What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

ইতিহাসের আলোয় কান্তজির মন্দির, রামসাগরের জল (1 Viewer)

Bergamo

Forum God
Elite Leader
Joined
Mar 2, 2018
Threads
9,649
Messages
117,051
Credits
1,241,096
Glasses sunglasses
Berry Tart
Statue Of Liberty
Profile Music
Sandwich
VbxyvAi.jpg


৯ ঘণ্টার দীর্ঘ পথ। বেয়াড়া ধুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ে এসে যখন হানা দিচ্ছে জানালা দিয়ে, তখন বিমানের মতোই যেন শহর, জনপদ অতিক্রম করে ছুটছে তো ছুটছেই দূরপাল্লার বাস। জানালার পাশে সিট। কানে এয়ারফোন। ভ্যাপসা গরমে শরীর কাহিল হলেও ঘামে ভেজে না। তবে মাঝেমধ্যে ধুলোবালির তরঙ্গ থেকে উঠে আসা ঝাপটাটা প্রশান্তির খোরাক জোগায় বৈকি।

দেখলাম, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে আসার পর একটি পথ ভাগ হয়ে ডান দিকে চলে যায়। ঢলে পড়া সূর্যটার দিকে তাকাতে তাকাতে অনেকগুলো দোকানপাট আর মানুষের হল্লা, মনে করিয়ে দিচ্ছে এখানে ব্যবসাটা সত্যি রমরমা। মরিচ-ভুট্টার জন্য বিশেষায়িত গাইবান্ধার রসমঞ্জরির স্বাদটাও পুনরায় চেখে দেখার লোভ হয়! কিন্তু জানি না, আজকাল ইন্দ্রিয় সংযত রাখার কৌশলপদ্ধতির সঙ্গে কীভাবে যে স্বতঃস্ফূর্ত সংযোগ ঘটেছে! গন্তব্য তাই উত্তরবঙ্গের সুনসান নীরবতার শহর দিনাজপুর।
ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে দিনাজপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুটি বাংলা ছবিতে আঁখিপাত যেমন হলো, তেমনি কয়েকটি হারানো দিনের জনপ্রিয় বাংলা গানের শ্রবণও সমাপ্ত হয়ে গেল। জানি, দিনাজপুর বিখ্যাত তার সুগন্ধি আতপ চালের জন্য। আছে কাটারিভোগ চাল। দিনাজপুরের চায়না ৩ লিচু সারা দেশে বিখ্যাত তার স্বাদের জন্য। চিড়া এবং খইয়েরও খুব সুনাম ওই অঞ্চলের। আছে মসুর ডালের সুস্বাদু পাপড়। পিঠাপুলির মধ্যে আছে নুনিয়া পিঠা, গুড়গুড়ি পিঠা অনেকে একে কুকুর ঢেলাও বলে থাকে। আর আছে শিদল। কচু, পুঁটিমাছ আর নানা শাকপাতা মিশিয়ে গাঁজন পদ্ধতিতে তৈরি হয় এই শিদল।

চারদিকে সবুজের আবহ। গলিতে গলিতে ধূপধুনার গন্ধ। কোথাও কামিনী, কোথাও বা বেলি আবার কোথাও সন্ধ্যামালতীর মিষ্টি সৌরভে ভরপুর চারি ধার। প্রতিটি বাড়ির গেট থেকে ফুলের টবে ছাওয়া। এমনকি বাড়িতে ঢোকার সদর দরজাটিও মনে হচ্ছে সবুজের দখলে! পলকা বাতাসে শরীর যেমন জুড়োচ্ছে, বৃষ্টিও নামি নামি করছে। এ রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি মুহূর্তে, শহরের কালীতলায় বহুকাল বাদে অ্যাডভোকেট দিলারার সঙ্গে দেখা। রিমেম্বার মেশিন ঘেঁটে ল কলেজজীবনের নানা রঙের স্মৃতি হাতড়ায় দিলারা। ড্রয়িং রুমের বুকশেলফ, দেয়াল, আলো, শৌখিন উপকরণ—সবকিছু নিরীক্ষণে ফুটে উঠেছে গৃহকর্তার রুচি ও সৃজনশীলতা। ইতিমধ্যে বৈঠকখানায় প্রবেশ করেছেন দিনাজপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, দিলারার বাবা আমার অতীব শ্রদ্ধাভাজন অ্যাডভোকেট আবদুল হালিম সাহেব। নানা বিষয়ে খোশগল্প জমে ওঠে। চা পর্ব শেষে মামলার নথিপত্র গোছাতে গোছাতে, আমাদের সঙ্গে প্রাণরসে মেতে ওঠেন তাঁর আইনজীবী সহকারী রাধাগোবিন্দ রায়ও।

শেষে দিনাজপুর প্রসঙ্গ আসতেই, সিনিয়র এই আইনজীবী তাঁর বিদ্যে বোঝাই চৌকস মাথা দিয়ে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যান দিনাজপুরের সুদূর অতীতের গর্বিত ইতিহাসের চুম্বক অংশে। টগবগে ঘোড়ার মতো আমরাও ছুটতে থাকি ইতিহাসের মসৃণ পথ ধরে।
তিনি বলেন, পলাশি প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার আট বছর পর দিনাজপুর জয় করে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। তখন ওখানে ছিল ঘোড়াঘাট নগরী। ঘোড়াঘাট দুর্গ দখলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে ইংরেজরা ওই সরকার এবং নগরটিরও পতন ঘটায়। তবে ভিনদেশি ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজ্যারম্ভের সূচনায় ওই অঞ্চলের রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, ওনার নাম 'দিনারাজ' থেকে সৃষ্টি করে দিনাজপুর জেলা। বর্তমান দিনাজপুর জেলা পূর্বের সেই দিনাজপুর রাজ্যের সামান্য এক খণ্ডাংশ মাত্র। আদি সেই দিনাজপুরের বৃহৎ একটি অংশ আমাদের থেকে বেহাত হয়ে চলে গিয়েছে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যে।

2ZVSbo5.jpg


নয়াবাদ মসজিদ

কোম্পানি সরকার কর্তৃক উত্তরবঙ্গ শাসনের জন্য যে বৃহৎ স্থায়ী জেলার কথা আমলে নেওয়া হয়, তার জেলা শহর স্থাপিত হয় পুনর্ভবা নদীতীরে দিনাজপুর নামক মৌজায়। কোম্পানি শাসন অবসানের পর ব্রিটিশ রাজ আমলেও একই মৌজায় স্থায়ী জেলা প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে দিনাজপুর শহর। দিনাজপুরে জেলা স্থাপিত হওয়ার শতাধিক বছর পরে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় দিনাজপুর পৌরসভা। বর্তমান দিনাজপুর জেলা অস্তিত্বে আসে প্রাচীন দিনাজপুর রাজ্যের কয়েক দফা বিভাজনের মাধ্যমে। এর মাঝে সর্বশেষ ১০০ বছরে দিনাজপুর বিভাজিত হয় তিনবার। বিস্ময়কর বটে!
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিভাজিত হয় দিনাজপুর। তখন দিনাজপুরের কেন্দ্র তথা মূল অঞ্চলটি বাংলাদেশে পড়ে। ভারতের অংশটি পশ্চিম দিনাজপুর নামে পরিচিত হয়, যা পরে আবার ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর নামে পৃথক দুটি জেলা গঠিত হয়েছে। আর বাংলাদেশের অংশটি বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা। ১৯৮৪ সালে ভেঙে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় নামে তিনটি জেলা গঠন করা হয় এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের কিয়দংশ রংপুর ও নীলফামারী জেলার অন্তর্গত হয়।

দিনাজপুর জেলার বর্তমান আয়তন ৩৪৩৮ বর্গকিলোমিটার। তবে পূর্বে এই অঞ্চল আয়তনে ছিল সুবিশাল। পাল রাজবংশের চরম উন্নতির সময়ে দিনাজপুর রাজ্য বর্তমান রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অধিকাংশ অঞ্চল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি বড় অংশজুড়ে বিস্তৃত ছিল। ভারতের বিহার রাজ্যের সামান্য একটি অংশও এই সুবিশাল দিনাজপুর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

NicrqWx.jpg


কান্তনগরে লেখক

এতক্ষণ তন্ময় হয়ে শুনছিলাম উত্তরবঙ্গের একটি জেলার ইতিহাস। যখন শেষ হলো,তখন এক গম্ভীর থমথমে পরিবেশ। দিলারা লাস্যময়ী। প্রশংসার নিরিখে বললে গানের গলাও জবাবহীন, সংগীতের তালিম নিয়েছিল নিমতলায় অবস্থিত দিনাজপুর সংগীত কলেজে। সে সুরেলা গলায় গান ধরে, 'মন মোর মেঘের সঙ্গী/ উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে/ নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সংগীতে/ রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম'…
গান শুনতে শুনতেই তৃপ্তির জোয়ারে রাত বাড়ে। বাইরে কুকুরগুলো সমস্বরে ডাকছিল, উচ্চ স্বরে তিনবার ডাকার পর কে যেন তাদের থামিয়ে দিল।

কর্তা আহার পর্ব সারতে মেহগনিরাঙা ডাইনিং টেবিলে ডেকে নিয়ে গেলেন। খাবার ঘরটি বেশ প্রশস্তই বলা যায়। এক পাশে সেগুন কাঠের দেরাজ। টেবিলে লাল বর্ডারের সাদা চিনেমাটির প্লেট, লতাপাতায় ডিজাইন করা আগেকার দিনের গ্লাস। সঙ্গে হ্যাঙ্গিং ল্যাম্প শেডে নান্দনিক স্পর্শ; সাবেক বনেদিআনার চিত্রকে সম্মুখে মেলে ধরল। প্রথম দফায় কাটারি চালের ভাতের ঘ্রাণ আর গরুর ভুনা মাংসের ম্যাজিকে নয়ন পরিতৃপ্ত হলে, আরও ভালো লাগা বাড়িয়ে দেয় একটি হাফ প্লেটে সাজিয়ে রাখা পেঁয়াজের সালাদ। বাহ্ বলে পাচকের প্রশংসা করতে না করতেই যেন ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে টেবিলে এসে হাজির হয় এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী আলুর ডাল-ডিম; তৎসঙ্গে পোলাও চাল, বুট এবং সুগন্ধি মসলার সমন্বয়ে তৈরি বুট-বিরিয়ানিও! স্বাদ নিয়ে মনে হলো, এ যেন বহুদিন পর কাঙ্ক্ষিত অধরাকে ধরতে পারা! মেহমানদারির বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার ভেতর তলিয়ে ভাবছিলাম, বাংলাদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য কী হতে পারে? ঘনবসতির সঙ্গে এখানে প্রতি ১০ কিলোমিটার পরপর কথ্য ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভাসের রীতিমতো পরিবর্তন হয়ে যাওয়া!

কালীতলায় রিকশা খুঁজে হয়রান হতে হতে টংঘরে এসে চা খেলাম। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উত্তরবঙ্গের জনাকয়েক সহজ-সরল মানুষের দিকে তাকাই! প্লাস্টিকের চেয়ারটি এগিয়ে দিতে দিতে একজন মায়াময় ইশারায় বসতে বললেন, যেন ঢাকা থেকে কোনো বড় বাবু আজ তার শহরে গিয়েছে বেড়াতে!

অধিক রাতে হোটেলে ফিরে, একটু বেলা করে ঘুম ভেঙেছে মালদাহপট্টির ইউনিক রেসিডেন্সিয়াল হোটেলে। শরীরে চনমনে আমেজ। প্রাকৃতিকভাবে বাতাসের দুর্গন্ধ দূর করে এয়ারফ্রেশনার যেমন চমৎকার আমেজ ছড়িয়েছে, তেমনি সীমিত আওয়াজে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শোনার ব্যবস্থাটাও মন্দ না। মনে হলো, বাহ্, অফিস ট্যুরে এসেও সময়টা কাটছে চোখের আরাম আর মনের আনন্দে!

u0oxMj1.jpg


কান্তনগরে আরেকটি স্থাপত্য

একটু পরেই আমাকে অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে যেতে হবে, দিনাজপুর জেলা জজ আদালতে। জানিয়ে রাখি, এই নিয়ে কোম্পানির কাজেই অন্তত বেশ কয়েকবার এই জেলা শহরটিতে আমার পদার্পণ ঘটেছে। যতবার শহরটিতে আসি, প্রতিবারই নতুন কিছু আবিষ্কার! আচ্ছন্ন করে মোহের ব্যারিকেড ভেঙে মুগ্ধতার মনভোলানো বিভ্রমও!
মুন্সীপাড়া, নিমতলা, গণেশতলা, ক্ষেত্রীপাড়া, কায়াপট্টি, বসুনিয়াপট্টি কিছুটা ব্যবসায়িক, আবার কিছুটা আবাসিক। পশ্চিম দিকে আরও একটু হেলান দিলেই নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাটি ষষ্ঠীতলা, বালুয়াডাঙ্গা, ঘাসিপাড়া, চাউলিয়াপট্টি এবং পূর্ব দিকে রিকশা বা ইজিবাইকে চড়ে এগিয়ে গেলে দেখবেন বালুবাড়ী মহল্লার ঘনবসতি। ষষ্ঠীতলা, ঘাসিপাড়া, কালীতলা, বড়বন্দর, বালুবাড়ী। বড় মাঠের পশ্চিমে মিশন রোড। রাস্তাগুলো জীর্ণ, কোথাওবা ভাঙাচোরা; তবে দৃশ্যকল্পের মাদকতায় একেবারে নির্ভেজাল।

দিনাজপুর শহরের মালদাহপট্টি এলাকা...শত বছরের পুরোনো দালানের পাশে বহুতল অট্টালিকা থাকলেও এখানেই যে কয়েকটি। স্ট্রিট ফুড-রেস্তোরাঁয় লোকজনের ভিড়। দেশের অন্য জেলা সদরের মতো এ শহরে আলিশান দালানের সাড়ম্বর প্রকাশ নেই; এর পরিবর্তে আছে পুরোনো আমলের ঘরবাড়িকে অবিকৃত রেখে বাংলার ঐতিহ্যটা ধরে রাখার প্রচেষ্টা।

বিয়ে, গায়েহলুদ, বাদ্যবাজনা, উলুধ্বনি, রান্না, অতিথি আপ্যায়নসহ হিন্দু শাস্ত্রমতে সব আয়োজনই ছিল। তবে বর-বধূ ছিল বৃক্ষ। মহাধুমধামে বৃক্ষের এমন বিয়ে ঘটেছে বড় কালীমন্দিরের সামনে। জমজমাট এই বিয়ের আয়োজনে মন্দিরপ্রাঙ্গণ ভক্ত-পুণ্যার্থীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।

6S1pC0C.jpg


বট ও পাকুড় গাছের বিয়ে

শাড়ি পরে টোপর মাথায় দিয়ে বউ বটেশ্বরী ও ধুতি-পাঞ্জাবি টোপর মাথায় দিয়ে বর পাকুড়। বিয়ে সন্ধ্যায়, তার আগেই হিন্দু শাস্ত্রমতে বাদ্যবাজনা, সনাতন আচার পালন, বরযাত্রীর আগমন ও অতিথি আপ্যায়ন—সবকিছুই পালন করা হয়েছে নিয়ম মেনে। বিষয়টি ছিল গল্পের মতো। জেলা জজ আদালতে লোকমুখে শুনে অদ্ভুত এ কাণ্ডটি সরেজমিনে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারিনি! দ্রুতবেগে ছুটলাম জেলা শহরের পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে দিঘন বড় কালীমন্দিরে। এই বিয়ের আয়োজন করেছেন দিঘন ও গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁরা নিজেরাই চাঁদা তুলে এই বিয়ের খরচ জুগিয়েছে। সন্ধ্যায় বিয়ে হলেও এই বিয়ে ঘিরে এলাকায় ছিল ব্যাপক চাঞ্চল্য। আর তাই দুপুরের আগেই মন্দিরপ্রাঙ্গণ ভরে ওঠে মানুষের পদাচারণে। সেখানে অনেকেই জানালেন, বট ও পাকুড়ের বিয়ে মানেই মঙ্গল আগমন। আর তাই অতি আগ্রহে এবং মঙ্গল কামনায় এই বিয়েতে এসেছেন।

পরের দিন প্রশান্তির বৃষ্টিটা নামল। মাতাল বেগে ভিজিয়ে দিতে লাগল শহীদুল সাহেব ও আমাকে। সইবে না জেনে চালকের আসন থেকে নেমে কোনোমতে বাইকটিকে ব্যালেন্স করে একটি দোকানের ভেতরে সেঁধিয়ে পড়লেন শহীদুল সাহেব। ইতিউতি তাকাতেই দেখলেন, তার আগেই নিরাপদ সুরক্ষাবলয়ে ঢুকে পড়েছি আমি। শহীদুল সাহেব ডেপুটি ম্যানেজার এবং আমার অফিস কলিগ। বাইকে চড়ে আমরা রওনা দিয়েছি কান্তজির মন্দির পরিদর্শনে।

কান্তজির মন্দির শ্রীকৃষ্ণের জন্য নিবেদিত। কালিয়াকান্ত জিউ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপনের জন্যই মন্দিরের নামকরণ হয়েছে কান্তজিউ, কান্তজি বা কান্তজির। মন্দিরটির সুবাদে এলাকাটি কান্তনগর নামে পরিচিতি পায়। সে জন্য পরবর্তী সময়ে এর আরেক নাম হয়ে যায় কান্তনগরের মন্দির।

অভাবনীয় নির্মাণশৈলী চোখ নতজানু করে দেয়। জানলাম, নির্মাণকালে মন্দিরটির চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। তিনতলায় নির্মিত এই মন্দিরের গঠনশৈলী স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন। তবে এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো সারা দেহে বসানো পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটার অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্য। প্রায় ১৫০০০ টেরাকোটার ফলকসমৃদ্ধ এই মন্দির ছিল অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে সুন্দর মন্দির। শুধু তা–ই নয়, অবিভক্ত ভারতের ১১তম আশ্চর্য ছিল এটি।

তবে পোড়ামাটির ফলকগুলোর বিশেষত্ব আসলে অন্যখানে। এগুলো সাধারণ কোনো টেরাকোটার কাজ নয়। এর গায়ে লাগানো প্রতিটি ফলকে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। তবে কিছু ফলকে মুঘল আমলের চিত্রবর্ণনাও দেখা যায়। তবে এসব ফলকের উপস্থাপন ছিল অনন্য, যা অন্যান্য টেরাকোটার নিদর্শনে দেখা যায় না। এর স্তম্ভের কার্নিশে সমসায়িক জীবন ও অভিজাত শ্রেণির শিকারের দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে মুঘল জীবনব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। মুঘল বাদশাহদের শিকার ও কারুকার্যখচিত রথের দৃশ্যায়ন দেখা যায় এ ধাপে। তৃতীয় ধাপে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনির বিবরণ। রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি বর্ণিত আছে এই অংশে।

V7HzsSN.jpg


কান্তজির মন্দিরে অপরূপ টেরাকোটা

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, সীতার বনবাস, বাকাসুর হত্যা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক কাহিনি স্থান পেয়েছে এই ধাপে। তবে এই ধাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লৌকিক উপস্থাপন। শ্রীকৃষ্ণের কাহিনিসমূহকে এখানে জনসাধারণের জীবনের মতো চিত্রায়িত করা হয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক গল্পকথা। পৌরাণিক কাহিনির লৌকিক উপস্থাপনে তাই কারিগরদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার এক অনন্য নিদর্শন এই ফলকগুলো। শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরের নির্জন এই কান্তনগরে হাঁটতে গিয়ে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শিবমন্দির ও সংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া বিশাল দিঘির সন্ধানও পেয়ে গেলাম।

এই মন্দিরে ব্যবহৃত এত উৎকৃষ্ট টেরাকোটার ফলক আপনি দেশের আর কোথাও দেখতে পাবেন না। কান্তজির মন্দিরের বিখ্যাত রাসমেলা দেখতেও চলে যেতে পারেন উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন জেলা দিনাজপুরে। কান্তনগরের শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর কাছে নিঃসন্দেহে আকর্ষণের। আর হ্যাঁ, কান্তজির মন্দির ভ্রমণের বোনাস হিসেবে দেখতে পাবেন ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদও। একটু জানিয়ে রাখি, কান্তজির মন্দির নির্মাণের জন্য ভারত থেকে আসা মুসলমান স্থপতিরা নিজেদের জন্য এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এখানেও মধ্যযুগীয় নির্মাণশৈলীর দেখা পাওয়া যায়।

রূপকথার কোনো স্বপ্নপুরী নয়। এটি একটি দৃষ্টিনন্দন পিকনিক বা বিনোদন স্পট। নাম স্বপ্নপুরী। দলবেঁধে পিকনিক অথবা ঘুরতে যাওয়ার জন্য উত্তরবঙ্গসহ সারা দেশের মানুষের পছন্দের জায়গা। দিনাজপুর শহর থেকে ফুলবাড়ী হয়ে একটু ভেতরের দিকে গেলেই দেখা মিলে স্বপ্নপুরীর। ১৯৯০ সালে প্রায় ৪০০ বিঘা জমির ওপর এটি তৈরি করা হয়। উত্তারাঞ্চলসহ বহু দূর থেকে মানুষ এখানে আসে মূলত পিকনিক করতে। এখানে কৃত্রিম ছোট চিড়িয়াখানাসহ চিত্তবিনোদনের নানা সামগ্রী রয়েছে। চিড়িয়াখানাটিও কম সমৃদ্ধ নয়। উত্তর জনপদের মানুষকে দেশ-বিদেশের বহু পশু-পাখির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে এটি।

জীবন্ত চিড়িয়াখানায় প্রবেশের সময় বাংলার ঐতিহ্য বিশ্বখ্যাত বেঙ্গল টাইগারের মুখাকৃতির এ প্রধান ফটকটি পর্যটকদের শিহরিত ও রোমাঞ্চিত করে। সুবিশাল স্বপ্নপুরীর স্থানে স্থানে রয়েছে চমৎকার বিশ্রাম ছাউনি। অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত স্বপ্নপুরীর বাগানে রয়েছে ঘনপাতা, লতাগুল্ম উথিত ঢেউবেষ্টনীর মাঝে বাগানবিলাসের সমারোহ। নিপুণ হাতের যত্নের পরশে বাগবাগিচার সৌন্দর্যে স্বপ্নপুরী পেয়েছে জীবন্তরূপ।

IAMrtky.jpg


রামসাগর দিঘির সামনে লেখক

ঢাকা থেকে 'সাগর' শব্দ শুনে কেউ হকচকিত হলেও এটি আসলে একটি দিঘিমাত্র। চোখে শীতলতা ছড়াল কেবলই দিঘির বিশালতা। দিনাজপুর জেলার তাজপুর গ্রামে অবস্থিত মানবসৃষ্ট দিঘিটি। এটি স্বচ্ছ নীলাভ জলের দ্যোতনায় বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় দিঘি। প্রশস্ত পাকা রাস্তা ধরে পুরো রামসাগর হেঁটে ঘুরে দেখতে দেখতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় ফুরিয়ে গেল। দিঘির পাড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, সেগুন, আমলকী, হরীতকী, দেবদারু, জারুল, কাঞ্চন, নাগেশ্বর, কাঁঠালিচাঁপা, বটসহ প্রায় দেড় শতাধিক গাছ যেন পর্যটকদের রাত প্রহরী হয়ে কাজ করছে! আর সতেজ অনুভূতির ঘ্রাণ ছড়াতে রয়েছে হরেক রকমের ফুল গাছ।

বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি, রাস্তাজুড়ে টুকরো টুকরো রুপালি আলো–ছায়ার খেলা। বাতাস ভরে ছিল অদ্ভুত এক মিষ্টি গন্ধ। অস্ফুট উচ্চারণে যেন নিজেকেই বলি, 'বুনো ভেষজ আতরের গন্ধ নয় তো?' ক্লান্তিতে ঘাসের মধ্যে কিছুক্ষণ বসার পর উঠে পড়লাম; পায়ের শব্দ আর চাপা স্বরের কথা শুনে। নির্জন জায়গা, আমার একটু ভয়ও করতে লাগল! পরে দেখলাম, ছায়ার আড়ালে চুপ করে নিজেদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সারছিলেন দুজন মধ্যবয়স্ক কৃষক। তারা আমাকে অভয় দিলেন। কোথা থেকে এসেছি? সেটা জানার জন্য অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়লেন।

লাঙল-গরুর জীবনযুদ্ধ। সারা বছর চাষাবাদ আর বছর শেষে মহাজনের ঋণের বোঝা; তবু তাদের সুখী সুখী ভাব যেন এক পজেটিভ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি! টিপসই দেওয়া এই মানুষগুলো বোঝেন না নানা প্রতিষ্ঠানের ছলা–কৌশল, চিনেন না কৃষির নব্য গজিয়ে ওঠা মধ্যস্বত্বভোগীদেরও! তাঁরা শুধু বোঝেন কায়িক শ্রমে অর্জিত মাঠের পর মাঠে পড়ে থাকা পাকা ধান। হাতে থাকা কীটনাশক ঘাসের ওপরে রেখে অতি আনন্দে যখন দুজনেই আঙুল দিয়ে দেখাতে থাকলেন, উত্তর থেকে দক্ষিণে মাইলের পর মাইল এই শস্য সমুদ্রের বিস্তার…! এর ভেতরেও কত সব পোকা। অন্ধকারে দলে দলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে ধানের ছড়ার ওপর। আবার কখনো বা দ্রুত ধাবমান ইঁদুরের খস খস শব্দ।

সৃজন-তরঙ্গের যৌথ শ্রমে গড়া রূপবতী শস্যভান্ডার দেখে মনে পড়ে, সেই কবে একদিন এই আলপথ ভেসে গিয়েছিল তেভাগার রক্ত জোছনায়! কী ভীষণ উদ্দীপনা জাগিয়ে তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলেছিল এই অঞ্চলে। এখনকার বর্গা বা ভাগ-চাষিরা কী তা জানে? মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ পাবেন চাষি, এক ভাগ জমির মালিক—এই ছিল দাবি। এই আন্দোলনের জনক হিসেবে খ্যাত হাজী মোহাম্মদ দানেশ দিনাজপুরের সূর্যসন্তান।
সন্ধ্যা ঘনীভূত হলে ঝিঁঝির ডাক, ময়ূরের নৃত্যে যেন মন ময়ূরের মতোই নেচে ওঠে। তেমনি দিনের বেলা গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি আর দেবদারুগাছের ফাঁকে ফাঁকে আলোর কিরণমালা—যেকোনো জীবনরসিককে আনমনা করে তুলবে গ্যারান্টি দিচ্ছি।

উদ্বিগ্ন পথিকের মতো ফাঁকা চাউনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও দূর হলো, যখন অপেক্ষা শেষে পাওয়া গেল অটোরিকশা। যেদিকে ছুটছি…উপত্যকা ও এর গাছপালাগুলোকে, একে ঘিরে থাকা এলাকা থেকে সম্পূর্ণ অন্য রকম মনে হচ্ছিল। এখানে সবুজ ঝোপঝাড় এবং গাছগাছালির সমারোহ। এটার একটাই অর্থ হতে পারে: ঝানঝিরা-শিঙ্গানগরের মাঝে আত্রাই নদীর ফিরিঙ্গি ঘাট এখনো বহাল তবিয়তে। অটোরিকশা দ্রুত দৌড়াতে থাকে। নদীকে বাস্তবে চোখে না দেখা পর্যন্ত এটা যে সত্যি বইছে, তা যেন আর বিশ্বাস হচ্ছিল না।

লেখক: মোস্তফা মহসীন
 

Users who are viewing this thread

Back
Top