What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected অচেনা অসুখ (1 Viewer)

dukhopakhi

Global Moderator
Staff member
Global Mod
Joined
Mar 3, 2018
Threads
102
Messages
12,090
Credits
112,008
Calculator
Mosque
Calculator
LittleRed Car
LittleRed Car
LittleRed Car
অচেনা অসুখ

লেখকঃ হায়দার আলী

পর্ব ১











১৯৭৭ সাল। আমার স্মৃতির পাতার সূচনালগ্ন বলা যায়। দাদার একান্নবর্তি কৃষক পরিবার। এই পরিবারে আমার দাদা দাদি, আমার আব্বা আম্মা আমার বড় ভাই আমি এবং চার বছরের ছোট বোন বেলী, দুই কাকু, পাঁচ ফুফু, আমার দাদার স্থায়ী সহকারী রুক্কু এবং দাদুর কতিপয় মহিলা সহকারী, গরু ছাগল, হাস মুরগি সব মিলিয়ে লোকে লোকারণ্য এক প্রাণবন্ত কৃষক পরিবার।

আমার মেঝো কাকু পরিবারের একমাত্র উচ্চশিক্ষিত মেট্রিক ফেইল জ্ঞানী ব্যাক্তিত্ব। তার সৌর্যদীপ্ত চৌকস চেহারা, জ্ঞানগর্ভ সাবলিল বাচনভংগি এবং সাহসী মনোভাবের জন্য পরিবারের তথা গ্রামের সকলের শ্রদ্ধা, স্নেহ এবং সম্মানের পাত্র।

ছোট কাকু রিপন, আমার বড় ভাই টিপু এবং ফুফাত ভাই লিটন এই তিনজন সমবয়সী নব্য স্কুলগামী ছাত্র। আদর্শলিপির অনেক আদর্শবাক্য তোতা পাখীর ন্যায় মূখস্ত করা তাদের জন্য ইতিমধ্যে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।, যেমন আলস্য দারিদ্র আনে, সত সংগে স্বর্গবাস, অসত সংগে সর্বনাস ইত্যাদি।, আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তখনও শুরু হয়নি তবে শুনে শুনে এরকম অনেক বাক্যই আমি তখন মূখস্ত করেছিলাম যা এখন ভুলে গেছি।

আমার মেঝো কাকুর কঠোর শাসন, একটুতেই কাকুর হাতের কানমলা, চিকন জিংলার বারি, কাকুর আনকমন প্রশ্ন ইত্যাদির ভয়ে আমরা বাছকিনার দল সর্বদায় ত্রঠস্থ থাকতাম। সন্ধায় সূর্য্য ডুবার সাথে সাথে পাটি বিছিয়ে কুপি অথবা হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসা ছিল বাধ্যতামূলক। আমি তখন স্কুলে না গেলেও সন্ধ্যাকালে সবার সাথে পড়তে বসা ছিল আমার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। পাটকাটির কলম বানিয়ে বড় বড় স্বর্বণের উপর হাত ঘুরানো শুরু করেছিলাম তখন। কোন কারনে কোন অজুহাতে আমি যদি পড়তে না বসতাম এবং কাকু সেটা বুঝতে পারতেন তবে সেদিন আমার রাতের খাবার নিষিদ্ধ ছিলো। একমাত্র আব্বা ছাড়া আর কারো ক্ষমতা নেই আমার রাতের খাবার অনুমোদন দেয়। কাজেই রাত যতই হোক আব্বা বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত আমার উপোস থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা।

বেলী আমার পিঠেপিঠি ছোট বোন। বয়স চার বছর। পরিবারের প্রথম মেয়ে শিশু। সকলের নয়নের মনি। তার কোন কাজ নেই। সদ্য ফুটন্ত বেলী ফুলের মত সৌরভ বিলানোই তার কাজ। সারাদিন শিশুসুলভ কলকাকলি আর একোল ওকোল ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর তেমন কোন কাজ নেই।

চৈত্রের কোন এক পরন্ত বিকেল। বড়রা যে যার কাজে ব্যস্ত। আমরা পাড়ার শিশুরা খেলার মাঠে বৈকালিক ছুটোছুটিতে ব্যস্ত। বাড়িতে বেলী একা। হয়ত কাওকে কাছে না পেয়ে সে বাড়ির পিছনে একাকি চলে গেছে কিছুটা নির্জন জংলের ভিতর। এই সুযোগে কোন এক অচেনা আততায়ী হানা দেয় তার উপর। তারপর সদ্য ফুটন্ত বেলী ফুলটি ঝরে পড়ে ভিতর বাড়ির নির্জন আংগিনায়।

বেলীর নিষ্প্রাণ দেহটি যখন আবিস্কৃত হয় তখন বাড়িতে বিলাপের মাতম। আমি খেলার মাঠ থেকে ফিরে গোধুলির ঝাপ্সা আলোয় ঝাপ্সা চোখে দেখছি বেলী নেই। তার ফুটফুটে নিথর দেহটি কোল বদলে বিলাপের মাথম চলছে। আমি নির্বাক বিশ্বয়ে অপলক দেখছি আর ভাবছি কি হল? কেউ বলছে থাপা খাইছে। অর্থাত কোন এক অশরীরী আত্মা অথবা প্রেতাত্মার রোষানলের শিকার সে। আমি বুঝিনি কিছুই।


এখন ২০২০ সাল। এক অচেনা অসুখে সারা পৃথিবী আজ অসুস্থ। এই অচেনা অসুখের ভয়ে ঘরে বন্দি জীবন যাপন করছি আর ভাবছি, কি ছিলো সেই অচেনা অসুখ যার ছোবলে বেলী চলে গিয়েছিলো পৃথিবী ছেড়ে? আধুনিক বিজ্ঞানের এর ডিজিটাল যুগ পারবে কি দিতে সেই প্রশ্নের উত্তর?

চলবে...
 
অচেনা অসুখ

পর্ব ২




বেলীর পর আমাদের পরিবারে আমার আরও দুইটি বোন আসে যাদের নাম সেলী এবং ডলি। সেলীর বয়স দুই বছর আর ডলির বয়স মাত্র দুই মাস। ডলি তখনও কোলে। বলা বাহুল্য, ডলির এই নামটি এক পর্যায়ে তার জীবন থেকে মুছে যায় এবং সে নিজেও কোন এক সময় পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে যায়। সেও এক মর্মান্তিক হৃদয় বিধারক ঘটনা বটে।

তখন আমরা দুই ভাই এবং দুই বোন। বলা যায় সুখী পরিবার। আমার বড়ভাই বাই নেচার আমার চেয়ে অনেক বেশী চৌকস, কর্মঠ এবং বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ। তার বয়স আনুমানিক দশ বছর। অপর দিকে আমি কিছুটা দুর্বল প্রকৃতির অলস, কর্মবিমূখ কল্পনাপ্রিয় ফাঁকিবাজ ছেলেমানুষ এবং আমার বয়স আনুমানিক আট বছর।

একান্নবর্তি বড় কৃষক পরিবারের গৃহবধু হওয়ায় আমার আম্ম সারাদিন রাত গৃহাস্থালী কাজে ব্যস্ত থাকেন। এইজন্য আমার এই দুই বোনের দেখভালের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে পড়েছে আমার বড় ভাইয়ের উপর। সে ডলিকে কোলে নিয়ে সেলীকে হাতে ধরে সারাদিন এপাড়া ওপাড়া ঘুরে বেড়ায়। সাথে আমিও থাকি কিন্তু গুড ফর নাথিং। আমার তেমন কোন দায়িত্ব নেই। আমি শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ায় পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলাধুলায়ও তেমন অংশ নিতে পারিনা। নিলেও কাঙ্ক্ষিত জয় লাভ করতে পারিনা। যদিও আমার বড় ভাই চায় আমি যেন তাদের সাথে খেলায় অংশ গ্রহন করি এবং ভাল করি। সে তার জমানো পয়সাগুলো একত্র করে পূরো এক টাকা দিয়ে পাড়ার ছেলেদের সাথে অংশিদারিত্বে যে ফুটবল কিনেছে খেলাধুলায় আমার অপারগতার দরুণ সেই পয়সাও বলা যায় এক প্রকার বিফলে যেতে বসেছে। সে নিজেও দুই বোনের দায়িত্বে থাকার কারনে কোন প্রকার খেলায় অংশ নিতে পারেনা। যায়হোক এভাবে আমাদের দিনকাল মুটামুটি চলছিলো বেশ ভালই।

একদিন আমার বড় ভাই আমাকে ডেকে প্রশ্ন করল, আমরা কয় ভাই, কয় বোন? আমি বললাম, দুই ভাই আর দুই বোন। তারপর সে আমাকে বলল, আল্লাহ কেন আমাদের এভাবে মিলিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছে তুই জানিস? আমি বললাম, না। তখন তিনি আমাকে বুঝিয়ে বললেন, আমরা দুই ভাই বড় এবং দুই বোন ছোট। আল্লাহ আমাদের উপর দায়িত্ব অর্পন করেছে যেন আমরা আমাদের বোনদের উপর দায়িত্ব পালন করতে পারি। কাজেই আমাদের দুই ভাইয়ের উপর দুই বোনের সমান দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখন তুই চিন্তা করে দেখ তুই কোন বোনের দায়িত্ব নিতে চাস?

আমি আমার মোটা মাথায় বিচক্ষণ ভাইয়ের প্রশ্নের মাইর প্যাঁচ ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না তাই আমতা আমতা করছিলাম। তখন তিনি আরও বুঝিয়ে বললেন, ধর তুই সেলীর দায়িত্ব নিলি। তখন তোর দায়িত্ব হবে তার দিকে খেয়াল রাখা। সে কোথায় যায়, কি করে, পানিতে পড়ে যায় কিনা বা কেউ তার কোন ক্ষতি করছে কিনা এই সকল বিষয় খেয়াল রাখা। আর যদি তুই ডলিকে নিতে চাস তবে তোর কাজ হবে তাকে কোলে রাখা এবং সে যদি তোর কোলে পশ্রাব পায়খানা করে সেগুলো সহ্য করা এবং পরিষ্কার করা। এখন ভেবে দেখ তুই কাকে নিতে চাস? তখন আমি বিষয়টা পরিষ্কার বুঝতে পেরে বললাম আমি সেলীকে নিতে চাই।

সেদিন থেকে আমরা দুইভাই এক অলিখিত চুক্তির ভিত্তিতে দুই বোনকে ভাগ করে নিলাম। বড় ভাই আমার হাতে সেলীকে ছেড়ে দিয়ে বলল আজ থেকে এই বোনের সম্পূর্ন দায় দায়িত্ব তোর উপর।

যদিও বয়ষানুক্রমে আমার ভাগে ডলি পড়ে কিন্তু যেহেতু সেলীকে নিলে দায়িত্বটা কিছুটা সহজ হয় সেহেতু নিজেকে বিজয়ী মনে করে আমি সেলীর হাত ধরে আনন্দের সাথে একটা দৌড় দিলাম। আর বড় ভাই ডলিকে কোল থেকে কাঁধে তুলে নিয়ে আমাদের সাথে দৌড়ে আসতে লাগল। তবে তাকে অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে কিছুটা হলেও দায়মুক্ত হয়েছে বলে মনে হল। আমি এবং সেলী দুই ভাইবোনের জীবনে নতুন এক নতুন অধ্যায় শুরু হওয়ার আমরা দুইজনেই খুশী।

কিন্তু হায়! ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। আমি আমার সারা জীবনে রিসার্চ করে দেখেছি, আমি যদি কোন কাজে এক গুণ দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছি সেই দায়িত্ব দুই গুণ ভারি হয়ে আমার মাথার উপর চেপে বসেছে। আর যদি পাঁচ গুণ দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছি তখন সেই দায়িত্ব দশগুণ হয়ে আমার কাঁদের উপর চেপে বসেছে। এটা আমার সারা জীবনের পরীক্ষিত ফলাফল।

যুদ্ধ পরবর্তি বাংলাদেশে প্রায় এক দশক ধরে গ্রামের সকল পরিবারের আর্থিক দৈন্যতা লেগেই আছে। আমাদের পরিবারেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। এসকল অভাব অনটনে আমাদের পারিবারিক বন্ধনেও ফাটল ধরতে দেখা গেছে। এর উপর পরপর দুই বছর খড়া এবং বন্যার কারনে আমার দাদার কৃষি ফসল প্রায় বিনষ্ট হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে আমরা দুই ভাইয়ের স্বাভাবিক শিশুতোষ জীবন যাপন এবং লেখাপড়া প্রায় ব্যহত হতে হয়েছে। আমার বড় ভাই কোন রকমে ২য় শ্রেণী পার হয়ে ৩য় শ্রেনীতে উঠতে পেরেছে। কিন্তু আমি শিশু শ্রেনীতে এক বছর অধ্যায়ন করার পর গত এক বছর আর স্কুলমূখী হতেই পারিনি। দুইভাই মিলে পরিবারকে যথাসাধ্য সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেমন বোনদের দেখাশুনা করা, বিল থেকে হাসের জন্য শামুক কুড়িয়ে আনা, বর্ষাকালে বিলে গিয়ে আব্বার সাথে মাছ ধরে আনা, শাপলা শালুক ইত্যাদি সংগ্রহ করা, বন্যায় ডুবে যাওয়া জমি থেকে ডুবিয়ে ডুবিয়ে ধান কুড়িয়ে আনা, গরু ছাগলের ঘাস কাঁটা ইত্যাদি। এতদসত্যেও পরিবারের আর্থিক দৈন্যতা কিছুতেই কিছু উন্নতি হয়নি। এমতাবস্থায় বড় ভাইকে কর্মের তালাসে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখা যায়নি। প্রাথমিক ভাবে আমার এক ফুফাত ভাই ময়মনসিংহের সম্বুগঞ্জ জুট মিলে চাকুরী দেয়ার কথা বলে পাঁচ বছরের জন্য তাকে নিয়ে যায়। আর আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে যাই এবং আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পাদিত অলিখিত চুক্তির কার্যকারিতা সাময়িক বিনষ্ট হয়। অর্থাৎ দুই বোনের দেখভালের সমস্ত দায় দায়িত্ব এসে পড়ে এই আমার উপর।

এদিকে সেলী কিছুটা বেড়ে উঠতে থাকে এবং কিছুটা সাবলম্বি হয়ে বাড়িতে একা ধুলোবালীর সংসার সাজিয়ে খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমি ডলিকে কোলে নিয়ে সারা পাড়া ঘুরে বেড়াই আর আমার ছাগলের পরিচর্যা করি। আমাদের গ্রামের উত্তর সীমান্তে একটি পরিত্যাক্ত উজার বাড়ি ছিলো যার নাম ছিলো অব্যার বাড়ি। আসলে বাড়িটি ছিলো অনেকটা ভুতুরে টাইপের পরিত্যাক্ত বাড়ি। কোন ঘর ছিলোনা কিন্তু মাটির উঁচু ভিটির কারনে সেখানে মাঠের মত ঘাস এবং অচেনা আগাছায় ভড়া ছিলো। এই বাড়ির আশেপাশে ছিলো অসংখ্য বাঁশঝাঁর এবং বন জঙ্গল এবং আমাদের লোকালয় থেকে একটু দূরে।

একদিন সকালে আমি আমার ছাগলটিকে সে পরিত্যাক্ত বাড়ির মাঝখানে ঘাস খাওয়ার জন্য খুঁটা দিয়ে রেখে আসি। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত আর যেখানে যাওয়া হয়নি। ভরদুপুরে আমি ডলিকে কোলে নিয়েই সেখানে যাই এবং ছাগলটিকে স্থান পরিপর্তন করে দিই। তখন ছিলো চৈত্র মাস এবং চারদিকে শুকনা বাঁশপাতার মড়মড় ধ্বনি আর বাতাসে বড়বড় বাঁশের হেলে পড়ার মটমট আওয়াজ। তখন সেখানে আমরা দুইজন ছাড়া আর কোন মানুষও ছিলোনা। আমি এসব বিষয় আরও আগে থেকেই দেখে অভ্যস্ত বিধায় তেমন ভয় পাইনি। তবে কিছুটা গা ছমছম ভাব হলেও তেমন পাত্তা না দিয়ে ডলিকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসি। কিছুক্ষণ বাঙলা ঘরের বারান্দায় বসে থাকি। কিন্তু ডলি কান্না করতে থাকে এবং কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। আমি তখন তাকে কোলে নিয়ে পাড়ার শেষ প্রান্তের দিকে মসজিদের কাছে চলে যাই আর তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু ডলির আচরণ ক্রমেই আমার কাছে অচেনা মনে হতে থাকে। তার শরীর ও মুখের রঙ ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে। আমি যতই তাকে কোলে রাখতে চাই কিছুতেই রাখতে পারিনা। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার কাছে মনে হয় ডলির শরীরের ওজন আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে এবং তাকে কোলে রাখা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ডলির এই অবস্থার জন্য আমি নিজেকে দায়ী মনে করে বাড়িতে যেতেও সাহস পাচ্ছিলাম না। অবস্থা বেশী খারাপ দেখে আমি তারাতারি বাড়ির দিকে চলে আসি এবং আম্মাকে সব কিছু খুলে বলি। আম্মাও বিষয়টা বুঝতে পারেন এবং তারাতারি ডলিকে গোসলের ব্যবস্থা করে আর আমাকে বলে মেনু মুন্সিকে তারাতারি খবর দিতে। মেনু মুন্সি আমাদের পাশের গ্রামের একজন নমকরা মাওলানা এবং আমাদের নিকটাত্মীয়।

আমি এক দৌড়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সেই গ্রামে যাই এবং মাওলানা সাহেবকে সব কিছু খুলে বলি। তিনি তখন মাত্র গোসল করে এসেছে নামাজ পড়তে যাবেন। আমাকে তিনি বললেন তুমি বাড়ি যাও আমি নামাজ পড়িয়ে আসতেছি।

আমি বাড়ি এসে দেখি ডলির অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। আম্মা তাকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। তার শরীর ফুলে আগের চেয়ে আরও বড় হয়ে গেছে এবং গায়ে লাল নীল ধরনের বিভিন্ন রঙ ধারন করছে।

কিছুক্ষণ পড়ে মাওলানা সাহেব আসেন এবং আম্মাকে বলেন সরিষার তেল গরম করতে। তিনি আরবিতে কিছু সূরা কেরাত পাঠ করতে থাকেন। তারপর তিনি সরিষার তেলে কয়েকবার ফু দিয়ে সেই তেল ডলির সারা শরীরে মালিশ করতে বলেন। আমি নির্বাক তাকিয়ে দেখছি কি হতে চলেছে। আমি দেখলান কিছুক্ষনের মধ্যেই ডলির অবস্থা আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে এবং ধীরেধীরে সে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। আল্লাহর কালামের এত গুণ আমি সেদিন সরাসরি দেখে বিশ্বয়ে হতবাক হয়েছি। সেদিন থেকে আমি আল্লাহর কালামের উপর পুর্ন আস্থা রাখি এবং প্রয়োজনে কাজে লাগাতে চেস্টা করি।

আমি ডলির পাশে বসে ডলিকে পাহারা দিচ্ছি আর আম্মা তার কাজে চলে গেছে। প্রায় দুই ঘন্টা ঘুমানোর পর দেখলাম ডলি একটু নড়েচড়ে উঠেছে। আমি তার বুকে হাত রাখি। কিন্তু সে আকাশ পাতাল চিৎকার করতে করতে সে ঘুম থেকে জেগে উঠে। আমি আবার তাকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেস্টা করি এবং অনেকক্ষণ পরে সে আবার শান্ত হয়।

এরপর থেকে বহু বছর ডলির এই সমস্যা লেগেই ছিলো। ডলি যখনই ঘুমায় তার পাশে একজন বসে থাকতে হয়। কারন যখন তার ঘুম ভাঙ্গে তখন সে ভয়ে চিৎকার করতে থাকে এবং তাকে কোলে নিয়ে ভয় ভাঙ্গাতে হয়। যেহেতু আম্মা কাজে ব্যস্ত থাকেন এবং বড়ভাই বাড়িতে নেই কাজেই সেই কঠিন কাজটি বহুদিন আমাকেই পালন করতে হয়েছে। আমার জীবনে দেখা ডলির এই অসুখটিও ছিলো এক অচেনা অসুখ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সব ধরনের চেনা অচেনা অসুখ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।​
 
অচেনা অসুখ

পর্ব - ৩




সত্তরের দশকে গ্রাম বাংলার কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া ছেলেগুলো হুক্কার পানির স্বাদ কেমন তা বোধ করি সবাই জানে। আমারও জানার সৌভাগ্য হয়েছিলো সেই ছেলেবেলায়। আমার দাদাজান মাঝেমাঝেই আমাকে সেই সুযোগ করে দিতেন। তিনি ভরদুপুরে মাঠ থেকে বাড়ি এসে প্রথমে ধানের খড় দিয়ে প্রায় তিন হাত লম্বা একটা বেনী বানাতেন। এই কাজে তিনি আমাকেও ব্যবহার করতেন। বেনী বানানোর পর একটা হুক্কা রেডি করতেন। হুক্কার কল্কিতে তামাক দিয়ে তার উপর উনুন থেকে এক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা বসিয়ে দিতেন। আরেক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা বেনীর মাথায় বসিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ ফু দিয়ে যখন নিশ্চিত হতেন যে আগুন আর নিভে যাবেনা ঠিক তখন তিনি আমাকে এগুলো দিয়ে মাঠে পাঠাতেন। আমি মাঠে যাওয়ার পথে মাঝেমাঝেই হুক্কার ডাবুরের যে ফুটো থাকে সেখানে মুখ লাগিয়ে জোরে টান দিতাম। আমার আনাড়ি টানে ধোঁয়ার পরিবর্তে হুক্কার তিক্ত পানি আমার মূখে এবং গলায় চলে আসতো। আমি ওয়াক থু করে সেই পানি ফেলে দিতাম আর ভাবতাম এর মধ্যে কি এমন আছে যে এর জন্য মাঠে প্রায় দশজন লোক অধির হয়ে বসে আছে!

দাদাজানের জমিগুলো ছিলো বাড়ি থেকে বেশ দূরে দূরে। এগুলোর আইডেন্টিফিকেশনের জন্য আলাদা আলাদা নামও ছিলো। যেমন, বাওয়া খেত, বোরো খেত, ছন খেত, কুইরা খেত, উজাড় বাড়ি, ভঙ্গার বাড়ি, বল্লার বাড়ি, উত্তরের বন্দ, দক্ষিনের বন্দ, যাই বিল ইত্যাদি। শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হেঁটে গেলেও বর্ষাকালে এগুলোর কোনটিতে কলাগাছের ভ্যালা নিয়ে যাওয়া লাগতো।

আমার উদোম শরীর, পড়নে লাল রঙের চেক লুঙ্গি। কাঁদে আগুনের বেনী আর হাতে জলন্ত হুক্কা। যাচ্ছি উত্তরের বন্দে যেখানে কিষানেরা সোনালী ফসল ফলানোর কাজে ব্যস্ত। আমি লুঙ্গির এক প্রান্ত কাঁদের উপর তুলে নিয়েছি যাতে হাটতে অসুবিধা না হয় আর খালি পায়ে হেঁটে চলেছি গ্রামের মেটো পথে সে এক দারুণ অনুভূতি । চারদিকে বিস্তির্ণ সবুজ প্রান্তর। মাঠে পাট গাছের কচি চারাগুলো কেবল মাথাছারা দিয়ে উঠছে। ঝিরঝির বাতাসে হেলেদুলে এগুলো ঢেউয়ের মত একটার গায়ে আরেকটা এসে পড়ছে। আমি দেখছি আর ভাবছি কিছুদিন পর এগুলো বড় হয়ে সোনালী আঁশে পরিনত হবে এবং কৃষকের ঘরে আসবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর আমার দাদাজানের দন্তহীন মুখে ফুটবে প্রশস্ত হাঁসি।

ফজর আলী ভাই আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। তিনি কিষান দলের সরদার। আমার দাদার খুব বিশ্বস্ত সহকারি। ফজর আলী ভাইয়ের বয়স আমার চেয়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর বেশী হলেও কেন যে তাকে ভাই বলে ডাকি তা আমি নিজেও জানিনা। হয়ত আন্তরিকতা। আমাকে দেখে তিনি সবাইকে আইলে আসতে বললেন। সবাই খেতের আইলে এসে বসল এবং তিনি নিজে হুক্কা উদ্ভোদন করে লাইন ধরে একে একে সবার কাছে দিলেন। মনে হল কি এক অমৃত শোধা আমি নিয়ে এসেছি যা পান করার জন্য সবাই আমারই জন্য অধির অপেক্ষায় ছিল। হুক্কা পর্ব শেষ হওয়ার পর সবাই আবার নব উদ্যমে কাজে মন দেয়। আমি ফজর আলী ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসি। সবাই ছেনী দিয়ে পাট গাছের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকা আগাছা গুলো সাফ করছেন আর মাটিগুলো একটু আলতো করে নরম করে দিচ্ছেন। আমি দেখছি তাদের সেই সুচারু কারুকাজ।

ফজর আলী ভাই আমার হাতে একটা ছেনী তুলে দিলেন আর বললেন, ভাই কিচ্চা হুনবা? মূলত আমি কিচ্চা হুনার জন্যই ফজর আলী ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসেছি। তার কাছে কিচ্চা হুনার অভ্যাস আমার বহুদিনের। আসলে আমার তখন কিচ্চা শোনারই বয়স। আমি খুশী মনে ফজর আলী ভাইকে বললাম, কও।

ফজ ভাই কিচ্চা বলেন আর আমি শুনি। সাথে কাজও চলতে থাকে সমান তালে। এভাবে এই মানুষটি কখন যে আমার একজন প্রিয় পাত্রে পরিনত হয়ে যায় আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। কেমন যেন তার প্রতি আমার একটা অন্য রকম ভাল লাগা তৈরী হয়ে যায়। এভাবে দিন যায় বছর যায় আর চলতে থাকে আমার কিচ্চা শুনা।

সম্ভবত সময়টা হবে ১৯৮০ সালের কথা। দেশে কি এক অজ্ঞাত রোগের আবির্ভাব হয়েছে। যে রোগে অনেক মানুষ ইতিমধ্যে মৃত্যুবরন করেছে এবং করছে। রেডিওর খবরে প্রকাশ, প্রাথমিক সিম্পটম হিসাবে ধারনা করা হয়েছে মানুষের পায়ের আঙ্গুল থেকে প্রথমে ঝিমঝিম অনুভুতি দেখা দেয়। তারপর সমস্থ শরীর ঝিমঝিম করতে করতে আক্রান্ত ব্যাক্তি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। রেডিওর খবরে আরও বলা হয়েছে ভিজ্ঞ ডাক্তারদের মতে এই এরকম রোগের কোন লক্ষন দেখা দেয়ার সাথে সাথে রূগীর মাথায় পানি ঢালতে হবে এবং সারা শরীর পানি দিয়ে মুছে দিতে হবে। তবে এর কোন ঔষধ এখনও আবিষ্কার হয়নি। রোগটা ছোঁয়াচে কিনা তা এখনও জানা যায়নি।

আমরা অজপাড়া গায়ের মানুষ। এমনিতেই সন্ধ্যার পর ঘর থেকে মানুষ বের হয়না বললেই চলে। তার উপর এমন অচেনা অসুখের খবরে কেমন যেন এমনিতেই শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে। বেলা ডুবার পরে মানুষ ঘর থেকে বের হওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। আমরা বাচ্চারা এ ঘর থেকে ও ঘরে গেলেও বাত্তি ছাড়া যাইনা আর একা কখনও বের হইনা। তার পরেও মনে হয় কে যেন পিছন থেকে ধরে ফেলবে এমন একটা অবস্থা।

ইতিমধ্যে গ্রামের দুই একজনের পায়ে ঝিমঝিম অনুভূতি দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় গ্রামের কিছু অতি উৎসাহী মানুষ এরকম কাউকে পাওয়া মাত্র মাথায় পানি ঢালার পরিবর্তে কয়েকজনে মিলে পাঁজাকোলা করে রুগীকে নিয়ে পুকুরে চুবিয়ে এনেছে। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসাবে এরুপ করেছে।

রাত আনুমানিক আটটা বাজে। হঠাত গ্রামের মধ্য থেকে মহিলাদের বিলাপের আওয়াজ শুনা যায়। আওয়াজটি আসছে আমার ফজর আলী ভাইয়ের বাড়ি দিক থেকে। কিন্তু ভয়ে আমরা কেউ বের হচ্ছিনা। কিন্তু খবর এসেছে ফজর আলী ভাইকে ঝিমঝিম রোগে ধরেছে এবং তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। খবর শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। ফজর আলী ভাইয়ের জন্য খুব মায়া হচ্ছে। কিন্তু ভয়ের কারনে গিয়ে দেখা বা খোঁজ নেয়াও সম্ভব হচ্ছেনা।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই শুনি ফজর আলী ভাই মারা গেছেন। গ্রামে একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। অচেনা অজ্ঞাত রোগে মানুষ মারা গেছে এইজন্য গ্রামে এক ধরনের ভূতুরে পরিবেশ তৈরী হয়েছে। মুরুব্বিরা আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদের বাড়ির বাহিরে যেতে নিষেধ করেছেন। অন্য দিকে ফজর আলী ভাইয়ের জানাজা এবং দাফন কাফনের আয়োজন চলছে। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো গিয়ে দেখে আসি। কিন্তু এমনিতেই আমি ভীতু টাইপের মানুষ তার উপর অচেনা অসুখের ভয়ে শেষ পর্যন্ত ঐ দিকে আর যাওয়া হয়নি। কিন্তু সেই অচেনা অসুখের কথা আমি আজও ভুলিনি। আমার প্রিয় ফজর আলী ভাইয়ের কথাও মনে থাকবে সারাজীবন।
 
অচেনা অসুখ


পর্ব - ৪




সত্তরের দশকে আমার গ্রামের মানুষের জীবনচক্র ছিল বিল কেন্দ্রিক। গ্রামের পূর্ব দিকে বিল, পশ্চিমে বিল এবং উত্তর দিগন্তের যতদূর চোখ যায় পুরাটাই বিল। গ্রামের মানুষের জীবিকা, অর্থনীতি, বিনোদন কোন কিছুই বিলকে বাদ দিয়ে নয়। ক্ষুধার অন্ন ধান, গম ডাল, আলু, পিঁয়াজ, রসুন এবং অর্থকরী ফসল পাট ছাড়াও বিলের প্রকৃতি প্রদত্ত সুস্বাদু মাছ, গবাদি পশু এবং হাঁস মুরগীর খাবার সবই আসে বিল থেকে। শীতকালের শুষ্ক মৌসুমে বিলের ফেটে যাওয়া চৌচির মাটিতে ঘোড়া দৌড় এবং ভরা বর্ষায় বাহারী রঙের নৌকা বাইছ গ্রামের মানুষের সুস্থ্য বিনোদনের উৎস।

আমার তখনও মাছ ধরার বয়স হয়নি। দিনে আব্বা এবং বড় ভাই মাছ ধরেন। রাতে আব্বা একা মাছ ধরতে যান। আব্বা রাতের আঁধারে যখন এক নইল্লা বাত্তি আর কোঁচ নিয়ে মাছ শিকারে যেতেন তখন প্রতি রাতেরই এক একটি গল্প তৈরী হতো। আমরা দুই ভাই বসে আব্বার মাছ শিকারের লোম হর্ষক গল্প শুনতাম।

রাত গভীর। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। মাছ ধরে ধরে আব্বা এগিয়ে চলেছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। রাতের আঁধারে অল্প পানিতে মাছেদের বিচরণের ছড়ছড় ধ্বনি মাছ শিকারীর মনে জাগে শিহরণ। একের পর এক কোঁচের আঘাতে আব্বার ডোলা ভরতে থাকে ছোট বড় নানা রকম মাছে।

হঠাত দেখেন অনেক বড় একটা মাছ। বোয়াল অথবা সইল মাছ আব্বার খুব কাছেই ঘুরাঘুরি করছে। আব্বা লোভে পড়ে মাছের পিছনে ছুটেন। একের পর এক কোঁচ দিয়ে টারগেট করেন কিন্তু মাছ একটু একটু করে স্থান পরিবর্তন করে। মাছটা এত কাছে কিন্তু কিছুতেই ঘায়েল করতে পারেন না। এভাবে কখন যে দিকভ্রান্ত হয়ে এক অচেনা যায়গায় চলে এসেছেন বুঝে উঠতে পারেন না। কিছুতেই বাড়ির রাস্তাও খুঁজে পান না। সামনে খুব পরিষ্কার রাস্তা দেখা যায়। কিন্তু সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর যাওয়ার পরেই মনে হয় এটা আসল রাস্তা নয়। দেখা যায় বিলের গভীর পানিতে চলে এসেছেন। সমূহ বিপদের সম্ভাবনা দেখে আবার পিছনে হটেন। এভাবে দেখা যায় রাত পোহায়ে ভোর হয়ে এসেছে। তখন বুঝতে পারতেন যে রাস্তা ভুল করেছেন। তিনি বাড়ি থেকে বহুদূর অচেনা অন্য গ্রামে চলে এসেছেন। আসলে এটা কোন মাছ ছিলোনা। মাছের ছদ্দবেশে ভুত প্রেত টাইপের কিছু ছিল। আব্বাকে দিকভ্রান্ত করে গভীর পানিতে নিয়ে ক্ষতি করাই ছিল তার উদ্যেশ্য। ছোটবেলায় আব্বার এই ধরনের গা ছমছম মাছ শিকারের গল্প শুনে শিহরিত হতাম। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব এডভেঞ্চারের মনে হতো আর ভাবতাম কবে যেতে পারবো মাছ শিকারের সেই এডভেঞ্চারে?

চৈত্র মাস। সারা বিল শুকিয়ে কাট হয়ে গেছে। জমির মাটি ফেটে চৌচির। তবে মাঝ বিলে পুকুরের মত কিছু ছোট ছোট খাদ আছে। খাদে এখনও পানি আছে। বিলের সমস্ত মাছ এইসকল খাদে আশ্রয় নিয়েছে। খাদের মালিক কাঠের কোনের সাহায্যে পানি সেচ করে মাছ ধরেন। আহা! কি লোভনীয় সেই মাছ। শিং, মাগুর, কৈ, সইল আরও কত প্রজাতির দেশী সুস্বাধু মাছ।

আমি আর আমার বড়ভাই বিলের খাদের পাড়ে বসে আছি। আমার কাছে একটি পিতলের বদনা। আমাদের মত আরও অনেকে এসেছে। খাদের মালিকের মাছ ধরার পরে যে মাছ অবশিষ্ট থাকবে তা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। যে যা ধরতে পারে নিয়ে যাবে। আমরাও সেই আশায় বসে আছি। যদিও আমি মাছ ধরতে পারিনা। বড়ভাই যে মাছ ধরে আনবে আমি বদনার মধ্যে সংরক্ষণ করবো এই আমার দায়িত্ব।

খাদের মালিকের মাছ ধরা শেষ। পাড়ের দর্শনার্থীরা হৈ হুল্লোড় করে খাদে নেমে গেছে। বড়ভাই আমাকে খাদের পাড়ে বসিয়ে নেমে গেছে মাছ ধরতে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই দুইটা বড় কৈ মাছ ধরে এনে বদনায় রেখে বদনার মূখে একদলা শুকনা কচুরিপানা দিয়ে আমাকে বদনার উপর বসে থাকতে বললেন। আর বদনার উপর থেকে আমাকে উঠতে নিষেধ করলেন। আমি বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরপর মানুষের চিৎকার শুনা যায়। হয়ত কেউ বড় মাছ পেয়েছে সেই আনন্দ সেলিব্রেট করছে। আমিও লোভ সামলাতে পারিনা। দাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করি আবার বসে পড়ি বদনার উপর। যেহেতু বড় ভাই নিষেধ করেছেন উঠতে।

হঠাৎ দেখি আমার খুব কাছেই একটা কৈ মাছ। চেপচেপে পানির মধ্যে কান্তা বাইরিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম পারফর্মেন্স দেখানোর এই সুযোগ। বড়ভাই দুইটা মাছ রেখে গেছে। আমি একটা ধরতে পারলে তিনটা হবে। আমি উঠে গিয়ে মাছটি ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দুষ্টু কৈমাছ আমার হাতে কাঁটা বিঁধিয়ে নেমে গেল হাটু পানিতে। ধরতে পারলাম না। আমার আফসোস বেড়ে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যে বড়ভাই আরও কিছু মাছ নিয়ে আসলেন। আমি বড় ভাইকে বললাম, এখানে একটা কৈ মাছ ছিলো। অল্পের জন্য ধরতে পারলাম না। বড় ভাই কিছুক্ষণ সেখানে হাতিয়ে কিছুই না পেয়ে আমাকে বললেন, তোকে না করছিলাম বদনা থেকে উঠতে। তিনি আমাকে বর্তসনা করে আবার চলে গেলেন খাদে। আমি কচুরিপানা সরিয়ে দেখি বদনার মধ্যে আগের একটা কৈ মাছ নাই। আমি তখন নিজের বোকামি বুঝতে পেরে নিজেই নিজেকে বর্তসনা করি।

আষাঢ় মাস। নয়া পানিতে বিল আবার যৌবন ফিরে পেয়েছে। চারদিকে পানি থৈথৈ করছে। নতুন পানিতে নতুন মাছ। পুঁটি, মলা ঢেলা, চান্দা চিংড়ী ইত্যাদি আরও কত কি। আমি আর বড়ভাই আবারো মাছ শিকারে বের হয়েছি। বড় ভাই ঠেলা জাল নিয়েছেন আর আমি ভাতের পাতিল। দুই ভাই মাছ ধরে ধরে বিলের গভীর জলে নেমে গেছি। ক্ষুধাও লেগেছে। মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে ডুব দিয়ে শালূক তুলে খেয়ে নিচ্ছি। তেমন কোন সমস্যা হচ্ছেনা। বড় ভাই জাল ঠেলে কিছুদুর নিয়ে উঁচু করে ধরে। তারপর দুইভাই জাল থেকে মাছ তুলে পাতিলে রাখি। মাছের সাথে মাঝেমাঝে মেটে সাপ এবং ডোরা সাপ জালে উঠে। আমি ভয় পাই। কিন্তু বড়ভাই সেই সাপের লেজে ধরে মাথার উপরে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে অনেক দূরে ছুড়ে মাড়ার কৌশল শিখে নিয়েছেন তখনই।

এখন আমরা যেখানে আছি সেখানে আমার গলা পানি। বড় ভাই অনেক কষ্টে জাল ঠেলছেন। আমি পাতিলের উপর ভর দিয়ে অনেকটা সাঁতারের মত ভেসে আছি। কিন্তু এখানে মাছ প্রচুর। জালে খেও দেয়ার সাথে সাথে মাছেদের উল্লাসে আমাদের চারপাশ মুখরিত। কয়েক খেও দিয়েই আমার পাতিল প্রায় ভরে গেছে। বড়ভাই শেষ খেও তুলে জালের মধ্যে কি যেন দেখতে পেলেন আর চিৎকার করে আমাকে বললেন তারাতারি ভাগ এখান থেকে। এখানে আর এক মূহুর্থ থাকা যাবেনা। আমিও ভয় পেয়ে পাড়ের দিকে সাঁতরাতে লাগলাম। বড়ভাই জাল নিয়ে আমার সাথে সাথে আসছেন। অনেকক্ষণ সাঁতরানোর পর আমরা পাড়ে এসে উঠলাম। বড়ভাই কিছুক্ষণ লাফালাফি করলেন। দেখে আমিও লাফাতে লাগলাম। তখন বড়ভাই আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভাল করে দেখে নিলেন। আমিও তার দিকে দেখে নিলাম। হঠাত মাটির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় একফুট লম্বা একটা জোঁক ফনা তুলে আমাদের রক্তের ঘ্রাণ নিচ্ছে। দেখে ভয়ে এবং ঘ্রিনায় আমার গা শিওরে উঠল। দুই ভাই দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসলাম।

বর্ষার মাঝামাঝি সময়। বিল এখন শান্ত। জোয়ারের পানির সাথে কোথা থেকে জাঁকেজাঁকে কচুরিপানা এসে বিল ভরে গেছে। এত উঁচু কচুরিপানা এর আগে দেখিনি। বিলের দিকে তাকালে পাহাড়ের মত মনে হয়। মাছ শিকার অনেকটা দুরূহ হয়ে গেছে। ভ্যালাও চালানো যায়না। অনেক কষ্টে কচুরিপানার ফাঁকে থেকে কিছু মাছ ধরা যায় তবে অনেক কষ্ট সাধ্য। তবে গরুর খাবার সংগ্রহ করা খুব সহজ হয়েছে।

মলুভাই তখন আমার গ্রামের টগবগে যুবক। লম্বা চৌরা কৃষ্ণকালো শরীর তার। আমি গরুর জন্য কচুরিপানা কাটতে গেছি বিলে আর মলুভাই ঠেলা জাল নিয়ে ঘন কচুরিপানার ফাঁক থেকে মাছ ধরতে গেছেন। আমি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই খাচা ভরে চলে এসেছি। কিন্তু মলু ভাইকে মাছ ধরতে দেখে আসলাম। আমি বাড়িতে আসার ঘন্টা খানেক পরে মলু ভাইদের বাড়ি থেকে কান্না এবং মানুষের চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পাই। খবর নিয়ে জানা গেল বিল থেকে এসে কি এক অচেনা অসুখে মলুভাই শয্যা নিয়েছেন। কি হয়েছে কেউ কিছু বলতে পারছে না। গ্রামের মুরুব্বিরা ঝাড়ফুঁকের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। অচেনা অসুখে মলু ভাইয়ের আর জ্ঞান ফেরেনি। দুপুর হওয়ার আগেই মলুভাই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। মলু ভাইয়ের সেই অচেনা অসুখ আজও এক রহস্য হয়ে রয়ে গেল আমার কাছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top