What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Other হেমন্ত মুখোপাধ্যায়- বাংলা গানের অন্যতম স্তম্ভ (1 Viewer)

আমি নির্ভেজাল হেমন্ত ভক্ত এবং ভগবানে বিশ্বাসী, কেন যে আমার ভগবানে এত বিশ্বাস, তা ব'লতে আমার কোন দ্বিধা নেই। একবার স্বর্গে ভগবানের ইচ্ছে হ'লো তিনি গান গাইবেন। তাই তিনি মর্ত্তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামে জন্ম নিয়ে মর্ত্তবাসীদের গান শোনাতে শুরু ক'রলেন। আমি জলসায় বেশ কয়েকবার এই ভগবানকে গান গাইতে স্বকর্ণে শুনেছি, তাই ভগবানকে বিশ্বাস না ক'রে যাই কোথায়?

আমাদের ঘন মেঘদূত নেমে আসত কলকাতায় বা যাদবপুরে, রাখালদা বা সত্যেনদার ক্যান্টিনে— 'তুমি এলে/অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এল, অনেক কথা মনে হল এলোমেলো…' যে তরুণটি কোনও দ্রুতগামিনী সুনয়নার দিকে এই শব্দগুলি ছুড়ে দিত, সে জানত আমাদের বহু যুগের ও পার হতে কোনও কালীদাস দেখা দেবেন না। কিন্তু আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখবেন এক জন বাঙালি, সরস্বতী স্বয়ং যাঁর কণ্ঠে, সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে শ্যামলা রঙের লাজুক মেয়েটি উল্টো দিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও আকুল কিন্নরকে কি দ্বিধাকম্পিত আশ্বাস দিত না, 'পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি?'
পুরো ষাটের দশক জুড়ে মহামায়া লেনের ঘুপচি রান্নাঘরে মুসুরির ডালে ফোড়ন দিয়ে অথবা শ্রাবণের পুঞ্জমেঘের দিকে তাকিয়ে মহাকরণের কনিষ্ঠ কেরানি যা ভেবেছে তা-ও তো হেমন্ত কণ্ঠই। 'আমি ঝড়ের কাছে রেখে এলাম আমার ঠিকানা।' এমন যে রবীন্দ্রনাথ, তিনিও তো আশ্রমিক আভিজাত্য থেকে মধ্যবিত্তের গ্রামোফোন রেকর্ড আর পাড়ার পৌষমাসের জলসায় ঠাঁই পেলেন হেমন্ত-ভগবানের কণ্ঠে, হারমোনিয়াম সহযোগে 'শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু, হে প্রিয়' গাইলেন বলেই। যারা সুচিত্রা-উত্তম, কচুরি-ছোলার ডাল, চুনি–বলরামের বাইরে যেতে চাইত না, তারাও মর্মে মর্মে টের পেল 'আমার ঘরে থাকাই দায়!'
সারা ভারতে এখনও বিয়ের ব্যান্ডপার্টি, আপনি চান বা না চান, বাজাবেই হেমন্ত সুরারোপিত নাগিনের 'মেরা মন দোলে' আর হ্যারিসন রোড পাড়ায় মেহবুবা ব্যান্ডে 'নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখীরা' তা ঠাকুর বিসর্জনই হোক আর শিবরাত্রিই হোক, নেমন্তন্নে শুক্তোর মতো পাতে পড়বেই। মোট কথা, স্বর্ণযুগের ষাট বছর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউই বাঙালি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কানের ভিতর দিয়ে মর্মে এত তীব্র ভাবে প্রবেশ করে প্রাণ আকুল করে তোলে নি।

বাঙালির কি গায়ক ছিল না? স্বর্ণকন্ঠীদের স্ব্বর্ণকণ্ঠে রাজ ক'রেছেন মান্না দে, কিশোর কুমার, ধনঞ্জয়, মানবেন্দ্র, শ্যামল মিত্র কিংবা তরুণ বন্দোপাধ্যায়ের কথা কি আমাদের মনে পড়বে না? নিঃসন্দেহে তাঁরা প্রতিভাবান। জনস্বীকৃতিতেও তাঁদের নাম আকাশছোঁয়া। তবু হেমন্ত নির্বিকল্প ও অনন্য। স্বরলিপির চতুরালি, রাগের উত্থানপতন পন্ডিতদের জন্য, হেমন্তর গলা শুনলেই বাঙালির মনে হয় নাড়ি, নক্ষত্র, ঋতুদল মধুলীনা। কত সিনেমা শুধু হেমন্তকে সম্বল করে দুর্গম পথে পাড়ি দিয়েছে।

'মরুতীর্থ হিংলাজ'এর 'পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তব' বলামাত্র মনে হয়, সব ক্লান্তি সব গ্লানি দূর হ'ল, আর 'শেষ পর্যন্ত' তো একটা অকিঞ্চিৎকর ছায়াছবি। নায়িকা বলতে সুলতা চৌধুরী। তেমন ভূ-বৈচিত্র্য, ইন্ডোর সেটের চাকচিক্য কিছুই নেই। পুরীর সাবেকি সমুদ্র আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের লাবণ্য সে ছবিকে তুমুল ভাবে উতরে দিল। সেই যে ভুলের বালুচর বুকে এসে বাসা বাঁধল, সে রকম মধুর ক্ষয়রোগ একজন্মে যাওয়ার নয়। তারপর থেকে মেঘলা দিনে মন একলাই থাকে— আর প্রতীক্ষা করে জাদুকরের মতো এক গায়কের। ভাদ্রমাসের ভ্যাপসা গরমেও দখিনা হাওয়া বয়ে যেতে পারে যদি হেমন্ত বেজে ওঠেন, ফাল্গুনে সেই ফুল্ল শিরিষ। আমাদের ময়লা সময়, আমাদের ধূসর শহর, আমাদের রংচটা হৃদয়কে তিনি হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো টেনে নেন মায়াবী সন্ধ্যায় আর উজ্জ্বল সকালে। যাবতীয় ঈর্ষা, কলহ, মৃত্যুভয় ও কামনা সরিয়ে রেখে আমরা যেন দেবতার সন্তানদের মতো আবিষ্কার করি হেমন্তের স্বরক্ষেপণ বায়ুকে মধুময় করে তুলেছে, সিন্ধুতে মধুক্ষরণ হচ্ছে।

আসলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে গায়ক বা সুরকার ভাবলে কিছুই বলা হয় না। তিনি সময়ের একটা অবিনশ্বর দাগ, এমন এক সাংস্কৃতিক উপস্থিতি, যিনি যুগের মুদ্রাভঙ্গকে বিপুল প্রতিভায় ইতিহাসের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত করেন। কী যে অলৌকিক সমাপতন! ১৯৪৭ সালে, আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বছরে, চালু দেশাত্মবোধের রমরমার মধ্যে তিনি গেয়েছিলেন কিংবদন্তীর সমান 'কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো'। এই গান যা ইতিহাসের বিদ্যুল্লতাকে অন্দরের মলিন উনুনে টেনে নিয়ে যায়, তাতো এখনও বাঙালির স্বাধীনতার ফাঁকি ও চল্লিশ দশকের ট্রমাকে কণ্ঠের কুসুমকোরকে ধারণ করে আছে। কী এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুনে পুড়তে পুড়তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সলিল চৌধুরীর সাহচর্যে রচনা করেন সময়ের যুগপৎ প্রাচীন ও নবীন মলাট। ১৯৫৫ সালের 'শাপমোচন' তো সভ্যতার রূপান্তরের ইতিকথা জনপ্রিয়তার মোড়কে। এই যে একটি সামন্ততান্ত্রিক সভ্যতা, গ্রামীণ সমাজ, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা পর্বে নগর সভ্যতার প্রণয়কটাক্ষে সায় দিল, আধুনিকতার দিক থেকে দেখলে তা অহল্যার শাপমোচনের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু গানে যে ঝড়ের যে দুর্ব্বার গতিবেগ, তা যেন আছড়ে প'ড়লো 'ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস আজকে হ'ল সাথী'তে আর বুঝিয়েই ছাড়ল এই ঝড়ই বস্তুত সমাজবদলেরই রূপক।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উত্তম-সুচিত্রার মেলোড্রামায় যে রীতিতে গাইতেন তার ভাবার্থ উত্তম-সুচিত্রার প্রতিটি হিট ছবিতে, 'লা লাল্লা লা' গানটিকে সন্ধ্যাকে সংগে নিয়ে রোমান্টিসিজমের কোন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন!

আবার রিয়ালিটির তথাকথিত কাঠিন্য যে কত অবলীলায় তিনি পার হয়ে যেতে পারেন তার দৃষ্টান্ত তো 'রানার', যা রূপকথার অধিক। এই হতভাগ্য ডাকহরকরার যাত্রা যে অন্তহীন, তা শুধু 'সা' থেকে শুরু করে ছ'বার ষড়জ পরিবর্তন আছে। অর্থাৎ 'সা' বদলে যাচ্ছে, থামছে না রুট কর্ডে। মেজর কর্ড-এর দিগন্ত থেকে মাইনর কর্ড-এর দিগন্ত জুড়ে সলিল একটা ছবি ফুটিয়ে তুলতে চান, টোনের অদলবদল করেন, না হলে পুঁজিবাদী ব্যবসার ক্লান্তি 'পিঠেতে টাকার বোঝা তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া' ধরা পড়বে না। হেমন্ত কী অনায়াসে এই দুরূহ ব্রত সম্পাদন করলেন! 'রানার'-এর থেকে জনপ্রিয় বাংলা গান আর কটা? হেমন্ত ব্যতিত 'রানার' গাওয়া সম্ভব?

গান গাইতে গাইতে আমার ভগবান কি ক্লান্ত হ'তেন না? ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলি, একটা জলসায় ২২ খানা গান একটানা প্রায় দেড়ঘন্টা ধ'রে গাইবার পরও মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতারা ছাড়বার পাত্র নন। সমবেত অনুরোধে ভগবান-কণ্ঠ আবার নতুন ক'রে মন্দ্রিত হ'ল, 'যে বাঁশি ভেঙে গেছে, তারে কেন গাইতে বল?' বাঁশিতে কিন্তু এতটুকু স্বর-সুর বিচ্যুতি ঘটেনি।

পাড়ার সেলাই দিদিমণি বা কোচিং সেন্টারের মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথকে অনেক দূর থেকে সসম্ভ্রমে দেখতেন। দেবব্রত বিশ্বাস, বলা বাহুল্য, একটু ধীরে ধীরে সর্বজনে নিবেদিত হন। কিন্তু, রবীন্দ্র শতবর্ষের পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কি অনায়াস কণ্ঠযাদুতে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সোজা মধ্যবিত্ত বাঙালির রোজনামচায় নিয়ে এলেন। সেই কবে ১৯৪৮ সালে 'প্রিয় বান্ধবী' চলচ্চিত্রে তিনি যখন গাইলেন 'পথের শেষ কোথায়', আমরা অক্লেশে ভাবলাম যে এই দার্শনিকতা আমাদেরও। অন্য তিন বাহু অবশ্যই দেবব্রত, কণিকা, সুচিত্রা। হেমন্ত না থাকলে 'শ্যামা', 'শাপমোচন', 'বাল্মিকী প্রতিভা', 'চিত্রাঙ্গদা' আর 'চণ্ডালিকা' উত্তর বাংলার পাহাড় থেকে নদিয়ার সমতল ঘুরে সুন্দরবনের সজনেখালি পর্যন্ত বাহুবিস্তার করতে পারত না। আমরা বাঙালি বলেই জানি, ভেড়ির নোনা জলও হেমন্ত পান করলে মিষ্টি হয়ে যেত!

সংযোজনে আরও বলি, একদা এলাকার যুব সমাজ রাস্তার মোড়ে তাল ঠুকত, 'হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা' আর লাইব্রেরিতে বই ফেরত দেওয়ার অবসরে কোনও কাজলনয়না কিশোরীকে জানাত, 'না তুম হামে জানো...'। এই সব গান মেরঠ থেকে কোচি, দেশজুড়েই বাজত। হেমন্ত বাঙালি হিসাবেই সর্বভারতীয় হয়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর ন'বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় 'দাদার কীর্তি' ছবির জন্য তিনি গেয়েছিলেন, 'চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে...'। এমন নির্মল আত্মনিবেদন সমস্ত আত্মাকে শুদ্ধ করে। যিনি অজেয় অব্যক্ত মানসগোচর, তাঁর প্রতি এই একক অঞ্জলি সিনেমা হল ছাড়িয়ে গায়ককে নিয়ে যায় ইতিহাসের পরপারে।

এক জন গায়ক যিনি সবিনয়ে মৃত্যুর দু'বছর আগে 'পদ্মভূষণ' উপাধি নিতে অস্বীকৃত হন, এক জন গায়ক যিনি হলিউডে প্লেব্যাক করেছেন, এক জন গায়ক যাকে বিশ্বভারতী সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছে, তিনি জীবন ও মৃত্যুতে ধুতি আর শার্টের মধ্য দিয়ে বাঙালিই রয়ে গেলেন। এমন সুদর্শন, অনুপম কণ্ঠের পুরুষ ছাড়া কে আর আমাদের শাসন করতে পারত স্বাধীনতার পর তিনটি দশক জুড়ে? একদা আমাদের সংস্কৃতিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রাজত্ব করতেন বলেই তাঁর শতবর্ষের পরেও ভগ্ন স্বাস্থ্য, হৃত স্বপ্ন, আমাদের মতো নির্জীব উত্তর প্রজন্মের মনে হয় বাঙালি হয়ে ওঠা কত বড় স্বর্গাভিযান!
আজ ১৬ই জুন, আমার ভগবানের জন্মদিন। তা সত্বেও আমার ভগবান তাঁর সারা জীবন ধ'রে শিল্পী-হেমন্তর থেকেও মানুষ-হেমন্তকে অনেক বড় ক'রে প্রতিভাত ক'রে গেছেন।
তাই আজ তাঁর জন্ম-শতবর্ষ পর, তাঁর জন্মদিনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ছে সুরলোকে যাত্রা দিনও তিনি কি মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন!
এবার সেটুকু বলি। এই লেখাটা আমি ডাঃ প্রবীর কুমার দত্ত মশায়ের লেখা থেকে পেয়েছি। ডাঃ দত্ত ছিলেন শিল্পীর জীবনের শেষ আট বছরের পারিবারিক চিকিৎসক।


"১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে বিপুল সংবর্ধনা ও ইলিশ মাছ নিয়ে দাদা-বউদি ফিরলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া সদ্য-ধরা কিছু ইলিশ মাছ কাঠের বাক্সে বরফ দিয়ে প্যাক করে উপহার দিয়েছিলেন। সেই রাত্রেই দুটি ইলিশ আমাদের বাড়ি পৌঁছে গেল। দাদার শরীর বিশেষ ভাল যাচ্ছিল না। ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়ছিলেন। তা সত্ত্বেও গায়ে অল্প জ্বর নিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠান করলেন। ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে বেলাবউদির ফোন পেয়ে আমরা দুজন (ডাঃ দত্ত ও তাঁর স্ত্রী ইন্দ্রানী) ছুটে গেলাম। দেখলাম, বেশ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বাড়িতেই অক্সিজেন, স্যালাইন, ওষুধপত্তরের ব্যবস্থা করা হল। বিশেষ উন্নতি না হওয়াতে কন্যা রাণু ও পুত্রবধূ মৌসুমীর সঙ্গে আলোচনা করে নার্সিংহোমে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। কার্ডিয়োলজিস্ট ডা. কান্তি বক্সির সঙ্গে যোগাযোগ করা হল।

দাদার রেকর্ড বা ক্যাসেট বেরোলেই উনি তার ওপর নাম সই করে আমাদের দিতেন। ওই দিনই রিলিজ হয়েছে তাঁর 'আনন্দ লহরী' ক্যাসেটটি। এত কষ্টের মধ্যেও বউদিকে ডেকে বললেন, ইন্দ্রাণীকে ক্যাসেটটি দিতে। ইন্দ্রাণী বাধা দিয়ে বলল, আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন, তখন আমাদের নাম লিখে, আমাদের দেবেন। ও জানত না, দাদা কোনও দিনও নিজ হাতে ক্যাসেটটা দিতে পারবেন না। তখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে, তারই মধ্যে একটি ছেলে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এল। ঘরে তখন ইন্দ্রাণী ছাড়াও আরও দুজন পরিচিতা মহিলা। দাদা স্ট্রেচারে ওঠার সময় জানতে চাইলেন, এঁরা কী ভাবে বাড়ি যাবেন। আশ্বাস দেওয়া হল, গাড়ি করে সনৎ এঁদের পৌঁছে দেবে। সঙ্গে লোকজন নেই, বেলাবউদি স্যালাইনের বোতল হাতে নিলেন, আমি অক্সিজেন-মাস্ক ধরে রইলাম। অ্যাম্বুলেন্সে বেলভিউ নার্সিং হোম যাচ্ছি, পদ্মপুকুরের কাছে দেখি, দাদা খুব ঘামতে শুরু করেছেন। নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন। বার বার অস্পষ্ট স্বরে বলছেন 'আর কত দূর?' বুঝতেই পারলাম আর একটি মারাত্মক হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হলেন। নার্সিংহোমে পৌঁছে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হলেন। ডা. বক্সি দাঁড়িয়ে থেকে যা যা করণীয়, সব করলেন। ঘণ্টা দুয়েক বাদে অবস্থা একটু থিতু হল, কিন্তু বিপদ কাটল না। ইঞ্জেকশনের জেরে ঘোরের মধ্যে রয়েছেন দেখে ঠিক হল, বেলাবউদি ও রাণুকে নিয়ে আমি বাড়ি ফিরে যাব। মৌসুমী বেলভিউতেই থাকবেন। রাত প্রায় বারোটা। হেমন্তদার গায়ে আলতো হাত রেখে বললাম, 'দাদা, বউদি ও রাণুকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোন।' অল্প একটু চোখ খুলে দাদা বললেন, 'মোস্ট ওয়েলকাম।' এটাই ওঁর শেষ কথা। ২৬ ভোররাতের হৃদয় নিংড়ানো কান্না যেন আকাশবাণী, আকাশ থেকে প্রচারিত হ'ল

"আমিও পথের মত হারিয়ে যাব
আমিও নদীর মত আসবোনা ফিরে আর
আসবোনা ফিরে কোনদিন।

আমিও দিনের মত ফুরিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনদিন।

মন আমার বাঁধলো বাসা ব্যাথার আকাশে
পাতা ঝড়া দিনের মাঝে মেঘলা বাতাসে।
আমিও ছায়ার মত মিলিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনদিন।

যাবার পথে পথিক যখন পিছন ফিরে চায়
ফেলে আসা দিনকে দেখে মন যে ভেঙ্গে যায় !

চোখের আলো নিভলো যখন মনের আলো জ্বেলে
একলা এসেছি আমি একলা যাব চলে।
আমিও সুখের মত ফুরিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনদিন।।" ....
 

Users who are viewing this thread

Back
Top