What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected সিঙ্গেল_ফাদার (1 Viewer)

#

*একটু ধৈর্যধরে পড়ুন।*

*কথা দিলাম ভালো লাগবে*

আমার নাম অরণ্য চৌধুরী, আমি একটি বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি করি দশ বছর ধরে। আজ আপনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবো আমার অতীতে।
আমার বাড়িতে আমার বাবা ছাড়া আর কেউ ছিল না। এতদিন পর্যন্ত আমি মনে মনে একটু রাগ করতাম আমার বাবা অংশুমান চৌধুরীর ওপরে। বড্ড অবুঝ, বাস্তববুদ্ধি কম বলেই জানতাম মানুষটার। ভদ্রলোক ব্যাংক কর্মী ছিলেন। রিটায়ার করেছেন। আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান। আমার মায়ের সঙ্গে আমার বাবার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল আমার বয়েস তখন মাত্র নয় বছর। আমি বলেছিলাম, আমি বাবার কাছে থাকতে চাই। তার ঠিক কি কারণ ছিল জানি না, তবে আমার বাবা মানুষটাকে চিরকালই বেশ নির্বিবাদী মনে হতো। ডিভোর্সের সঠিক কারণ আমি তখন জানতাম না। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, আমার মামার বাড়ির দাদু মারাত্মক রকমের ধনী মানুষ। অল্পবয়সে বাবা-মাকে হারানো অংশুমান চৌধুরীকে মেয়ের পাত্র নির্বাচন করেছিলেন এই কারণেই যাতে আমার বাবা ঘরজামাই থাকেন। কিন্তু আমার বাবা নির্বিবাদী মানুষ হলেও এই প্রস্তাবে রাজি হননি। আমার দাদু ভেবেছিলেন, বিয়ের পর সম্পত্তি আর সুখের ঠিকানা দেখে বাবা নিশ্চয়ই রাজি হবে, সেই ভরসাতেই নিজের একমাত্র আদুরে মেয়ে নীহারিকার বিয়ে দিয়েছিলেন আমার বাবার সঙ্গে।

যাইহোক ডিভোর্সের পরে বাবাকে অনেকেই দ্বিতীয় বিবাহের জন্য জোর করেছিল। কিন্তু আমার বাবা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, অরু তোর কি মত? তুই কি নতুন মা চাস? যদি তুই বলিস তবেই আমি বিয়ে করবো।
আমি তখন জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, না, মা চাই না। মা সম্পর্কে কেমন একটা ভয় তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। রেগুলার দেখতাম, বাবা অফিস থেকে ফিরলেই মা কি পেয়েছি আর কি পাইনির হিসেব নিয়ে বসতো। আমার মা ছিল খুব সুন্দরী। অত্যন্ত অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়ে। মায়ের বন্ধুদের কত ভালো বিয়ে হয়েছে, আর মায়ের হয়েছে ছাপোষা সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে, এই নিয়েই হতো বেশি ঝামেলা। বাবা বিরক্ত হয়ে বলতো, তাহলে চলে যাও, আমার তো কিছুই করার নেই। আমি জ্ঞান হয়ে থেকে এটাই শুনে আসছি। মা নিজেও দাদুর বিজনেসের একটা অংশ দেখতো। এমন টানাপোড়েন হতে হতেই আমার দাদু মারা গেলেন। দাদুর পেট্রোল পাম্প থেকে আরো কি সব বড় বড় ব্যবসা অনাথ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে মা চলে গেল বাপের বাড়ি। কখনো আমি যেতাম মায়ের সঙ্গে, কখনো এবাড়িতেই থেকে যেতাম শম্পাদির কাছে। শম্পাদি আমাদের সব সময়ের পরিচারিকা। গলাটা কর্কশ হলেও স্বভাবটা ছিল খুব মিষ্টি। দাদু মারা যাবার কয়েকমাস পরেই বাবার নামে মিউচ্যুয়াল ডিভোর্সের জন্য উকিলের চিঠি এলো। আমার বাবা শান্ত মানুষ, কোনো অশান্তি না করেই দিয়ে দিল ডিভোর্স। মা আমার কাস্টাডি নিয়ে একটু লড়েছিল, কিন্তু আমি বেঁকে বসেছিলাম। আমাদের ছোট দোতলা বাড়ি আর বাবাকে ছেড়ে যাবো না বলে জেদ ধরেছিলাম।
বছর খানেকের মধ্যেই মা বিয়ে করে সেটেল্ড হয়েছিল বাপের বাড়িতেই। বাবাকেও অনেকেই বিয়ের জন্য জোর করেছিল, কিন্তু ওই যে বললাম, আমার বাবা বড্ড ভালো মানুষ, তাই আমার মত নয় বছর বয়সী বাচ্চার মতামত জানতে এসেছিল। আমি কি বুঝেছিলাম কে জানে, আবার ঝগড়া, আবার অশান্তি...এই ভেবেই তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, না আমার মা চাই না। বাবা হেসে বলেছিল, বেশ, তোর কথাই শেষ কথা।
আমার বাবা অংশুমান চৌধুরী সেই ঊনচল্লিশ বছর বয়েস থেকেই সিঙ্গেল ফাদার।
প্রথম প্রথম খুবই সমস্যা হতো। আমায় স্কুলে পাঠানোর সময় কখনো মোজা পেতো না, কখনো টাই.... শম্পাদি টিফিন বানাত, বাবা আমাকে রেডি করতো, বাসে তুলে দিতো।
আমাকে নিজের হাতে খাইয়েও দিত তাড়াতাড়ি করে।
মাসখানেক যুদ্ধের পরে বাবা আগেরদিন রাতেই আমার স্কুলের সব গুছিয়ে রাখতো। পরের দিন সকালে হাসতে হাসতে বলতো, অরু আজ আর দেরি হবে না, আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
প্রতিটা দিন আমার হোমওয়ার্ক খাতা চেক করতো বাবা, আমার সমস্ত সুখের দিকে নজর দিতো সবসময়।
কিভাবে যেন আমাদের দুজনের একটা ছোট্ট পৃথিবী তৈরি হয়ে গেল। বাবা অফিস থেকে ফিরে একটা রান্নার বই দেখে দেখে রোজই কিছু না কিছু ডিস ট্রাই করতো। আমার তার মধ্যে সব থেকে পছন্দের ছিল ক্যারামেল পুডিং। শম্পাদি রান্না খারাপ করতো না, কিন্তু নতুন ডিস বানানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমার মাকে অবশ্য আমি চা আর চাউমিন ছাড়া আর কিছু রান্না করতে কখনো দেখিনি। বাবা যে সব দিন সাফল্য পেতো এমন নয়, মাঝে মাঝেই বাবার বানানো খাবার মুখে দিয়ে আমি আর বাবা নির্বাক হয়ে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিছুক্ষণ পরে দুজনেই হাসতে হাসতে বলতাম, নেক্সট টাইম বেটার কিছু হবে। বাবা হেসে বলতো, ওই জন্যই আজ হুলোটাও খেলো না আমার বানানো চাইনিজ মাঞ্চুরিয়ান। কেমন গরগর করলো রাগে।
বাবা ছিল আমার সব থেকে কাছের বন্ধু।
আমি আমার সব গোপন কথা বাবাকে বলতাম। আমার শরীরের সমস্ত হরমোনাল চেঞ্জের কথাও। আসলে বাবাকে আমি বন্ধু ভাবতাম। একাধিপত্য জারি করে রেখেছিলাম বাবার সবটা জুড়ে।
আমার মাধ্যমিকের রেজাল্টের পরে বাবা আমার আড়ালেই মাকে ফোন করেছিল বোধহয়। আমি জেলার মধ্যে অষ্টম হয়েছিলাম, এই খবরটা মাকে সম্ভবত বাবাই দিয়েছিল। মা রাতের দিকে ফোন করে বলেছিল, বাবার কাছে ছিলে তো, তাই রাজ্যে এক থেকে কুড়ির মধ্যে আসতে পারলে না। অমন লক্ষ্যহীন মানুষের সংস্পর্শে থাকলে পিছিয়েই যেতে হবে। এত বছরে তোমার বাবা নিজের জীবনে একটা প্রমোশন জোগাড় করতে পারেনি সে নাকি ছেলেকে এগিয়ে দেবে, স্বপ্ন দেখতেই জানে না অংশুমান চৌধুরী। নেহাত তোমার গায়ে আমার রক্ত আছে বলেই, এটুকু করতে পেরেছ। সকাল থেকে স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব, পরিচিতদের ফোনে উচ্ছসিত প্রশংসা শোনার পর মায়ের মুখ থেকে অমন তিরস্কার শুনে বাবার ওপরেই রাগটা গিয়ে পড়েছিলো। বাবা কেন ওই মহিলাকে এখনও ফোন করে? যে মহিলা এই বাড়ি থেকে চলে যাবার পরে তার সন্তানের কোনো খোঁজটুকু পর্যন্ত নেয়নি! এমনকি জন্মদিনের উইশও করেনি। মায়ের সবটুকু রাগ পড়েছিলো আমার ওপরে। যেহেতু আমি বাবার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম তাই হয়তো। আসলে মা হেরে যাওয়া মেনে নিতে পারে না, পারে না কোনোরকম ব্যর্থতা মানতে। তাই আমার ওপরে ভালোবাসার থেকেও বাবাকে হারিয়ে আমাকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। সেটা পারেনি বলেই মায়ের মনে সমস্ত রাগ আর বিরক্তি উৎপাদন করেছিলাম স্বয়ং আমি।
আগে আমাদের গোটা ড্রয়িংরুম জুড়ে ছিল মায়ের নানা ভঙ্গিমার ছবি। সেইসব ছবির দিকে আমি অপলক তাকিয়ে থাকতাম, আর ভাবতাম মা কত সুন্দর, ঠিক যেন রূপকথার গল্পের পরী। মায়ের পাশে ওই গোল্ডেন ফ্রেমের মধ্যে আমারও ইচ্ছে করতো থাকতে। কিন্তু মাকে ঠিক সাহস করে বলে উঠতে পারিনি কখনও। আমি যখন জন্মেছিলাম তখন নাকি আমার দিদা-দাদু বলেছিলেন, যা: আমাদের মেয়ের মত রং বা মুখ কিছুই তো হলো না। এতো অংশুমানের মত চাপা রঙের হলো। এই শুনে নাকি মা আমার জন্মের পর তিনদিন আমার মুখ দেখেনি। এ কথা অবশ্য আমাকে বাবা বলেনি, গল্পের ছলে এ কথা বলেছিল আমার দিদা। বাবা তো সবসময় একটাই কথা বলতো, তোর মা একটু মুডি, নাহলে মানুষটা খারাপ নয়। আসলে প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ তো, এই বাড়িতে এসে ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না নীহারিকা। বাবার মুখে মায়ের নামে কখনো নিন্দে শুনিনি আমি। এমনকি ডিভোর্সের পরেও আত্মীয়স্বজনদের বাবা বলেছে, প্রতিটা মানুষ আলাদা, তাদের চিন্তা ভাবনাও ভিন্ন, তাই সারাটা জীবন জোর করে একই ছাদের নিচে থাকার নাম কিন্তু জীবন নয়। নীহারিকা যা করেছে ঠিক করেছে। ও নিজে জীবনটা নিজের মত করে এনজয় করুক। আমিও থাকি অরুকে নিয়ে। না, বাবার মুখে মায়ের ন্যূনতম নিন্দে কখনো আমি শুনিনি। তবুও বড্ড স্বার্থপর মনে হতো ওই মহিলাকে।
বাবার কাছে একদিন বলেও ফেলেছিলাম, মা কি সেলফিস? বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, ধুর পাগল। সেলফ সেন্টার্ড তো আমরা সকলেই। আমরা কেউ কি নিজের জায়গা ছেড়ে নড়তে চাই? তোর মা বহুবার বলেছিল, তোর মায়ের বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকার কথা, আমি তো শুনিনি। তোর মা বলতো, প্রমোশনের জন্য চেষ্টা করার কথা, আমি তো শুনিনি। নীহারিকার যা যা ইচ্ছে ছিল, সেগুলো যেহেতু কোনোটাই আমার ইচ্ছে নয়, তাই আমি সেগুলো একটাও শুনতে চাইনি। তাহলে স্বার্থপর তো আমিও হলাম। আসলে কি জানিস অরু, আমরা সব সময় দোষগুলোকে অন্যের দিকে ঠেলে দিয়ে পরম তৃপ্তি পাই। মনে হয় যেন আমি নির্দোষ। স্বার্থপর তো সবাই রে। যদি ডিভোর্সটা আমি চাইতাম তাহলে সমাজ তোর মায়ের পাশে দাঁড়াতো অবহেলিতা নারী বলে। যখনই তোর মা চাইলো তখনই সমাজ আমার পাশে দাঁড়ালো আমি একা বলে। তোর ছোট মাথায় এত ঢুকবে না বুঝলি! তবে একটা কথা বলি, দিনরাত অশান্তি করে, মনের বিরুদ্ধে এক ছাদের নিচে জোর করে থাকার নাম জীবন নয়। সংসার তো নয়ই। আমি তো বলবো, তোর মা একেবারে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাবার দিকে অপলক তাকিয়েছিলাম আমি, কি নির্বিকারভাবে কথাগুলো বলছে বাবা। মায়ের কোনো দোষ না দিয়েই। কিছু না বলেই আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। বাবা জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, তুই আমার সাইড নিলি তাই সিঙ্গেল ফাদার বলে সবাই আমাকে স্যালুট করলো। এই দেশে কত সিঙ্গেল মাদার আছে জানিস? কোনো হিসেব নেই। কজনের কথা আমরা জানি! আসলে এটা আমাদের মনের গঠন, সন্তান তার মায়ের কাছেই থাকবে, বাবা তো দায়িত্ব নিতে অপারগ, এটাই মানি সবাই।
জানিস অরু, তোর মা যেদিন নার্সিংহোমে তোকে প্রথম দেখেছিলো, তখন বলেছিল, ইস, ভাবতেই পারছি না, একটা জীবনের জন্ম দিলাম আমি?
বাবা যতই মায়ের দোষ ঢাকুক, আমার তো মাকে চূড়ান্ত স্বার্থপর মনে হতো।
সেই মাকে ফোন করে আমার মাধ্যমিকের রেজাল্ট জানানোটা বড্ড বিরক্তি উৎপাদন করেছিল আমার মনের মধ্যে। আমি কাউকে না পেয়ে বাবাকেই আক্রমণ করেছিলাম। কেন তুমি ওই মহিলাকে ফোন করেছিলে? কেন আমার রেজাল্ট বলেছিলে?
বাবা কাঁচুমাচু গলায় বলেছিল, তোর মায়েরও যে স্বপ্ন ছিল তোকে ঘিরে, তাই জানিয়েছিলাম।
কথাটা তো নীহারিকা ভুল বলেনি রে, স্বপ্ন দেখা চোখ আমার সত্যিই নেই। তুই আমার কাছেই বড় হচ্ছিস বলে হয়তো তোর মা ধরেই নিয়েছে তুইও আমার মতই লক্ষ্যহীন হবি।
আমি প্রায় চিৎকার করে বলেছিলাম, তোমার কি মাকে আড়াল না করলে চলছে না? তোমায় একবার বলেছিলাম না, আমার কোনো মা চাই না?
বাবা শান্ত স্বরে বলেছিল, তুই এত ভালো রেজাল্ট করলি এটা তো আমার জয় রে, তাই সেলিব্রেট করলাম। নিজের মানুষ তো তেমন কেউ নেই, তাই তোর মাকে জানালাম আনন্দটুকু। সেদিন বাবার স্বরে এমন কিছু ছিল যেটা আমার কান এড়ায়নি। তারপর থেকে আমি বাবার ওপরে ছোটখাটো বিরক্ত হলেও কখনো আঘাত করিনি বাবাকে। ষোলো বছরের আমি, সদ্য কিশোর পার করা আমি অনুভব করছিলাম, একাকীত্ব বড় বিষম বস্তু। বাবা অফিসে যায়, কখনো সখনো বাবার দু চারজন বন্ধুও আসে, আমিও থাকি, তবুও মনের দিক থেকে বাবা বড্ড একা। আর ওই একাকীত্বের ঘন অন্ধকার জায়গাটায় আমার স্নেহের হাত কিছুতেই পৌঁছাতে পারে না। ধীরে ধীরে যত বড় হচ্ছিলাম বুঝতে পারছিলাম, বাবার বিয়ে হয়েছে, আমি হয়েছি, সংসার করেছে ঠিকই নিয়মমাফিক। মায়ের সঙ্গে অনুষ্ঠান বাড়িতে গেছে, বেড়াতে গেছে, মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলেছে কিন্তু দুটো বিপরীত মেরুর মানুষ যেন আপ্রাণ চেষ্টায় নিজেদের এক করার চেষ্টা করে গেছে। মা তবুও ইচ্ছে মত চলার চেষ্টা করেছে, বাবা বেচারা দিশেহারা হয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছে।
যবে থেকে আমার জ্ঞান হয়েছে আমি দেখেছি, বাবা কেমন যেন উদাসীন। মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ ছাড়া আর কিছু বলতো না মাকে। কিন্তু ওই যে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা এলোমেলো দৃষ্টির বাবাটার দিকে তাকিয়ে আমি অনুভব করতাম, মানুষটা বড্ড একলা। আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া একটা পাখির থেকেও বেশি একলা। নুয়ে পড়া গাছের ডালটার থেকেও বেশি। শুকনো হয়ে যাওয়া ফুলগুলোর থেকেও আরও একটু বেশি। আমি আমার ছোট্ট বুদ্ধি আর সীমিত সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করতাম বাবাকে আগলে রাখতে, কিন্তু বাবার ওই নিরবচ্ছিন্ন শূন্যতার আকাশে তেমন আঁচড় বোধহয় কাটতে পারতাম না। যদিও বাবা কোনোদিন বলেনি সে একা। সব সময় বলতো, আমার সঙ্গে তো আমার ছেলে আছে, তাই আমি সব থেকে ধনী পুরুষ।
এরপরে ধীরে ধীরে বদলে গিয়েছিল আমাদের জীবনযাত্রা। আমি পড়াশোনায় মারাত্মক ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। জয়েন্ট পাস করার তাগিদ আমাকে বইমুখো করেছিল দিনের বেশিরভাগ সময়টাতেই। বাবা আরও একলা হয়ে যাচ্ছিল, আমি টের পাইনি নিজের ব্যস্ততার কারণে। নতুন ইন্সট্রিটিউট, নতুন কোচিং সেন্টার, অনেক বন্ধু সব মিলিয়ে জমাটি জীবন। সব থেকে বড় হলো সামনের লক্ষ্য। ইঞ্জিনিয়ারিংএ চান্স পেতে হবে। বাবা তখনও আমার স্কুল ড্রেস গুছিয়ে রাখতো, ব্রেকফাস্ট টেবিলে ওয়েট করতো আমার জন্য। আমি রাত পর্যন্ত পড়ে বেলায় উঠতাম, বাবা তখন অফিসে। কেমন ভাবে যেন একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছিলাম আমি বাবার থেকে নিজের অজান্তেই।

ইঞ্জিনিয়ারিংএ চান্স পেয়ে আমি চলে গেলাম হোস্টেলে। সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশে অ্যাডজাস্ট করছিলাম। বাড়ির জন্য, বাবার জন্য মনখারাপ করতো খুব। তবুও ধীরে ধীরে মন বসে গেল হোস্টেলে। অদ্ভুতভাবে হোস্টেল লাইফটাকে খুব ভালোবেসে ফেললাম। বাড়ি ফিরতেই মন চাইতো না। দিন পনেরো পর পর রবিবার ডাক পড়তো গেস্টরুমে। গিয়ে দেখতাম বাবা দাঁড়িয়ে আছে, একটু অস্বস্তি নিয়েই বলতো, জানি তোর পড়া আছে, বেশিক্ষণ থাকবো না, তোকে একটু দেখেই চলে যাবো।
আমার জন্য বেশ বড় একটা টিফিন কৌটোতে থাকতো ক্যারামেল পুডিং। বাবা পাল্টায়নি, আমি পাল্টে গিয়েছিলাম, তাই আমার তখন এগুলোকে কেমন যেন আদিখ্যেতা মনে হতো। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোস্টেলে সাধারণত কারোরই বাবা-মা তেমন আসতো না। আমরাই যেতাম ছুটিতে বাড়ি। তাই বাবার এই পনেরো দিন অন্তর অন্তর হোস্টেলে এসে হানা দেওয়াটা ক্রমশ বিরক্তিকর হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে বোঝালেও বুঝতে চায়নি। বলেছিল, আচ্ছা বেশ দশ মিনিট থেকেই ফিরে যাব।
আমি রেগে যেতাম, বন্ধুরা লেগপুল করতো। একদিন হোস্টেলের বারান্দা থেকে দেখেছিলাম বাবা ঢুকছে গেটে। আমি আমার এক বন্ধুকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলাম, অরণ্য কোচিংয়ে গেছে, রুমে নেই।
বাবাকে গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে নিশ্চিন্তে নেমেছিলাম নীচে। রাস্তায় বেরিয়েই দেখেছিলাম, গেটের বাইরের ঝাঁকড়া কদম গাছটার নিচে বাবা বসে আছে। আমি দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিলাম, বাবা খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, ভাগ্যিস ওয়েট করলাম, তাই দেখা হয়ে গেল তোর সঙ্গে। সেদিন আর বেশি কথা না বলে চলে গিয়েছিল বাবা।
পরের সপ্তাহ থেকে আর আসেনি বাবা। ফোনে খোঁজ নিয়েছে মাঝে মাঝে। ছুটিতে বাড়ি গেলেও খুব অল্প কথা হয়েছে বাবার সঙ্গে। অফিসের কাজ আর বই পড়া, গান শোনা, বাগান করা নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছিল বাবা। আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম, বাবা নিজের বাইরে খুব যত্ন করে একটা শক্ত আবরণ তৈরি করছে। যেখানে বাড়তি আবেগ, নরম আদর, সূক্ষ্ম কান্নাগুলো খুব সহজেই আঘাত পেয়ে ফিরে আসবে। বাবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা আমার হাতে দিয়ে বলতো, বাইরে থাকিস তুই, রাখ, আমার আর কি এমন খরচ!
আমার উচ্ছল জীবনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকতো বাবা, না কোনো প্রত্যাশা নিয়ে নয়, শুধুই আমার উন্নতি দেখবে বলে। আমি অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছিলাম। বাবারও বয়েস বাড়ছিল, এগিয়ে আসছিল অবসর নেবার দিন।
ক্যাম্পাসিংএ জব অফার পেয়ে চলে গেলাম ব্যাঙ্গালোর।
নতুন শহর, চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্টের ভিড়ে ভুলেই গেলাম, একটা মানুষ একলা রয়েছে বাগানের কয়েকটা গাছকে সঙ্গী করে। ঝকঝকে শহরে নিজেকে নিয়ে মেতে উঠলাম। মা চাই না, গোটা তোমাকে চাই বলা সেই আমিটা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম শুধুই নিজেকে নিয়ে। উইকএন্ডে একটা ফোন করতাম নিয়ম করে। বাবা ততদিনে আনন্দ, দুঃখের অনুভূতিগুলোকে লুকাতে শিখে গেছে। তাই নিরুদ্বেগ গলায় বলতো, খাওয়া দাওয়া করছিস তো ঠিক মত? অফিসে খুব প্রেসার বুঝি? সাবধানে থাকিস। বেশি রাত জাগিস না। নিয়মে বাঁধা এই কটা কথা বলার পরে চুপ করে থাকতো বাবা, ফোনের এ প্রান্তে আমি শুনতে পেতাম নিঃশ্বাসের আওয়াজ। হয়তো দীর্ঘশ্বাস ছিল সেগুলো। ছোটবেলায় আমি আর বাবা কত কথা বলতাম, রাতে শুয়েও ঘুমাতে চাইতাম না, বকবক করেই যেতাম। বাবা বলতো, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়, সকালে স্কুল আছে, উঠতে পারবি না তো।
ছাদ থেকে একটা এরোপ্লেন দেখলে সেটাও না যতক্ষণ বাবাকে বলতাম আমার ঘুম আসতো না। বাগানে হলদে প্রজাপতি থেকে আমার স্কুলে ক্রিকেটে ছয় মারার অভিজ্ঞতাও বলতেই হতো বাবাকে। বাবাও বলতো অফিসের মহেশকাকু, প্রতাপকাকু, মালিনী আন্টির কথা। প্রতাপকাকু নাকি মালিনী আন্টির ব্যাগ থেকে চুরি করে লুচি তরকারি খেয়ে নিয়েছে, লাঞ্চ টাইমে টিফিনবক্স খুলে মালিনী আন্টি অবাক, ছয়খানা লুচি, তরকারির বদলে চানাচুর মুড়ি রয়েছে। হেসে হেসে খুন হয়েছি আমি। এমন কত কত কথা থাকতো তখন অরু আর বাবার মধ্যে। এখন যেন অরণ্য চৌধুরী আর অংশুমান চৌধুরীর মধ্যে একটা অজানা নিস্তব্ধতা এসে ভিড় করেছে। শব্দগুলো এলোমেলো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে তবুও কিছুতেই জমাট বেঁধে সাজানো বাক্য হতে নারাজ। সারাদিন অফিসে কত কি ঘটছে, কত নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে আমার, কেন জানি না মনে হচ্ছে বাবাকে সেসব বলা অনর্থক। বাবা যেন বড্ড দূরের বাসিন্দা এখন।

অফিসের ছুটিতে বাড়ি ফিরে বাবাকে একটা দামি স্মার্টফোন ধরালাম। ফেসবুক ওপেন করে বললাম, নাও, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করো। আড্ডা দাও সবাই মিলে। চাইলে বেড়াতেও যেতে পারো ট্যুর এজেন্সির সঙ্গে।
বাবা হেসে বলেছিল, যারা কাছের তারাই চিনলো না, আবার ডিজিটাল মাধ্যম! ফেসবুকে কি আর মুখ চেনা যায় রে অরু? ফেসটাই যে ঢাকা থাকে। তবুও আমি বাবার একাকীত্ব কাটাতে খুলে দিলাম ফেসবুক। নিজেই খুঁজে খুঁজে বাবার কিছু কলেজ ফ্রেন্ডকে পাঠালাম রিকোয়েস্ট। সারাজীবন ব্যাংকে কাজ করা মানুষ, তাই ফেসবুক শিখতে সময় নিলো না বেশি। নিস্পৃহ গলায় বলল, বেশ তো, জীবনে কম মানুষ তো দেখলাম না কাউন্টারে, এবারে না হয় ডিজিটাল মাধ্যমে দেখি পুরোনো আর নতুনদের।
দিন পাঁচেকের জন্য মাত্র বাড়ি ফিরেছিলাম, পুরোনো বন্ধু, বান্ধব, আত্মীয়দের বাড়ি ঘুরে বাড়িতে ছিলাম খুব কম সময়ই। তবুও বাবা নিজের হাতে বানিয়ে দিয়েছিল ক্যারামেল পুডিং। কিন্তু দুঃখের বিষয় তখন আমার আর ওটা প্রিয় ছিল না। দু চামচ খেয়ে নাড়াঘাঁটা করছি দেখে বাবা বলেছিল, আজ তেমন ভালো বানাতে পারিনি, তুই বরং অন্য কিছু খা। বোলটা বাবা-ই নিয়ে গিয়েছিল আমার সামনে থেকে, যেন অস্বস্তি থেকে বাঁচাবে বলেই।

ছোটবেলায় বাবা বলতো, তোর মনের সব কথা আমি বুঝতে পারি, আমার গর্ভে না হোস ঔরসজাত তো, রক্তের টান বুঝলি? বাবা বোধহয় সারাজীবনই আমার মুখ দেখে সবটুকুই বুঝতে পারতো।
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল ভীষণ রকমের ব্যস্ততায়। ব্যাঙ্গালোরের ফ্ল্যাটে বসে মাঝে মাঝেই ভাবতাম, বাবা এখন ঠিক কি করছে? গোলাপী করবী ফুলের গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ফুল গুনছে? নাকি বেগনভেলিয়ার লতাটার ঘাড় ধরে তুলে দিচ্ছে ছাদের কার্নিশে? মনটা হুহু করে উঠতো। ট্রান্সফারের চেষ্টা করতে করতে পেয়েও গেলাম অবশেষে।
বাবা এখন রিটায়ার্ড ম্যান, আমিও ট্রান্সফার নিয়ে ফিরে এসেছি কলকাতায়। আমি আঠাশের বিবাহযোগ্য ছেলে। তাই বাবা ম্যাট্রিমনি থেকে শুরু করে ঘটক সব কিছু নিয়োগ করেছে আমার বিয়ের জন্য। আমার একাকীত্ব কাটানোর জন্যই। আমাকেও বলেছে, তোরা তো এখনকার ছেলে, নিজেদের পছন্দ মত একজনকে খুঁজে নে, আমি তোর বিয়েটা দিতে চাই।

না, দুর্ভাগ্যবশত আমার প্রেমটা টেকেনি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বছর খানেক প্রেম হয়েছিল সৃজনীর সঙ্গে। বিশেষ কোনো কারণে নয়, হঠাৎ করেই সৃজনীর কাছে আমি বড্ড বোরিং হয়ে যাই, মাত্র সাতমাসের সম্পর্কে যখন বোরনেস আসে তখন সাতজন্ম দূরে থাকুক সাত বছর যে কাটবে না সেটা বুঝেই হয়তো সৃজনী ব্রেকআপ করেছিল। দুদিন ডায়রির পাতায় দুটো স্যাড কবিতা লিখেছিলাম, একমাত্র আমিই সেগুলোকে কবিতা আখ্যা দিয়েছিলাম, বন্ধুরা দেখে বলেছিল, লিখিস না বস, জয় গোস্বামী এসে তোর বাড়ির সামনে ধর্না দেবে। সেই ভয়ে নয়, এক্সামের চাপেই সৃজনীর দুঃখ আর কবিতার কাব্যিক শব্দ, দুটোকেই দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম আমি। তাই এক কথায় বলতে গেলে আমি সিঙ্গেল। বাবা চেষ্টা করে যাচ্ছিল আমার জীবনসঙ্গিনী খোঁজার। আমিও মতামত দিচ্ছিলাম। উত্তরপাড়ায় আমাদের বাড়ি, এখান থেকে আমি কলকাতা যাতায়াত করতাম। রাতে বাড়ি ফিরলেই বাবা একটা করে মেয়ের প্রোফাইল এনে হাজির করতো আমার সামনে। ডিনার টেবিলে আলোচনা হতো।

কয়েকদিন আগে আমি মোবাইল ঘাঁটছিলাম, বাবা আগেই খেয়ে উঠে গিয়েছিল, শম্পাদি রাতের রান্না করে বরাবরই চলে যেত। খাওয়া দাওয়ার পরে টেবিল মোছা, টুকিটাকি রান্নাঘর পরিষ্কারের কাজ বাবাই করে নিতো। শম্পাদি এখনও আমাদের বাড়ির রাঁধুনি রয়ে গেছে, বয়েস বেড়েছে, কাজের গতি কমেছে, ক্রমশ বাড়ির লোক হয়ে গেছে অবশ্য।
বাবা রান্নাঘরে কিছু একটা করছিল, ঠিক সেই সময় বাবার হোয়াটসআপে টিংটং আওয়াজ করে একটা মেসেজ ঢুকলো, জ্বর কমেছে তোমার? নাকি এখনো আসছে রাতের দিকে? অরুকে বলেছো? আমার কৌতূহল হচ্ছিল মেসেজগুলো দেখে। উচিত নয় বুঝেও বাবার ফোনটা হাতে তুলে নিলাম টেবিল থেকে।
ভদ্রমহিলার ডিপি দেখে চিনতে পারলাম না একেবারেই।
তবে বয়েস বাবার মতই হবে। ভদ্রমহিলার মুখে একটা স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে।
আমি স্ক্রল করতে শুরু করলাম। দেখলাম প্রচুর গল্প করেছে বাবা এই মহিলার সঙ্গে। এক জায়গায় বাবা লিখেছে, অরু যে চায়নি আর কেউ তার মা হোক, তাই একাই রয়ে গেছি। ভদ্রমহিলা লিখেছেন, সে বেশ করেছো, আমার উনি যখন মারা গেলেন তখন আমার বয়েস একচল্লিশ। বাড়িতে চেষ্টা করেছিল বিয়ের, ইচ্ছে করেনি আবার বাধা পড়তে, যদি মনের মিল না হয় তাহলে? আমারও একটাই ছেলে বিদেশে সেটেল্ড, আমিও একাই থাকি সন্ধের শুকতারা আর ভোরের সূর্যকে সঙ্গী করে।
বাবা বলেছে, একলা লাগে না সুতনুকা? কলেজে তো তুমি সব থেকে হুল্লোড়ে মেয়ে ছিলে। যদিও আমি তোমাকে ওই দূর থেকেই দেখতাম, সাহসে কুলায়নি কথা বলার। ফেসবুকে আবার দেখে, ভয়ে ভয়েই পাঠিয়েছিলাম রিকোয়েস্ট। বললে না তো, একা লাগে না?
সুতনুকা বলে মহিলা লিখেছেন, একেবারেই যে লাগে না তা নয়, রাতের অন্ধকারটা বড্ড বেইমানি করে। নৈরাশ্য ঘিরে ধরতে চায় যেন! নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে একলা আমি থাকি এই বাড়িটাতে, একটা অচেনা ভয় মাঝে মাঝে তাড়া করে বেড়ায়। মনে হয় দেখা হবে তো ভোরের লালচে সূর্যের সঙ্গে! নাকি নীলচে অন্ধকার কেড়ে নেবে আমার নিঃশ্বাস নেবার ক্ষমতাটুকুও।
বাবা লিখেছে, অরুর বিয়েটা দিয়ে ওকে সংসারী করে দিতে পারলেই আমার ছুটি। একাকীত্ব কার নাম নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি, হাত বাড়ালেও কেউ ধরবে না হাতটা এই অনুভূতিটাই বড্ড নিঃস্ব করে দেয় মনকে, তাই না সুতনুকা?
অরু যেন ওর মনের মত জীবনসঙ্গী পায়। নাহলে অ্যাডজাস্ট করতে করতে হয়তো এক সময় আমার মতই হেরে যাবে। ওয়েভলেন্থ ম্যাচ না করলে ওর জীবনটাও আমার আর নীহারিকার মত হয়ে যাবে।
সুতনুকা লিখেছেন, নীহারিকা তো শুরু করেছিল, তুমি করলে না কেন?
বাবা লিখেছে, ভেবেছিলাম অরু আছে আমার কাছে, ওকে মানুষ করতে করতেই কেটে যাবে। তখন তো বুঝিনি, অরু এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবে আর আমি একলা! সুতনুকা বলেছেন, তা অরুর বিয়ের পর কি করবে ভেবেছো কিছু?
বাবা লিখেছে, ভেবেছি তো, ওদের সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো একটা জায়গায়। সে কথা সব হয়েই গেছে, শান্তিনিকেতনের কাছে একটা আশ্রমের খোঁজ পেয়েছি। আর কষ্ট হবে না। যেদিন অরু প্রথম আমায় মিথ্যে বলেছিল, সেদিন কষ্ট পেয়েছিলাম খুব। তারপর মানুষটা আমি বদলাইনি ঠিকই, কিন্তু কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতাটাকে রোজ বাড়িয়ে নিয়েছি একটু একটু করে।
আমি জানি না কখন আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে মেসেজগুলো পড়তে পড়তে। আসলে আমি তো নীহারিকা চৌধুরিরও ছেলে, তাই সেলফসেন্টার্ড হবো সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক।
নিজেকে তখন মারাত্মক দোষী মনে হচ্ছিল। বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রনায় মনে পড়ে যাচ্ছিল হোস্টেলের বাইরে অপেক্ষারত বাবার সেই মুখটা।
লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম আমি। বাবা এসে মাথায় হাত রেখে বললো, খাওয়া হয়নি এখনো? দে থালাটা নামিয়ে দিই।
আমি আচমকা প্রশ্ন করলাম, বাবা সুতনুকা আন্টির সঙ্গে শুরু করা যায় না?
বাবা আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো, না যায় না। অনেক দেরি হয়ে গেছে অরু। এবার তোর শুরুর পালা, আমি শেষের পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছি, শুধু শেষ খেয়াটা আসার অপেক্ষায়। সুতনুকা আমার বন্ধু, বোবা কষ্টের সঙ্গী মাত্র। আমি জেদ ধরে বললাম, তবুও থাকো না তোমরা একসঙ্গে শেষ বয়েসটা!
বাবা হেসে বললো, আর এখন যদি তোর বাবা শুরু করে নতুন করে, তাহলে সমাজ মানবে কেন? তোর দিকে আঙুল তুলবে যে! তখন তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে অরু। তুই উঠে পড়, আমি টেবিলটা পরিষ্কার করে নিই।
আমি অন্তর্দ্বন্দ্বে দগ্ধ হচ্ছিলাম। সেদিনও আমার জন্য বাবা সঙ্গী চাননি, আজও আমার জন্যই...
বাবাকে একলা থাকতে বাধ্য আমিই করেছি। কিসের সমাজ? যখন আমি আর বাবা একলা লড়েছি তখন কে ছিল আমাদের পাশে? যখন বাবা একাকীত্ব ভুগছে দিনের পর দিন তখন কে ছিল বাবার পাশে? তাহলে আজ কেন সেই অর্থহীন সমাজ আমাদের দিকে আঙুল তুলবে? সেই ছোটবেলার মত আবার অবুঝ মানুষটার ওপরে রাগ হচ্ছিল আমার। বড্ড জেদি।

আমার পাত্রী নির্বাচন করেছে বাবা, আমিও মত দিয়েছি। রাজন্যাকে আমরাও খুব পছন্দ হয়েছে। গত দু মাসে আমরা বেশ কয়েকবার মিট করেছি। ওর আর আমার ম্যাক্সিমাম পছন্দ এক। রাজন্যা বেশ মিশুকে মেয়ে।
আমি ছোট থেকে আমার জীবনের সব খুঁটিনাটি ওকে বলেছি, শুনে ও শুধু একটাই কথা বলেছে, ভুল করেছ অরণ্য। এভাবে একটা মানুষকে একলা করে দিয়েছো তুমি। প্রতিটা মানুষের স্বাধীনতা আছে নিজের মত করে বাঁচার, বাবাকে তুমি কোনো সুযোগই দাওনি, এটা ভুল অরণ্য!

আজ আমার ফুলশয্যা। আমি বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সুতনুকা আন্টিকে নিমন্ত্রণ করে এসেছিলাম। আন্টি এসেছেন বিয়েতে। আমাকে আশীর্বাদ করার সময় আমি আন্টিকে আড়ালে বলেছিলাম, আন্টি আপনি আমাদের সঙ্গেই থেকে যান না প্লিজ। আন্টি মুচকি হেসে বলেছেন, তোর বাবা তাড়িয়ে দেবে যে।
বাবা বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সমস্ত মানুষকে আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেনি। মাও এসেছিল আমার বিয়েতে, বাবাই বোধহয় নিমন্ত্রণ করেছিল। বেশিক্ষণ থাকেনি। রাজন্যার জন্য একটা গয়না দিয়ে চলে গেছে। মা সম্পর্কে আমার সত্যিই আজ আর কোনো অনুভূতি অবশিষ্ট নেই। আমি শুধু অপলক ওই মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যাকে লোকে সিঙ্গেল ফাদার বললেও মায়ের ঘাটতি কোনোদিন উপলব্ধি করতে দেয়নি।
কলিগদের বিদায় জানিয়ে নিজের ফুলসাজানো ঘরে ঢুকে দেখলাম রাজন্যা নেই। ওকে ঘরের কোথাও না দেখে ড্রয়িংরুমে বেরিয়ে গিয়ে দেখলাম, রাজন্যা বাবাকে জোর করে খাইয়ে দিতে দিতে খুব বকছে, আমাকে নতুন বউ মনে কোরো না, আমি কিন্তু খুব রাগী। ভীষণ ঝগড়া করতে পারি। তুমি কেন এত রাত পর্যন্ত না খেয়ে ঘুরছিলে প্যান্ডেলে? আগে খাও, তারপর আমি তোমার ছেলের কাছে যাবো। আর শোনো, কাল সকাল থেকেই এ বাড়িতে আমার শাসন শুরু হবে। তোমাকে নিয়ম করে খেতে হবে, অকারণে রাত জাগা চলবে না। তোমার মেয়ে এসে গেছে, সুতরাং এসব অবাধ্যতা আর চলবে না।
আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম, বাবা মুখে খাবার নিয়ে কাঁদছে। মুখটা হাসিতে পরিপূর্ণ। আমি কেন এভাবে আপন করে নিতে পারিনি বাবাকে?
রাজন্যার মাথায় হাত রেখে বাবা বললো, তাহলে আমার শান্তিনিকেতনে যাওয়ার প্ল্যানটা কি হবে রে? রাজন্যা হেসে বললো, সে একদিন তোমায় গাড়ি করে কবিগুরুর আশ্রমে ঘুরিয়ে আনবো খন। আর শোনো তুমি যদি এ বাড়ি ছেড়ে যাবার কথা ভুলেও ভাবো তাহলে কিন্তু আমিও চলে যাবো। আমার আরেকটা আব্দার তোমায় রাখতে হবে বাবা, না বলবে না বলো?
বাবা জলটা খেয়ে বললো, বল কি চাই?
সুতনুকা আন্টিকে চাই, আমরা তিনজনে বকবক করবো সারাদিন তোমার ঐ গাছগাছালির সঙ্গে। বাবা বললো, আর তোর নাচের স্কুলের কি হবে? রাজন্যা নিশ্চিন্তে বললো, কেন আমি তো তোমায় বলেই দিলাম একতলার ডান দিকের বড় ঘরটায় আমি নাচের স্কুলটা খুলবো। আমি নাচ শেখাবো, তুমি আর সুতনুকা আন্টি দুজনে বসে আমার স্টুডেন্ট সামলাবে। বাবা প্লিজ, বিয়েতে এটা আমার গিফ্ট, তুমি না করো না। বাবা একটু অস্বস্তি নিয়ে বললো, সুতনুকা কি আসবে এবাড়িতে?
রাজন্যা বললো, সে দায়িত্ব তোমার এই মেয়ের।
না, সুতনুকা আন্টি পার্মানেন্টলি আসেনি এই সংসারে। তবে রাজন্যার আব্দারে সপ্তাহে দিন তিনেক আসেন গাড়ি নিয়ে। বাবার সঙ্গে বাগানে বসে গল্প করেন তারপর চলে যান। বাবার মুখের সেই নিশ্চুপ যন্ত্রণা চেপে রাখার রেখাগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছিলো, সেখানে ফুটে উঠছিল একটা আলো ঝলমলে নির্মল আকাশের প্রতিবিম্ব। রাজন্যা আর বাবার বন্ধুত্ব ভীষণ গাঢ়, ওরা যেন বাবা-মেয়ের মত।
এত বছর পরে আজ আমি সম্মুখীন হয়েছিলাম বাবার, সেদিনের মিথ্যের জন্য ক্ষমা চাইলাম। বাবা বহুদিন পরে আবার আমায় বুকে জড়িয়ে ধরলো। আমি সেই ছোটবেলার মত কেঁদে ফেললাম, ফিসফিস করে বললাম, তোমাকে শুধুই একাকীত্ব উপহার দিয়েছি আমি, আমাকে ক্ষমা করো বাবা।
বাবা কথা না বলে আমার পিঠের ওপরে হাত রাখল নীরবে।
আমি অরণ্য চৌধুরী, আজ আমি আপনাদের সকলের সামনে একটা কথাই বলতে চাই, একাকীত্ব বড় কষ্টের, কাউকে একা করে দেবেন না।

আমি তাকিয়ে দেখলাম, হল ভর্তি লোকের মুখে কোনো কথা নেই, চোখে অস্বস্তি,n আমি বেশ বুঝতে পারছি এখানে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ কারোর না কারোর একা হবার কারণ। আমি হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, 'চলো বন্ধু হই' সংস্থার একটাই উদ্যোগ হবে মানুষ যেন একাকীত্বে না ভোগে। সম্পর্কের কোনো সংজ্ঞা হয় না, কিছু সম্পর্ক গড়ে ওঠে মনের টানে, সব সম্পর্কের নাম দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই, বরং হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলুন, চলো বন্ধু হই।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top