ফোর্ট উইলিয়ামের লক লিনি
সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রস্তুতি নিলাম স্কটিশ হাইল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রার। একটা নির্দিষ্ট ট্রেইল ধরে ট্যুর বাসের প্যানারোমা উইন্ডোর পাশে বসে হেলেদুলে উপভোগ করব স্কটিশ হাইল্যান্ডের বিখ্যাত এলাকাগুলো। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বিশেষ করে উপত্যকাগুলো অবস্থিত স্কটিশ লখগুলোর কথা ভেবে। স্কটিশ গ্লেনদের ভাষায় লখ মানে হচ্ছে লেক বা হ্রদ।
লখ লোমন্ডে মুনর অ্যান্ড বেনস
স্কটল্যান্ডে রয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে গভীর মিঠাপানির হ্রদ; যে হ্রদের সুমিষ্ট জলে তৈরি হয় জগদ্বিখ্যাত পানীয় হুইস্কি। সঙ্গে আছে রবার্ট ব্রুসের ক্যাসল, ফোর্ট উইলিয়াম ক্যাসল, ব্রিটেনের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বেন নেভিস এবং পাশাপাশি আরও তিনটি শৃঙ্গ, যা থ্রি সিস্টার্স নামে পরিচিত। এই একই ট্রেইলে অভিজ্ঞতা হবে গ্রেট গ্লেনকো ভ্যালি, রিভার কো, দৈত্যের লখ নেস, উরকোয়ার্ট ক্যাসল, বালাখালিশ এবং বিখ্যাত ইনভারনেস ক্যাসল দর্শনের।
যাত্রার শুরুতেই দেখা হলো লখ লেভেনের সঙ্গে। পাখিদের প্রজনন আর গোলাপি পায়ের হাঁসের জন্য বিখ্যাত এই স্কটিশ সমতলভূমির মিঠাপানির লখ বা হ্রদ। লখ লেভেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত রয়েছেন মেরি, দ্য কুইন অব স্কটস। তিনি ব্যাটল অব লংসাইডে হারার পর এই লখ লেভেন ক্যাসলে তাঁকে আটকে রেখেছিলেন তাঁরই সৎভাই জেমস স্টুয়ার্ট।
মিঠাপানির হ্রদ লখ লেভেন
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে আরও কিছু দূর যাওয়ার পরই পৌঁছালাম লখ লোমন্ডে। স্কটিশ ইতিহাসে পড়লাম, এই ফ্রেশ ওয়াটারের লখ লোমন্ডে নাকি প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে অর্থাৎ নিওলিথিক সময়ে প্রথম মানুষের আনাগোনা শুরু হয়। কিছু কিছু সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। লখ লোমন্ড তেমনি একটি স্কটিশ হ্রদ, যার পাশে সকালের সোনালি আলোর আভায় পৃথিবীর সব থেকে যুদ্ধবাজ অপ্রেমিক লোকটার মনেও মানবিকতার উদ্রেক হবে নিশ্চিত।
সেদিন সকালের পবিত্রতম আলোয় লখ লোমন্ডের পাশে ক্যাফেটেরিয়ার উঠানে বসে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে মনে হচ্ছিল, ‘এমন মানব জনম আর কি হবে, মন যা চায় ত্বরায় করো এই ভবে…’ কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে নিই, লখ লোমন্ড হলো দৈর্ঘ্যে ৩৬.৪ কিলোমিটার আর প্রস্থে ১ থেকে ৮ কিলোমিটার।
লখ লোমন্ডে সস্ত্রীক লেখক
সর্বমোট ৭১ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে স্কটল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির এই হ্রদের গভীরতা ১৫৩ মিটার। লখ লোমন্ডকে বিদায় জানিয়ে দুপাশে বর্ণনারহিত সৌন্দর্যকে সঙ্গী করে যাত্রা শুরু হলো ফোর্ট উইলিয়ামের পথে। চারপাশের সব উঁচু পাহাড় আর লখ লিনির কোলে তাক লাগানো পাহাড়ি শহর ফোর্ট উইলিয়াম। লিনি হ্রদের ওপাশটা ঠিক কাশীরাম দাশের লেখা মহাভারতের স্বর্গারোহণ পর্বে ব্যবহৃত প্রাচীন চিত্রের মতো। নীল জল, নীল আকাশ আর মেঘের কোলে হেলান দেওয়া পাহাড়।
ফোর্ট উইলিয়াম থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বেন নেভিস। ততক্ষণে সূর্যও ঠিক মাথার ওপর তীক্ষ্ণ উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। স্কটিশ হাইল্যান্ডে এমন সূর্যকরোজ্জ্বল দিন পাওয়াও যেন এক মহাভাগ্য। ফোর্ট উইলিয়ামের একটি ক্যাফেতে দুপুরের খাবার খেতে খেতে উপভোগ করছিলাম লখ লিনিতে বোট সার্ফারদের আনন্দভ্রমণ।
এই অবসরে বলে নেওয়া যাক ফোর্ট উইলিয়ামের কিছু গল্প। ফোর্ট উইলিয়াম হলো লখাবার এলাকার একটি ছোট শহর। যে শহরে মাত্র ১০ হাজার মানুষের বাস।
ফোর্ট উইলিয়াম স্কটিশ ক্লেন অর্থাৎ ভূমিপুত্রদের এলাকা হলেও ষোড়শ শতকে ওয়ার্স অব থ্রি কিংডমের সময়ে ব্রিটিশ সেনাপতি অলিভার কর্নওয়াল এই এলাকা দখল করলে শহরের জৌলুশ বৃদ্ধি পায়। ওই সময়ে নিরাপত্তার জন্য কাঠ দিয়ে নির্মিত হয় দুর্গ, যা পরবর্তী সময়ে বিশ শতকের শেষের দিকে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে ভেঙে ফেলা হয় নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য।
স্কটিশ হাইল্যান্ডের ফোর্ট উইলিয়াম
মধ্যাহ্নবিরতির শেষে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে যাত্রা শুরু হলো বেন নেভিসের উদ্দেশে। আমি পাহাড়ি মানুষ। সিলেটের উঁচু পাহাড়ি ভূমিতে জন্ম আর বেড়ে ওঠা। এমন পাহাড়, নদী, জল দেখলে ধুরুমচান্দি বুকের মধ্যে জেগে ওঠে পাহাড়ি সত্তা। পাহাড়ি ট্রেইল ধরে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে বেন নেভিসের দিকে হাঁটছি; মনে হচ্ছে আমার শৈশবের নদী দেওরভাগা ডানে রেখে উঁচু শ্রীমতী টিলার গা ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছি স্কুলের পথে। আর নিচে কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছে নাম না জানা স্বচ্ছ জলের ছড়া।
লেখক: পিএইচডি গবেষক ও প্রভাষক, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, অ্যাংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ