আধিভৌতিক
মূল লেখকঃ ডাঃ আফতাব হোসেন
মূল লেখকঃ ডাঃ আফতাব হোসেন
১৯৮৪ সাল। ঢাকা মেডিকেলে থার্ড ইয়ারে পড়ি। তখনও মেডিকেলের ছাত্রদের জন্য চটি (ছোট নোট বই) এর প্রচলন হয়নি। দু একজন অতি উৎসাহী ছাত্র স্যারদের লেকচার সংগ্রহ করে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপিয়ে কেবল বিক্রি করতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে একজন আমাদের এক বছরের সিনিয়র ফরিদ ভাই। একদিন আমাকে বললেন,
- তোমার বাড়ি তো বরিশাল। আমার কতগুলি প্যাথলজির চটি নিয়ে বরিশাল মেডিকেলে যাবে?
শুনে আমি চোখ ত্যাড়া করে তাঁর দিকে তাকালাম। বাপ যে টাকা পাঠায়, তাতে পিঁপড়ার পেট টিপে চলার মতো করে কোনোমতে মাস চলে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো বিলাসিতা কোথায়? ব্যবসায়ী মনের ফরিদ ভাই ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন (পরবর্তীতে তিনি বাণিজ্যিক ভাবে একজন ভীষণ সফল ব্যবসায়ী হয়েছিলেন)। হেসে বললেন,
- চিন্তা কইরো না। যাওয়া আসা ও থাকা খাওয়ার খরচ আমিই দেবো। সাথে এক কপি তোমার জন্য ফ্রি। তুমি শুধু নোটগুলো ফোর্থ ইয়ারের মাহবুবের কাছে রেখে আসবে।
এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে ! আমার হিসেবি মন অংক কষতে বসে গেল। বরিশাল শহর থেকে ঘণ্টা তিনেক দূরে নানা বাড়ি। আমি তো নোট দিয়ে সহজেই নানা বাড়ি যেতে পারি। তাতে থাকা খাওয়ার খরচটাও বেঁচে যাবে আর নানীর হাতের মজাদার রান্নাও খাওয়া যাবে। ভাগ্য ভালো হলে আসার সময় নানী একশ টাকার একটা নোট হাতে গুজে দিলেও দিতে পারেন। আর চটির সৌজন্য কপি তো আছেই। এত বড় লোভনীয় প্রস্তাব হাতছাড়া করার মতো বেকুব আমি নই। সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলাম।
ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম পানিপথ হলেও তখন এখনকার মতো এত বিলাসবহুল কেবিন-ওয়ালা লঞ্চ ছিল না। যেতে হলে লঞ্চ কিংবা স্টিমারের ডেকে কাঁথা বালিশ নিয়ে যেতে হত। সে পথ না মাড়িয়ে আমি ঘুর পথে বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেমতে পরদিনই এক গাট্টি চটি নিয়ে বরিশালের বাসে উঠলাম।
বরিশাল মেডিকেলে পৌছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি চটিগুলি প্রাপকের হাতে সপে দিয়ে ছুটলাম লঞ্চঘাটের দিকে। নানা বাড়ি যেতে হলে বরিশাল থেকে লঞ্চে যেতে হবে নলছিটি । সেখান থেকে মাইল দুই হাঁটা পথ। আমি জানতাম, সন্ধ্যা সাতটায় নলছিটি যাবার লঞ্চ আছে। পেয়েও গেলাম। ছোট দেড় তলা লঞ্চ। কীর্তনখোলার পানি কেটে তরতর করে এগিয়ে চলল নলছিটির দিকে। নদীর বুকের হিমেল হাওয়া আমার সারাদিনের জার্নির ক্লান্তি মুছে দিল। আমি চোখ বন্ধ করলাম। অমনি নানীর মিষ্টি মুখটা ভেসে উঠল। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো কেমন চমকে উঠবেন, ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠলাম। সাথে আমার সমবয়সী, অন্যতম বন্ধু ও ছোট মামা তো আছেই।
কিন্তু বাঁধ সাধল অন্য খানে। সারাদিন পেটে দানাপানি পড়েনি। এতক্ষণে নদীর রুচিকর মিষ্টি হাওয়ায় শ্রীকান্তের নতুনদার মতো আমার খিদেটাও চেগিয়ে উঠল। আমার তো নতুনদার মতো হুকুম শোনার জন্য কান্ত কিংবা ইন্দ্র বসে নেই যা খাবার জোগাড় করবে। ছোট লঞ্চ। খাবার দোকানও নেই। নিজেকে বোঝালাম, রসো, এই তো ঘণ্টা দুই। তারপরই তো নানা বাড়িতে কবজি ডুবিয়ে গলা পর্যন্ত খেতে পারবি। আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদ নেই। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে এখানে সেখানে উঁকি দিচ্ছে কিছু তারা। ঢাকা শহরে থাকি। বৈদ্যুতিক আলোয় কখন চাঁদ ওঠে, কখন অস্ত যায়, কখন শুক্লপক্ষ, কখন কৃষ্ণপক্ষ, কখন পূর্ণিমা, কখন অমাবস্যা, কিছুই জানি না। এমন কী বাংলায় এটা কোন মাস, তাও জানি না। শুধু জানি বর্ষা কাল। তবে এই মেঘে বৃষ্টি হবে না। খিদে ভুলে থাকতে আমি আকাশের তারা গুনতে শুরু করলাম।
একসময় লঞ্চটি আমাকে নলছিটি নামিয়ে দিল। কবজি উলটে ঘড়ি দেখলাম, রাত নটা। এ আর এমন কী রাত ? ছোট্ট থানা শহর নলছিটি। এখনও কিছু দোকানপাট খোলা। হলুদাভ ম্লান বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। দুচার জন লোক বসে আড্ডা মারছে। আমি একটা দোকান থেকে নানীর জন্য পান আর জর্দা কিনলাম। গ্রামের মানুষ খুব আলাপী হয়। বিশেষ করে অপরিচিত কাউকে দেখলে খোঁজ খবর নিত। মেডিকেলে থার্ড ইয়ারে পড়লেও আমার মাকুন্দ মার্কা চেহারার জন্য স্কুলের ছাত্র বলে মনে হত। একজন খেজুরে আলাপ জুড়ে দিল,
- মনু যাবা কই?
- পরমপাশা।
- আইছ কোম্মেইদ্যা?
- ঢাকা থেকে।
- ল্যাহো কোন কেলাসে?
বরিশালের মানুষ "পড় কোন ক্লাসে" জানতে হলে বলে, ল্যাহো কোন কেলাসে। আমার ভিতরে তখন বাড়ি যাবার তাড়া। মেডিকেলে পড়ি বললে আবার ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে। তাই বললাম,
- ডাক্তারি পড়ি।
সব কটা চোখ আমার দিকে এমন করে তাকালো, যেন এমন আজগুবি কথা তাদের বাপের জন্মেও শোনেনি। লোকটা ভাবল, আমি বুঝি দুষ্টুমি করছি। গ্রামের বয়স্ক মানুষ। একটা বাচ্চা ছেলের দুষ্টুমি তাঁর পছন্দ হল না। সে খেঁকিয়ে উঠল,
- ব্যাডা মোর লগে মশকরা হরো ? নাক চাপলে দুদ বাইর হয়, দারি মোছের দ্যাহা নাই, কও ডাক্তারি পরো?
এ প্রশ্নের কী জবাব দেব? আমার দাঁড়ি গোঁফ তেমন ওঠেনি, সে দোষ কি আমার? আমি কথা না বাড়িয়ে হাঁটা দিলাম। যেতে যেতে শুনলাম, একজন বলছে,
- অইলেও অইতে পারে। শহরের পোলাপান, বয়স বোজা যায় না।
আর একজন একটু চেঁচিয়ে বলল,
- মনু, সাবদানে যাইও। আইজ বাদ্দোর মাইস্যা আমাবইস্যা ( ভাদ্র মাসের অমাবস্যা)।
শেষ কথাটা শুনে মনে মনে শিউরে উঠলাম। এই ভাদ্র মাসের অমাবস্যা নিয়ে দাদির মুখে অনেক লোমহর্ষক কাহিনী শুনেছি। এবং অবশ্যই তা ভূত প্রেত জাতীয়। এমনিতেই আমার অন্ধকারকে ভীষণ ভয়। তাঁর উপর এই অমাবস্যার রাতে অন্ধকার গ্রামের পথে দুই মাইল হেঁটে যেতে হবে। পথে কোনো সঙ্গী সাথী পাব কি? একটা অজানা ভয়ের ঠাণ্ডা সাপ আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নীচে নেমে গেল। একবার ভাবলাম, ফিরে যাই। কিন্তু সে উপায়ও নাই। বরিশাল যাবার আর কোনো লঞ্চ রাতে নেই। আফসোস হচ্ছিল, রাতটা বরিশাল মেডিকেলের হোস্টেলে থেকে কাল সকালে এলেও পারতাম। কপালের লিখন, না যায় খণ্ডন !
ছোট্ট শহর। মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই শেষ হয়ে এলো। কমে এলো দোকানপাট। রাস্তায় কোনো ল্যাম্পপোস্ট নেই। দু একটা ঘর থেকে আলোর রশ্মি আসছে বাইরে। যতই শহর থেকে বাইরের দিকে যাচ্ছি, ততই যেন অন্ধকার ঝাপটে ধরছে। তাও রাস্তার দুই ধারে ঘরগুলোতে প্রাণের সাড়া পাচ্ছিলাম। এক সময় তাও শেষ হয়ে গেল।
শহরের শেষ প্রান্তে এসে রাস্তাটা দুই ভাগ হয়ে গেছ। তারই মাঝখানে একটা বাঁধানো কবর। ব্রিটিশ আমলে কোনো এক চায়নিজ থাকত এই শহরে। নিঃসন্তান, আত্মীয় বান্ধবহীন বেচারা মারা গেলে স্থানীয়রা তাকে এখানেই কবর দেয়। মুসলমান নয় বলে জানাজা হয়নি। হিন্দু নয় বলে পুড়িয়েও ফেলেনি। তাই, শত বছরের পুরনো এই কবরকে ঘিরে স্থানীয়দের ধারণা, সৎকারহীন চায়না ম্যানের অতৃপ্ত আত্মা আজও এই কবরের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়।
আমি আড়চোখে কবরটির দিকে তাকালাম। অযত্নে, অবহেলায়, জঙ্গলে, আগাছায় পূর্ণ হয়ে আছে কবরের বেদি। অন্ধকারে জায়গাটাকে আরও ভূতুরে মনে হল। মনে হল, হলুদ চামড়া, থ্যাবড়া নাক আর কুতকুতে চোখ নিয়ে বৃদ্ধ চাইনিজ বুঝি চেয়ে আছে আমার দিকে। ভাবতেই শরীর হিম হয়ে গেল। অযুত, লক্ষ লোমকূপ সজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে গেল। আমি একটুখানি আলোর আশায় চারিদিকে তাকালাম। কোথাও কোনো আলো নেই। দূরে গাছ গাছালিতে ঘেরা গ্রামের বাড়িগুলি অন্ধকারের চাঁদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। যত দোয়া দরুদ জানি, পড়তে পড়তে সাহায্যের আশায় আকাশের দিকে তাকালাম। ভোজবাজির মতো হারিয়ে গেছে আকাশের সব তারা। পুরো আকাশ ঢেকে গেছে কালো মেঘে।
ভাবলাম, আর কোনো দিকে নয়, শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটব। অথচ শরীরটা কেমন ভারি হয়ে আসছে। পা চলতে চাইছে না। মনে হল, শুধু চাইনিজের আত্মা নয়, আরও কিছু আত্মা জড় হয়েছে মজা দেখার জন্য। তারা অন্ধকারে সাদা দাঁত বের করে হাসছে। ফিসফিস করে কথা কইছে। আমি কোনো মতে ভারি শরীরটা টেনে নিয়ে চলতে থাকলাম। এমন সময় কবরের মধ্যে একটা সরসর শব্দ হল। অজান্তেই ঝট করে সেদিকে তাকালাম। দেখি, অন্ধকারে ছোট্ট দুটো আগুনের গোলার মতো চোখ চেয়ে আছে আমার দিকে। যেন এক লাফে এসে এখনই আমার ঘাড় মটকে খাবে। আমি জমে বরফ হয়ে গেলাম।
আমি স্থির চেয়ে আছি সেই জ্বলজ্বলে চোখের দিকে। সেও চেয়ে আছে আমার দিকে। যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে সময়। হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে সে চোখ দুটো চলে এলো রাস্তার উপর। অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম, ছোটখাটো ভল্লুকের মতো একটা সাদা বেড়াল। ছোট বেলায় রাতে দাদী নানীর কোলের ভেতর অনেক শুয়েছি। অদ্ভুত সব ভূত প্রেতের গল্প শুনতে শুনতে ভয়ে আরও কুঁকড়ে যেয়ে তাদের শরীরের ওম নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়েছি। বহুবার শোনা সেই সব গল্প আমার আবার মনে পড়ে গেল। কবরস্থানে থাকা বেড়ালগুলো নাকি নিছক বেড়াল নয়। ওদের শরীরে ভর করে থাকে যত অশরীরী আত্মা। এ সব বেড়াল কামড়ায় না। তবে দুই পায়ের ফাঁক গলে একবার যেতে পারলে কম্ম সাবাড়। আমাকে শেখানো হয়েছিল, এমন পরিস্থিতিতে পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হবে। যাতে কোনো মতেই বেড়াল পায়ের ফাঁক দিয়ে না যেতে পারে। আমি পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতেও ভুলে গেলাম। বেড়ালটা আমাকে ঘিরে চক্কর কাটতে শুরু করল। আমি নড়াচড়া ভুলে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি। সব দোয়া দরুদ ভুলে গেছি। তল পেটে এক অসম্ভব চাপ অনুভব করছি। মনে হচ্ছিল, যে কোনো সময় বয়াতি বংশের পোলার ইজ্জত পানিতে ভেসে যেতে পারে। আমার দুকানে তব্ধ লেগে গেল। পৃথিবীর কোনো শব্দ আর আমার কানে আসছিল না।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা হাত আমার কাঁধে পড়ল। মুহূর্তে মনে হল, বুঝি বেড়ালটা চায়না ম্যানের রূপ ধারণ করে আমার কাঁধে হাত দিয়ে দিয়েছে। এখনই ঘাড় মটকে খাবে। আমি পড়ে যেতে যেতে কোনমতে একবার ফিরে তাকালাম।
অবাক হয়ে দেখি, সাদা পাঞ্জাবী পরা, সাদা দাঁড়ি চুলের এক বৃদ্ধ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। এই অন্ধকারেও তাঁর মুখ আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম। যেন মুখ থেকে এক ধরণের জ্যোতি বের হচ্ছে। সে হাসি মুখেই জানতে চাইল,
- কী মনু, এইখানে খাড়াইয়া রইছ ক্যান?
পরিষ্কার মানুষের কণ্ঠস্বর। শুনেছি ভূত প্রেতের কণ্ঠ চিকোন নাকি গলার হয়। এনারটা ভরাট গলা। এই অন্ধকার নির্জন রাস্তায় তিনি কোথা থেকে দেব দূতের মতো উদয় হলেন, আমার মাথায় এলো না। তবু মানুষের গলা শুনে আমার ভয়টা যেন ঘাম দিয়ে ছেড়ে গেল। একটা ঢোক গিলে কোনমতে বললাম,
- পরমপাশা যাব।
তিনি তেমনই হাসি মুখে বললেন,
- লও। তোমারে আউগাইয়া দিয়া আসি।
বৃদ্ধ এবার কাঁধ থেকে হাতটা নামিয়ে আমার একটা হাত ধরলেন। ঠাণ্ডা, নরম মোলায়েম সে হাত। গ্রামের মানুষের এত নরম হাত কী করে হয়, আমার চিন্তায় এলো না। সে আমার হাত ধরে সামনে এগিয়ে চললেন। আমার শরীরটা পাখির পালকের মতো হালকা মনে হচ্ছিল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর সাথে চলতে লাগলাম। যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে চাইলাম, আগুন চোখের সে বেড়ালটিকে কোথাও দেখতে পেলাম না। জংলা কবরে যেন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে নাম না জানা সে চায়না ম্যান।
খোয়া বিছানো বড় ডিসট্রিক্ট বোর্ডের বড় রাস্তা। এখানে সেখানে খানাখন্দ। তাতে পানি জমে আছে। হয়ত দিনের বেলা এখানে বৃষ্টি হয়েছে। বয়সের তুলনায় বেশ দ্রুত হাঁটছেন বৃদ্ধ। যেন অনেক তাড়া তাঁর। নাতীর বয়সী হয়েও তাঁর সাথে তাল মেলাতে আমাকে রীতিমত ছুটতে হচ্ছে। ছুটতে যেয়ে রাস্তায় জমা পানিতে জুতো, প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে। ভাদ্র মাসের আকাশে মেঘ করলে বাতাস থাকার কথা নয়। ভ্যাপসা গরম পড়ার কথা। অথচ একটা ঠাণ্ডা মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সে বাতাসে ভাসতে ভাসতে আমাকে নিয়ে উড়ে চললেন অলৌকিক সেই সাদা মানুষটি।
কতক্ষণ ছুটেছিলাম জানি না। হঠাৎ দূরে দরগাবাড়ি দেখা গেল। আর এক তিন রাস্তার মোড়। রাস্তার দুপাশে কয়েকটা দোকান। দরগাবাড়িতে তখনও কারেন্ট পৌছাইনি। একটা দোকান খোলা। তার কুপির আলো আমার চোখে পড়ল। অমনি বন্ধ হয়ে গেল বাতাস। আমি যেন ধপ করে মাটিতে পড়লাম। পাশে চেয়ে দেখি, নেই বৃদ্ধ!
আমি ডানে, বামে, পিছনে তাকালাম। কোথাও নেই। যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। আসলেই কি কেউ ছিল আমার সাথে? নাকি সবই আমার দৃষ্টি বিভ্রম (Hallucination) ? নাকি কোনো অশরীরী সদয় আত্মা আমাকে পৌঁছে দিল গন্তব্যে। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল! এবার আমি সত্যি সত্যি সেই কুপির আলোতে চোখ রেখে দৌড়াতে শুরু করলাম।
এক দৌড়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। হাপরের মতো আমার বুক ওঠা নামা করছে। দোকানি দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করছিল। কাছেই নানা বাড়ি। আমাকে চেনে। হাঁপাতে দেখে অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলেন,
- কী অইছে ফিরুজ? হাপাইতেয়াছো ক্যা? এত রাইতে আইলা কোম্মেইদ্যা (কোত্থেকে) ?
আমি তার কথার জবাব না দিয়ে কোনমতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললাম,
- পানি।
লোকটা আরও অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর আর কিছু জিজ্ঞেস না করে জগ থেকে একটা গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলেন। আমি দাঁড়িয়ে দাড়িয়েই ঢক ঢক করে পুরাটা খেয়ে ফেললাম। এতক্ষণে যেন আমার ধরে প্রাণের সাড়া পেলাম। গ্লাসটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম,
- ঢাকা গোনে আইছি মামা।
দোকানি মামা কুপিটা উঁচিয়ে ধরে আমার মুখটা দেখলেন। আমার মুখ, শরীর তখন ঘামে ভিজে জবজবা। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা খাঁচায় বন্ধ ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। কী বুঝলেন দোকানি মামা কে জানে? বললেন,
- এট্টূ খারাও। আমি দোকান বন্দ কইরা তোমারে বারি দিয়া আইতেয়াছি।
শুনে আবার ভয় পেয়ে গেলাম। সাদা বৃদ্ধের মতো এও কোনো অশরীরী কেউ নয় তো ? শুনেছি, ভূত প্রেতদের পা উলটো দিকে ঘোরানো থাকে। বৃদ্ধের পায়ের দিকে তাকানো হয়নি। আমি এবার দোকানির পায়ের দিকে তাকালাম। নাহ, পা ঠিকই আছে, যথাস্থানে। তাছাড়া ভূত প্রেত তো আলো সহ্য করতে পারে না। দোকানি মামার হাতে কুপি। তিনি দোকান বন্ধ করে একটা শক্তিশালী টর্চ হাতে নিয়ে বললেন,
- লও, যাই। আর কোনো ভয় নাই।