ব্রিটিশ আমল থেকেই দ্যুতি ছড়াচ্ছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ। এ কলেজ থেকে বেরিয়েছেন নামী রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সংস্কৃতিকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, লেখক ও সাংবাদিক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, সব সময়ই সামনের সারিতে ছিলেন এখানকার শিক্ষার্থীরা।
১৯২১ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই কলেজে আড্ডা দিয়েছেন, গান গেয়েছেন, কবিতা লিখেছেন। ১৯২৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কলেজ প্রাঙ্গণে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দুই দফা এ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন র্যামন ম্যাগসাইসাই বিজয়ী বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আখতার হামিদ খান।
মহারানির নাম, দানবীরের দান
১৮৯৯ সালের ২৪ নভেম্বর কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন দানবীর ও জমিদার রায় বাহাদুর আনন্দচন্দ্র রায়। মহারানি ভিক্টোরিয়ার নামে এ কলেজের নাম করা হয়। কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় এলাকার রানীর দীঘির পশ্চিম পাড়ে কলেজের অবস্থান। বর্তমানে এই ভবনে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ দেওয়া হয়। এখানকার জামতলা ও রানীর দীঘির পাড় ঘিরে আড্ডা ও গল্পে মাতেন শিক্ষার্থীরা। আর প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে, ধর্মপুর এলাকায় ১৯৬২ সালে চালু হয় ডিগ্রি শাখা। সেখানে চলে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির পাঠদান।
কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইতিহাসবিদ গোলাম ফারুক জানান, দেশভাগের আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে কয়েকটি কলেজ ছিল, ভিক্টোরিয়া কলেজ তার মধ্যে অন্যতম। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এখানকার শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। ১৯৬৮ সালের ১ মে কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়।
আলোকিত ছাত্ররা
উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী শচীন দেববর্মন, ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ওসমান চৌধুরী, সাবেক উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদ, ফজলুল হালিম চৌধুরী, শামসুল হক, সাংবাদিক এবিএম মূসা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এস এম শাহজাহান, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞান লেখক অজয় রায়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্যতম রূপকার রফিকুল ইসলাম, জাতীয় পতাকার রূপকার শিবনারায়ণ দাস, অক্সফোর্ডের গবেষক আবদুস সাত্তার খান এ কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। অনেক খ্যাতনামা রাজনীতিবিদও এই কলেজে পড়েছেন।
শিক্ষা–সহশিক্ষা, দুই ক্ষেত্রেই সরব
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে ২৭ হাজার ৯৯৪ শিক্ষার্থী আছেন। কলেজে ২০টি বিষয়ে স্নাতক এবং ১৮টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর চালু আছে। শিক্ষক আছেন ১৭০ জন।
সহশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সারা বছরই সরব থাকে কলেজ প্রাঙ্গণ। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ বিতর্ক পরিষদ, সাংস্কৃতিক সংগঠন নোঙর, নাট্য সংগঠন ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটার, রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধন ও রেড ক্রিসেন্ট, বিএনসিসি, রোভার স্কাউটের মতো সংগঠনগুলোর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব চর্চার সুযোগ পান। ক্যাম্পাস সাহিত্য পত্রিকা নামে একটি প্রকাশনা বের হয় নিয়মিত। এ কলেজে ৫০০ আসনবিশিষ্ট একটি মিলনায়তন আছে। বছরের বিভিন্ন সময় সংস্কৃতিকর্মীরা নানা ধরনের আয়োজন দিয়ে মিলনায়তনটি মাতিয়ে রাখেন।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবু জাফর খান বলেন, সারা বিশ্বেই এ কলেজের শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এ অঞ্চলের বাতিঘর ভিক্টোরিয়া কলেজ শিক্ষিত নাগরিকের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করছে।
লেখক: গাজীউল হক