দেশে কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম চলছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্মুখসারির যোদ্ধাসহ ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারী-পুরুষেরা টিকা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত বড় কোনো সমস্যা বা প্রতিক্রিয়ার কথা শোনা যায়নি। তবে অনেকেরই মনে প্রশ্ন—অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চুলকানি, একজিমা ইত্যাদি থাকলে টিকা নেওয়া যাবে কি না!
অ্যালার্জি নানা ধরনের আছে। কারও আছে চুলকানি বা আরটিকেরিয়া, কারও অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, কারও চোখ লাল হয়ে চুলকায় বা কনজাংটিভাইটিস হয়, কারও শ্বাসকষ্ট হয় বা হাঁপানি আছে, কারও আবার ফুড অ্যালার্জি আছে। অনেকেরই ডাস্ট অ্যালার্জি আছে বা ধুলাবালি লাগলেই চুলকায়, হাঁচি-কাশি আসে, শ্বাসকষ্ট হয়। কারও বা নিকেল বা ধাতুতে অ্যালার্জি, ইমিটেশন গয়না পরলে চুলকায়। কেউ কৃত্রিম তন্তুতে বোনা কাপড় পরতে পারেন না। কারও বিড়াল-কুকুরের লোমে, কারও কার্পেটের আঁশে। এমনকি অনেকেই আছেন, যাদের নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক বা ওষুধেও অ্যালার্জি আছে। বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য গবেষকদের মত হলো, এমন মানুষদের কারোরই কোভিড-১৯ টিকা নিতে কোনো বাধা নেই।
আমাদের দেশে কোভিশিল্ড, যা অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। এটি ভেক্টর বর্ন, মানে এতে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অংশ ব্যবহৃত হয়েছে। এতে তীব্র মাত্রার অ্যালার্জির উদাহরণ নেই বললেই চলে। ফাইজার-বায়োটেকের টিকায় পলি ইথিলিন গ্লাইকল (পিইজি) ব্যবহৃত হয়েছে, যাতে কারও কারও তীব্র মাত্রার অ্যালার্জি বা অ্যানাফিল্যাক্সিস হতে শোনা গেছে। তবে সেটাও নগণ্যসংখ্যক মানুষের ক্ষেত্রেই ঘটেছে।
অ্যানাফিল্যাক্সিস হলো তীব্র মাত্রার অতি সংবেদনশীলতা, যাতে রোগী সংবেদনশীল বস্তুটির সংস্পর্শে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই শকে চলে যেতে পারেন, মানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, রক্তচাপ নেমে যাওয়া, হৃৎস্পন্দন না পাওয়া ইত্যাদি। কারও যদি ইতিপূর্বে অন্য কোনো টিকা বা ওষুধ গ্রহণের পর এমন অ্যানাফিল্যাক্সিসের ইতিহাস থাকে, যে পরিস্থিতিতে তিনি শকে চলে গিয়েছিলেন এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে বা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল, তারা কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণের আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন আর নিবন্ধনের সময় বা টিকাকেন্দ্রে বিষয়টি অবহিত করুন। তবে এরাও যে টিকা নিতে পারবেনই না তা বলা হয়নি, তবে তাঁদের ক্ষেত্রে একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
কোভিড-১৯ টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণের পর কারও যদি তীব্র অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া বা অ্যানাফিল্যাক্সিস হয়, তবে দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাঁদের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার আগে অ্যালার্জি প্রতিরোধক ওষুধ দেওয়া বা অন্য ব্র্যান্ডের টিকা দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে অন্য দেশগুলোতে।
সাধারণ অ্যালার্জি থাকলে
- করোনার টিকা আপনি নিশ্চিন্তে নিতে পারবেন। তবে নিবন্ধনের সময় বা টিকাকেন্দ্রে বিষয়টি উল্লেখ করুন।
- অ্যালার্জির ইতিহাস তীব্র হলে একটি বড় কেন্দ্রে বা হাসপাতালে যেখানে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত আছে, সে রকম একটি কেন্দ্র বেছে নিন।
- টিকা নেওয়ার পর একটু বেশি সময় (অন্তত আধা ঘণ্টা) বিশ্রামকক্ষে অপেক্ষা করুন। বেশির ভাগ প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবেই হয়ে থাকে। টিকাকেন্দ্রে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসার কিট সরবরাহ করা হয়েছে।
- টিকা দেওয়ার পর শরীরে চুলকানি, ফুসকুড়ি (র্যাশ), নাক বন্ধ, পানি পড়া, চোখ লাল ইত্যাদি হলে একটি অ্যান্টিহিস্টামিন বড়ি খেয়ে নিতে পারেন। জ্বর বা শরীরে ব্যথা হলে প্যারাসিটামলও খেয়ে নিন। তবে টিকা নেওয়ার আগে অ্যান্টিহিস্টামিন বা প্যারাসিটামল প্রতিরোধব্যবস্থা হিসেবে নেওয়া যাবে না। এতে টিকার ইমিউন রেসপনস ব্যাহত হতে পারে।
- কারও আরেকটু তীব্র মাত্রার অ্যালার্জি, যেমন অ্যানজিওইডিমা হলে চোখ, মুখ, ঠোঁট ফুলে যেতে পারে, গলা বা শ্বাসনালি ভারী মনে হতে পারে। তাঁরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বা টিকাকেন্দ্রেই স্টেরয়েড ও অ্যান্টিহিস্টামিন ইনজেকশন নিতে পারবেন। এতেও আতঙ্কের কিছু নেই, এটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
- টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর তীব্র মাত্রার অ্যালার্জি বা প্রতিক্রিয়া হলে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন।
* অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ আরাফাত | চেয়ারম্যান, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।