What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন’: একজন বাঙালি মুসলমান শিল্পপতির সংগ্রামগাথা (প্রথম পর্ব) (1 Viewer)

jdV8Gft.jpg


আবদুল বারী চৌধুরী। উৎস: এ, কে, খান স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদক: হেলাল হুমায়ুন, প্রকাশক: এ কে খান নাগরিক স্মরণসভা কমিটি, ৮ নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোড, চট্টগ্রাম, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ১৯৯১

১৮২৪-২৬, ১৮৫২-৫৩ ও ১৮৮৫ সালে মোট তিন দফা যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা বার্মাকে একটি ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করে। ১৮৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটেন বার্মাকে তার ভারত সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা সেখানে ভারতীয়দের অভিবাসনে উৎসাহিত করে। ১৯০১, ১৯১১ ও ১৯২১ সালের ভারতীয় আদমশুমারি অনুযায়ী বর্ম্মা তথা বার্মায় বাঙালির সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে বাঙালির একটা বড় অংশই ছিল চট্টগ্রামবাসী, তথা চাটগাঁইয়া। সংখ্যাধিক্যের কারণে শুমারির প্রতিবেদনে চট্টগ্রামবাসীর তথ্য নিয়ে পৃথক একটি অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়। বার্মার সঙ্গে চট্টগ্রামবাসীর সম্পর্ক অবশ্য অতি সুপ্রাচীন। ১৪৬-১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে চট্টগ্রাম কখনো সম্পূর্ণ আবার কখনো আংশিকভাবে প্রায় হাজার বছরকাল আরাকান রাজ্যভুক্ত ছিল। আরাকান বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) একটি অঙ্গরাজ্য। তবে বাঙালিদের অধিকাংশের বসবাস ছিল তখন রেঙ্গুনে (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন)। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার তৎকালীন ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল।

রেঙ্গুনের এক প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবদুল বারী চৌধুরী। প্রায় এক যুগের মতো বার্মা লেবার ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন আবদুল বারী। ১০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে বার্মার উত্তর ও দক্ষিণ পেগুর ইয়োমাহা বনে 'হাতি খেদা' ব্যবসাও পরিচালনা করেছেন। বার্মার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচাররত 'আঞ্জুমান-ই-উলামা-ই-বাঙ্গালা' খ্যাত প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি সর্বতোভাবে সহায়তা করতেন। বার্মায় তাঁর চালের কল ছিল। ইরাবতী বদ্বীপ কেবল বার্মার নয়, এটি ছিল তখন গোটা বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধান উৎপাদনকারী এলাকা। বার্মা থেকে চট্টগ্রামে আমদানি করা হতো চাল। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম থেকে আকিয়াব বন্দরে রপ্তানি হতো প্রধানত হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, শর্ষে, শণ ও পাটের দড়ি। চট্টগ্রাম ও বার্মার পণ্য আমদানি-রপ্তানিকারকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবদুল বারী। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে আবদুল বারীর জন্ম। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের 'স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম' শীর্ষক গ্রন্থ পড়ে জানা যায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রপথিক আবদুল বারীকে। আন্দোলনের তহবিল গড়ার জন্য ১০ হাজার টাকা দানের কথা ঘোষণা করেছিলেন স্বরাজ্য তহবিলে। বিশ শতকের শুরুতে সাগেইং জেলায় ডেপুটি কমিশনার এবং পরবর্তী সময়ে রেঙ্গুনে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন মরিস কলিস। তাঁর আত্মজীবনী 'ট্রায়ালস ইন বার্মা' গ্রন্থে আবদুল বারী চৌধুরী সম্পর্কিত নানা তথ্য রয়েছে। বিশিষ্ট আইনজীবী ও রাজনীতিক এবং কলকাতা পৌর সংস্থার প্রথম বাঙালি মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ছিলেন আবদুল বারী চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বার্মায় ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক ইস্যুতে তাঁরা একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছেন। ১৯০৫-০৬ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে চলে বিলেতি (ব্রিটিশ) পণ্য বর্জন ও বিলেতি বস্ত্র দহনের কর্মকাণ্ড। স্বদেশি আন্দোলনের এই প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালের ৮ জুলাই গড়ে তোলা হয় 'বেঙ্গল ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী' নামক এক স্বদেশীয় জাহাজি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দরের উপকূল-বাণিজ্যবাহী বিলেতি জাহাজ কোম্পানির সংস্রব ত্যাগের উদ্দেশ্যেই ছিল এই উদ্যোগ। পণ্যবাহী জাহাজের ব্যবসায় (মার্কেন্টাইল মেরিন) অর্থাৎ সমুদ্রপথে বিদেশ থেকে জিনিসপত্র আনা-নেওয়ার ভাড়া ও অভ্যন্তরীণ জলপথের শুল্ক হিসেবে বহু অর্থ তখন দেশ থেকে চলে যেত বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলোর থলিতে। স্বদেশি আন্দোলনের সময় এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা প্রখর হয়ে ওঠে।

DkU5npr.jpg


'বেঙ্গল ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী'র জাহাজ, উৎস: 'টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ইম্প্রেসন্স অব বার্মা: ইটস হিস্ট্রি, পিপল, কমার্স, ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড রিসোর্সেস'; আর্নল্ড রাইট, পৃ. ১৭০, ইলিয়ডস গ্রেটার ব্রিটেন পাবলিশিং কোম্পানি লিমিটেড, লন্ডন, ১৯১০

শচীন দত্তের লেখা 'চট্টগ্রাম: বিপ্লবের বহ্নিশিখা' গ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় 'বেঙ্গল ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী' প্রতিষ্ঠার কথা। 'বিল্ডার্স অব মডার্ন ইন্ডিয়া: ভি. ও. চিদাম্বরম পিল্লাই' এবং 'স্বদেশী এন্টারপ্রাইজ ইন বেঙ্গল ১৯০০-১৯২০' গ্রন্থেও লেখা রয়েছে 'বেঙ্গল ষ্টীম নেভিগেশন'-এর বিষয়টি। এই কোম্পানির জাহাজ রেঙ্গুন-চট্টগ্রাম, কলকাতা-রেঙ্গুন এবং কলকাতা-চট্টগ্রাম চলাচল করত। এগুলো ছিল একই সঙ্গে যাত্রী ও পণ্যবাহী জাহাজ। মুন্সী ইসান আলী ছিলেন কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন মুন্সী মোহাম্মদ কালা মিয়া। কোম্পানির পরিচালনা পরিষদে আরও ছিলেন আবদুল বারী চৌধুরী, ফজলুর রহমান চৌধুরী, ওবায়দুর রহমান চৌধুরী, মুন্সী আবদুর রহমান ও মুন্সী ইনায়েত আলী। 'নর্ড ডয়েসার লয়েড' নামক জার্মান কোম্পানির কাছ থেকে ১ হাজার ৩০১ টন ক্ষমতাসম্পন্ন 'টাংগলিন' ও 'পাকনাম' জাহাজ দুটি কেনেন তাঁরা। ইউরোপিয়ান নাবিক দ্বারা জাহাজগুলো পরিচালিত হতো। এগুলোয় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ডেক প্যাসেঞ্জারের ব্যবস্থা ছিল। কোম্পানির হেড অফিস ছিল∑১৮ স্পার্ক স্ট্রিট, রেঙ্গুন। ১০ রুপি মূল্যের এক লাখ শেয়ার, অর্থাৎ মোট ১০ লাখ রুপি মূলধন নিয়ে কোম্পানিটি ব্যবসা শুরু করে। ১৯০৭ সালে কোম্পানি শেয়ার হোল্ডারদের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। ইত্যবসরে তারা আরও দুটি জাহাজ কেনার পরিকল্পনা নেয়।

ytompGO.jpg


১৮৯০ সালে রেঙ্গুন বন্দর, আলোকচিত্রী: ফিলিপ এডলফ ক্লাইয়ার, উৎস: উইকিমিডিয়া কমনস

'ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স, চট্টগ্রাম' পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯০৫-০৬ সালে কলকাতা-চট্টগ্রাম-রেঙ্গুন জলপথে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন ও এশিয়াটিক স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির সর্বমোট ১৪টি জাহাজ চলাচল করত। নতুন দেশীয় কোম্পানি 'বেঙ্গল ষ্টীম নেভিগেশন', ইউরোপীয় কোম্পানি দুটির অনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিকার হয়। 'বেঙ্গল ষ্টীম'কে পরাস্ত করতে তারা অন্যায্যভাবে যাত্রীভাড়া ও পণ্যের মাশুল কমিয়ে দেয়। বিদেশি কোম্পানি দুটি নিজস্ব ক্ষতি স্বীকারের কূটকৌশলে দেশীয় নেভিগেশন কোম্পানিটিকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য করে ১৯১০ সালে। ৬ লাখ রুপিতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশনের কাছে জাহাজ বিক্রির মাধ্যমে কোম্পানির পরিসমাপ্তি ঘটে। নৌ-বাণিজ্য বিষয়ে সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায় 'বাংলার আর্থিক ইতিহাস: বিংশ শতাব্দী (১৯০০-১৯৪৭)' গ্রন্থে লিখেছেন, শুধু বাংলার অভ্যন্তরীণ জলপথ ও উপকূল বাণিজ্য নয়, সে সময় বিদেশি কোম্পানির জাহাজে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যও পরিচালিত হতো। ব্রিটিশ জাহাজে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৭০ শতাংশের পরিবহনের কাজ চলত। বাকি ৩০ শতাংশের মধ্যে ২৯ শতাংশের পণ্য পরিবহনের দায়িত্ব পেয়েছিল অন্যান্য বিদেশি জাহাজ কোম্পানি। ভারতীয় জাহাজে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের মাত্র ১ শতাংশ পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা ছিল। নৌ-বাণিজ্যের এ চিত্র অবশ্য বরাবরই এমন ছিল না। ৩৯৯-৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে চীনা পর্যটক ফাহিয়ান তাম্রলিপ্তকে বাংলার প্রধান সমুদ্রবন্দররূপে দেখতে পান। বাঙালিরা যে এককালে সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্যে প্রসিদ্ধ ছিল, তার প্রমাণ চণ্ডীমঙ্গল ও মনসামঙ্গল সাহিত্যে লিপিবদ্ধ আছে। বাংলার বারভূঁইঞাদের সময়ে এবং ঢাকায় মোগল রাজপ্রতিনিধিদের আমলে শ্রীপুর, বাকলা বা চন্দ্রদ্বীপ প্রধান নৌবন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। এভাবে সুদীর্ঘকাল ধরেই ভারতবর্ষ নৌ-বাণিজ্যে স্বনির্ভর ছিল। এই স্বনির্ভরতার পথে বিভিন্ন সময় নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। লোমহর্ষক এক সরকারি আদেশবলে বিভিন্ন আকার ও আয়তনের নৌকা তৈরি ও মেরামত নিষিদ্ধ করা হয়, যা প্রকাশিত হয় ১৭৮৯ সালের ২৯ জানুয়ারি 'কলিকাতা গেজেট'-এ। কেউ সেই আদেশ অমান্য করলে সরকারের সেটা বাজেয়াপ্ত করার অধিকার ছিল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর 'আত্মচরিত' গ্রন্থে সে আদেশ পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশ করেছেন।

NhvNqQz.jpg


'কলিকাতা গেজেট'-এ প্রকাশিত সরকারি আদেশ, উৎস: আত্মচরিত (দ্বিতীয় খণ্ড), আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, কলিকাতা, ১৯৩৭, পৃ: ৩৬৮-৩৬৯

অন্যায্যতা ও নীতিহীনতার শিকার হয়েও ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় জাহাজশিল্পের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় ভারতের বড় লাট লর্ড ওয়েলেসলির মন্তব্যে∑'কলিকাতা বন্দরে ১০,০০০ টন জাহাজ আছে। ঐ সমস্ত জাহাজ মাল বহন করিবার জন্য ভারতেই নির্ম্মিত। কলিকাতা বন্দরে বর্ত্তমানে যত টন জাহাজ আছে এবং বাংলা দেশে পোতশিল্প যেরূপ উন্নতি লাভ করিয়াছে (এবং ভবিষ্যতে আরও দ্রুত উন্নতি করিবে), সেই সমস্ত বিবেচনা করিয়া নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে বাংলার ব্রিটিশ বণিকদের পণ্য লণ্ডন বন্দরে চালান দিবার জন্য যত টন জাহাজের প্রয়োজন হইবে, কলিকাতা বন্দর তাহা সমস্তই যোগাইতে পারিবে।' কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির কার্যনির্বাহী অঙ্গসংগঠন কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স এবং ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের নগ্ন হস্তক্ষেপে ভারতীয় নৌ-বাণিজ্যকে উৎসাহ প্রদানের 'ওয়েলেসলি নীতি' রহিত হয়। সামুদ্রিক জাহাজি পরিবহন মূলত ইউরোপীয়দের হাতেই রয়ে যায়। একই অবস্থা হয় অধিকাংশ উপকূলবর্তী ও অভ্যন্তরীণ জাহাজি পরিবহন ব্যবস্থাতেও। কেবল মুম্বাইয়ে ভারতীয় বা এশীয়দের মালিকানায় জাহাজ ছিল। ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানিগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করত পুরোদমে। অন্যদিকে দেশীয় কোম্পানিগুলোর প্রতি আচরণ ছিল পুরোই বিমাতাসুলভ। চেম্বার অব কমার্স গঠনের মাধ্যমে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ছিল সারা ভারতে সুসংগঠিত। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন শাখায় প্রবেশের দরজাগুলো ছিল ইউরোপীয়দের নিয়ন্ত্রণে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বাংলা, মাদ্রাজ ও উত্তর ভারতীয় তিনটি চেম্বার অব কমার্সের কোনোটিতে বস্তুত কোনো ভারতীয় সদস্যই ছিল না। কোনো কোনো সংস্থার নিয়মাবলিতে ভারতীয়দের বাদ দেওয়ার জন্য স্পষ্ট ধারা ছিল। ফলে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা যৌথ একচেটিয়া অবস্থা রক্ষা করত। ফলে, এর মাধ্যমে তারা ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে ও শিল্পে নতুন প্রবেশকারীদের বাধা দিত।

AhbcUwb.jpg


'বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী'র শেয়ার সার্টিফিকেট (১৯৩১ সাল), উৎস: স্ক্রিপোফিলি, বন্ড এবং শেয়ার সার্টিফিকেট সংগ্রহকারীদের অনলাইন ক্যাটালগ

এত সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অদম্য ব্যবসায়ী আবদুল বারী চৌধুরী ২০ বছর পর পুনরায় জাহাজ ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। এটা ছিল ১৯২৭ সালের শেষ দিকের কথা। 'স্ট্রেইটস হেযাজ লাইন' রেঙ্গুন ও চট্টগ্রামের মধ্যে যাত্রীবাহী জাহাজ সেবা চালু করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানিটি এর কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। তারা স্বত্ব হস্তান্তর করে বারী চৌধুরীর কাছে। পূর্ববর্তী 'বেঙ্গল ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী' নামের সঙ্গে 'বর্ম্মা' শব্দটি যুক্ত করে এই দফায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী'। ১৯২৮ সালের জুলাই মাসে এটি পাবলিক লি. কোম্পানিতে পরিণত হয়। আবদুল বারী ছিলেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পরিচালকদের অধিকাংশই ছিলেন চাটগাঁইয়া। কোম্পানির হেড অফিস ছিল∑৬৪৪ মার্চেন্ট স্ট্রিট, রেঙ্গুন। পঁচিশ রুপি মূল্যের এক লাখ শেয়ার অর্থাৎ মোট পঁচিশ লাখ রুপি মূলধন নিয়ে কোম্পানিটি ব্যবসা শুরু করে। এজেন্ট ছিল কলকাতার টার্নার মরিসন অ্যান্ড কো.। 'ইংলিস্টন' (৪৮০৮ টন ক্ষমতাসম্পন্ন) ও 'সুলতানিয়া' নামক দুটি জাহাজ দিয়ে কোম্পানির যাত্রা। এগুলো ছিল একই সঙ্গে যাত্রী ও পণ্যবাহী জাহাজ। চট্টগ্রাম থেকে আকিয়াব হয়ে রেঙ্গুন পর্যন্ত সাপ্তাহিক যাত্রীবাহী জাহাজ লাইনে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির। ঘন ঘন ভাড়া বৃদ্ধি ও সুযোগ-সুবিধার সংকোচ সাধন করে কোম্পানিটি একদিকে যেমন নিজেদের আয়ের অঙ্ক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছিল, তেমনি অন্যদিকে তাদের জাহাজগুলোয় যাত্রীদের দুর্ভোগও জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। 'বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী'র অভ্যুদয়ের ফলে যাত্রীরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন'। তৃতীয় আরেকটি জাহাজ সংযুক্তির মাধ্যমে 'বেঙ্গল বর্ম্মা কোম্পানী' কলকাতার বিভিন্ন বন্দর পর্যন্ত তাদের জাহাজ লাইন বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নেয়। ইতিমধ্যেই এ সংস্থা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার স্টিমার সার্ভিস চালু করে, পরবর্তী সময়ে যা মংডু পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। মংডু নিম্ন বার্মার সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত, আরাকান প্রদেশের একটি সাবডিভিশন বা মহকুমা। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত 'বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন'-এর বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, 'মালার্ড' (১৯৩ টন ক্ষমতাসম্পন্ন) ও 'নিলা' (২০৮ টন ক্ষমতাসম্পন্ন) নামের দুটি স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। সপ্তাহে চার দিন এই স্টিমার চলাচল করত। চট্টগ্রাম থেকে মংডু আসা-যাওয়ার পথে পারকি, খাটখালী, ছনুয়া, ভোলা, কুতুবদিয়া, উজানটিয়া, মাতারবাড়ী, ধিমাহিয়া, বদরখালী, জে এম ঘাট, পোকাটি, কক্সবাজার ও মংডুতে যাত্রী ওঠানামা করত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মংডুর পরিবর্তে স্টিমার টেকনাফ হয়ে হ্নীলা পর্যন্ত যেত। চলবে...

PMvHlKV.jpg


'বেঙ্গল বর্ম্মা ষ্টীম নেভিগেশন কোম্পানী'র বিজ্ঞাপন (১৯৩৪ সাল), উৎস; ১৯৩৪ ব্র্যাডশ, পৃ. ৩০৮বি

  • লেখক: হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, গবেষক

সহায়ক গ্রন্থ:

০১। 'হিস্ট্রি অব দ্য বেঙ্গলি স্যাটলারস ইন বার্মা ১৮২৬ টু ১৯৬২, দেয়ার ইমপ্যাক্ট অন দ্য পলিটিক্যাল, ইকোনমিক অ্যান্ড কালচারাল লাইফ অব বার্মা মিয়ানমার' শীর্ষক পিএইচডি অভিসন্দর্ভ, ডালিয়া ভট্টাচার্য, ডিপার্টমেন্ট অব হিস্ট্রি, ইউনিভার্সিটি অব নর্থ বেঙ্গল, ২০১৩
০২। 'প্রাচীন আরাকান রোয়াইঙ্গা হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসী', আবদুল হক চৌধুরী, পৃ. ০১, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯৪, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
০৩। 'আ হিস্ট্রি অব চিটাগং' (ভলিউম-২), সুনীতি ভূষণ কানুনগো, প্রকাশক: দীপংকর কানুনগো, পৃ. ২৮২-৮৩, প্রথম প্রকাশ: ২০১০
০৪। 'রিপোর্ট অন ফরেস্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন বার্মা, ১৯১৯, পৃ. ৮৬-৮৭
০৫। 'রিপোর্ট অব দ্য রয়েল কমিশন অন লেবার ইন ইন্ডিয়া', ভলিউম-১০, পৃ. ১০১, ১৯৩১, বার্মা
০৬। শ্রীলতা চ্যাটার্জি, 'কংগ্রেস পলিটিকস ইন বেঙ্গল ১৯১৯-১৯৩৯', পৃ. ৮২, এনথেম প্রেস, লন্ডন, প্রথম প্রকাশ: ২০০২
০৭। রসায়নাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বিমলেন্দু মিত্র, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলিকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ১০৩-১০৬
০৮। 'ইকোনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া (১৮৫৭-১৯৫৬)', সম্পাদনা: ভি বি সিং, প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৫, অ্যালাইড পাবলিশার্স প্রাইভেট লি., পৃ. ৩৪৯-৩৫০
০৯। 'ভারতের আধুনিক শিল্পে বিনিয়োগ ও উৎপাদন ১৯০০-১৯৩৯', অমিয় কুমার বাগচী, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, পৃ. ১৮০ ও ২১৪, প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৭
১০। বার্মা মুসলিম লীগ সভাপতি এম আজমের ২৯ জানুয়ারি ১৯২৯ তারিখের পত্র, 'সাপ্লিমেন্টারি মেমোরেন্ডাম সাবমিটেড বাই দ্য মুসলিম লীগ বার্মা, রয়েল কমিশন', ভলিউম-১৬, পৃ. ৪৩৭-৪৩৮, উইথ মিনিটস অব অ্যাভিডেন্স অ্যান্ড এপেনডাইসেস (ইন্ডিয়ান স্টেটিউটরি কমিশন)
১১। ইন্ডিয়ান লেবার ইন রেঙ্গুন, ই জে এল এনড্রু, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোটেক্টরস অব ইমিগ্র্যান্টস অ্যান্ড ইমিগ্র্যান্টস রেঙ্গুন (রিটায়ার্ড), অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৩৩
১২। 'স্বতন্ত্র' (সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন), ভলিউম-৮, ইস্যু ৩২-৫২, ম্যানেজিং এজেন্সি সিস্টেম স্যুড গো, এস প্রণব মূর্তি, পৃ. ৩১, ১৯৫৩, হায়দরাবাদ, সিন্ধু, ভারত
১৩। 'চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ', আবদুল হক চৌধুরী, ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, চট্টগ্রাম
১৪। 'কক্সবাজারের ইতিহাস', কক্সবাজার ফাউন্ডেশন, প্রকাশকাল: ১৯৯০, পৃ. ২৮৫-২৮৬
১৫। 'লয়েডস রেজিস্টার অব শিপিং ১৯৪৭ সেইলিং ভেসেলস'

১৬। 'ইন্ডাস্ট্রি ইয়ার বুক অ্যান্ড ডিরেক্টরি-১৯৩১'
 

Users who are viewing this thread

Back
Top