What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ডাইনি (1 Viewer)

rdbvrHC.jpg


ভূত-প্রেত, রাক্ষস-খোক্ষসে আমার বিশ্বাস নেই; কিন্তু গুজবে আছে।

পাঁচ বছরের পুলিশি চাকরিজীবনে দেখেছি গুজব মেঘের ওপর ভাসে না—পেছনে যথেষ্ট কোনো কারণ থাকেই আসলে। তবে রহনপুরের গুজবটা অদ্ভুত…এখানে নাকি ডাইনি আছে!

ডাইনি এখন রূপকথার পাতাতেও থাকে কি না সন্দেহ। ছেলেমেয়েরা এখন সাইফাইয়ের নামে ভবিষ্যৎ নিয়ে রূপকথা পড়ে। এলিয়েন থাকতে পারে এখন, কিন্তু ডাইনি কেন?

চেয়ারম্যান রইসউদ্দীনের সঙ্গে অবশ্য এসব তর্ক করে লাভ নেই। তিনি জেলা সদর থেকে ফোন করে জানিয়েছেন মিশনে যেতে হবে। ডাইনি ধরার মিশন। এমনকি কোথায় গেলে এখন ডাইনিটাকে পাওয়া যাবে, সেটাও বলে দিয়েছেন।

রহনপুর বরেন্দ্রভূমি। লাল মাটির এলাকা। উঁচু পাড় চিরে সরু একটা নদী চলে গেছে। নদীর নাম পুনর্ভবা। নদীর এপারে বাজার, ওপারে বাগান। আমবাগান। মাইলের পর মাইল এই আমবাগানে সূর্য পর্যন্ত ঢুকতে পারে না। কিন্তু আমাদের ঢুকতে হবে। কারণ, এখানেই সেই ডাইনির বাস।

মফিদুল আমার সহকারী। সে আরও দু–একজন স্থানীয় মানুষকে জুটিয়ে নিয়েছে। আমরা ঢালের পাড়ে ভ্যানগাড়িটা ছেড়ে এসেছি। এদিকটায় হাঁটা ছাড়া উপায় নেই।

প্রথমেই টমেটোর খেত—বিঘা সাতেক তো হবেই। তারপর আমবাগাম। ফজলি আমের গাছগুলো একেকটা দানব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গুঁড়িগুলো মনে হচ্ছে ইংরেজ আমলের সাক্ষী। মফিদুল বলল, স্যার, সাবধানে। সূর্যের আলো পড়তে পারে না তো, মাটি খুব পিছল!

আমরা পিছল মাটিতে বুটের ছাপ ফেলতে ফেলতে এগিয়ে চলি। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করি, ডাইনির উৎপাত কদ্দিনের?

'ম্যালাদিনের। বচ্ছর দশেক তো হইবোই!'

আরেকজন বলে ওঠে, 'বুরবাকের মতন কথা কইয়ের না জি রবু কাকা…ডাইনি আইসছে বারো বচ্ছরের এক দিনও কম না।'

'কোথা থেকে আসছে?'

'ইন্ডিয়া থেইকা হইতে পারে। ইন্ডিয়ারই। এত সুন্দর কি আর এই দিকে কেউ আছে নাকি?'

'ডাইনি তাহলে সুন্দর?'

'খুবই সুন্দর। পরির মতন দ্যাখতে। পানপাতা মুখ। রাইতের বেলা ওড়ে।'

আগের লোকটা আবার ধমক দিয়ে ওঠে, 'উড়তে দেখছ তুমি রবি কাকা? আন্দাজে সারকে কথা কহিও না। উড়তে পারে কি না হামরা কেহু দেখি নাই জি।'

'তাহলে কী করতে দেখেছেন?'

এবার দুজনেই চুপ। আমরা অনেকটা ভেতরে চলে এসেছি। সূর্যের আলো সত্যিই এদিকে পড়ে না। ভরদুপুরে অন্ধকার হাতড়াতে হবে এমন অবস্থা। গাছের গায়ে গায়ে গাঢ় সবুজ শেওলা লেগে আছে। শেওলার সঙ্গে মুখ লেপ্টে আছে কচি কচি শামুক। মফিদুল টর্চ জ্বালিয়ে দেয়। তাতেও অবশ্য দেখার খুব সুবিধা হয় না।

স্থানীয় একজন বলে, 'আপনাদের পিস্তলে গুলি আছে তো জি?'

'কেন? ডাইনি তো আর বাঘ না যে গুলি করে মারতে হবে!'

'ডাইনি হইল বাঘের বাপ!'

যে বলছিল তার শরীরে যেন কাঁটা দেয়। শিউরে ওঠে। আমি বলি, ভয় পাচ্ছেন? ভয় পেলে আসতে হবে না আমাদের সঙ্গে। ফেরত যেতে পারেন।

'না না। ডাইনিরে দেখা লাগব। কুনোদিন তো দেখি নাই।'

'কেউ দেখেছে এলাকার?'

'মন্তাজ! মন্তাজ দেখছিল। চোখ পুইড়া গেছে দুই চোখ।'

'কেন?'

'রূপে। রূপে পুড়ছে।'

'তাহলে ডাইনির এই দোষ! রূপে চোখ পুড়িয়ে দেয়।'

'না না আরও দোষ আছে জি। ঘরের নরদের রাইতের বেলা বাহির কইরা দেয়। সারা রাইত ডাইনির সাথে থাইকা পরদিন থেইকা ঘরের নারীগুলারে আর চিনতে পারে না!'

'মাথা খারাপ হয়ে যায় পুরুষদের?'

'ডাইনিরে দেখলে আপনারও মাথা খারাপ হইয়া যাইব।'

লোকটা এই অন্ধকারের মধ্যে একটা সস্তা সানগ্লাস পরে নেয়। মফিদুলকে বলি, আমার কিন্তু সিম্পল কেস মনে হচ্ছে...আপনি কী ভাবছেন?

'একটা মেয়ে এই বাগানের মধ্যে বাস করা শুরু করেছে। মেয়েটি সুন্দর। তার আকর্ষণে ছেলেরা আসে। সম্ভবত বারবনিতা। মেয়েটির রূপমুগ্ধ হয়ে ছেলেরা ঘরোয়া মেয়েদের দিকে ভুলেও আর তাকাচ্ছে না। আপাতত মনে হচ্ছে এমনটাই সমস্যা।'

'তাহলে গুজবের একটা কার্যকারণ পেয়েই…'

কথা শেষ করার আগেই ছম করে একটা শব্দ শুনি আমরা। এই নৈঃশব্দ্যের ভেতরে তা এত বেশি কানে লাগে যে আমরা সবাই, যে যেখানে ছিলাম, দাঁড়িয়ে যাই থমকে। স্থানীয় লোক দুজন একসঙ্গে বলে ওঠে, 'গুলি করেন জি, গুলি করেন জি!'

কিন্তু কাকে গুলি করব? কোথায়বা গুলি করব? অন্ধকার, জলজ-শীতলার মধ্যে যেদিকে তাকাই শুধু গাছ আর গাছ। তা ছাড়া কেনই–বা গুলি করব? তখনই পেছনে একটা শব্দ হলো…এবার আর ছম না। কে যেন পাতা মাড়াল পায়ে। আমরা ঘুরতেই আর কিছু দেখলাম না। মফিদুল ফিসফিসিয়ে বলে, আমি যেই ব্যাখ্যা দিয়েছি স্যার সেটা সত্য না–ও হতে পারে। আসলেই হয়তো তেমন কিছু আছে…আসলেই হয়তো ডাইনি আছে…

ফড়ফড় করে একটা পাখি উড়ে গেল। ঘামে আমার কলারটা ভিজে গেছে এরই মধ্যে—এবার কলিজাটা ধড়াম করে ওঠে। কিন্তু এরপর একদম চুপ সব। সাহিত্যে বলে পিনপতন নীরবতা। আমাদের সবার কণ্ঠ অকারণেই নেমে গেছে। স্থানীয়দের একজন বলে, 'পাখি উড়ার সম হয়তো সে উইড়া গেছে!'

আরেকজন বলে, 'তাইলে আমরা ফিরা যাই!'

ফিরে আমারও যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু আরেকটু না থাকলে চেয়ারম্যানের কাছে খবর যাবে যে আমি পুরো বাগানটা সার্চ করিনি। তাই এগিয়ে যাই। অন্যরা নিরুপায় হয়ে আসে। আর এগিয়ে পাঁচ কদম যেতে না যেতেই একটা ছায়া হঠাৎ আমাদের পাশ দিয়ে যেন চলে যায়। চট করে। মফিদুল চিৎকার করে ওঠে, 'স্যার…'

সামনে তাকাতেই দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। একটা মেয়ে। ২২ কি ২৩ বছর বয়স। পানপাতা মুখ। অসম্ভব সুন্দর দেখতে। চুলগুলো এসে পড়েছে নগ্ন বুকের ওপর। শরীরে শুধু শেওলা। চুলের ভেতর যেন বাষ্প। কিন্তু এতটুকুই! কোনো বড় বড় নখ নেই, দাঁত নেই, ডানা নেই! এমনকি রূপের এত তেজও নেই যে আমাদের চোখ পুড়ে যাবে। সাধারণ, খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। ডাইনি তো নয়!

স্থানীয়রা বলে, 'গুলি করেন স্যার, ডাইনিটা নাইলে পালায়ে যাবে!'

মফিদুল বলে, 'ঘটনা যা-ই হোক, গুলি করে দেন স্যার। না হলে দুর্নাম হবে। করেন স্যার।'

আমি গুলি করি না। বরং এগিয়ে যাই। ডাইনিটা পিছিয়ে যেতে থাকে। পেছন থেকে স্থানীয়রা বলে, 'সার, যায়েন না সার…আর ফিরত আসতে পারবেন না! সার…'

আমি কারও কথা শুনি না। এগোতে থাকি। এগোতেই থাকি। আর যখন ডাইনিটার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়াই, দেখি ডাইনিটার ঠোঁটে অল্প অদ্ভুত হাসি। তারপর ডাইনিটা ছুট দেয় উল্টো দিকে। আমিও দৌড়াই সেদিকেই। রাস্তা পিছল সত্যিই, কিন্তু আমরা কেউ পড়ে যাই না। আমরা ঢুকে যেতে থাকি গভীরতম বাগানে।

এরপর আমাকে আর ডাইনিকে দেখা যায় না রহনপুরে। এলাকায় গুজব রটে ডাইনিকে দেখে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম; সেই সুযোগে ডাইনিও আমার হৃৎপিণ্ড খুলে রেখেছে নিজের জাদুর কৌটায়। আমি চাইলেও তাই ডাইনির কাছ থেকে আর ফিরতে পারব না।

আগেই বলেছি, প্রতিটি গুজবের পেছনেই আসলে কিছু না কিছু কার্যকারণ থাকে!

লেখক: আহমেদ খান
 

Users who are viewing this thread

Back
Top