১৯৮২ বিশ্বকাপ। প্রথমবারের মতো সেবার বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছে আফ্রিকান দেশ আলজেরিয়া। নিজেদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচেই জয়ের উল্লাসে মেতে ওঠা দলটি কয়েকদিন পরেই শিকার হয়েছিলো ফুটবলের সবচেয়ে বড় ন্যাক্কারজনক ঘটনার, যার জন্য আলজেরিয়ার জন্য সমব্যথী হয়েছিলো পুরো বিশ্বও। এমনকি সেই ঘটনার পরে বিশ্বকাপের নিয়মকানুনেও আসলো পরিবর্তন। আজকে আমরা জানবো সেই ঘটনার কথাই।
নবাগত আলজেরিয়ার প্রথম ম্যাচই ছিলো তৎকালীন ফুটবল পরাশক্তি পশ্চিন জার্মানির বিপক্ষে। সেই বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে বেলজিয়াম চমকে দিলেও সেই চমকের পুনরাবৃত্তি আলজেরিয়া ঘটাবে তার পক্ষে বাজি লাগারও কোনো মানুষ ছিলো না। কিন্তু পুরো বিশ্বকে হতভম্ব করে দিয়ে সেটিই করে দেখালো আফ্রিকান ফক্সরা।
পশ্চিম জার্মানি সেবার বিশ্বকাপে এসেছিলো দুর্দান্ত ফর্ম নিয়েই। বাছাইপর্বের আটটি ম্যাচই জিতেছিলো তারা। আট ম্যাচে ৩৩ গোলের বিপরীতে হজম করেছিলো মোটে ৩টি গোল। পল ব্রিটনার, কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে, উলি সিয়েলার ছাড়াও অনেক প্রতিভাবান ও তারকা খেলোয়াড়ে ভরা ছিলো পুরো পশ্চিম জার্মানির দল। নিজেদের জয়ের ব্যাপারে তারা এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলো ম্যাচের আগে আলোচনার মূখ্যবস্তু ছিলো পশ্চিম জার্মানি কয়টি গোল করতে পারবে তা নিয়েই। এমনকি প্রেস কনফারেন্সে আলজেরিয়াকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করেন জার্মানির খেলোয়াড়েরা। নিজেদের সপ্তম গোল নিজেদের কুকুর ও অষ্টম গোল নিজেদের স্ত্রী বান্ধুবীদের উৎস্বর্গ করার গল্পও বলে গিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে। কোচ জাপ ডারওয়েল তো অঙ্গীকার করেন যে, এই ম্যাচ হেরে গেলে মিউনিখে ফেরত যাওয়ার ট্রেন থেকেই তিনি নদীতে ঝাঁপ দেবেন!
সেই ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়া আলজেরিয়ান ফুলব্যাক চাবানে মিরজিকান পরবর্তীতে বলেন যে, জার্মানির এক খেলোয়াড় নাকি মুখে সিগার নিয়েও খেলার কথা বলেছিলেন। জার্মানদের এত কিছু বলার পর আলজেরিয়ানরা প্রথমে ভেবেছিলো এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা। শুরুতে মনস্তাত্ত্বিক খেলায় আলজেরিয়াকে পেছনে ফেলতেই এতসব। পরবর্তীতে তারা বুঝতে পারে, জার্মানরা আলজেরিয়ানদের আদৌ গোনাতেই ধরেনি। আর এটিই তাদের জন্য বড় আশীর্বাদ হয়ে আসে। আলজেরিয়ানদের নিয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনা না করেই মাঠে আসে জেপ ডারওয়েলের শিষ্যরা। পরবর্তীতে জেপ ডারওয়েল স্বীকার করেন যে, তার কাছে আলজেরিয়ানদের খেলার একটি ভিডিও ছিলো, কিন্তু তিনি তার খেলোয়াড়দের সেটি দেখতে বলেননি। কারণ তিনি মনে করেছিলেন সেই ভিডিও দেখে পশ্চিম জার্মান খেলোয়াড়রা হেসে গড়াগড়ি খাবেন। কিন্তু জার্মান খেলোয়াড়রা জানতো না নাইজেরিয়ানদের হারিয়েই বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছিলো এই আফ্রিকান দেশটি। বিশ্বকাপের আগে প্রীতি ম্যাচে হারিয়েছে আয়ারল্যান্ড, রিয়াল মাদ্রিদ ও বেনফিকার মতো দলগুলোকেও। ভিডিও দেখলে জার্মানরা হয়তো আরো জানতে পারতো গতি ও পায়ের দক্ষতা ছাড়াও প্রতিটি আলজেরিয়ান খেলোয়াড়ের মাঠের তৎপরতা চোখে পড়ার মতোই ছিলো।
ম্যাচের দিন ট্যাকটিকাল ক্ষেত্রেও আলজেরিয়া ছিলো এগিয়ে। গোলমুখে পল ব্রিটনারকে একাই নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন ফুলব্যাক মিরজিকান। দ্বিতীয়ার্ধে যোগ্যতর দল হিসেবেই ৫৪ মিনিটে এগিয়ে যায় আলজেরিয়া। রাবাহ মাজদেরের দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে লিড নেয় আলজেরিয়ানরা। তবে জার্মানরা গা ঝেড়ে ওঠে সাথে সাথেই। ৬৭ মিনিটে দলকে সমতায় ফেরান কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে। কিন্তু জার্মানদের হতভম্ব করে দিয়ে সেই গোলের সেন্টার থেকে নয় পাসের মধ্যেই আবার গোল করে বসে আলজেরিয়া। সেটি নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত বলে পরে উল্লেখ করেন দ্বিতীয় গোল করা বেলৌমি।
অন্যদিকে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হওয়া মারজিকানের পারফরম্যান্সে ম্যাচের ধারাভাষ্যকার হিউ জোনস এতটাই অভিভূত হয়েছেন যে, তিনি এই বিশ্বকাপের সেরা আবিষ্কারও বলে দেন তাকে। ৮৮ মিনিটের মাথায় নিজেও গোল পেয়ে যেতেন এই ডিফেন্ডার। নিজেদের ডিবক্স থেকে একাই টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন পশ্চিম জার্মানির ডিবক্সে। শুমাখার দুর্দান্তভাবে বলটি আটকিয়ে না দিলে টুর্নামেন্ট সেরা গোলই হয়ে যেতো সেটি। আর ঠিক বিপরীত অবস্থা জার্মানদের শিবির। পর্যুদস্ত একেকজন যেন ডুবন্ত টাইটানিকের নাবিক। বেলৌমি পরবর্তীতে বলেছেন, আমরা শুরু থেকেই জার্মান দল ও দেশকে সম্মান প্রদর্শন করে এসেছি। কিন্তু আমরা উল্লাসিত এই কারণে যে তাদেরকে আমরা আমাদের সম্মান করতে বাধ্য করেছি।
আলজেরিয়ার এই জয়োৎসব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পরের ম্যাচেই অস্ট্রিয়ার সাথে ২-০ গোলে হেরে যায় তারা। যার মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বড় মঞ্চে খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতার অভাব। জার্মানির বিপক্ষে জয়ের পর তাদের উচিত ছিলো শান্ত থাকা। এর অভাবের ফল পরে দ্বিতীয় ম্যাচে প্রভাব রেখেছিলো। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া কোনোভাবেই হালকা করে নেয়নি আলজেরিয়াকে। অস্ট্রিয়ান কোচ জর্জ স্মিড আফ্রিকান নেশন্স কাপ থেকেই আলজেরিয়ানদের খেলার ধরন অনুসরণ করে আসছিলেন। তাই তার শিষ্যরা সহজেই জিতে নেয় ম্যাচটি।
যা-ই হোক, সেই হারের ধাক্কা কাটিয়ে আলজেরিয়ানরা পরের ম্যাচেই ট্র্যাকে ফিরে। চিলির সাথে জিতে নেয় ৩-২ গোলে। কিন্তু এই ম্যাচেও তাদের অনভিজ্ঞতার জন্যই পরবর্তীতে কাঁদতে হয়। একটা সময়ে ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ায় চাইলে তারা ৩ গোলের লিড ধরে গোল ব্যবধান ধরে রাখতো পারতো। কিন্তু নিজেদের আলজেরিয়ান অ্যাটাকিং ধরন দেখাতে গিয়ে রক্ষণাত্মক না খেলে একের পর এক আক্রমণ করতে গিয়ে উল্টো আরো দুই গোল খেয়ে বসে তারা। তবুও এই জয়ে মোটামুটি সুবিধাজনক স্থানে চলে যায় আলজেরিয়া। শুধুমাত্র গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচের একটি রেজাল্টই তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তা হলো অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে জার্মানির ১-০ গোলের জয়। তাতে তিন দলের পয়েন্ট ছয় হলেও গোল ব্যবধানে বাদ পড়ে যাবে আলজেরিয়া। ১-০ ব্যতীত আর যেকোনো ফলাফলেই আলজেরিয়া প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে উঠে যাবে দ্বিতীয় রাউন্ডে।
ম্যাচের দিন মাত্র ১০ মিনিটেই হর্স্ট রুবেশ পশ্চিম জার্মানিকে লিড এনে দেন। তারপর? তারপর আর কিছুই হয়নি। এই স্কোর দুই দলের জন্যই সুবিধাজনক হওয়ায় বাকি ৮০ মিনিট দুই দলই খেললো নামেমাত্র। কারো গোলমুখেই আর কোনো শট ছিলো না। দুই দলই পুরো বিশ্বের সামনে খেললো এক ষড়যন্ত্রমূলক খেলা। ম্যাচশেষ হলোও ১-০ গোলে। আলজেরিয়ানদের স্বপ্নও ভেঙে চুরমার হলো শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথেই। মাঠের বাইরে ততক্ষণে আলজেরিয়ান সমর্থকদের আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। গিজনে হওয়া সেই ম্যাচে স্থানীয় স্প্যানিশ সমর্থকেরাও আলজেরিয়ানদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। সংবাদ মাধ্যমগুলোও ফলাও করে এই ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে। তবে অস্ট্রিয়ান ও জার্মান কোনো খেলোয়াড়ই সংবাদ সম্মেলনে কথা বলতে চাননি। উল্টো অস্ট্রিয়ার ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি বেফাঁস মন্তব্য করে বসেন। তিনি বলেন, পুরো খেলাটি ছিলো একটি ট্যাকটিকাল ম্যাচ। এখানে যদি ১০ হাজার মরুভূমি বাসিন্দা এসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে তাহলে বলতেই হবে তারা কেউই শিক্ষিত নয়। তবে আলজেরিয়ান খেলোয়াড়রা ছিলেন একেবারেই শান্ত। মারজিকান বলেন, আমরা আমাদের মাথা উঁচু করেই বিদায় নিচ্ছি। কিন্তু তারা দ্বিতীয় রাউন্ডে যাচ্ছে মাথা নিচু করেই।
***
অনেক তর্ক-বিতর্কের পরেও ফিফা শেষপর্যন্ত শাস্তি দেয়নি কোনো দলকেই। কারণ, সুযোগ্য প্রমাণও ছিলো না ফিফার হাতে। তবে সেই ম্যাচের পর বড়সড় এক পরিবর্তন আসে খেলার সূচিতে। সেই বিশ্বকাপের পর প্রতিটি গ্রুপ পর্বের শেষ রাউন্ডের দুই ম্যাচ শুরু হয় একসাথে। সেজন্য বেলৌমি পরবর্তীতে বলেন যে, এটি জয়ের চেয়েও বড় কিছু। এটি বোঝায় যে আলজেরিয়া বিশ্বকাপের মঞ্চে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। তবে আলজেরিয়ান খেলোয়াড়রা যতই শান্ত থাকুক না কেন, সেদিন লাখ লাখ আলজেরিয়ানদের সাথে কেঁদেছিলো পুরো ফুটবল বিশ্ব। অবশ্যই অস্ট্রিয়ান আর জার্মানরা বাদে।
©Zahid Rifat
নবাগত আলজেরিয়ার প্রথম ম্যাচই ছিলো তৎকালীন ফুটবল পরাশক্তি পশ্চিন জার্মানির বিপক্ষে। সেই বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে বেলজিয়াম চমকে দিলেও সেই চমকের পুনরাবৃত্তি আলজেরিয়া ঘটাবে তার পক্ষে বাজি লাগারও কোনো মানুষ ছিলো না। কিন্তু পুরো বিশ্বকে হতভম্ব করে দিয়ে সেটিই করে দেখালো আফ্রিকান ফক্সরা।
পশ্চিম জার্মানি সেবার বিশ্বকাপে এসেছিলো দুর্দান্ত ফর্ম নিয়েই। বাছাইপর্বের আটটি ম্যাচই জিতেছিলো তারা। আট ম্যাচে ৩৩ গোলের বিপরীতে হজম করেছিলো মোটে ৩টি গোল। পল ব্রিটনার, কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে, উলি সিয়েলার ছাড়াও অনেক প্রতিভাবান ও তারকা খেলোয়াড়ে ভরা ছিলো পুরো পশ্চিম জার্মানির দল। নিজেদের জয়ের ব্যাপারে তারা এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলো ম্যাচের আগে আলোচনার মূখ্যবস্তু ছিলো পশ্চিম জার্মানি কয়টি গোল করতে পারবে তা নিয়েই। এমনকি প্রেস কনফারেন্সে আলজেরিয়াকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করেন জার্মানির খেলোয়াড়েরা। নিজেদের সপ্তম গোল নিজেদের কুকুর ও অষ্টম গোল নিজেদের স্ত্রী বান্ধুবীদের উৎস্বর্গ করার গল্পও বলে গিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে। কোচ জাপ ডারওয়েল তো অঙ্গীকার করেন যে, এই ম্যাচ হেরে গেলে মিউনিখে ফেরত যাওয়ার ট্রেন থেকেই তিনি নদীতে ঝাঁপ দেবেন!
সেই ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়া আলজেরিয়ান ফুলব্যাক চাবানে মিরজিকান পরবর্তীতে বলেন যে, জার্মানির এক খেলোয়াড় নাকি মুখে সিগার নিয়েও খেলার কথা বলেছিলেন। জার্মানদের এত কিছু বলার পর আলজেরিয়ানরা প্রথমে ভেবেছিলো এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা। শুরুতে মনস্তাত্ত্বিক খেলায় আলজেরিয়াকে পেছনে ফেলতেই এতসব। পরবর্তীতে তারা বুঝতে পারে, জার্মানরা আলজেরিয়ানদের আদৌ গোনাতেই ধরেনি। আর এটিই তাদের জন্য বড় আশীর্বাদ হয়ে আসে। আলজেরিয়ানদের নিয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনা না করেই মাঠে আসে জেপ ডারওয়েলের শিষ্যরা। পরবর্তীতে জেপ ডারওয়েল স্বীকার করেন যে, তার কাছে আলজেরিয়ানদের খেলার একটি ভিডিও ছিলো, কিন্তু তিনি তার খেলোয়াড়দের সেটি দেখতে বলেননি। কারণ তিনি মনে করেছিলেন সেই ভিডিও দেখে পশ্চিম জার্মান খেলোয়াড়রা হেসে গড়াগড়ি খাবেন। কিন্তু জার্মান খেলোয়াড়রা জানতো না নাইজেরিয়ানদের হারিয়েই বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছিলো এই আফ্রিকান দেশটি। বিশ্বকাপের আগে প্রীতি ম্যাচে হারিয়েছে আয়ারল্যান্ড, রিয়াল মাদ্রিদ ও বেনফিকার মতো দলগুলোকেও। ভিডিও দেখলে জার্মানরা হয়তো আরো জানতে পারতো গতি ও পায়ের দক্ষতা ছাড়াও প্রতিটি আলজেরিয়ান খেলোয়াড়ের মাঠের তৎপরতা চোখে পড়ার মতোই ছিলো।
ম্যাচের দিন ট্যাকটিকাল ক্ষেত্রেও আলজেরিয়া ছিলো এগিয়ে। গোলমুখে পল ব্রিটনারকে একাই নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন ফুলব্যাক মিরজিকান। দ্বিতীয়ার্ধে যোগ্যতর দল হিসেবেই ৫৪ মিনিটে এগিয়ে যায় আলজেরিয়া। রাবাহ মাজদেরের দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে লিড নেয় আলজেরিয়ানরা। তবে জার্মানরা গা ঝেড়ে ওঠে সাথে সাথেই। ৬৭ মিনিটে দলকে সমতায় ফেরান কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে। কিন্তু জার্মানদের হতভম্ব করে দিয়ে সেই গোলের সেন্টার থেকে নয় পাসের মধ্যেই আবার গোল করে বসে আলজেরিয়া। সেটি নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত বলে পরে উল্লেখ করেন দ্বিতীয় গোল করা বেলৌমি।
অন্যদিকে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হওয়া মারজিকানের পারফরম্যান্সে ম্যাচের ধারাভাষ্যকার হিউ জোনস এতটাই অভিভূত হয়েছেন যে, তিনি এই বিশ্বকাপের সেরা আবিষ্কারও বলে দেন তাকে। ৮৮ মিনিটের মাথায় নিজেও গোল পেয়ে যেতেন এই ডিফেন্ডার। নিজেদের ডিবক্স থেকে একাই টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন পশ্চিম জার্মানির ডিবক্সে। শুমাখার দুর্দান্তভাবে বলটি আটকিয়ে না দিলে টুর্নামেন্ট সেরা গোলই হয়ে যেতো সেটি। আর ঠিক বিপরীত অবস্থা জার্মানদের শিবির। পর্যুদস্ত একেকজন যেন ডুবন্ত টাইটানিকের নাবিক। বেলৌমি পরবর্তীতে বলেছেন, আমরা শুরু থেকেই জার্মান দল ও দেশকে সম্মান প্রদর্শন করে এসেছি। কিন্তু আমরা উল্লাসিত এই কারণে যে তাদেরকে আমরা আমাদের সম্মান করতে বাধ্য করেছি।
আলজেরিয়ার এই জয়োৎসব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পরের ম্যাচেই অস্ট্রিয়ার সাথে ২-০ গোলে হেরে যায় তারা। যার মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বড় মঞ্চে খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতার অভাব। জার্মানির বিপক্ষে জয়ের পর তাদের উচিত ছিলো শান্ত থাকা। এর অভাবের ফল পরে দ্বিতীয় ম্যাচে প্রভাব রেখেছিলো। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া কোনোভাবেই হালকা করে নেয়নি আলজেরিয়াকে। অস্ট্রিয়ান কোচ জর্জ স্মিড আফ্রিকান নেশন্স কাপ থেকেই আলজেরিয়ানদের খেলার ধরন অনুসরণ করে আসছিলেন। তাই তার শিষ্যরা সহজেই জিতে নেয় ম্যাচটি।
যা-ই হোক, সেই হারের ধাক্কা কাটিয়ে আলজেরিয়ানরা পরের ম্যাচেই ট্র্যাকে ফিরে। চিলির সাথে জিতে নেয় ৩-২ গোলে। কিন্তু এই ম্যাচেও তাদের অনভিজ্ঞতার জন্যই পরবর্তীতে কাঁদতে হয়। একটা সময়ে ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ায় চাইলে তারা ৩ গোলের লিড ধরে গোল ব্যবধান ধরে রাখতো পারতো। কিন্তু নিজেদের আলজেরিয়ান অ্যাটাকিং ধরন দেখাতে গিয়ে রক্ষণাত্মক না খেলে একের পর এক আক্রমণ করতে গিয়ে উল্টো আরো দুই গোল খেয়ে বসে তারা। তবুও এই জয়ে মোটামুটি সুবিধাজনক স্থানে চলে যায় আলজেরিয়া। শুধুমাত্র গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচের একটি রেজাল্টই তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তা হলো অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে জার্মানির ১-০ গোলের জয়। তাতে তিন দলের পয়েন্ট ছয় হলেও গোল ব্যবধানে বাদ পড়ে যাবে আলজেরিয়া। ১-০ ব্যতীত আর যেকোনো ফলাফলেই আলজেরিয়া প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে উঠে যাবে দ্বিতীয় রাউন্ডে।
ম্যাচের দিন মাত্র ১০ মিনিটেই হর্স্ট রুবেশ পশ্চিম জার্মানিকে লিড এনে দেন। তারপর? তারপর আর কিছুই হয়নি। এই স্কোর দুই দলের জন্যই সুবিধাজনক হওয়ায় বাকি ৮০ মিনিট দুই দলই খেললো নামেমাত্র। কারো গোলমুখেই আর কোনো শট ছিলো না। দুই দলই পুরো বিশ্বের সামনে খেললো এক ষড়যন্ত্রমূলক খেলা। ম্যাচশেষ হলোও ১-০ গোলে। আলজেরিয়ানদের স্বপ্নও ভেঙে চুরমার হলো শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথেই। মাঠের বাইরে ততক্ষণে আলজেরিয়ান সমর্থকদের আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। গিজনে হওয়া সেই ম্যাচে স্থানীয় স্প্যানিশ সমর্থকেরাও আলজেরিয়ানদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। সংবাদ মাধ্যমগুলোও ফলাও করে এই ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে। তবে অস্ট্রিয়ান ও জার্মান কোনো খেলোয়াড়ই সংবাদ সম্মেলনে কথা বলতে চাননি। উল্টো অস্ট্রিয়ার ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি বেফাঁস মন্তব্য করে বসেন। তিনি বলেন, পুরো খেলাটি ছিলো একটি ট্যাকটিকাল ম্যাচ। এখানে যদি ১০ হাজার মরুভূমি বাসিন্দা এসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে তাহলে বলতেই হবে তারা কেউই শিক্ষিত নয়। তবে আলজেরিয়ান খেলোয়াড়রা ছিলেন একেবারেই শান্ত। মারজিকান বলেন, আমরা আমাদের মাথা উঁচু করেই বিদায় নিচ্ছি। কিন্তু তারা দ্বিতীয় রাউন্ডে যাচ্ছে মাথা নিচু করেই।
***
অনেক তর্ক-বিতর্কের পরেও ফিফা শেষপর্যন্ত শাস্তি দেয়নি কোনো দলকেই। কারণ, সুযোগ্য প্রমাণও ছিলো না ফিফার হাতে। তবে সেই ম্যাচের পর বড়সড় এক পরিবর্তন আসে খেলার সূচিতে। সেই বিশ্বকাপের পর প্রতিটি গ্রুপ পর্বের শেষ রাউন্ডের দুই ম্যাচ শুরু হয় একসাথে। সেজন্য বেলৌমি পরবর্তীতে বলেন যে, এটি জয়ের চেয়েও বড় কিছু। এটি বোঝায় যে আলজেরিয়া বিশ্বকাপের মঞ্চে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। তবে আলজেরিয়ান খেলোয়াড়রা যতই শান্ত থাকুক না কেন, সেদিন লাখ লাখ আলজেরিয়ানদের সাথে কেঁদেছিলো পুরো ফুটবল বিশ্ব। অবশ্যই অস্ট্রিয়ান আর জার্মানরা বাদে।
©Zahid Rifat