আজিজুর রহমান ছিলেন ব্র্যান্ড ডিরেক্টর। কমার্শিয়াল ছবিতে তিনি যে বক্তব্যধর্মী ধাঁচ নিয়ে এসেছিলেন অনেকেই তা পারেননি। তাঁর ছবি শুধুই বিনোদিত করার জন্য ছিল না তিনি গুরুত্বপূর্ণ সোশ্যাল মেসেজ দিতেন তাঁর ছবিতে। শুধু কি গল্পে, তিনি মেসেজ দিতেন বাণিজ্যিক ছবি কীভাবে নির্মাণ করতে হয় সেটা নিয়েও। তাঁর ছবিগুলো অমূল্য সম্পদ। তিনি আমাদের চলচ্চিত্রের একজন আদর্শ নির্মাতা।
জন্ম ১০ অক্টোবর ১৯৩৯। বগুড়ার সান্তাহারে। তিনি ক্যাপ্টেন এহতেশামের সহকারী ছিলেন। তারপর নিজে চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করে নাম করেন। দর্শক তাঁর ছবির জন্য অপেক্ষা করত।
প্রথম ছবি – সাইফুলমুলক বদিউজ্জামাল
উল্লেখযোগ্য ছবি : মধুমালা, ছুটির ঘণ্টা, স্বীকৃতি, সমাধান, অতিথি, অপরাধ, শাপমুক্তি, কুয়াশা, অমর প্রেম, অশিক্ষিত, অনুভব, মাটির ঘর, মহানগর, জনতা এক্সপ্রেস, সোনার তরী, শেষ উত্তর, অগ্নিশিখা, কথা দাও, বাপবেটা ৪২০, শ্বশুরবাড়ি, শিশমহল, মায়ের আঁচল, মেহমান, যন্তর মন্তর, ডাক্তারবাড়ি ও দুখিনী জোহরা।
তিনি তাঁর ছবিতে বক্তব্য রাখতেন সামাজিকভাকে। এক ‘ছুটির ঘণ্টা’ দিয়ে স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষকে সচেতন করে দেয়া হয়েছিল। স্কুল ছুটির কোনো শিক্ষার্থী যেন আটকা না পড়ে স্কুলে সেটি খেয়াল রাখতে হবে। বাস্তব ঘটনা থেকে নির্মিত তো তাই এ ছবির গুরুত্বও বেশি এবং আজিজুর রহমান দরদ দিয়ে নির্মাণ করেছেন। ‘একদিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাবো’ গানটিতে যে কিশোর মনের অদম্য ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে সে স্বপ্ন দেখছে ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ গানে এবং সে-ই ছেলেটি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাচ্ছে।
‘অশিক্ষিত’ ছবিটিতে তিনি সাক্ষরতা আন্দোলনকে সামাজিকভাবে তুলে ধরেছেন। ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ এ গানে রাজ্জাক শিশুশিল্পী সুমনের কাছে এ আবদার করে এবং সুমন রাজিও হয়। বিদ্যার্জনের যে কোনো বয়স নেই এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কতটা আপন হতে পারে ছবিটি সে কথাই বলে।
‘অনুভব’ ছবির ‘আমার মন তো বসে না গৃহকাজে’ গানটির গভীরতা যে কত গভীর এবং দেহতত্ত্বের আড়ালে জীবনের কঠিন সত্য বর্ণনা করা হয়।
‘মাটির ঘর’ ছবিতে রাজ্জাক-শাবানার বন্ধন এত গভীর যে একজন আরেকজনের জন্য কবর খুঁড়ে অপেক্ষা করে। রাজ্জাক যায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এবং মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে আসে। শাবানাকে বলে-‘যাবি না আমার সাথে?’ শাবানা হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়লে রাজ্জাক তাঁকে গুলি করে এবং দুজনের সমাধি হয়। অনবদ্য সে দৃশ্য ও অভিনয়। জীবনসঙ্গীর বন্ধন কত গভীর হওয়া উচিত এ বক্তব্য ছবিটিতে ছিল।
‘মাসুদ রানা’-র পাশাপাশি ‘কুয়াশা’ সিরিজের কমার্শিয়াল ছবিতে থ্রিলারের মজা দেন আজিজুর রহমান। কিংবদন্তি অভিনেতা আনোয়ার হোসেনকে স্টাইলিশ লুকে দেখা যায়।
‘অতিথি’ ছবির ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’ গানটির মতো গান পুরো ঢালিউডেই নেই। এখানেও ফসলের ক্ষেত সংরক্ষণের জন্য মেসেজ দেয়া হয়েছে।
নাউম ও এহতেশামের সঙ্গে আজিজুর রহমান
‘ডাক্তারবাড়ি’ তাঁর আরেকটি মাস্টওয়াচ ছবি। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার জন্য গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা তরতে চায় না ডাক্তার পরিবারের ছোটভাইরা। ডাক্তার তাই শক্ত অবস্থান নিয়ে ছোটভাইদের আলাদা করে দিয়ে, সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি করে তাদেরকে ভুল/সঠিক বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং তারা সঠিক পথে ফিরে আসে।
‘শেষ উত্তর’ ছবিতে শাবানাকে ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে নিয়েও তিনি পিওর অভিনয় বের করে নিয়েছেন, ‘কথা দাও’-এর মতো পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল ছবিতেও অভিনয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নির্মাণ করেছেন। ‘দিল’ মিউজিক্যাল কমার্শিয়াল ছবির মধ্যে তাঁর ওয়ান অফ দ্য বেস্ট। ‘বাপবেটা ৪২০’-ও পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল ছবি।
কালজয়ী ছবি উপহার দিয়েও একজন কিংবদন্তি পরিচালক আজিজুর রহমান কোনো জাতীয় পুরস্কার পাননি। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপও ছিল। এমন একজন সেরা নির্মাতাকে জাতীয় পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা লজ্জার আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য। শুধু চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার ‘সমাধান’ ছবিতে পান ১৯৭২ সালে।
আমাদের চলচ্চিত্রকে গর্বের জায়গাকে পৌঁছে দিতে যে নির্মাতারা অবদান রেখেছেন একজন আজিজুর রহমান তাঁদের মধ্যে প্রথমদিকে। তিনি গত ১৪ মার্চ মারা গেছেন, কিন্তু অসাধারণ সব চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন দর্শকের মনে।
* লিখেছেন: রহমান মতি
জন্ম ১০ অক্টোবর ১৯৩৯। বগুড়ার সান্তাহারে। তিনি ক্যাপ্টেন এহতেশামের সহকারী ছিলেন। তারপর নিজে চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করে নাম করেন। দর্শক তাঁর ছবির জন্য অপেক্ষা করত।
প্রথম ছবি – সাইফুলমুলক বদিউজ্জামাল
উল্লেখযোগ্য ছবি : মধুমালা, ছুটির ঘণ্টা, স্বীকৃতি, সমাধান, অতিথি, অপরাধ, শাপমুক্তি, কুয়াশা, অমর প্রেম, অশিক্ষিত, অনুভব, মাটির ঘর, মহানগর, জনতা এক্সপ্রেস, সোনার তরী, শেষ উত্তর, অগ্নিশিখা, কথা দাও, বাপবেটা ৪২০, শ্বশুরবাড়ি, শিশমহল, মায়ের আঁচল, মেহমান, যন্তর মন্তর, ডাক্তারবাড়ি ও দুখিনী জোহরা।
তিনি তাঁর ছবিতে বক্তব্য রাখতেন সামাজিকভাকে। এক ‘ছুটির ঘণ্টা’ দিয়ে স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষকে সচেতন করে দেয়া হয়েছিল। স্কুল ছুটির কোনো শিক্ষার্থী যেন আটকা না পড়ে স্কুলে সেটি খেয়াল রাখতে হবে। বাস্তব ঘটনা থেকে নির্মিত তো তাই এ ছবির গুরুত্বও বেশি এবং আজিজুর রহমান দরদ দিয়ে নির্মাণ করেছেন। ‘একদিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাবো’ গানটিতে যে কিশোর মনের অদম্য ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে সে স্বপ্ন দেখছে ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ গানে এবং সে-ই ছেলেটি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাচ্ছে।
‘অশিক্ষিত’ ছবিটিতে তিনি সাক্ষরতা আন্দোলনকে সামাজিকভাবে তুলে ধরেছেন। ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ এ গানে রাজ্জাক শিশুশিল্পী সুমনের কাছে এ আবদার করে এবং সুমন রাজিও হয়। বিদ্যার্জনের যে কোনো বয়স নেই এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কতটা আপন হতে পারে ছবিটি সে কথাই বলে।
‘অনুভব’ ছবির ‘আমার মন তো বসে না গৃহকাজে’ গানটির গভীরতা যে কত গভীর এবং দেহতত্ত্বের আড়ালে জীবনের কঠিন সত্য বর্ণনা করা হয়।
‘মাটির ঘর’ ছবিতে রাজ্জাক-শাবানার বন্ধন এত গভীর যে একজন আরেকজনের জন্য কবর খুঁড়ে অপেক্ষা করে। রাজ্জাক যায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এবং মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে আসে। শাবানাকে বলে-‘যাবি না আমার সাথে?’ শাবানা হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়লে রাজ্জাক তাঁকে গুলি করে এবং দুজনের সমাধি হয়। অনবদ্য সে দৃশ্য ও অভিনয়। জীবনসঙ্গীর বন্ধন কত গভীর হওয়া উচিত এ বক্তব্য ছবিটিতে ছিল।
‘মাসুদ রানা’-র পাশাপাশি ‘কুয়াশা’ সিরিজের কমার্শিয়াল ছবিতে থ্রিলারের মজা দেন আজিজুর রহমান। কিংবদন্তি অভিনেতা আনোয়ার হোসেনকে স্টাইলিশ লুকে দেখা যায়।
‘অতিথি’ ছবির ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’ গানটির মতো গান পুরো ঢালিউডেই নেই। এখানেও ফসলের ক্ষেত সংরক্ষণের জন্য মেসেজ দেয়া হয়েছে।
নাউম ও এহতেশামের সঙ্গে আজিজুর রহমান
‘ডাক্তারবাড়ি’ তাঁর আরেকটি মাস্টওয়াচ ছবি। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার জন্য গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা তরতে চায় না ডাক্তার পরিবারের ছোটভাইরা। ডাক্তার তাই শক্ত অবস্থান নিয়ে ছোটভাইদের আলাদা করে দিয়ে, সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি করে তাদেরকে ভুল/সঠিক বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং তারা সঠিক পথে ফিরে আসে।
‘শেষ উত্তর’ ছবিতে শাবানাকে ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে নিয়েও তিনি পিওর অভিনয় বের করে নিয়েছেন, ‘কথা দাও’-এর মতো পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল ছবিতেও অভিনয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নির্মাণ করেছেন। ‘দিল’ মিউজিক্যাল কমার্শিয়াল ছবির মধ্যে তাঁর ওয়ান অফ দ্য বেস্ট। ‘বাপবেটা ৪২০’-ও পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল ছবি।
কালজয়ী ছবি উপহার দিয়েও একজন কিংবদন্তি পরিচালক আজিজুর রহমান কোনো জাতীয় পুরস্কার পাননি। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপও ছিল। এমন একজন সেরা নির্মাতাকে জাতীয় পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা লজ্জার আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য। শুধু চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার ‘সমাধান’ ছবিতে পান ১৯৭২ সালে।
আমাদের চলচ্চিত্রকে গর্বের জায়গাকে পৌঁছে দিতে যে নির্মাতারা অবদান রেখেছেন একজন আজিজুর রহমান তাঁদের মধ্যে প্রথমদিকে। তিনি গত ১৪ মার্চ মারা গেছেন, কিন্তু অসাধারণ সব চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন দর্শকের মনে।
* লিখেছেন: রহমান মতি