What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন’: বাঙালি মুসলমান শিল্পপতির সংগ্রামগাথা: শেষ পর্ব (1 Viewer)

cHEfrCp.jpg


ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির বিজ্ঞাপন, উৎস: ব্রিটিশ এম্পায়ার এক্সিবিশন-১৯২৪ ক্যাটালগ

'বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী'র স্টিমার 'নিলা'য় ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের। তাঁর লেখা 'অভিযাত্রিক' (১৯৪০) ভ্রমণকাহিনি পড়লে পাঠকের সামনে ভেসে ওঠবে সেই 'নিলা' স্টিমার ও মংডু যাওয়ার পথ। তিনি লিখেছেন- "কক্সবাজার থেকে গেলুম মংডু। 'নিলা' বলে একখানা ছোট স্টীমার চাটগাঁ থেকে কক্সবাজার আসে, সেখানা প্রতি শুক্রবারে তখন মংডু পর্যন্ত যেতো। শুটকি মাছ স্টীমারের খোলে বোঝাই না থাকলে এ সব ছোট জাহাজের ডেকে যাওয়া অত্যন্ত আনন্দদায়ক।

উপকূল আঁকড়ে জাহাজ চলে, সুতরাং একদিকে সব সময়েই সবুজ বনশ্রেণী, মেঘমালা, জেলেডিঙির সারি, কাঠের বাড়ি, বৌদ্ধ মন্দির, মাঝে মাঝে ছোট নদীর মুখ, কখনো রৌদ্র কখনো মেঘের ছায়া-যেন মনে হয় সব মিলিয়ে সুন্দর একখানি ছবি।…বিকেলে মংডুতে স্টীমার ভিড়লো। মংডু একেবারে ব্রহ্মদেশ। সেখানে পা দিয়েই মনে হ'ল বাংলাদেশ ছাড়িয়ে এসেচি! বর্মী মেয়েরা মোটা মোটা এক হাত লম্বা চুরুট মুখে দিয়ে জল আনতে যাচ্চে, টকটকে লাল রেশমী লুঙি পরা যুবকেরা সাইকেলে চড়ে সতেজে চলাফেরা করচে, পথের ধারে এক এক জায়গায় ছোট ছোট চালাঘর, সেখানে পথিকদের জলপানের জন্যে এক কলসী করে জল রাখা আছে।"

বেঙ্গল বর্ম্মার প্রতিযোগী ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি সম্পর্কে খানিক বর্ণনা দেওয়াটা সমীচীন হবে। এই কোম্পানি যে কতটা প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় ছিল সংযুক্ত বিজ্ঞাপন থেকে তা অনেকটা অনুমান করা যাবে। বাংলার সঙ্গে ব্রহ্মদেশ, মাদ্রাজ, বোম্বাই, সিংহল, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি অঞ্চলের বাণিজ্য চলত। এসব বাণিজ্যে পরিবহনের কাজ করত ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন।

ভারতীয় উপমহাদেশের অভ্যন্তরীণ জলপথ ছাড়াও বিভিন্ন মহাদেশীয় জলপথে ছিল তার নিরঙ্কুশ আধিপত্য। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল তখন এই কোম্পানির আওতাভুক্ত। পেনিনস্যুলার অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির (পি অ্যান্ড ও) সঙ্গে যৌথভাবে কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালিত হতো। 'বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী'কে নৌ–বাণিজ্য থেকে হটিয়ে নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েমের জন্য বিদেশি জাহাজ কোম্পানিটি নানা অন্যায্য কৌশলের আশ্রয় নেয়। ১৯৩৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে আবদুল হালিম গজনবীর ভাষ্যে উঠে এসেছে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির সেসব কূটকৌশলের কথা। মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর 'যুগ বিচিত্রা' গ্রন্থে ব্রিটিশ ভারত নেভিগেশন কোম্পানির কূটকৌশলের এ বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, "অতুল বিভবশালী বিদেশী কোম্পানী ঘোষণা করিলেন, তাহাদের জাহাজে যাত্রীদের জন্য দুই বেলা ফ্রি চা এবং নাস্তা, ছয় মাস পর উহার সহিত যুক্ত হইল দুই বেলা তৃপ্তিদায়ক আহার, তারপর যুক্ত হয় প্রত্যেক যাত্রীর জন্য একখানি স্নানের সাবান, দেহ মর্দন ও কেশবিন্যাস তৈল এবং একখানি করিয়া তোয়ালে। যাত্রী সাধারণ তবু তাহাদের ফাঁদে পা বাড়াইল না। এক বৎসর পর উপরোক্ত সুবিধাসহ প্রতি টিকেটের উপর প্রথমে দুই টাকা, তারপর চারি টাকা, তারপর সাত টাকা, তারপর দশ টাকা, সর্বশেষে টিকেটের গোটা টাকাটাই (চৌদ্দ টাকা) কনসেশন হিসাবে প্রদত্ত হইতে থাকিল। …দেশী বেঙ্গল-বার্মা কোম্পানী মহা ফাঁপড়ে পড়িয়া গেলেন। বিদেশী কোম্পানীর ন্যায় অর্ধ বোঝাই কিম্বা ক্ষেত্র বিশেষে প্রায়-খালি জাহাজ একাধিক বৎসর দূরে থাক্, একাধিক সপ্তাহ পর্যন্ত চালু রাখা তাহাদের পক্ষে মোটেই সম্ভবপর ছিল না। তাই তাহাদিগকেও কিছু কিছু কনশেসনের কথা ঘোষণা করিতে হইল। এবার বিদেশী কোম্পানি তাহাদের শেষ আঘাত হানিলেন। তাহারা ছেলে ধরার ন্যায় যাত্রী ধরার জন্য বাঙলার কয়েকটি জেলায় মাহিনা করা লোক নিযুক্ত করিলেন। ইহারা যাত্রীদিগকে তাহাদের স্ব স্ব যাত্ৰাস্থান হইতে কোম্পানীর খরচে চট্টগ্রামে লইয়া আসিত। শুনিয়াছি, চট্টগ্রামে পৌঁছার পর হইতে রেঙ্গুন বন্দরে অবতরণ পর্যন্ত ইহারা কোম্পানীর নিকট হইতে 'জামাই ষষ্ঠী' দিবসের আদর-আপ্যায়ন লাভ করিত। …বাধ্য হইয়া জনাব আবদুল বারী চৌধুরী কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা সিন্ধিয়া ষ্টীম নেভিগেশন নামক অপর একটি দেশীয় কোম্পানীর হাতে ছাড়িয়া দিলেন। বেঙ্গল-বার্মা কোম্পানীর বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী কোম্পানী সর্ব প্রকার কনসেশন প্রত্যাহার করেন।"

cyCT4bM.jpg


সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেডের বিজ্ঞাপন, উৎস: ১৯৪১ সালের ১৪ নভেম্বর 'দ্য বোম্বে ক্রনিকল' পত্রিকা

ভারতীয় জাহাজ কোম্পানিকে ধ্বংস করার জন্য 'ডেফার্ড রিবেট' বলে আরেকটি নিন্দনীয় প্রথারও চল ছিল তখন। এই প্রথা অনুযায়ী ক্রমাগত এক বৎসর বা অনুরূপ সময় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বিদেশি জাহাজে তাদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করলে আদায়ি ভাড়ার শতকরা দশ ভাগ রিবেট তথা ছাড় পেত। রিবেট কাটা যাওয়ার ভয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের প্রেরিত মালের সামান্য অংশও দেশি জাহাজে পাঠাতে রাজি হতো না। এ ছাড়া বিদেশি জাহাজবিমা কোম্পানিগুলো ভারতীয় জাহাজে প্রেরিত পণ্যের বিমা করতে অস্বীকার করে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বিদেশি জাহাজে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে বাধ্য করত। এত সব প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও আবদুল বারী চৌধুরীকে বিপর্যস্ত করার জন্য বার্মার তৎকালীন আয়কর বিভাগের ইংরেজ কর্মকর্তাদেরও যথেষ্ট অবদান ছিল। 'ইন্ডিয়ান ল রিপোর্ট রেঙ্গুন সিরিজ-১৯৩১'–এ কেস স্টাডি হিসেবে যা স্থান করে নিয়েছে। 'আবদুল বারী চৌধুরী বনাম কমিশনার অব ইনকাম টেক্স বার্মা' শিরোনামের ২৪ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণে দেখা যায়, আবদুল বারী চৌধুরীর বিপরীতে আয়কর কর্মকর্তার ভিত্তিহীন নোটিশ ও অভিযোগের জবাবে আপিল-শুনানি সহকারী কমিশনার হয়ে শেষ পর্যন্ত তা কমিশনার পর্যন্ত গড়ায়। কমিশনারের কাছেও সেটার গ্রহণযোগ্য সমাধান হয় না। অবশেষে আবদুল বারী চৌধুরীকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। বিজ্ঞ আদালত বারী চৌধুরীর আবেদন আমলে নেন। আয়কর কর্মকর্তার মূল্যায়নকৃত সম্পদের বিবরণী বাতিল করে নতুনভাবে তা প্রস্তুতের নির্দেশ দেন। এত সব প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও স্বদেশি জাহাজি প্রতিষ্ঠানের বিফলতার আরেকটি কারণ ছিল নিজেদের মধ্যে অনিষ্টকর প্রতিযোগিতা। ইংরেজ ম্যাককিনন-ম্যাকেঞ্জিরা যখন নৌ–বাণিজ্যে যৌথ একচেটিয়া অবস্থা তৈরির মাধ্যমে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশনসহ অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির স্বার্থরক্ষার প্রয়াস পেয়েছে, তখন স্বদেশীয়রা দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে। তবে ইংরেজদের এই অনিয়মের বিরুদ্ধে তারা যৌথ সংগ্রাম করেছেন। ১৯২৭ সালে ভারতীয় ব্যবস্থা পরিষদে 'উপকূল বাণিজ্য বিল' নামের একটি বিল উত্থাপন করেন এম এন হাজী। ওই বিলকে সমর্থন করে রেঙ্গুনের বেঙ্গল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন তারবার্তা প্রেরণ করে। ভারতের উপকূল বাণিজ্য যাতে ভারতবাসীদের মধ্যেই সংরক্ষিত থাকে, সেজন্যই ছিল এই বিলের অবতারণা। কিন্তু ইউরোপীয় সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার কারণে বিলটি পরিত্যক্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৬ সালে 'বিল টু কন্ট্রোল দ্য কোস্টাল ট্রাফিক অব ইন্ডিয়া' শিরোনামের একটি বিল উত্থাপন করেন আবদুল হালিম গজনবী ও পি এন সাপ্রু। ভারতের উপকূলে কোনো বিদেশি জাহাজ কোম্পানি যাতে ভাড়া কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে ভারতীয় জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে অসঙ্গত প্রতিযোগিতা করতে না পারে, সেটাই ছিল এই বিলের উদ্দেশ্য। বিলগুলো তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর না হলেও ভারতীয় নৌ–বাণিজ্যে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে।

79j5LU4.jpg


বোম্বাই গমনের পর সেখানকার পত্রিকায় আবদুল বারী চৌধুরীকে নিয়ে শিরোনাম, উৎস: ১৯২৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর 'দ্য বোম্বে ক্রনিকল' পত্রিকা

অনিয়মের কবলে পড়ে শুধু আবদুল বারী চৌধুরীর বেঙ্গল বর্ম্মাই নয়, ১৯০৫ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে অন্ততপক্ষে ২০টি দেশি জাহাজি প্রতিষ্ঠান তাদের নৌ–বাণিজ্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়। যেখানে আনুমানিক মোট মূলধন ছিল প্রায় ১০ কোটি টাকা। ভাগ্যকুলের রায় পরিবারের ইস্ট বেঙ্গল রিভার স্টিমার সার্ভিস কোম্পানিটি অসম প্রতিযোগিতায় জাহাজি ব্যবসা থেকে হঠতে বাধ্য হয়। ঠাকুর পরিবারের বাষ্পীয় পোত পরিবহনশিল্প স্থাপনের চেষ্টা ইউরোপীয়দের অন্যায্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ধ্বংস হয়ে যায়। ইংরেজ কোম্পানির বিবিধ অনৈতিক হস্তক্ষেপে চিদাম্বরম পিল্লাই তাঁর সি ভা কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হন। প্রফুল্লচন্দ্রের কোম্পানি প্রায় দুই লাখ টাকা লোকসান দেয়। অর্থাভাব প্রকট হওয়ার প্রাক্কালে ব্রিটিশ জাহাজি প্রতিষ্ঠানটি বেঙ্গল বর্ম্মাকে তাদের কাছে কোম্পানি বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল। এটা ছিল ১৯৩২ সালের কথা। কিন্তু বারী চৌধুরী এত সহজে হেরে যাওয়ার মানুষ নন। তিনি সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন–এর ওয়ালচাঁদ হীরাচাঁদের দ্বারস্থ হন। যিনি ছিলেন একজন মাড়োয়ারি জৈন ব্যবসায়ী। কিলাচাঁদ দেবচাঁদ ও নরোত্তম মোরার্জীর সহযোগিতায় ১৯১৯ সালে তিনি সিন্ধিয়া স্টীম নেভিগেশন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতীয় শিপিং পেশাদার এবং সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশনের জেনারেল ম্যানেজার মনসুখালাল আত্মরাম মাস্টারের লেখা থেকে জানা যায়, 'বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী' হস্তান্তরের পূর্ণ ঘটনা। আইনজীবী মনসুখালাল ছিলেন ওয়ালচাঁদ হীরাচাঁদের একজন বিশ্বস্ত সহযোগী। তিনি লিখেছেন, 'আমি ও ওয়ালচাঁদ তখন কলকাতায়। বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশনের চেয়ারম্যান শ্রী আবদুল বারী চৌধুরী একদিন রাত ১১.০০টায় গ্র্যান্ড হোটেলে এসে ওয়ালচাঁদের সাক্ষাৎপ্রার্থী হন। এক ঘন্টা অপেক্ষা করলে তিনি ওয়ালচাঁদের দেখা পেতে পারেন বলে আমি তাঁকে জানাই। তিনি তখন আমাকে বলেন যে, পাঁচ লক্ষ টাকার যোগান না হলে "বেঙ্গল বর্ম্মা কোম্পানী"কে পরবর্তী সকালে লর্ড ইনচেকপের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না। মধ্য রাতে শ্রী ওয়ালচাঁদ ফিরলে আমি তাঁকে বিষয়টি অবহিত করি। ওয়ালচাঁদ আমার পরামর্শ নেন। 'বেঙ্গল বর্ম্মা কোম্পানী'কে যথাসময়েই পাঁচ লক্ষ টাকা দেন ওয়ালচাঁদ।' ওয়ালচাঁদ এর ভাষায়, 'চৌধুরী ওয়াজ এ ম্যান অব প্যাট্রিওটিজম, ডিভোশন টু ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড আইডিয়ালিজম, বাট হি ল্যাকড ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্রেন্থ…।' পরিচালনায় পরিবর্তন এলে 'বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী লিমিটেড'–এর প্রতিটি শেয়ারের ফেস ভ্যালু ২৫ রুপির পরিবর্তে ২ রুপি ০৮ আনায় ধার্য হয়। তবে ১৯৫১ সালের মে মাসে কোম্পানি গুটিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত বেঙ্গল বার্মা স্টীম নেভিগেশন নামেই কোম্পানির সেবা চালু থাকে, ১৯৫০ সালের ডেক প্যাসেঞ্জার কমিটির প্রতিবেদন থেকে যা নিশ্চিত হওয়া যায়। সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন নৌ-বাণিজ্যে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখায়। তারা ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির কাছ থেকে চাকদারা (৩০৩৫ টন), ইডাভানা (৫২৮৪ টন) ও কোকানাডা (৩৯৫৮ টন) নামের তিনটি জাহাজ কিনে বার্মিসটান, জলগোপাল ও জলদুর্গা নামে নতুনভাবে নামকরণ করে।

BuoiL2w.jpg


সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির নতুন জাহাজ ক্রয়, উৎস: ১৯৩৩ সালের ২৮ আগস্ট 'দ্য বোম্বে ক্রনিকল' পত্রিকা

১৯৩৫ সালে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে বার্মিসটান ডুবে যায়। তারপরও ১৯৩৮ সাল নাগাদ তারা সিন্ধিয়া এবং বেঙ্গল বর্ম্মার সঙ্গে যুক্ত করে ইন্ডিয়ান কো-অপারেটিভ, রতননগর, মালাবর, মার্চেন্ট ও ইস্টার্ন স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি এবং দ্য হজ লাইন লিমিটেড। বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলো অবশ্য অন্যায্য প্রতিযোগিতায় সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশনকে হঠানোর কম চেষ্টা করেনি। এই সংস্থাটিই প্রথম ভারতীয় জাহাজ কোম্পানি, যেটি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পেরেছিল। ইত্যবসরে ওয়ালচাঁদের কোম্পানি জাহাজ ছাড়াও একে একে সুগার মিল, ব্যাংক, কনস্ট্রাকশনসহ বহু শিল্প-কারখানার মালিক হন। ১৯৬৫ সালে মনোপলিস এনকোয়্যারি কমিশন ওয়ালচাঁদ গোষ্ঠীকে ভারতের প্রথম কুড়িটি ব্যবসায়ী পরিবারের অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করে।

VUVFtWc.jpg


বার্মেসটন জাহাজ দুর্ঘটনা, উৎস: ১৯৩৫ সালের ০১ আগস্ট 'দ্য বোম্বে ক্রনিকল' পত্রিকা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা আক্রমণ করলে ব্যবসা-বাণিজ্য ফেলে আবদুল বারী চৌধুরী রিক্ত হস্তে চট্টগ্রামে ফেরত আসেন এবং সেখানে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। ইতিমধ্যে তিনি ইন্তেকাল করলে তাঁর জামাতা এ কে খান ১৯৫০ সালে পাকিস্তান স্টিম নেভিগেশন নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। 'ফতেহাবাদ' ও 'জাহাঙ্গীরাবাদ' নামের এই কোম্পানির দুটি জাহাজ ছিল। চট্টগ্রাম-হ্নীলা ভায়া কক্সবাজার পথে জাহাজগুলো যাতায়াত করত। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এগুলোর কার্যক্রম চলমান ছিল। দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ পর দুই প্রজন্মের জাহাজ ব্যবসার অবসান ঘটে।

D9wQ6V4.jpg


১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র হজে যাওয়ার প্রাক্কালে এস এস জলগোপাল জাহাজের ডেকে আবদুল বারী চৌধুরী। ছবিতে ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন মুসলিম নেতাদের মধ্যে আছেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন, হাবিবুল্লাহ বাহার, কবি মোজাম্মেল হক, নুরুল হক চৌধুরী, এ কে খান (বারী চৌধুরীর জামাতা) ও অন্য আরও কয়জন, উৎস: এ কে খান স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদক: হেলাল হুমায়ুন, প্রকাশক: এ কে খান নাগরিক স্মরণসভা কমিটি, ৮ নবাব সিরাজুদ্দৌলা রোড, চট্টগ্রাম, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ১৯৯১

লেখক: হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, লেখক ও গবেষক

সহায়ক গ্রন্থপুঞ্জি:

  • অভিযাত্রিক, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, পৃ. ৫৩, প্রকাশকাল: ১৯৪০, মিত্র ও ঘোষ, ১০ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা।
  • টু সেঞ্চুরিস অব ওভারসিজ ট্রেডিং: দ্য অরিজিনস অ্যান্ড গ্রোথ অব দ্য ইনচেকপে গ্রুপ, স্টিফেন জোন্স, ১৯৮৬।
  • দ্য লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি ডিবেটস, সিক্সথ সেশন অব দ্য ফিফথ লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি, ভলিউম-৫, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭।
  • যুগ বিচিত্রা, অসম প্রতিযোগিতা, মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ, মাওলা ব্রাদার্স, পৃ. ৩০৯-৩১০, ১৯৬৭।
  • দ্য কেস ফর দ্য কন্ট্রোল অব ইন্ডিয়ান কোস্টাল ট্রাফিক-উইথ দ্য অপিনিয়নস অব দ্য ইন্ডিয়ান প্রেস অ্যান্ড ইন্ডিয়ান কমার্শিয়াল বডিজ অন দ্য বিল ইন্ট্রুডিউসড ইন দ্য লেজিসল্যাটিভ অ্যাসেম্বলি, প্রকাশক: ধীরেন্দ্র নাথ সেন, ১৯৩৬
  • ওয়ালচাঁদ হীরাচাঁদ: ম্যান, হিজ টাইমস অ্যান্ড অ্যাচিভমেন্টস, জি ডি খনোলাকার, ১৯৬৯।
  • বিজন্যাস লিগেন্ডস, গীতা পরিমল, পেঙ্গুইন বুকস, ভারত, প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৮।
  • ওয়ালচাঁদ ডায়ামন্ড জুবিলি কমেমোরেশন, বি ডি সরদেশাল, পৃ. ২২৭, ১৯৪২।
  • পোর্টফোলিও বুক অব গ্রেট ইন্ডিয়ান বিজনেস স্টোরিস: রিভার্টিং টেইলস অব বিজনেস লিডারস অ্যান্ড দেয়ার টাইমস, পেঙ্গুইন বুকস, ২০১৫।
  • সো আই রেস্ট অন মাই ওরস: কালেকশন অব রাইটিংস অ্যান্ড স্পিসেস, ১৯৪৭-১৯৭০, এম এ মাস্টার, ভলিউম-২, পেইজ-৩৫ ও ৭৩।
  • সাগা অব সিন্ধিয়া ১৯১৯-১৯৬৯, টাটা প্রেস লি., ২৭ মার্চ ১৯৬৯।
  • বাংলাদেশ ওসান গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট।
  • মেরিটাইমবিষয়ক প্রকাশনা বন্দর বার্তা, আন্তর্জাতিক সীমানায় বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ, জিনারুল ইসলাম, ১ অক্টোবর ২০২০।
  • ইস্ট পাকিস্তান ইয়ার বুক, ভলিউম-৩, পৃ. ৪৯৪, ১৯৬০।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top