ্গে দুধরনের খাবারের স্বাদ আস্বাদন করা যায়। এঞ্চোভি ফ্রাইটা প্রথমে একটু তেতো লাগছিল, পরে লেবুর রস ছিটিয়ে, সস-মেয়োনেজ মিশিয়ে খেতে খুব একটা খারাপ লাগেনি।
এঞ্চোভি ফ্রাই, দেশি স্বাদে বিদেশি মাছ।
এঙ্কোভি ফ্রাই, দেশী স্বাদে বিদেশী মাছ
স্প্লিট শহরের গোড়াপত্তনকারী সম্রাট ডাইওক্লিশিয়ানের জন্ম কোনো রাজপরিবারে হয়নি। তৃতীয় শতাব্দীর সে সময়টাই রোমান সাম্রাজ্যের ভিত অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবেশী রাজ্যের আক্রমণ, রাজ্যের ভেতরকার বিদ্রোহ, অন্তঃকোন্দল, খ্রিষ্টধর্মের উত্থান—সব মিলিয়ে দেখা গেল, টানা ৫০ বছর ধরে কোনো সম্রাটই দু–তিন বছরের বেশি টিকতে পারেননি। তাঁদের বেশির ভাগের কপালেই জোটে নির্মম মৃত্যু।
জীবনের বেশির ভাগ সময় রোমান সেনাদলের আস্থাভাজন সদস্য ও পরে সেনাপতি থাকায় এক সংকটময় মুহূর্তে সেনাসদস্যদের সহায়তায় ডাইওক্লিশিয়ান হয়ে গেলেন রোমান সাম্রাজের অধিপতি অগাস্টাস ডাইওক্লিশিয়ান। রোমান রাজাদেরকে তাঁদের প্রথম রাজা অগাস্টাসের নামানুসারে অগাস্টাস উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সাধারণত কোনো রাজা কখনোই নিজের রাজ্যকে বিভক্ত করার দুঃসাহস করেন না। কিন্তু সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে ডাইওক্লিশিয়ান চিন্তা করলেন, এই বিশাল সাম্রাজ্যের দেখাশোনা করা তাঁর একার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিলেন।
প্রাসাদের সিলভার গেইট; মূল প্রাসাদের চারটা গেইটের একটা
প্রথমে রোমান সাম্রাজ্যকে পূর্ব ও পশ্চিম দুভাগে ভাগ করলেন। নিজের কাছে রাখলেন তুলনামূলক সমৃদ্ধিশালী পূর্বভাগ, যার অন্তর্গত বর্তমান বলকান অঞ্চল, মিসর ও তুরস্কের বেশ কিছু অঞ্চল। আর পশ্চিম ভাগের অগাস্টাস বানালেন আস্থাভাজন ম্যাক্সিমিয়ানকে। পরবর্তীকালে দুই অগাস্টাস তাঁদের আওতাধীন রাজ্যকে আরও দুই ভাগে ভাগ করলেন। নতুন সৃষ্ট এই দুই ভাগের দায়িত্ব তাঁরা বিশ্বস্ত কারও হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরা ভাবলেন, এমন বিশ্বস্ত মানুষ পরিবার ছাড়া আর কোথায়–বা পাওয়া যাবে! যেই ভাবা সেই কাজ, ডাইওক্লেশিয়ান ও ম্যাক্সিমিয়ান—দুজনেই তাঁদের কন্যাদের বিয়ে দিলেন যথাক্রমে কন্সটেন্টিয়াস ও গ্যালেরিয়াসের সঙ্গে। পরিকল্পনামাফিক গ্যালেরিয়াস ও কন্সটেন্টিয়াসকে সিজার উপাধি দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে নতুন দুই প্রদেশের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়। ইতিহাসের পাতায় এই শাসনামল Diocletian's Tetrarchy বা চার রাজার শাসনব্যবস্থা হিসেবে বেশ গুরুত্বসহকারে চিহ্নিত আছে।
তো, এত সব করে রোমান সাম্রাজ্যকে সাময়িক স্থিতি এনে দেওয়া ডাইওক্লেশিয়ান একসময় হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। এদিকে বয়সও বাড়ছিল। এবার তিনি আরেকটি অভূতপূর্ব পরিকল্পনা করলেন। সচরাচর অমরত্ব ও ক্ষমতার লোভে যেখানে তখনকার কোনো রাজাই গদি ছাড়ার চিন্তা করতেন না, সেখানে তিনিই প্রথম,যিনি স্বেচ্ছায় অবসরের সিদ্ধান্ত নেন। এরই বদৌলতে, সতেরো শ বছর পরও ঠায় দাঁড়িয়ে আমাদের সামনের এই অবকাশ যাপন প্রাসাদ।
সনাতন ও আধুনিকতার সহাবস্থান
সময়ের ব্যবধানে প্রাসাদের মূল স্থাপত্যশৈলীর অনেকটাই আজ বিবর্তিত, তবু রোমান আমলের আর কোনো প্রাসাদ নাকি এতটা অক্ষত নেই। দখল ও অপরিকল্পিত গৃহায়ণে প্রাসাদের করিডর, রাস্তাগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। সংকীর্ণ হলেও হলুদাভ মার্বেল পাথরের রাস্তাগুলো বেশ পরিষ্কার ও ঝকঝকে। অবশ্য পুরো শহরটাতেই একটা আভিজাত্য রয়েছে।
কিছুদূর আগানোর পর কফি খেতে ইচ্ছে হলো। সামনেই দেখলাম একটা কফি শপ, নাম ববিস। দুই কাপ কফি নিয়ে আবার হাঁটা অব্যাহত রাখলাম। কফির কাপে চুমুক দিতেই শরীরটা চাঙা হয়ে উঠল, স্বাদটাও বেশ। কাপের গায়ে ববিসের নিচে ১৯৪৯ লেখা, মনে মনে বললাম, এক জিনিস এত বছর ধরে বানালে পটু তো হতেই হবে। একটা পেরিস্টাইল স্কয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
বেল টাওয়ার; পেগান দেশে খৃষ্টানদের স্থায়ী নিদর্শন
স্কয়ারের চারপাশে সিঁড়ির মতো সীমানা দেওয়া আর মাঝে সমতল মার্বেলের মেঝে। একসময় হয়তো এখানে রাজদরবার বসত। কত বিচার-সালিশ, আচার-অনুষ্ঠান হয়ে গেছে এই আঙিনায়, তা এখন কেবল কল্পনা করা যায়।
(চলবে)
* লেখক: চৌধুরী মিরাজ মাহমুদ ছগীর