স্পর্ধিত তারুণ্য কোনকালেই–বা পরোয়া করেছে কারও ভ্রূকুটি? তার এক তুড়িতেই উড়ে গেছে অন্যায়কারীর সব তর্জন-গর্জন, জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে দৃপ্ত পদক্ষেপে সে-ই তো এনেছে নতুন ভোর। যুগে যুগে দেশে দেশে ইতিহাসের পাতায় রক্তের অক্ষরে লেখা হয়েছে এমনি কত অমিত সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাণের নাম, নিঃশঙ্কচিত্তে যাঁরা এগিয়ে গেছেন মৃত্যুর দুয়ারে, শুধু এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাবেন বলে! তাঁদেরই একজন জার্মানির সোফি—দুর্মর, সাহসী, স্বাপ্নিক আর আদর্শে অবিচল। অত্যাচারীর সীমাহীন নির্মমতায় মাত্র একুশের জীবনপ্রভাতেই চলার পথ ফুরিয়ে গিয়েছিল সোফির, অথচ রুদ্ধ করা যায়নি তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তাঁর জন্মশতবর্ষে দাঁড়িয়ে মানবতা আর স্বদেশপ্রেমের দৃপ্ত চেতনায় ভাস্বর অবিনাশী সোফিকে তাই বারবার মনে পড়ে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র বছর কয়েক আগে। পরাজিত-ধস্ত জার্মানির ভবিষ্যৎ দুলছে তখনো অনিশ্চয়তার দোলাচলে। এই রকম এক সময়ে ১৯২১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ জার্মানির এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে সোফির জন্ম, পোশাকি নাম সোফি ম্যাগডালেনা স্কল। বাবা ছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিমের এক ছোট্ট শহরের অধিকর্তা। ছয় ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ সোফি। নিরাপদ ঘেরাটোপে ছোটবেলাটা কাটলেও কৈশোরে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই দেশজুড়ে শুরু হয়ে গেছে হিটলারের শাসন, নাৎসিদের রমরমা চারদিকে। এ সময় আরও অনেকের মতোই জার্মানির হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে হিটলারের তর্জন-গর্জনে পরাক্রান্ত নেতার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন জার্মানির যুবসমাজের অধিকাংশরাই। ফলে অস্বাভাবিক নয় যে বড় ভাই হান্স যুক্ত হয়েছিলেন হিটলার ইয়ুথ মুভমেন্টে, আর সোফি সদস্যপদ নেন লিগ অব জার্মান গার্লসে। কিন্তু গোড়া থেকেই তাঁদের পিতা ছিলেন হিটলারের কঠোর সমালোচক। বাড়িতে উদার পরিবেশে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে উগ্রবাদী আদর্শের বিপদ সম্পর্কে ছেলেমেয়েকে সচেতন করার চেষ্টাও তিনি করেছিলেন। তবে ছেলেমেয়েদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার প্রবণতায় আতঙ্কিত হলেও ওদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি তিনি।
ভাইবোন দুজনেরই ঝোঁক ছিল শিল্পকলার প্রতি। সোফি ভালোবাসতেন নাচতে, পিয়ানো বাজাতে। এমনকি ছবি আঁকার হাতও মন্দ ছিল না। জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে জার্মান রোমান্টিসিজমের উদারনৈতিকতায় সঞ্জীবিত সংগীত, শিল্পকলা ও সাহিত্যের প্রকৃত অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। কিন্তু ক্রমে হিটলারের থার্ড রাইখের জবরদস্তিমূলক রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে মুক্ত চিন্তাচেতনার সহাবস্থান কঠিন, এমনকি অসম্ভব হয়ে উঠছিল। ইহুদিসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী এবং ভিন্ন ভাবধারার শিল্পী-সাহিত্যিকদের ওপর দমন-পীড়নের খড়্গ নেমে এলে সোফির মনোজগৎও গভীরভাবে আলোড়িত হয়। এদিকে উচ্চাভিলাষী হিটলারের মাত্রাছাড়া আগ্রাসনে ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ড আক্রান্ত হয়। তখন তাঁর রাজনৈতিক কপটতা আর অপ্রকাশ্য থাকল না। অনিবার্য পরিণতি হিসেবেই পিছু পিছু এল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
চলমান যুদ্ধের মধ্যেই, ১৯৪০-এর বসন্তে সোফির হাইস্কুলে পাঠগ্রহণ সমাপ্ত হয় এবং একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষক পদে তিনি নিযুক্ত হন। কিন্তু পরের বছরই যুধ্যমান দেশে বাধ্যতামূলকভাবে ন্যাশনাল লেবার সার্ভিসে তাঁকে যোগ দিতে হয়। এখানকার কঠোর সামরিক নিয়মকানুন, অনুদার-বদ্ধ পরিবেশে হাঁপিয়ে ওঠে তাঁর মন। একটি মুক্ত-স্বাধীন জীবনের জন্য, যুদ্ধের দামামা বন্ধের জন্য, অবিচারহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় এবং পূর্ব সীমান্তে যুদ্ধরত তাঁর প্রিয়তম ফ্রিটজের সঙ্গে সুখী জীবন কাটানোর জন্য বুভুক্ষু সোফি ক্রমে রূপান্তরিত হন নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে এক দৃঢ়চেতা-নির্ভীক যোদ্ধায়। এ সময় ফ্রিটজকে এক চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, কী করে কিছু মানুষ ক্রমাগতই অন্যের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। আমার এটা ভয়াবহ লাগে! আর হ্যাঁ, এসবের জন্য দয়া করে পিতৃভূমির দোহাই দিতে এসো না!’
১৯৪২ সালের মে মাসে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন সোফি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বড় ভাই হান্স ও তাঁর বন্ধুরা—যাঁরা পূর্ব সীমান্তে যুদ্ধাক্রান্ত জনমানুষের দুর্দশা দেখে এসেছেন স্বচক্ষে—তাঁরা আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারলেন না, সমমনাদের নিয়ে গোপনে ক্রমে সংগঠিত হয়ে উঠলেন। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক কার্ট হুবারও যোগ দিলেন এই তরুণদের সঙ্গে। নাৎসিদের যুদ্ধ-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অহিংস-শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের ডাক দিয়ে ‘দ্য হোয়াইট রোজ’ শিরোনামাঙ্কিত এঁদের প্রথম লিফলেটটি প্রকাশিত হয় জুন ১৯৪২-এ। পরবর্তী আট মাসে ছাত্র-জনতার উদ্দেশে আরও পাঁচটি লিফলেট মুদ্রণ ও বিতরণ করেন তাঁরা। সে সময়ের পরিস্থিতি বিবেচনায় এসব কাজে সম্পৃক্ততার ভয়াবহ পরিণতি অজানা ছিল না। কিন্তু তারুণ্যের ধর্মই যে অন্যায়ের সামনে মাথা নত না করা! তাই গোড়া থেকেই অন্যদের সঙ্গে নির্ভয়া সোফিও হোয়াইট রোজের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।
প্রথমে শুধু মিউনিখে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমেই সমগ্র জার্মানিতে পৌঁছে যায় সাদা গোলাপের সুবাস। তাদের প্রচারপত্রগুলোর লেখনি ছিল তীক্ষ্ণ, ক্ষুরধার এবং অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণে নির্ভীক। পঞ্চম লিফলেটটিতে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয় নাৎসিদের বিবেকহীন, অন্যায় যুদ্ধের অবসানে, আত্মিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ কলুষিতকরণের প্রতিবাদে শামিল হতে। ‘আমাদের কণ্ঠস্বর রোধ করা যাবে না’—লেখা হয়েছিল একটি প্রচারপত্রে।
১৯৪৩-এর জানুয়ারি নাগাদ যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি তাঁদের আরও আশাবাদী করে তোলে। সাহসও যায় বেড়ে। একপর্যায়ে যুদ্ধবিরোধী-হিটলারবিরোধী গোপন লিফলেট প্রচারণাই শুধু নয়, প্রকাশ্যে দেয়াললিখনেও নেমে পড়েন সাদা গোলাপের সদস্যরা। তাঁদের উৎসাহ-উদ্যোগে সবাইকে চমকে দিয়ে মিউনিখের দেয়ালে দেয়ালে কিছুদিনের মধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে উঠতে থাকে ‘হিটলার নিপাত যাক’ স্লোগানসংবলিত গ্রাফিতি।
তবে বিপদ হাঁটছিল পিছু পিছুই।
১৯৪৩-এর ১৮ ফেব্রুয়ারির সকাল। হান্স ও সোফি তাঁদের ষষ্ঠ (এবং সর্বশেষ) লিফলেটটি বিতরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত। বিভিন্ন কক্ষে তখন ক্লাস চলছে, সর্বত্র সুনসান নীরবতা। সোফি-হান্স দ্রুতগতিতে ভবনের বিভিন্ন কোণে কাগজের তাড়াগুলো রাখতে লাগলেন, ক্লাসের বিরতিতে বেরিয়েই শিক্ষার্থীরা যেন হাতে পায় সেগুলো।
পরিকল্পনামতো কাজ প্রায় সারা যখন, হঠাৎ কী যে খেয়াল চাপল সোফির! হয়তো আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে ভেবেই, দ্রুত পায়ে একতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে রেলিংয়ের ওপরে রাখা একতাড়া কাগজ একধাক্কায় উড়িয়ে দিলেন বাতাসে। শূন্যে ভেসে ভেসে সাদা গোলাপের পাপড়ির মতো সেগুলো ছড়িয়ে পড়ল নিচতলার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। আর ঠিক তখনই, সেই অবিস্মরণীয় একটি মুহূর্তে বদলে গেল সবকিছু।
নাৎসিদের পাঁড় সমর্থক এক দ্বাররক্ষীর নজর এড়ায়নি দৃশ্যটা। যথাস্থানে খবর পৌঁছে যায় দ্রুত। সেই দিনই গ্রেপ্তার হন সোফি ও হান্স। তল্লাশিতে সপ্তম লিফলেটের খসড়া উদ্ধার হলো হান্সের ব্যাগ থেকে। তারই সূত্রে একই দিন গ্রেপ্তার হলেন দলের আরও এক সদস্য—প্রোবস্ট। দীর্ঘ, কষ্টকর জেরা চলল তিনজনের। অন্য সহযোগীদের বাঁচাতে হোয়াইট রোজের সব কর্মকাণ্ডের দায় তুলে নিলেন তাঁরা নিজেদের কাঁধে।
হিটলারের কুখ্যাত সহযোগী বিচারক রোলা-ফ্রিজলারের নেতৃত্বে দ্রুতগতিতে বিচারকাজ চলল। বিচারালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্ভীক সোফির শেষ উত্তর ছিল, ‘আমি আগের মতোই বলতে চাই যে জাতির মঙ্গলের জন্য সর্বোচ্চটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমি। আমার কোনো অনুশোচনা নেই এবং যেকোনো পরিণতি বহন করতে আমি প্রস্তুত।’
প্রহসনের বিচারে পরিণতি জানাই ছিল। তিনজনকেই দেশদ্রোহের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। জীবনের শেষ প্রভাতে সোফি লিখেছেন, ‘কী সুন্দর রোদ ঝলমলে একটা দিন, অথচ আমাকে চলে যেতে হবে...যদি হাজারো মানুষ জেগে না ওঠে, ঝাঁপিয়ে না পড়ে কাজে, তবে এই মৃত্যুর কী মূল্য?’
১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সোফি, হান্স ও প্রোবস্টকে হত্যা করা হয় গিলোটিনে। সোফির বয়স তখন মাত্র ২১।
পরে ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন দলের আরও তিন মূল সদস্য। বিচার করে পর্যায়ক্রমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় সবারই।
স্বভাবতই জার্মান পত্রপত্রিকায় এই বীর সেনানীদের মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছিল নগণ্যভাবে। তবে হোয়াইট রোজের ষষ্ঠ প্রচারপত্রটি সুকৌশলে পাচার হয় ব্রিটেনে, সেখানে নতুন করে ছাপিয়ে বছরের মাঝামাঝি সময়ে মিত্রপক্ষের বিমান থেকে শত শত কপি নিক্ষেপ করা হয়েছিল জার্মানির বুকে। অত্যাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রকে রুখে দাঁড়ানো, অহিংসা, শান্তি আর সাম্যে অটল আস্থা রাখা কিছু মানুষের স্বপ্ন নিয়ে সাদা গোলাপের পুষ্পপত্রের মতো সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল যুধ্যমান দেশটির পথে পথে।
নিষ্ঠুর-অমানবিক শাসকের শোষণযন্ত্রে নিষ্পেষিত সোফি আর তাঁর সহযোদ্ধাদের দেখা হয়নি নতুন একটি ভোর। কিন্তু যেমনটা তাঁরা বলেছিলেন, রুদ্ধ করা যায়নি তাঁদের কণ্ঠস্বর।
দিন কয়েক আগে পার হলো সোফির স্কলের জন্মশতবর্ষ। এ উপলক্ষে সোফি ও তাঁর সহযোদ্ধাদের জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
[FA]pen[/FA] লেখক: মৃত্তিকা সহিতা