What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

মোঘল সম্রাজ্ঞীর দুর্গাপুজো (1 Viewer)

*আজ থেকে চারশো বছর আগের কথা। দিল্লির অধীশ্বর তখন সম্রাট জাহাঙ্গীর। মোঘল হারেমে এসে হাজির হয়েছিলেন দেবী দশভূজা দুর্গা। মা দুর্গাকে পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছিলেন ভারতসম্রাট আকবরের বিধবা মহিষী বৃদ্ধা যোধাবাঈ।*

*যোধাবাঈ ছিলেন রাজপুত রাজকন্যা। অম্বররাজ মানসিংহের বোন। রাজপুতরা বিষ্ণুর উপাসক। তিনি ছিলেন আকবরের হিন্দু মহিষী। তাঁরই পুত্র জাহাঙ্গীর। আকবরের পর মোঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট হন।*

*মোঘল সম্রাট আকবর সাম্রাজ্য বিস্তারে নেমে, সমগ্র বাংলাকে নিজের অধীনে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন সমগ্র বাংলাকে শাসন করতেন বারোজন জমিদার বা ভুঁইয়া। তাঁদের মধ্যে এগারো জন মোঘল আধিপত্য মেনে নিয়ে দিল্লির আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু যশোররাজ প্রতাপাদিত্য ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা। তিনি ছিলেন বারো ভুঁইয়ার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। তাঁর বিরুদ্ধে বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েও, আকবর তাঁকে পরাস্ত করতে পারেননি।*

*আকবরের মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে বসেন জাহাঙ্গীর। তিনি যশোররাজ প্রতাপাদিত্যকে বাগে আনতে, যুদ্ধবাজ অম্বররাজ মান সিংহকে বাংলার সুবেদার করে পাঠিয়েছিলেন। হিন্দু রাজা মান সিংহ বুঝেছিলেন, জলে জঙ্গলে বাংলাদেশের সুদক্ষ সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে কোনও মতেই তিনি সুবিধা করে উঠতে পারবেন না। তাই তিনি তাঁর উদ্দেশ্য হাসিল করতে শঠতার আশ্রয় নিলেন।*
*বর্তমান উত্তর ও দক্ষিণ ২৪-পরগনার কিছু অংশ, যশোর, খুলনা ও বাখরগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল ভূখণ্ড ছিল প্রতাপাদিত্যের শাসনাধীন। ধুমঘাটের কাছে বিশাল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করে, প্রতাপাদিত্য সেখানে বসবাস করতেন আর তাঁর রাজকার্য পরিচালনা করতেন। কিন্তু সুবিশাল সেই রাজপ্রাসাদ তো প্রাসাদ নয়, যেন এক গোলকধাঁধা। প্রাসাদের গোপন মানচিত্র ছাড়া সেখানে প্রবেশ করা ছিল অসম্ভব। প্রতাপাদিত্যের সামরিক শক্তির মূল উৎস ছিল তাঁর সেনাবাহিনীর সেনাধ্যক্ষ শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। কারণ তিনি ছিলেন যুদ্ধবিদ্যায় অসম্ভব পারদর্শী। যশোরেশ্বরী মা ভবানী, মা কালীই ছিলেন তাঁর সকল শক্তি ও সমৃদ্ধির মূলে। তিনি রাজপ্রাসাদ চত্বরে বিরাট মন্দির নির্মাণ করে শ্বেতপাথরের সিংহাসনে মা যশোরেশ্বরীর কষ্টিপাথরের বিগ্রহ স্থাপন করেন। মহারাজ নিজেই দেবীর পায়ে নিত্য পুষ্পাঞ্জলি দিতেন। যে কোনও যুদ্ধে তিনি দেবীর আশীর্বাদ না নিয়ে যেতেন না।
*অম্বররাজ মান সিংহ প্রতাপাদিত্যকে পরাস্ত করতে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঢাকায় এসে ঘাঁটি গাড়লেন। গোপনে গুপ্তচর নিয়োগ করে তিনি প্রতাপাদিত্যের সকল শক্তির উৎস সম্পর্কে জেনে নিলেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রথমে দেবীর আশীর্বাদ থেকে প্রতাপাদিত্যকে বঞ্চিত করতে হবে। তার জন্য মায়ের বিগ্রহকে অপহরণ করতে হবে। আর যশোররাজের আস্থাভাজন রাজকর্মচারীদের সুকৌশলে বশে আনতে হবে। তিনি প্রথম মহারাজের সেনাধ্যক্ষ শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়কে বশে আনতে চাইলেন। কারণ তাঁকে বশে আনতে পারলে যশোররাজকে সহজে যুদ্ধে পরাস্ত করা যাবে। কিন্তু সে চেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হন। তিনি সফল হন প্রতাপাদিত্যের হিসাবরক্ষক ভবানন্দ মজুমদারকে বশে আনতে। তাঁর নিকট থেকে তিনি প্রতাপাদিত্যের রাজপ্রাসাদের গোপন মানচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেন।*

*ভবানন্দ মজুমদার ছিলেন অত্যন্ত লোভী এবং উচ্চাভিলাষী। তিনি তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার বিনিময়ে মান সিংহের নিকট থেকে কৃষ্ণনগরের জমিদারি লাভ করেন। মোঘলসম্রাট খুশি হয়ে তাঁকে 'মহারাজা' উপাধিতে ভূষিত করেন। ইনিই কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ।*

*মান সিংহ ধুমঘাট রাজপ্রাসাদের প্রতিরক্ষার সমস্ত গোপন নথি সংগ্রহ করে প্রতাপাদিত্যের ঘোর শত্রু সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতার সাবর্ণ জমিদার ও বাঁশবেড়িয়ার জমিদারদের সাহায্য নিয়ে শেষমেশ সমস্ত আটঘাট বেঁধে অতর্কিতে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ধুমঘাট আক্রমণ করলেন। যুদ্ধে যশোররাজ প্রতাপাদিত্য-শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় জুটির পরাজয় ঘটে। তাঁদের দু'জনকে বন্দী করে দিল্লির সম্রাটের কাছে পাঠানোর বন্দোবস্ত করা হয়। সেই সঙ্গে অম্বররাজ মান সিংহ যশোরেশ্বরীর বিগ্রহ অপহরণ করে অম্বরে নিয়ে যান। আজও সেখানে যশোরেশ্বরী পূজিত হন।*

*বন্দী করে দিল্লিতে আনার সময় বারাণসীর সেনা-ছাউনিতে অসুস্থ যশোররাজ প্রতাপাদিত্য প্রাণ ত্যাগ করেন। মোঘলসম্রাট জাহাঙ্গীরের আদেশে যশোররাজের সেনাধ্যক্ষ শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়। কারাগারের নির্জন অবসরে বাঙালী ব্রাহ্মণ সন্তানের একমাত্র সঙ্গী ছিল ঈশ্বরচিন্তা; আর কাজ বলতে ছিল ধর্মগ্রন্থ পাঠ। এই ভাবে দিনের পর দিন কাটতে থাকে। এরই মাঝে এসে যায় মহালয়া। দেবীপক্ষ। পিতৃতর্পণের কাল। ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ সন্তান শঙ্কর সারা জীবন সৈন্যবাহিনীর নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত ছিলেন বটে, কিন্তু কখনও মহালয়ার দিনে নদীতে পিতৃতর্পণ করতে ভোলেননি। তাই এবারও পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জলদানের জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। তিনি তাঁর ইচ্ছার কথা সম্রাটকে জানালেন। কিন্তু সম্রাট তা নাকচ করে দিলেন। এতে ধার্মিক ব্রাহ্মণসন্তান শঙ্কর অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। তিনি সংকল্প করলেন, অনশনে প্রাণত্যাগ করবেন।*

*শুরু করলেন অনশন। এই দুঃসংবাদ পৌঁছল অন্তঃপুরে বৃদ্ধা রাজমাতা মহিষী যোধাবাঈয়ের কানে। তিনি এই সংবাদে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। রাজমাতা উপস্থিত হলেন পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজদরবারে। পুত্রকে বৃদ্ধা অশক্ত মাতা বললেন, শঙ্করের ইচ্ছা মঞ্জুর করতে। কারণ সম্রাট আকবর ছিলেন সকল ধর্মের প্রতি সমমনোভাবাপন্ন, উদার। তিনি তাঁর এক হিন্দু মহিষী ছিলেন। তাই রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে তাঁর জন্য পুজো-অর্চনার ব্যবস্থাও করেছিলেন। স্বয়ং আকবর পুজোর প্রসাদও নিতেন।*

*সম্রাট জাহাঙ্গীর মায়ের আদেশে শঙ্করকে যমুনার ঘাটে তর্পণের অনুমতি দেন। মহালয়ার দিনে রাজপুরুষের তর্পণ দেখতে যমুনার ঘাটে ভিড় জমে যায়। সেই ভিড়ের মধ্যে ছিলেন বোরখা পরিহিতা বৃদ্ধা রাজমাতা যোধাবাঈ। তিনি শঙ্করের তর্পণ অনুষ্ঠানে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে একদিন সমস্ত দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে কারাগারে শঙ্করের সম্মুখে উপস্থিত হন। তাঁকে দেখে বন্দী শঙ্কর বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান। তিনি শঙ্করকে বললেন যে, তিনিই তাঁর পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরকে বলে তাঁর তর্পণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এবার তিনি পুত্রকে বলে তাঁর বন্দী জীবনেরও অবসান ঘটাবেন। কিন্তু রাজমাতা তাঁর একটি ইচ্ছার কথা শঙ্করকে জানালেন। তিনি বললেন, বাঙালী হিন্দুরা তো শক্তির আরাধনা করে। তাই সে যেন তাঁর জন্মভিটেয় ফিরে গিয়ে শক্তির দেবী দুর্গার পূজো করেন। কারণ সম্প্রতি তিনি রাতে নিদ্রায় দেবী দশভূজা দুর্গাকে দর্শন করেছেন। আর স্বপ্নে দেবীর শ্রীচরণে পুষ্প নিবেদন করেছেন। তাই তিনি তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি রাজপুত। বিষ্ণুর উপাসক। তা ছাড়া তাঁর পক্ষে মুসলমান রাজপ্রাসাদে দুর্গাপুজো করা সম্ভব নয়। তাই শঙ্কর যেন ভিটেয় ফিরে গিয়ে দেবী দুর্গার পুজো করেন ও তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন।*

*শিবভক্ত শঙ্কর জানালেন, তাঁর পক্ষে শক্তির আরাধনা করা সম্ভব নয়। কারণ তাতে দেবাদিদেব মহাদেব রুষ্ট হবেন। তাই তিনি তাঁর আদেশ পালনে অক্ষম। তখন রাজমাতা যোধাবাঈ বললেন, তুমি আমার নামে দুর্গাপূজো করবে, আর আমিই তার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করব। শুধু তাই নয়, আমৃত্যু আমি পূজোয় গিয়ে মাতৃরূপ দর্শন করব। মায়ের পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দেব। যোধাবাঈয়ের কথায় শঙ্কর রাজি হলেন। রাজমাতার মধ্যস্থতায় সম্রাট জাহাঙ্গীর শঙ্করকে কারাগার থেকে মুক্তি দিলেন। শৈব শঙ্কর উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের ভিটেয় ফিরে এসে রাজমাতা যোধাবাঈয়ের নামে সঙ্কল্প করে দুর্গাপূজোর সূচনা করেন। আজও উত্তর ২৪-পরগনার বারাসতের দক্ষিণপাড়ায় শৈব শঙ্করের চালু করা 'শিবের কোঠার দুর্গা' পুজো হয়।*
*বর্তমানে পূজোপাঠ হয় গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার মতে এবং কংসনারায়ণী রীতি মেনে। দেবী দালানে এক কাঠামোয় প্রতিমা বানানো হয়। কিন্তু প্রতিবার নতুন প্রতিমা বানানো হলেও কাঠামো সেই আদ্যিকালের। বেদিতে দেবীর প্রতিমা প্রতিস্থাপনের পরে মহালয়ার পর দিন থেকে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। পঞ্চমীতে হয় বোধন। ষষ্ঠীতে ষষ্ঠীপুজো। সপ্তমীতে হাঁড়িকাঠ বসিয়ে পাঁঠা বলি হয়। অষ্টমীতে আখ ও কুমড়ো বলি হয়। নবমীতে পাঁঠা বলির পর হাঁড়িকাঠ তুলে ফেলা হয়। কিন্তু হাঁড়িকাঠ প্রতিষ্ঠা থেকে তুলে ফেলা পর্যন্ত বাড়ির বিধবারা অন্নগ্রহণ করেন না।*

*যশোররাজ প্রতাপাদিত্যের সেনাধ্যক্ষ শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত পূজো এখনও হলেও, এই বংশের একাদশ পুরুষ কিরণশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় জানান, বর্তমানে পুজো আর মোঘল সম্রাজ্ঞীর নামে হয় না। তিনি আরও জানান যে, শঙ্করের দুর্গাপূজো দর্শনে শেষ পর্যন্ত মোঘল সম্রাজ্ঞী বারাসতে আসতে পারেননি। কারণ তিনি বয়সের ভারে অশক্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু শঙ্কর যখন শিবের কোঠায় ধুমধাম করে দেবী দুর্গার আরাধনায় রত, সেই সময় অশ্বারোহী এক রাজপুরুষ এসে শঙ্করের হাতে তুলোট কাগজে লেখা একটি চিঠি ধরিয়ে দেন। চিঠিখানি এসেছিল ঢাকার নবাব ইসলাম খানের মারফত। চিঠির খাম খুলে শঙ্কর দেখেন পত্রপ্রেরক আর কেউ নন, স্বয়ং রাজমাতা যোধাবাঈ। চিঠি পড়ে শঙ্করের মন বিষাদে ভরে যায়। পত্রপ্রেরক জানিয়েছেন, আমি মায়ের পূজোয় উপস্থিত থাকতে পারলে ধন্য হতাম। কিন্তু যেতে পারলাম না; কারণ বয়সের ভারে আমি দারুণভাবে অশক্ত হয়ে পড়েছি। দেবী দুর্গা মায়ের কাছে আমার একান্ত প্রার্থনা যে তোমার দেবী আরাধনা সফল ও সম্পূর্ণ হোক।*
*লেখক: দেবব্রত সরকার।*
*তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ঠা আশ্বিন ১৪১০ রবিবার (২১শে সেপ্টেম্বর, ২০০৩)।*
 

Users who are viewing this thread

Back
Top