What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected দুরকম বন্ধু পৃথিবীতে আছে (1 Viewer)

gqow0od.gif


আমার বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, 'তুমি অফিসে আর আমি স্কুলে চলে গেলে লোকটা যে আমাদের বাসায় আসত, এ কথা তুমি জানতে?'

বাবার নির্বিকার উত্তর, 'জানতাম।'

'এ নিয়ে কখনো কিছু বলোনি? আমার মাকে, বা তোমার ওই বন্ধুকে?'

'তোমার মাকে একবার বলেছিলাম যে ব্যাপারটা আমি জানি।'

'ব্যস, এইটুকু? আর কিছু না?'

'না, আর কিছু না।'

বুঝতে পারল বোধ হয় উত্তরটা পছন্দ আমার হয়নি, এবার উল্টো প্রশ্ন করল, 'বললে কী হতো?

কী হতো সেটা বোঝার বয়স তখন আমার হয়নি, কেননা পিতা-পুত্রের এই কথোপকথনের সময়কালে আমার বয়স ছিল মাত্র বারো। তারও দুবছর আগে আমার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়েছে। সেই দশ বছর বয়সে আমি মার পিছু পিছু একটি নিশ্চিন্ত ও আরামদায়ক ঠিকানায় না গিয়ে আমার বাবার সঙ্গে থেকে গিয়েছিলাম।

আমাদের দুকামরা ঘর; পলেস্তারা খসে পড়া দেয়াল, মেঝের ফাটলগুলো মুখব্যাদান করে আছে, আর জঘন্য একটি স্নানঘর লাগোয়া পায়খানা। তবু আমি থেকে গেলাম। মানুষটা বিরক্তিকর, একঘেয়ে ও উদ্যমহীন, তাকে ত্যাগ করার জন্য আমার মা এক শ একটা কারণ দেখাতে পারবে, যার অধিকাংশই যথাযথ। কিন্তু আমি যাবতীয় রাগ-ক্ষোভ-বিরক্তি নিয়েই লোকটাকে ভালোবাসি। পরস্পরের প্রতি আমাদের এই ভালোবাসা গৃহহীন মানুষের সঙ্গে পথের কুকুরের মতো শর্তহীন। একটা মানুষ মার খাচ্ছে, অপমানে জর্জরিত হচ্ছে, প্রতিদিনের পরাজয়কে মেনে হাসিমুখে বেঁচে থাকছে—এই লোকটাকে ভালো না বেসে পারা যায়!

আমার বাবা খুব বন্ধুপ্রবণ মানুষ। তার বন্ধুসংখ্যাও তাই কম নয়। তবে সবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় তা নয়, শুধু নির্দিষ্ট একটি পরিমণ্ডলে নিয়মিত তার যোগাযোগ। তাদের সঙ্গে তাস খেলা, মদ খাওয়া, আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি। ঘটনাচক্রে তারা সবাই আর্থিকভাবে অনেক বেশি সচ্ছল, এমনকি বিত্তশালী। নাকি নিজের দারিদ্র্যের গ্লানি মুছতেই বিত্তবান বন্ধুদের সঙ্গ তার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তারা আমার দরিদ্র বাবাকে সহ্য করতেন, করুণা করতেন বা হয়তো ভালোও বাসতেন। আসলে একটা লোক লাগে, বন্ধু পরিমণ্ডলে যাকে কেন্দ্র করে হাসি-তামাশা জমে ওঠে, বিনা দ্বিধায় যাকে বিদ্রূপে বিদ্ধ করা যায়। এই যেমন মা যে বন্ধুদের একজনের সঙ্গে চলে গেল, সেই বন্ধুর সঙ্গে আমার মার প্রেমপর্ব নিয়ে চূড়ান্ত অশ্লীল ও আদিরসাত্মক আলাপ-আলোচনার সময়ও আমি আমার বাবাকে হাসতে দেখেছি। আমি সেই হাসির বেদনা জানি, এখন তো চৌদ্দ বছর বয়স আমার, আমি জানব না! কিন্তু আমার বাবা বন্ধুদের রসিকতায় হাসে। এর নামই বোধ হয় অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি। আমি জানি, আমার বাবা খুবই সংবেদনশীল একজন মানুষ, কিন্তু ভেঙে চুরমার হওয়ার সময়ও মানুষটার মুখে হাসি থাকে বলে বন্ধুরা তাকে চিনল না। ধরুন, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কিংবা একজন শিল্পোদ্যোক্তা, যিনি কিনা আবার চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক, বা শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত ও বেশি অর্থ উপার্জনকারী এক শল্যচিকিত্সক—এঁদের সঙ্গে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানের হিসাবরক্ষকের তো বন্ধুত্ব হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হয়েছে। এই সৌভাগ্যেই লোকটা গদগদ, তো তার মন ও সংবেদনের খোঁজ রাখার দায় কার! বাবা আমাকে একটা অদ্ভুত কবিতার চারটি পঙ্ক্তি শোনাল একদিন—

দুরকম বন্ধু আছে পৃথিবীতে, একজন

ভিজিটিং আওয়ার্সে আসে, ফিরে যায়

সূর্যাস্তের আগে

অন্যজন বসে থাকে হাসপাতালের গেটে

অনন্ত দুঃখের রাত জাগে।

ভাঙা, কিন্তু গমগমে গলা বাবার। শুনে কবিতার মর্ম ও সুর বেশ বুঝতে পারি। আমার তো চৌদ্দ চলছে। বললাম, 'হাসপাতালের গেটে সারা রাত জেগে থাকার মতো বন্ধু তোমার আছে?'

কান পর্যন্ত বিস্তৃত হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল, 'আছে।'

'কে?'

'তুই। হা হা হা।'

বহুদিন পর বাবার কথায় আমার উদ্গত অশ্রু সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সত্যিই তো, এই লোকটা আমার চার আনা বাবা, আর বারো আনা বন্ধু। না হলে আমি মার সঙ্গে গেলাম না কেন? যার নিজেরই ঘরসংসারের ঠিকঠিকানা নেই, তার সঙ্গে থাকলাম কেন।

স্কুল থেকে ফিরে আমি ঘরে একা, বাবা অফিস থেকে ফিরে এলে কিছু একটা মুখে দিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়া। কারণ, ওই বয়সের একটা ছেলেকে মধ্যরাত পর্যন্ত একা ঘরে রেখে যাওয়া নিরাপদ নয়। কোথায় আমার লেখাপড়া, কোথায় কী! শুধু ছুটির দিন সকালবেলা একটু পড়াশোনা হয়, বাবাই টিউটর। আমি এরই মধ্যে দিব্যি ঠেলেঠুলে ক্লাসের পর ক্লাস ডিঙিয়ে যাই।

সন্ধ্যার পর বাবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, পান করে, তাস খেলে, ছোটদের শুনতে হয় না এমন কথা বলে ও শোনে, আমিও তার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকি। আমার কোনো বন্ধু নেই, আমি বাবার বন্ধু। তার কোনো বন্ধুর বাসায় ড্রয়িংরুমের এক কোণে, কারোর বারান্দায় বা পাশের ঘরে আমার জায়গা হয়ে যায়। বন্ধুরা বাবাকে সহ্য করেন, আমাকেও করেন, কিংবা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যান। সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন—এ কথাওবা বলি কী করে, মাঝে মাঝে ভালোমন্দ এটা–ওটা খেতে-টেতেও দেন।

শল্যচিকিত্সকের ছোট মেয়েটা প্রেমে পড়েছিল এক সহপাঠীর। সেই সহপাঠী প্রতারণা করল, এমনকি কোনো ফাঁকে তোলা মেয়েটার কিছু অর্ধনগ্ন ছবি ছেড়ে দিল ইন্টারনেটে। আমার বাবাকে সেদিন পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে দেখেছি এক উকিল বন্ধুর বাসা থেকে আরেক পুলিশ অফিসার বন্ধুর দপ্তরে। বলা যায়, সেই রুদ্ধশ্বাস ছোটাছুটির কারণেই আটক করা হলো শল্যচিকিত্সকের ছোট মেয়ের বন্ধুকে, নেট থেকে দ্রুত ছবিও তুলে ফেলা হলো। সে যাত্রায় চিকিত্সক ও তাঁর মেয়ের ইজ্জত রক্ষা পেল। তিনি হাত ধরে বললেন, 'থ্যাংকু দোস্ত।'

বাবা বিগলিত, ধন্য। এ রকম কাজে লেগে যায় লোকটা, এমনকি এক বন্ধুর ঘুষের টাকা আরেক সরকারি কর্মকর্তা বন্ধুকে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত। নানা ফাই-ফরমাশও খাটে অনেক সময়। দাসত্ব ও বন্ধুত্ব প্রায় একাকার। কিন্তু কোনো গ্লানি নেই।

অনায়াসে হাত পাতে। অজস্র অপমানের স্মৃতি কী করে যেন ভুলে যায়। কী জানি হয়তো ভোলে না, পুরোনো ঘা খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতে কে চায়!

'হাজারখানেক টাকা দিতে পারিস, মাসের শুরুতে ফিরিয়ে দেব।' হাত কচলায়, চোরের মতো হাসে আমার বাবা।

বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেসে বলেন, 'তোমার এই কায়দাটা পাল্টাও দোস্ত, একই রেকর্ড বারবার বাজালে শুনতে ইচ্ছা করে না।'

কোনো উত্তর না দিয়ে হে হে করে হাসতে থাকে। রাগে-ঘৃণায় আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়, এই লোকটা আমার বাবা!

ব্যবস্থাপনা পরিচালক একটা গল্প ফাঁদেন, 'গোলপাহাড়ের মোড়ে একটা ভিখিরি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভিক্ষা করত। পা ভাঙা। আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল। গাড়ির কাচ নামিয়ে একদিন বললাম, ভাঙা ঠ্যাং নিয়া তো বহুদিন হয়া গেল এইবার কায়দাটা বদলাও। কী আশ্চর্য, ঠিকই বদলে ফেলল। পরদিন গিয়ে দেখি পা ভালো হয়ে গেছে, হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা...হা হা হা।'

বাবা তখনো হে হে, আর বহুজাতিক তাঁর পকেট থেকে দুটো পাঁচ শ টাকার নোট দিয়ে বলল, 'কোন মাসের শুরুতে যেন ফেরত দিবা, দোস্ত?'

অনায়াসে একটা ভিখিরির গল্পের সঙ্গে বন্ধুর টাকা ধার চাওয়ার গল্পটা মিলিয়ে দিলেন বন্ধু। বাবা টাকাটা পকেটে পুরল।

'তুমি মান-অপমান বোঝো না?' একান্তে পেয়ে আমি রাগ উগরে দিই।

'বন্ধুদের মধ্যে আবার মান-অপমান কী? বন্ধুরা তো ঠাট্টা-মশকরা করতেই পারে।'

'তুমি পারবে?'

আমার বাবার মুখে জবাব নেই। জানে, পারবে না। আমার মাকে নিয়ে অশ্লীল ঠাট্টা-রসিকতা কম হয়নি বাবার বন্ধুদের আড্ডায়। কিন্তু এই তো বছরখানেক আগে শিল্পোদ্যোক্তা বন্ধুটিরও স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে, তা-ও পরকীয়া প্রেমের কারণে। এ নিয়ে নানা জায়গায় হয়তো কথাবার্তা চলেছে কিছুদিন, তবে এই বন্ধুদের আড্ডায় বিন্দুমাত্র শব্দবাদ্য হয়নি।

আমার নিজস্ব কোনো গল্প নেই, আমি বাবার গল্পের একটা চরিত্র শুধু। ছোটবেলায় একা ঘরে রেখে যাওয়া নিরাপদ ছিল না বলে বাবা তার সঙ্গে বয়ে নিয়ে যেত, কিন্তু বড় হওয়ার পরও দুজনের একসঙ্গে ঘোরাফেরার নিয়মটা চালু রয়ে গেল। যা বড় হওয়ার শরীর-মনে বেড়ে উঠছি, কিন্তু পৃথক কোনো গল্প নেই। সহপাঠী কর্তৃক প্রতারিত শল্যচিকিত্সকের কন্যাটি কয়েক দিন আমার পেছনে লেগেছিল। তার দুঃসময়ে যখন আমার বাবা ছোটাছুটি করছিল, তখন আমিও তো ছিলাম পাশে, তখন বোধ হয় চোখে পড়েছিল। আমি মায়ের চেহারা পেয়েছি, দেখতে শুনতে ভালো, তা ছাড়া করুণা থেকেও অনেক সময় এক-আধটু প্রেম নাকি জন্মায়, সে রকম কিছু হতে পারে, বা অনেকে তাত্ক্ষণিক জখমের উপশম হিসেবে যেকোনো একটা প্রতিষেধক খোঁজে। মেয়েটা একটু এগিয়ে এসেছিল। বাবারা আড্ডায় মেতে উঠলে আমি পাশের ঘরে বা বারান্দায় একা বসে থাকি। খোঁজখবর করতে এসে একটু নরম–সরম, একটু আদুরে ভাবসাব। এতে আমার কিছু হতো না এটাই–বা কী করে বলি, আমার তো চৌদ্দ বছরই। কিন্তু আমি আমার বাবা নই, আমি পায়ের তলার মাটিটাকে ছোটবেলা থেকেই বেশ চিনি। কোথায় শল্য চিকিত্সা আর কোথায় হার্ডওয়্যারের কাউন্টারে বসে টাকা গোনা—এ দুটি কাজের ধারভারের ব্যবধান কতটুকু, তা বুঝব না! টেনিস বলের মতো চঞ্চল কিশোরীর হাত থেকে আমি কোনোমতে পালিয়ে বাঁচি। আমার বাবা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, আফটার অল আমার বন্ধু তো। একদিন পানমত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে কনুই দিয়ে আমার কোমরে গুঁতা দিয়ে চোখ টিপে জানতে চায়, 'কী, ব্যাপারটা কী?'

আমি এমন রাগী ভঙ্গিতে তাকাই, লোকটা আর এগোনোর সাহস পায় না, গুটিয়ে যায়। ব্যাপারটা এখানে শেষ।

এর মধ্যে একদিন অফিস থেকে ফিরে বাবা বললেন, 'তোর সাথে একটা কথা আছে।'

চেহারার মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব, কথাটা কীভাবে আমার কাছে তুলবে এ নিয়ে দ্বিধায় আছে বোঝা যায়। বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, বড়লোক বন্ধুদের মতো আমাকেও কেমন যেন সমীহ করে লোকটা। বন্ধুদের কাছে ছোট হয়ে থাকা বোধ হয় অভ্যাসেই দাঁড়িয়ে গেল তার। বললাম, 'এত চিন্তার কী আছে বলে ফেল।'

এরপর আমার বাবা যে কথাটা বলল, সেটা সত্যি কিছুটা বিস্ময়কর। তার সাবেক স্ত্রী, মানে আমার মা ফোন করেছিল তাকে। অনেক কষ্টে নাকি নতুন ফোন নম্বর জোগাড় করতে হয়েছে, তার চেয়েও বড় কথা নানা নিয়ম পেরিয়ে মানসিক রোগীদের একটি আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফোন করেছে মহিলা। বছরখানেক এই রিহ্যাব সেন্টারে আছে। ইতিমধ্যে তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন। রিহ্যাব সেন্টারে, মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দেন, দেখা করতে আসেন না। ভালো বিপদে পড়েছে বোঝা গেল।

এসব কথা শোনার পর আমি কোনো কথা না বলে একবার বাবার মুখের দিকে তাকালাম। বেশ কয়েক মুহূর্তের জন্য একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। আমার চেহারাটা কঠিন হতে শুরু করেছিল, একটা বঞ্চনা ও অপমানের বোধ দীর্ঘকাল চেপে রাখার কারণেই হয়তো সহানুভূতির পরিবর্তে একধরনের বিদ্বেষ বোধ করছিলাম আমি। আর ঠিক তখনই আমার বাবা বলল, 'তোকে একবার নিয়ে যেতে বলছিল খুব করে, যাবি?'

এমন হাহাকারের মতো শোনাল গলাটা, আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। বললাম, 'কেন?'

'হ্যাঁ, ঠিকই তো, কেন? আমরা কেন যাব?' আমার কথায় সায় দেওয়ার জন্যই যে এই কথাগুলো বলা তা বেশ বুঝতে পারি। অথচ যাওয়ার জন্য ছটফট করছিল লোকটা।

শেষ পর্যন্ত আমরা গিয়েছিলাম। দুঃসময়ে মানুষ কতটা বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে আমার এককালের অসাধারণ সুন্দরী মাকে দেখে তা টের পেলাম। এই কবছরে একেবারেই বুড়িয়ে গেছে। তার চেয়েও বড় কথা, চোখের দৃষ্টিটা অস্বাভাবিক। তবে মানসিক হাসপাতালে রাখার মতো রোগী নয়। আমাদের দেখে আমার মা কাঁদছিল, আর বারবার অনুরোধ করছিল তাকে আমাদের সঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে।

আমার বাবা নির্বাক ছিল বলেই আমাকে বলতে হয়েছিল, 'তা কী করে সম্ভব, তুমি এখন অন্য একজনের স্ত্রী।'

আমার মা নিশ্চিত করে বোঝাতে চাইল, ওই লোক এতে বাধা তো দেবেই না, বরং মুক্তির আনন্দ অনুভব করবে। আমরা সেদিন তার কাতর অনুনয় উপেক্ষা করে ফিরে এসেছিলাম।

দুদিন ধরে বাবাকে বিষণ্ন লাগছিল। প্রতারণা, অর্থাভাব ও অসম্মানের মধ্যে যে লোকটা অভিব্যক্তি গোপন করার অসাধারণ কৌশল আয়ত্ত করে ফেলেছিল, সেই লোকটাও যেন নিজেকে আর লুকাতে পারছে না। এক ছুটির দিনের সকালে বললাম, 'আমার মাকে ওই রিহ্যাব সেন্টার থেকে নিয়ে এলে ভালো হয়, কী বলো?'

মুহূর্তে ঝলমল করে উঠল সকালবেলার আলো, একবার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে, যখন নিশ্চিত হলো ঠাট্টা নয়, আমি সত্যিই ফিরিয়ে আনতে চাই তার সাবেক স্ত্রী, অন্যের সঙ্গে চলে যাওয়া স্ত্রীকে, তখন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল নিতান্ত শিশুর মতো।

'আমাদেরই তো ফিরিয়ে আনা উচিত, এই সময়ে আমরা না আনলে আর কে আনবে? আমরা আবার আগের মতো থাকব। টাকাপয়সার অভাব তো সব সময় ছিল...মরে তো আর যাব না...।' খুব জোরের সঙ্গে প্রায় অর্থহীন কিছু কথা বলে যাচ্ছিল আমার বাবা।

আমার খুব ইচ্ছে করছিল সেই অদ্ভুত কবিতাটি একবার আবৃত্তি করি, 'দুরকম বন্ধু আছে পৃথিবীতে...।' কিন্তু ভাঙা আর গমগমে গলা তো আমার নয়, তাই আবৃত্তি করা হয় না।

ওই দিন সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে পড়লাম আমরা। দুই বন্ধু মিলে তৃতীয়জনকে আনতে যাচ্ছি।

লেখক: বিশ্বজিৎ চৌধুরী
 

Users who are viewing this thread

Back
Top