কিশোরী সুমাইয়ার মধ্যে নিজের মেয়েকে খুঁজে পেয়েছিলেন আবদুল বারী
কাঁধে তাঁর কাচের বাক্স। বাক্সের ভেতরে-বাইরে চুড়ি, ফিতা, কানের দুল, নূপুর, টিকলি, আলতা, টিপসহ নারীদের হরেক সাজসামগ্রী। ৫০ ছুঁই ছুঁই আবদুর বারী গ্রামের এক বাঁশঝাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিলেন বাক্স কাঁধে, জ্যৈষ্ঠের ভরদুপুরে কাঠফাটা রোদের সঙ্গে ভ্যাপসা গরমে একটু জিরিয়ে নিতে।
ফেরিওয়ালা আবদুল বারীকে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসেছিল এক দুরন্ত কিশোরী। কাচের বাক্সে দৃষ্টি রেখে মুহূর্তে এক জোড়া নূপুর পছন্দ করেছিল সে। নূপুর হাতে নিয়েই জানতে চেয়েছিল, ‘দাম কত?’ আবদুল বারী চেয়েছিলেন ২০ টাকা। কিন্তু কিশোরীর কাছে ছিল ১০ টাকা।
ফেরিওয়ালা আবদুল বারী কিশোরী মেয়েটার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তাঁর তাকানোতে স্পষ্ট পিতৃত্বের ছাপ। এরপর বললেন, ‘খুকি, টেকা লাগবে না, নূপুরটা তোমার পছন্দ হইচে? এমনিতেই দিলাম।’
কিশোরী মেয়েটির চোখেমুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠল। কিন্তু বিনে পয়সায় সে নেবে না। অনেকটা জিদ করেই দশ টাকার একটা নোট ফেরিওয়ালার হাতে গুঁজে দিতে চাইল। তখন আবদুল বারী বললেন, ‘খুকি, হামার বাড়িত তোমার মতোই দেখতে ফুটফুটে দুটো খুকি আছে। তুমি নূপুরটা নাও, তুমি আমার খুকির মতো।’
৬ জুন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শালমারা ইউনিয়নের হাবিবের বাইগুনী গ্রামে বাঁশঝাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিলাম বলেই ফেরিওয়ালা আবদুল বারী আর কিশোরীর নূপুর কেনার এ দৃশ্য চোখ আটকে গিয়েছিল।
আবদুল বারী আলাপে জানালেন, বাড়ি তাঁর দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায়। স্ত্রী মরিয়ম বেগম আর তিন মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংসার। বসতভিটা ছাড়া সহায়সম্বল বলতে কিছুই নেই। কিশোর বয়সে বেছে নেন ফেরিওয়ালার এই পেশা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরেন। সারা দিন এগ্রাম–ওগ্রাম ঘুরে রাতে কোনো স্কুল-কলেজের বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েন। সেখানেই রান্না করেন। সকালে পান্তা মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়েন ফেরি করতে। এক মাস, কখনো দুই মাস পর ফেরেন স্ত্রী-কন্যাদের কাছে।
আবদুল বারী বলেন, সারা দিনে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা বিক্রি হয়। আয় হয় গড়ে ৪০০ টাকা।
এই আয়ে আবদুল বারীর সংসার চলে। জানালেন, জমানো টাকায় বিয়ে দিয়েছেন বড় মেয়েকে। মেজ ও ছোট মেয়ে পড়ে স্কুলে।
আবদুল বারীর সঙ্গে যখন এসব আলাপচারিতা চলছিল, তখনো নূপুর হাতে কিশোরী মেয়েটি দাঁড়িয়ে। সে জানাল, তার নাম সুমাইয়া। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তাই শুনে ফেরিওয়ালা আবদুল বারী আবেগ আপ্লুত হয়ে বললেন, ‘হামার খুকি বিজলীও ওই ক্লাসেই পড়ে, কত দিন খুকিটাক দেখি না।’
মেয়ের জন্য তাঁর ব্যাকুলতায় চোখের সামনে ভেসে উঠল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টি ‘কাবুলিওয়ালা’র রহমত শেখের কাল্পনিক ছবি। সুদূর আফগানিস্তান থেকে কলকাতায় আখরোট, বাদাম, কিশমিশ বিক্রি করতে এসে কিশোরী মিনির মধ্যে নিজের মেয়েকে খুঁজে পেয়েছিল রহমত শেখ। আবদুল বারী বেশভূষায় ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের রহমত শেখের মতো নন। তবে কিশোরী মেয়ে সুমাইয়ার মধ্যে নিজের মেয়ে বিজলীকে খুঁজে পেয়ে যে আকুলতা দেখালেন তিনি, তখন মনে হয়েছিল, যেন রহমত শেখই ফিরে এসেছে আবদুল বারী হয়ে!
* লেখক: আনোয়ার পারভেজ (বগুড়া)