ছবিতে যে দুজন মানুষকে দেখছেন তাদের চেনেন না এমন শ্রোতা বাংলা গানে পাওয়া যাবে না। সম্পর্কে দুজন গুরু-শিষ্য। যে দুজন মিলে আমাদের বাংলা গানের ভাণ্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ আর বহু কালজয়ী চিরসবুজ গানের সাথে জড়িত থাকা দুটি নাম। অর্থাৎ যে কোন একজনের কর্ম ও সৃষ্টির কথা উদাহরণসহ তুলে ধরতে গেলে আরেকজন এমনিতেই চলে আসবে, আসতে বাধ্য। কারণ দুটি মানুষ যে একে অপরের অসাধারন সব সৃষ্টির সাথে জড়িত। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনের কর্মের উদাহরণ তুলে ধরা শুধু আমার পক্ষেই নয় যে কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি ও হবেও না কোনদিন। এ এক অসম্ভব কাজ।
বাংলাদেশের গানের ভাণ্ডার সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তাদের কাছে ‘আলম খান’ নামটি কতটুকু প্রিয় সেটা নতুন করে বলার কোন প্রয়োজন নেই। আলম খান হলেন আমাদের বাংলা গানের ‘সুরসম্রাট’।
১৯৪৪ সালের ১০ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের বানিয়াগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আলম খান। বাবার নাম আফতাব উদ্দিন খান ও মায়ের নাম জোবেদা খানম। ৫ ভাইবোনের মধ্যে আলম খান ছিলেন দ্বিতীয়। আলম খানের বাবা ছিলেন তৎকালীন সময়ের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার। জন্মের পর কিছুদিন কলকাতায় ছিলেন। বাবার চাকরির সুবাদে কলকাতায় চলে যান। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পুরো পরিবার আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন। স্থায়ী হয়ে যান ঢাকায়। ঢাকার স্থানীয় বেবি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন যেখানে প্রাইমারী পর্যন্ত পড়েন। এরপর সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করার পর আর পড়ালিখা করেননি। গানের নেশায় পড়াশুনা বাদ দিয়ে দেন। আজিমপুর কলোনিতে থাকাবস্থায় ৮/৯ বছর বয়সেই প্রতিবেশী বড় ভাই রতনের উৎসাহে অর্কেস্ট্রা গ্রুপে বাদ্যযন্ত্র বাজনা শিখা শুরু করেন এবং সেইখানে প্রথম সারেগামা’র হাতেখড়ি হয়। গানে শেখানোর ইচ্ছে প্রথম দিকে আলম খানের বাবার মত ছিল না কিন্তু মায়ের উৎসাহে আলম খান গানবাজনা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে কিশোর আলম খানের অতি আগ্রহ দেখে ওস্তাদের কাছে তালিম নিতে নিয়ে যান বাবা আফতাব উদ্দিন খান। ওস্তাদ ননি চ্যাটার্জীর কাছে সঙ্গীতের উপর তালিম নেন।
১০/১১ বছর বয়সে রাস্তায় একজন ব্যান্ড বাজিয়ে ঘুরে ঘুরে অর্থ উপার্জন করতে দেখেন। রাস্তার সেই ব্যান্ড বাদকের পিছে পিছে ঘুরতেন এবং একদিন ব্যান্ড বাজানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেন এবং লোকটির কথামতো নিজে একটা ব্যান্ড কিনেন এবং এরপর সেটা দিয়েই শিখেন। আগে রতন ভাইয়ের কাছ থেকে সারেগামা শেখায় নতুন করে তা শিখতে হয়নি। আজিমপুর ছেড়ে যখন কমলাপুরে নিজেদের নতুন বাড়ীতে এলেন তখন পরিচয় হয় কবি জসিমউদ্দিনের সাথে। পল্লীকবি জসিমউদ্দিন থাকতেন একই এলাকায়। আলম খানের সমবয়সী ছিল জসিমউদ্দিনের ছেলে ফিরোজ। ফিরোজের সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে মাঝেমধ্যে জসিম উদ্দিনের বাড়ীতে যেতেন। এভাবেই কিশোর বেলায় কবি জসিমউদ্দিনের সান্নিধ্য আসার সুযোগ হয়েছিল আলম খানের। সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে থাকতেই বন্ধুদের নিয়ে অর্কেস্ট্ গ্রুপ করলেন নিতান্ত শখের বশে যারা বিনে পয়সায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন।
১৯৬১ সালে মঞ্চ নাটক ‘ভাড়াটে বাড়ী’তে আবহ সঙ্গীতের কাজ করে ১৫০ টাকা আয় করেন যেখানে সহযোগী মিউজিসিয়ানদের দিয়ে আলম খান পেয়েছিলেন ৪৫ টাকা যা ছিল সঙ্গীত জীবনে তাঁর প্রথম রোজগার আর এভাবেই তিনি পেশাদার সঙ্গীত পরিচালনায় যুক্ত হয়েছিলেন। ঐ মঞ্চ নাটকের কাজের পর পিটিভি’র প্রযোজক সাকিনা সারোয়ার বাচ্চাদের একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন যা করার পর বেশ সাড়া পড়ে যায় আর এইভাবেই টেলিভিশনে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। বাচ্চাদের অনুষ্ঠানের সফলতায় তৎকালীন পিটিভির প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মামুন সহ অনেকের নজরে পড়েন। স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর খানেক আগে আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজিত টেলিভিশনের প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’ এর সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পান। টেলিভিশনের নাটকেও দারুণ সফল হলেন যার ফলে পরবর্তীতে আবদুল্লাহ আল মামুনের মঞ্চনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘ইডিয়ট’ সহ বেশকিছু নাটকের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। খুব সহজেই বয়সে বছর তিনেকের বড় আবদুল্লাহ আল মামুনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে যায়। টেলিভিশন নাটক, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, মঞ্চ নাটকের কাজ করে জনপ্রিয়তা পেয়ে যান যার ফলে ১৯৭০ সালেই পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের ‘‘কাঁচ কাঁটা হীরে’’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ করা শুরু করেন।প্রথম ছবিতেই ‘জলতরঙ্গ মন আমার/ঠুনঠান ঠুনঠান বাজে’ ও ‘আজ নয় কাল/কাল নয় পরশু/কেউ তো আমার কথা ভাববে’ গান দুটো দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা পায় যার ফলে আলমগির কুমকুমের একটি ছবিতে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পান কিন্তু ততদিনে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় কাজটা শেষ হয়ে উঠেনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আলম খান পরিবারের সাথে ঢাকাতেই থাকেন তাঁর অন্য দুই ছোটভাই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন করেন। আলম খান সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করলেও ছোট ভাই আজম খানের অনেক অপারেশনে অস্র ও গোলাবারুদ নিরাপদ স্থানে রাখার সহায়তা করতেন। আজম খানের দলের সহযোগী যোদ্ধা রানা প্রায় সময় আলম খানের কাছে স্টেনগান, গ্রেনেড রেখে নিরাপদ স্থানে চলে যেতেন। অপারেশনের সময় এসে রাতের আঁধারে আলম খানের কাছ থেকে কখনও স্টেনগান ,কখনও গ্রেনেডগুলো নিয়ে যেতেন আবার কাজ শেষে স্টেনগানগুলো আলম খানের কাছে রেখে যেতেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৭২ সাল থেকে আবার চলচ্চিত্রে গান করার সুযোগ পান এবং এরপর থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত সঙ্গীত পরিচালনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ছোট ভাই আজম খান যখন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে পপ গান শুরু করে তখন আলম খান তাঁদের সহযোগিতা করেন এবং আলম খানের সেই সময়কার প্রায় সব গানগুলোর সুরকার ছিলেন আলম খান। চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক আলম খান আলাদা একটি অধ্যায়। আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বউ’ ছবিতে মুকুল চৌধুরীর লিখা ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটিতো সেইসময় এমনই বাজীমাৎ করলো যে গানটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের চিরসবুজ ও জনপ্রিয়ত গানের তালিকায় শীর্ষস্থানে আজো রয়ে গেছে। বাংলাদেশের চলচিত্রের গানের জীবন্ত কিংবদন্তী অ্যান্ড্রু কিশোর ও শাম্মি আখতার হলেন আলম খানের আবিষ্কার।
১৯৫৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালে শিবলি সাদিকের ‘মেইলট্রেন’ ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক করেন আলম খানের সুরে কিন্তু ছবিটা পরে আর মুক্তি পায়নি। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের ‘মাস্টার মেকার’ নামে খ্যাত এ জে মিন্টুর ‘প্রতিজ্ঞা’ ছবির মাধ্যমে আলম খানের ‘এক চোর যায় চলে’ গানটি দিয়ে সবার নজর কাড়েন। ছবি মুক্তি পাওয়ার পর একেবারে অপরিচিত অ্যান্ড্রু কিশোর কণ্ঠের ‘এক চোর যায় চলে/ এ মন চুরি করে’ গানটি হয়ে যায় সুপারহিট। অথচ সেই ছবিতে সুবীর নন্দী’র কণ্ঠে একক ‘আমি শুইনাছি শুইনাছি টাকার পাখা গজাইছে’ ও খুরশিদ আলমের কণ্ঠে একক ‘বান্দা তুলেছে দুহাত/ কবুল করো মোনাজাত’ গান দুটিও ছিল। তাদেরকে ছাপিয়ে নতুন এন্ড্রো কিশোরের গাওয়া ‘এক চোর যায় চলে’ গানটি দর্শকদের মুখে মুখে ফিরে ।
সুরকার শেখ সাদী খান ও গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর সঙ্গে অ্যান্ডু কিশোর
অ্যান্ড্রু কিশোর তখন রাজশাহীতে থাকতেন এবং ঢাকায় এসে গান রেকর্ড করে আবার চলে যেতেন কিন্তু অ্যান্ড্রু কিশোরের ইচ্ছে ছিল ঢাকায় নিয়মিত থেকে পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিয়মিত গান করার যার কোন নিশ্চয়তা তিনি কারো কাছ থেকে পাচ্ছিলেন না। বিএ পাশ করার পর গুরু আলম খানের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়েই ১৯৮১ সালে রাজশাহী ছেড়ে অ্যান্ড্রু ঢাকায় চলে আসেন। এরপর শুরু হয় গুরু শিষ্যের অসাধারণ সব সৃষ্টি। মহিউদ্দিনের ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবিতে সৈয়দ শামসুল হকের লিখা অ্যান্ড্রু কিশোরের কণ্ঠের ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ৱতোরা দেখ ,দেখরে চাহিয়া’, ‘আমি চক্ষু দিয়ে দেখতে ছিলাম’ গানগুলো দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে ঝড় তোলে। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবির গানের জন্য পেয়ে যান গীতিকার সৈয়দ শামসুল হক, সুরকার আলম খান ও শিল্পী অ্যান্ড্রু কিশোর প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পীর পুরস্কার লাভ করেন । আলম খান যে সেই সময় কত আধুনিক ও মেলোডি গান চলচ্চিত্রে করতেন তার একটি নমুনা হলো মাসুদ পারভেজের ‘নাগপূর্ণিমা’ ছবির ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’ গানটি যা ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা সুর ও কম্পোজিশন। যে গানটি শুনলে কেউ ধারনা করতে পারবে না যে গানটি কোন ফোক ফ্যান্টাসি ছবির।
শুধু যে আধুনিক ঘরানার গানেই পারেন তা নন, আজিজুর রহমান বুলি’র ‘প্রান সজনী’ ছবির গানগুলো শুনলে ফোক গানে আলম খানের অসাধারণ কাজের প্রমান পাওয়া যায়। ‘প্রান সজনী’ ছবির ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘কত রঙ্গ জানো রে মানুষ’সহ সবগুলো গান আজো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দর্শক ও শ্রোতারা মনে রেখেছে।
শুধু বাংলাদেশের অ্যান্ড্রু কিশোর ও শাম্মি আখতার নন উপমহাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী জীবন্ত কিংবদন্তী কুমার শানুও এই আলম খানের আবিস্কার। ১৯৮৫ সালে শিবলি সাদিকের ‘তিন কন্যা’ ছবির গান দিয়ে কুমার শানু জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন যার সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন আলম খান।কুমার শানুকে তখন সবাই শানু ভট্টাচার্য নামে চিনতেন। আলম খানের গান শুনলে মনে হবে গাওয়া খুব সহজ কিন্তু আসলে তা নয়। যারা আলম খানের সুরে গান করেছেন তাঁরা বুঝেছেন যে কত কষ্ট, কারণ আলম খানের সব গানেই খুব ছোট ছোট করে একাধিক কারুকাজ থাকে যা সব শিল্পীর কণ্ঠে ধরে রাখা সম্ভব নয়। আলম খানের সুর মানে মন পাগল করা মেলোডিয়াস সুর যে কারণে চলচ্চিত্রে আলম খানের গান খুব সহজেই দর্শক ও শ্রোতাদের মনে গেঁথে যেতো। চলচ্চিত্রের গানের জন্য ৭ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন এই অসাধারণ সুরের যাদুকর। এ যাবত ৩০০ টি ছবির ১৫০০টি গান সুর করেন আলম খান ।
আলম খানের সুরে অ্যান্ড্রু কিশোরে উল্লেখযোগ্য গানগুলো: এক চোর যায় চলে, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, আমি চক্ষু দিয়ে দেখতে ছিলাম, তোরা দেখ দেখরে চাহিয়া, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, কি যাদু করিলা, কত রঙ্গ জানো রে মানুষ, ভালোবেসে গেলাম শুধু, জনি আমার নাম, চোর আমি ডাকু আমি বলনারে, দুনিয়াটা মস্ত বড়, আজ রাত সারারাত জেগে থাকবো, তুমি যেখানে আমি সেখানে, বুকে আছে মন মনে আছে আশা, চলরে চল সাগরে চলোর, তুই তো কাল চলে যাবি, প্রিয়া আমার প্রিয়া, জীবনের গল্প আছে বাকী অল্প সবাই তো ভালোবাসা চায়, রুমাল দিলে ঝগড়া হয়, আমি তোমার মনের মতো কিনা, আমি একদিন তোমায় না দেখিলে, তুমি আজ কথা দিয়েছো, কোথায় স্বর্গ আর কোথায় নরক, আর যাবো না আমেরিকা, আমি পাথরে ফুল ফুটাবো, আমার এ গান তোমারই জন্য, জীবন যেন শুরু হলো আবার, বেলি ফুলের মালা দিয়ে, আমারে তুই প্রেম শিখাইয়া, শিখা আমার শিখা, এখানে দুজনে নির্জনে, ভালোবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া, এই মাটি আমার ভাইয়ের রক্ত মাখা, যদি মানুষের মতো মানুষ হতে চাও, সবার জীবনে প্রেম আসে, আমরা দুজন চিরসাথি, ও সাথিরে যেও না, এইদিন সেইদিন কোনদিন, তুমি আমার জীবনের শুরু , আমি আজ কথা দিলাম আই লাভ ইউ, এই তো ছিল আশা …… সহ আরও অসংখ্য অসংখ্য গান ।