জায়গাটা সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। প্রতিযোগিতার নাম চ্যাম্পিয়নস লিগ। ইউরোপ মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালের ফিরতি লেগ। ম্যাচের ৮০ মিনিট পেরিয়ে গেছে। রিয়াল মাদ্রিদ ১-০ গোলে পিছিয়ে, দুই লেগ মিলিয়ে পিছিয়ে থাকার ব্যবধানে ২-৩। ম্যাচে বাকি মিনিট দশেক জাল অক্ষত রাখতে পারলেই ফাইনালে বায়ার্ন। চাইলে এ পরিস্থিতিকে আপনি অন্যভাবেও বলতে পারেন—বার্নাব্যুর গ্যালারিতে কিংবা টিভি পর্দার সামনে বসে থাকা সবাই জানতেন, এটাই সেই সময়!
লোকে বলে, বার্নাব্যুতে ৯০ মিনিট লম্বা হয়। ম্যাচে প্রতিপক্ষ এগিয়ে থাকলে তো কথাই নেই। বার্নাব্যুর ৯০ মিনিট তখন যেন অনন্তকাল! কথাটা যে গতকাল রাতে যোগ করা ১৩ মিনিটের জন্য বলা হচ্ছে না, সেটাও আপনি জানেন। 'ডন' সিনেমার সংলাপ টেনে রসিকতা করে আপনি হয়তো বলতে পারেন, রিয়ালের 'ঘর' থেকে জিতে আসা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও—সেখানে অসংখ্য ম্যাচে প্রতিপক্ষ এগিয়ে গিয়ে শেষ দিকে যখন জয়ের সুবাস পাচ্ছে, ঠিক তখনই রিয়ালের গোল, অর্থাৎ 'অতিথি' হয়ে আসা দলটির জন্য ৯০ মিনিট আরও লম্বা, কমল রাতের বয়সও।
এ নতুন নয়, মৌসুমের পর মৌসুম ধরে বার্নাব্যু 'অতিথি'দের এমন সব লম্বা রাত 'উপহার' দিচ্ছে। তাতে মজে রিয়াল সমর্থকদের মুখে মুখে হুয়ানিতোর সেই কথাটাও অমরত্ব পেয়েছে, 'নাইনটি মিনিটস ইন দ্য বার্নাব্যু ইজ আ ভেরি লং টাইম।'
বায়ার্ন মিউনিখের জন্য বার্নাব্যুতে গতকাল রাতটা ঠিক এমনই ছিল। সে রাতের আলোয় কে পথ দেখে ফাইনালে উঠেছে আর কে ঝলসে গেছে, সেটাও আপনি জানেন। শুধু একটা প্রশ্ন, ওই সময়ে ঠিক কী মনে হয়েছিল, যখন হোসেলু নামলেন? এটা তো রিয়াল মাদ্রিদ—দুই দশকের বেশি সময় ধরে এমন সব পরিস্থিতিতে তাদের বেঞ্চ থেকে আপনি মাঠে 'নক্ষত্র' নামতে দেখেছেন।
সেই যে রাউল গঞ্জালেস থেকে রুদ ফন নিস্টলরয়, রোনালদো, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, গঞ্জালো হিগুয়েইন, গ্যারেথ বেল থেকে বেনজেমা—তাঁরা সবাই তারকা এবং পিছিয়ে পড়া দলকে তাঁরা সেকেন্ডের ব্যবধানে সমতায় ফেরাবেন বা জেতাবেন, সেটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। সেই মঞ্চে যিনি নামলেন, সেই লোকটির নাম হোসেলু বলেই ঝামেলাটা বেধেছে। বার্নাব্যুর রাতকে সত্যিই জাদুকরি মনে হচ্ছে!
কিংবা ধোপদুরস্ত কোট-টাই পরে ডাগআউটে পায়চারি করতে থাকা ওই লোকটির কথাই ভাবুন। দল ১ গোলে পিছিয়ে, হার চোখ রাঙাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে তিনি 'আস্তিন' থেকে বের করলেন ধুলো পড়া এক 'তাস'। পরে সেটাই হয়ে দাঁড়াল 'ট্রাম্প কার্ড'! কার্লো আনচেলত্তির আসলে করারও কিছু ছিল না। ৬৮ মিনিটে ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর ১২ মিনিট পর্যন্ত একাদশ দিয়েই সমতায় ফেরার চেষ্টা করেছেন রিয়াল কোচ। বেঞ্চে গোল করার লোক বলতে শুধু স্ট্রাইকার হোসেলু এবং উইঙ্গার ব্রাহিম দিয়াজ। ৮১ মিনিটে দুজনকে একসঙ্গে নামানো ছাড়া আর কী করতে পারেন!
দুজন যখন নামছিলেন, বার্নাব্যু নামের সেই মায়াপুরীর অবস্থাটা একবার স্মরণ করা যাক। গ্যালারির ছোট্ট 'লাল' অংশ বাদে চারপাশে 'সাদা'র ঢেউ। কানফাটা গর্জন। বার্নাব্যু যেন অনুচ্চারে ভক্তদের মুখ দিয়েই বলছিল, সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকতে পারে, এমন কাউকে চাই, তাহলেই এই মায়াপুরীতে জ্বলে উঠবে সেই আশ্চর্য প্রদীপ! কে জানত, বাতিটা জ্বালবেন হোসেলুর মতো কেউ—যিনি কিনা আরব্য রজনীর সেই আলাদিনের মতোই খুব সাধারণ কেউ।
একটু চেষ্টার সঙ্গে ভাগ্যের পরশ থাকলে কী না হয়! ৮৮ মিনিটে হোসেলুর প্রথম গোলটি নিশ্চয়ই এখনো মন থেকে মুছে যায়নি। ১৩ বছর ধরে বায়ার্নের গোলপোস্টে 'চীনের প্রাচীর'–এর প্রতীক এবং ম্যাচজুড়ে দুর্দান্ত খেলা ম্যানুয়েল নয়্যারের বিশ্বস্ত হাত থেকে কি ঠিক তখনই বলটা ফসকে যেতে হবে! হোসেলুও কীভাবে যেন একদম জায়গামতো ছিলেন, টোকা মেরে বল জালে পাঠিয়ে যেন প্রদীপের সলতেটা ঠিক করলেন। তিন মিনিট পরই জ্বলল আলো। আন্তনিও রুডিগারের ক্রসে পা ছুঁইয়ে হোসেলুই জ্বাললেন সেই আলো। এবারও একদম জায়গামতো—পুরো ৯০ মিনিটজুড়ে রিয়াল তারকাদের কেউ যা করতে পারেননি, বার্নাব্যুতে পিছিয়ে পড়ার পর বরাবরের মতোই সেই অন্তিম মুহূর্তে কীভাবে যেন কেউ একজন দাঁড়িয়ে যান জায়গামতো! তাতেই জ্বলে ওঠে সেই আশ্চর্য প্রদীপের আলো—যার রং সাদা—আসলে রং নয়, এক অনির্বচনীয় অনুভূতি!
তারপর অনেক কথা হলো, অনেক বিতর্ক আর ঝড়ঝাপটা শেষে একসময় শেষ বাঁশি বাজল। হোসেলু উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন বার্নাব্যুর জাদুকরি সবুজ গালিচায়। কাঁদছিলেন। সেটা যে আনন্দাশ্রু, তা আপনি জানেন। আপনি আরও জানেন, নায়কদের এই মঞ্চে তাঁর থাকার কথা ছিল না। রিয়ালের হয়ে দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী স্টিভ ম্যাকম্যানামানই বলেছেন, 'কেউ ভাবেনি, ত্রাণকর্তা হয়ে উঠবেন হোসেলু!' জায়গাটা মায়াপুরী বলেই হয়তো...থাক সে কথা। অশ্রুর গল্প হোক, টলোমলো সেই চোখের গহিনে লুকোনো পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত গল্পও; অখ্যাত কারও নায়ক হয়ে ওঠা—পৃথিবীর মানুষ এই গল্প পছন্দ না করে পারে না। সব মানুষকেই যে জীবনের কোনো না কোনো সময় 'অখ্যাত' শব্দটার মধ্য দিয়ে যেতে হয় কিংবা থাকতে হয়।
এবার সেই গল্পই হোক।
অবনমনে পড়া এসপানিওল থেকে গত বছরের জুনে হোসেলুকে ১৫ লাখ ইউরোয় ধারে কিনেছে রিয়াল। চুক্তিতে মৌসুম শেষে তাঁকে স্থায়ীভাবে কেনার সুযোগ থাকলেও তখন সম্ভবত হোসেলুও ভাবেননি এটা। আশপাশে যে এনদ্রিকের মতো উঠতি এবং কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো বিশ্বসেরাকে নিয়ে আলোচনা। রিয়ালের মতো ক্লাব হোসেলু নয়, তারকাদের নাড়াচাড়া করতে অভ্যস্ত এবং করিম বেনজেমা চলে যাওয়ায় তাঁকে যে 'ঠেকা কাজ চালাতে' নিয়ে আসা হয়েছে, সেটা জানতেন হোসেলুও। তাঁর ব্যাপারে রিয়ালের দর্শনটা ছিল পরিষ্কার—বেঞ্চ থেকে নেমে গোল করবেন, দামে কম, মানে ভালো। তবে এর মধ্যেও কিন্তু নিজেদের ভেতরকার দর্শন ঠিকও রেখেছে রিয়াল। সেই দর্শনও আপনার জানা—যার মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের 'ডিএনএ' আছে, যে কিনা মরার আগে মরে না!
জার্মানির স্টুটগার্টে জন্মানো এই স্ট্রাইকার চার বছর দেশটির স্কুলে পড়াশোনার পর তাঁর পরিবার পাড়ি জমায় স্পেনে। ১২ বছর বয়সে যোগ দেন সেল্তা ভিগোর বয়সভিত্তিক দলে। ২০০৯ সালে সেখান থেকে তাঁর ঠিকানা হয় রিয়াল মাদ্রিদ 'বি' দল। কিন্তু পরের বছর পর্যন্ত তাঁকে ধারে ফিরে যেতে হয়েছিল সেল্তাতেই। রিয়ালের 'ডিএনএ' তাঁর ভেতরে প্রোথিত হয় ২০১১ সালে—রিয়াল 'বি' দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোল স্কোরার। সেই একই দলের আলভারো মোরাতাকে নিয়ে ইউরোপের ক্লাবগুলো টানাটানি করেছে, এমনকি রিয়ালও তাঁকে একবার ফিরিয়ে এনেছে কিন্তু হোসেলু ঝরাপাতার মতোই কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন!
কোথায়? আপনি বলবেন, কোথায় নয়! ২০১১ সালে রিয়াল মূল দলের হয়ে দুটি ম্যাচে বেনজেমার বদলি নেমে গোল করেছিলেন হোসেলু। এর মধ্যে প্রথমটিতে গোল করেছিলেন প্রথম স্পর্শেই! কিন্তু কেউ তাঁকে মনে রাখেনি। রিয়ালে তখন রোনালদো-বেনজেমাদের যুগ। পরের বছর শুরু হয় হোসেলুর 'বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র'-অভিযান। ২০১২ সালে রিয়াল ছাড়ার পর তাঁর ক্যারিয়ারে পরবর্তী ক্লাবগুলোর নাম যেন গুনে শেষ করা যায় না—হফেনহাইম, আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট, হ্যানোভার ৯৬, স্টোক সিটি, দেপোর্তিভো লা করুনিয়া, নিউক্যাসল ইউনাইটেড, আলাভেস ও এসপানিওল।
হোসেলু এই পথে উত্থান-পতন দেখেছেন—অবনমন এড়ানোর লড়াই করেছেন, মিড টেবিলে থেকে মৌসুম শেষ করেছেন। তিন বছরে তিন জার্মান ক্লাবে খেলে ৩০ গোলও করতে পারেননি। এরপর ইংল্যান্ডে স্টোক ও নিউক্যাসলে মোট চার বছর কাটিয়ে ১৫ গোলও পাননি। প্রশ্ন হলো, এমন স্ট্রাইকারকে রিয়াল ধারেই–বা ফিরিয়ে আনবে কেন? ওই যে 'ডিএনএ'র কথা বলা হলো, সেটাই মূল কারণ।
হোসেলু মনেপ্রাণে একজন 'মাদ্রিদিস্তা'। ২০১২ সালে হফেনহাইমে থাকতে টুইট করেছিলেন, 'কেউ কি আমাকে রিয়াল মাদ্রিদের খেলা দেখার ভালো একটি লিংক দিতে পারেন।' কিংবা তার ১০ বছর পর ২০২২ সালে প্যারিসে 'আর্ক দে ট্রায়াম্ফ'–এর সামনে তোলা সেই ছবিটি। হোসেলুর গায়ে রিয়ালের জার্সি, দেখতে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে প্রিয় দলের খেলা। ভাবতে পারেন, মাত্র দুই বছর পর, হ্যাঁ, মাত্র দুই বছর পর সেই হোসেলুই বদলি নেমে রিয়ালকে তুললেন ফাইনালে, সেটাও মাঠে নামার পর বলে প্রথম তিন টাচের মধ্যে দুই টাচেই ২ গোল!
আপনি বলবেন, এ স্বপ্নের মতো। না, বাস্তবতা কখনো কখনো দূরতম কল্পনাকেও ছাপিয়ে যায়! সেটা কতটা, শুনতে পারেন জুড বেলিংহামের মুখে, 'মনে হয় না সে আজ রাতে (গত রাতে) ঘুমাতে পারবে। সবকিছুই তার প্রাপ্য। মৌসুমজুড়েই সে ছিল দলের অসাধারণ এক সদস্য। এই রাতটা তার।' অথচ বার্নাব্যুর এই রাতের মালিক যিনি, তাঁর কথা শুনুন, 'এমন পারফরম্যান্সের স্বপ্ন সবাই দেখেন। কিন্তু যা ঘটল, আমার সুন্দরতম স্বপ্নগুলোও তার মতো এত বড় নয়। নায়ক কাকে বলে আমি জানি না। তবে খুব সুখী লাগছে...এই দলটা কখনো হাল ছাড়ে না, এটা রক্তেই।'
হুয়ানিতো এখন আর বেঁচে নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় ভদ্রলোক ১৯৯২ সালেই মাত্র ৩৭ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে উয়েফা কাপে (ইউরোপা লিগ) ইন্টার মিলানের বিপক্ষে প্রথম লেগে ২-০ গোলে হারের সিরি 'আ'র ক্লাবটির খেলোয়াড়দের হুঁশিয়ার করে রিয়ালের এই ফরোয়ার্ড বলেছিলেন, 'বার্নাব্যুতে ৯০ মিনিট অনেক লম্বা হয়।' হুয়ানিতোর কথা রেখেছিল বার্নাব্যু। ফিরতি লেগ ৩-০ গোলে জেতার পর হুয়ানিতোর সেই কথা ধীরে ধীরে এখন অমরত্ব পেয়েছে। অথচ হুয়ানিতো তেমন ডাকাবুকো কেউ ছিলেন না। হোসেলুও নন। কিন্তু 'ডিএনএ' তো একই! আর বার্নাব্যু পারেও বটে! রিয়ালের এই মায়াপুরী কখন কাকে নায়ক বানাবে, তা কে জানে! গত শনিবার এই মাঠে কাদিজের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ে রিয়াল যে লিগ শিরোপা নিশ্চিত করল, সেখানে শেষ গোলটি মনে আছে তো? হ্যাঁ, হোসেলুর। আবারও সেই যোগ করা সময়ে!
হোসেলুকে আপনি চাইলে আলাদিন বলতেই পারেন। কিংবা বার্নাব্যুকে আশ্চর্য প্রদীপ। আসলে মানুষ হোক সাধারণ কিংবা অভিজাত, কোনো কিছুই যে তাঁর অসাধ্য নয়!
জায়গাটা সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। প্রতিযোগিতার নাম চ্যাম্পিয়নস লিগ। ইউরোপ মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালের ফিরতি লেগ। ম্যাচের ৮০ মিনিট পেরিয়ে গেছে। রিয়াল মাদ্রিদ ১-০ গোলে পিছিয়ে, দুই লেগ মিলিয়ে পিছিয়ে থাকার ব্যবধানে ২-৩। ম্যাচে বাকি মিনিট দশেক জাল অক্ষত রাখতে পারলেই ফাইনালে বায়ার্ন। চাইলে এ পরিস্থিতিকে আপনি অন্যভাবেও বলতে পারেন—বার্নাব্যুর গ্যালারিতে কিংবা টিভি পর্দার সামনে বসে থাকা সবাই জানতেন, এটাই সেই সময়!
লোকে বলে, বার্নাব্যুতে ৯০ মিনিট লম্বা হয়। ম্যাচে প্রতিপক্ষ এগিয়ে থাকলে তো কথাই নেই। বার্নাব্যুর ৯০ মিনিট তখন যেন অনন্তকাল! কথাটা যে গতকাল রাতে যোগ করা ১৩ মিনিটের জন্য বলা হচ্ছে না, সেটাও আপনি জানেন। 'ডন' সিনেমার সংলাপ টেনে রসিকতা করে আপনি হয়তো বলতে পারেন, রিয়ালের 'ঘর' থেকে জিতে আসা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও—সেখানে অসংখ্য ম্যাচে প্রতিপক্ষ এগিয়ে গিয়ে শেষ দিকে যখন জয়ের সুবাস পাচ্ছে, ঠিক তখনই রিয়ালের গোল, অর্থাৎ 'অতিথি' হয়ে আসা দলটির জন্য ৯০ মিনিট আরও লম্বা, কমল রাতের বয়সও।
এ নতুন নয়, মৌসুমের পর মৌসুম ধরে বার্নাব্যু 'অতিথি'দের এমন সব লম্বা রাত 'উপহার' দিচ্ছে। তাতে মজে রিয়াল সমর্থকদের মুখে মুখে হুয়ানিতোর সেই কথাটাও অমরত্ব পেয়েছে, 'নাইনটি মিনিটস ইন দ্য বার্নাব্যু ইজ আ ভেরি লং টাইম।'
বায়ার্ন মিউনিখের জন্য বার্নাব্যুতে গতকাল রাতটা ঠিক এমনই ছিল। সে রাতের আলোয় কে পথ দেখে ফাইনালে উঠেছে আর কে ঝলসে গেছে, সেটাও আপনি জানেন। শুধু একটা প্রশ্ন, ওই সময়ে ঠিক কী মনে হয়েছিল, যখন হোসেলু নামলেন? এটা তো রিয়াল মাদ্রিদ—দুই দশকের বেশি সময় ধরে এমন সব পরিস্থিতিতে তাদের বেঞ্চ থেকে আপনি মাঠে 'নক্ষত্র' নামতে দেখেছেন।
সেই যে রাউল গঞ্জালেস থেকে রুদ ফন নিস্টলরয়, রোনালদো, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, গঞ্জালো হিগুয়েইন, গ্যারেথ বেল থেকে বেনজেমা—তাঁরা সবাই তারকা এবং পিছিয়ে পড়া দলকে তাঁরা সেকেন্ডের ব্যবধানে সমতায় ফেরাবেন বা জেতাবেন, সেটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। সেই মঞ্চে যিনি নামলেন, সেই লোকটির নাম হোসেলু বলেই ঝামেলাটা বেধেছে। বার্নাব্যুর রাতকে সত্যিই জাদুকরি মনে হচ্ছে!
কিংবা ধোপদুরস্ত কোট-টাই পরে ডাগআউটে পায়চারি করতে থাকা ওই লোকটির কথাই ভাবুন। দল ১ গোলে পিছিয়ে, হার চোখ রাঙাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে তিনি 'আস্তিন' থেকে বের করলেন ধুলো পড়া এক 'তাস'। পরে সেটাই হয়ে দাঁড়াল 'ট্রাম্প কার্ড'! কার্লো আনচেলত্তির আসলে করারও কিছু ছিল না। ৬৮ মিনিটে ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর ১২ মিনিট পর্যন্ত একাদশ দিয়েই সমতায় ফেরার চেষ্টা করেছেন রিয়াল কোচ। বেঞ্চে গোল করার লোক বলতে শুধু স্ট্রাইকার হোসেলু এবং উইঙ্গার ব্রাহিম দিয়াজ। ৮১ মিনিটে দুজনকে একসঙ্গে নামানো ছাড়া আর কী করতে পারেন!
দুজন যখন নামছিলেন, বার্নাব্যু নামের সেই মায়াপুরীর অবস্থাটা একবার স্মরণ করা যাক। গ্যালারির ছোট্ট 'লাল' অংশ বাদে চারপাশে 'সাদা'র ঢেউ। কানফাটা গর্জন। বার্নাব্যু যেন অনুচ্চারে ভক্তদের মুখ দিয়েই বলছিল, সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকতে পারে, এমন কাউকে চাই, তাহলেই এই মায়াপুরীতে জ্বলে উঠবে সেই আশ্চর্য প্রদীপ! কে জানত, বাতিটা জ্বালবেন হোসেলুর মতো কেউ—যিনি কিনা আরব্য রজনীর সেই আলাদিনের মতোই খুব সাধারণ কেউ।
একটু চেষ্টার সঙ্গে ভাগ্যের পরশ থাকলে কী না হয়! ৮৮ মিনিটে হোসেলুর প্রথম গোলটি নিশ্চয়ই এখনো মন থেকে মুছে যায়নি। ১৩ বছর ধরে বায়ার্নের গোলপোস্টে 'চীনের প্রাচীর'–এর প্রতীক এবং ম্যাচজুড়ে দুর্দান্ত খেলা ম্যানুয়েল নয়্যারের বিশ্বস্ত হাত থেকে কি ঠিক তখনই বলটা ফসকে যেতে হবে! হোসেলুও কীভাবে যেন একদম জায়গামতো ছিলেন, টোকা মেরে বল জালে পাঠিয়ে যেন প্রদীপের সলতেটা ঠিক করলেন। তিন মিনিট পরই জ্বলল আলো। আন্তনিও রুডিগারের ক্রসে পা ছুঁইয়ে হোসেলুই জ্বাললেন সেই আলো। এবারও একদম জায়গামতো—পুরো ৯০ মিনিটজুড়ে রিয়াল তারকাদের কেউ যা করতে পারেননি, বার্নাব্যুতে পিছিয়ে পড়ার পর বরাবরের মতোই সেই অন্তিম মুহূর্তে কীভাবে যেন কেউ একজন দাঁড়িয়ে যান জায়গামতো! তাতেই জ্বলে ওঠে সেই আশ্চর্য প্রদীপের আলো—যার রং সাদা—আসলে রং নয়, এক অনির্বচনীয় অনুভূতি!
তারপর অনেক কথা হলো, অনেক বিতর্ক আর ঝড়ঝাপটা শেষে একসময় শেষ বাঁশি বাজল। হোসেলু উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন বার্নাব্যুর জাদুকরি সবুজ গালিচায়। কাঁদছিলেন। সেটা যে আনন্দাশ্রু, তা আপনি জানেন। আপনি আরও জানেন, নায়কদের এই মঞ্চে তাঁর থাকার কথা ছিল না। রিয়ালের হয়ে দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী স্টিভ ম্যাকম্যানামানই বলেছেন, 'কেউ ভাবেনি, ত্রাণকর্তা হয়ে উঠবেন হোসেলু!' জায়গাটা মায়াপুরী বলেই হয়তো...থাক সে কথা। অশ্রুর গল্প হোক, টলোমলো সেই চোখের গহিনে লুকোনো পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত গল্পও; অখ্যাত কারও নায়ক হয়ে ওঠা—পৃথিবীর মানুষ এই গল্প পছন্দ না করে পারে না। সব মানুষকেই যে জীবনের কোনো না কোনো সময় 'অখ্যাত' শব্দটার মধ্য দিয়ে যেতে হয় কিংবা থাকতে হয়।
এবার সেই গল্পই হোক।
অবনমনে পড়া এসপানিওল থেকে গত বছরের জুনে হোসেলুকে ১৫ লাখ ইউরোয় ধারে কিনেছে রিয়াল। চুক্তিতে মৌসুম শেষে তাঁকে স্থায়ীভাবে কেনার সুযোগ থাকলেও তখন সম্ভবত হোসেলুও ভাবেননি এটা। আশপাশে যে এনদ্রিকের মতো উঠতি এবং কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো বিশ্বসেরাকে নিয়ে আলোচনা। রিয়ালের মতো ক্লাব হোসেলু নয়, তারকাদের নাড়াচাড়া করতে অভ্যস্ত এবং করিম বেনজেমা চলে যাওয়ায় তাঁকে যে 'ঠেকা কাজ চালাতে' নিয়ে আসা হয়েছে, সেটা জানতেন হোসেলুও। তাঁর ব্যাপারে রিয়ালের দর্শনটা ছিল পরিষ্কার—বেঞ্চ থেকে নেমে গোল করবেন, দামে কম, মানে ভালো। তবে এর মধ্যেও কিন্তু নিজেদের ভেতরকার দর্শন ঠিকও রেখেছে রিয়াল। সেই দর্শনও আপনার জানা—যার মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের 'ডিএনএ' আছে, যে কিনা মরার আগে মরে না!
জার্মানির স্টুটগার্টে জন্মানো এই স্ট্রাইকার চার বছর দেশটির স্কুলে পড়াশোনার পর তাঁর পরিবার পাড়ি জমায় স্পেনে। ১২ বছর বয়সে যোগ দেন সেল্তা ভিগোর বয়সভিত্তিক দলে। ২০০৯ সালে সেখান থেকে তাঁর ঠিকানা হয় রিয়াল মাদ্রিদ 'বি' দল। কিন্তু পরের বছর পর্যন্ত তাঁকে ধারে ফিরে যেতে হয়েছিল সেল্তাতেই। রিয়ালের 'ডিএনএ' তাঁর ভেতরে প্রোথিত হয় ২০১১ সালে—রিয়াল 'বি' দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোল স্কোরার। সেই একই দলের আলভারো মোরাতাকে নিয়ে ইউরোপের ক্লাবগুলো টানাটানি করেছে, এমনকি রিয়ালও তাঁকে একবার ফিরিয়ে এনেছে কিন্তু হোসেলু ঝরাপাতার মতোই কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন!
কোথায়? আপনি বলবেন, কোথায় নয়! ২০১১ সালে রিয়াল মূল দলের হয়ে দুটি ম্যাচে বেনজেমার বদলি নেমে গোল করেছিলেন হোসেলু। এর মধ্যে প্রথমটিতে গোল করেছিলেন প্রথম স্পর্শেই! কিন্তু কেউ তাঁকে মনে রাখেনি। রিয়ালে তখন রোনালদো-বেনজেমাদের যুগ। পরের বছর শুরু হয় হোসেলুর 'বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র'-অভিযান। ২০১২ সালে রিয়াল ছাড়ার পর তাঁর ক্যারিয়ারে পরবর্তী ক্লাবগুলোর নাম যেন গুনে শেষ করা যায় না—হফেনহাইম, আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট, হ্যানোভার ৯৬, স্টোক সিটি, দেপোর্তিভো লা করুনিয়া, নিউক্যাসল ইউনাইটেড, আলাভেস ও এসপানিওল।
হোসেলু এই পথে উত্থান-পতন দেখেছেন—অবনমন এড়ানোর লড়াই করেছেন, মিড টেবিলে থেকে মৌসুম শেষ করেছেন। তিন বছরে তিন জার্মান ক্লাবে খেলে ৩০ গোলও করতে পারেননি। এরপর ইংল্যান্ডে স্টোক ও নিউক্যাসলে মোট চার বছর কাটিয়ে ১৫ গোলও পাননি। প্রশ্ন হলো, এমন স্ট্রাইকারকে রিয়াল ধারেই–বা ফিরিয়ে আনবে কেন? ওই যে 'ডিএনএ'র কথা বলা হলো, সেটাই মূল কারণ।
হোসেলু মনেপ্রাণে একজন 'মাদ্রিদিস্তা'। ২০১২ সালে হফেনহাইমে থাকতে টুইট করেছিলেন, 'কেউ কি আমাকে রিয়াল মাদ্রিদের খেলা দেখার ভালো একটি লিংক দিতে পারেন।' কিংবা তার ১০ বছর পর ২০২২ সালে প্যারিসে 'আর্ক দে ট্রায়াম্ফ'–এর সামনে তোলা সেই ছবিটি। হোসেলুর গায়ে রিয়ালের জার্সি, দেখতে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে প্রিয় দলের খেলা। ভাবতে পারেন, মাত্র দুই বছর পর, হ্যাঁ, মাত্র দুই বছর পর সেই হোসেলুই বদলি নেমে রিয়ালকে তুললেন ফাইনালে, সেটাও মাঠে নামার পর বলে প্রথম তিন টাচের মধ্যে দুই টাচেই ২ গোল!
আপনি বলবেন, এ স্বপ্নের মতো। না, বাস্তবতা কখনো কখনো দূরতম কল্পনাকেও ছাপিয়ে যায়! সেটা কতটা, শুনতে পারেন জুড বেলিংহামের মুখে, 'মনে হয় না সে আজ রাতে (গত রাতে) ঘুমাতে পারবে। সবকিছুই তার প্রাপ্য। মৌসুমজুড়েই সে ছিল দলের অসাধারণ এক সদস্য। এই রাতটা তার।' অথচ বার্নাব্যুর এই রাতের মালিক যিনি, তাঁর কথা শুনুন, 'এমন পারফরম্যান্সের স্বপ্ন সবাই দেখেন। কিন্তু যা ঘটল, আমার সুন্দরতম স্বপ্নগুলোও তার মতো এত বড় নয়। নায়ক কাকে বলে আমি জানি না। তবে খুব সুখী লাগছে...এই দলটা কখনো হাল ছাড়ে না, এটা রক্তেই।'
হুয়ানিতো এখন আর বেঁচে নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় ভদ্রলোক ১৯৯২ সালেই মাত্র ৩৭ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে উয়েফা কাপে (ইউরোপা লিগ) ইন্টার মিলানের বিপক্ষে প্রথম লেগে ২-০ গোলে হারের সিরি 'আ'র ক্লাবটির খেলোয়াড়দের হুঁশিয়ার করে রিয়ালের এই ফরোয়ার্ড বলেছিলেন, 'বার্নাব্যুতে ৯০ মিনিট অনেক লম্বা হয়।' হুয়ানিতোর কথা রেখেছিল বার্নাব্যু। ফিরতি লেগ ৩-০ গোলে জেতার পর হুয়ানিতোর সেই কথা ধীরে ধীরে এখন অমরত্ব পেয়েছে। অথচ হুয়ানিতো তেমন ডাকাবুকো কেউ ছিলেন না। হোসেলুও নন। কিন্তু 'ডিএনএ' তো একই! আর বার্নাব্যু পারেও বটে! রিয়ালের এই মায়াপুরী কখন কাকে নায়ক বানাবে, তা কে জানে! গত শনিবার এই মাঠে কাদিজের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ে রিয়াল যে লিগ শিরোপা নিশ্চিত করল, সেখানে শেষ গোলটি মনে আছে তো? হ্যাঁ, হোসেলুর। আবারও সেই যোগ করা সময়ে!
হোসেলুকে আপনি চাইলে আলাদিন বলতেই পারেন। কিংবা বার্নাব্যুকে আশ্চর্য প্রদীপ। আসলে মানুষ হোক সাধারণ কিংবা অভিজাত, কোনো কিছুই যে তাঁর অসাধ্য নয়!