What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected টেমস নদীর বাঁকে (1 Viewer)

dukhopakhi

Global Moderator
Staff member
Global Mod
Joined
Mar 3, 2018
Threads
98
Messages
10,973
Credits
103,718
LittleRed Car
LittleRed Car
Camera photo
T-Shirt
Thermometer
Glasses sunglasses
প্রিয় লেখক ডাঃ আফতাব হোসেনের আরেকটি লেখা আপনাদের মাঝে নিয়ে আসলাম। এটা ভ্রমণ বিষয়ক একটি উপন্যাস। বরাবরের মতো এটাও আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে।

আসুন তবে শুরু করি



টেমস নদীর বাঁকে

মূল লেখকঃ ডাঃ আফতাব হোসেন



পর্ব-১ (লন্ডনের পথে)





ছাত্র জীবনে সেবা প্রকাশনীর বই পড়তাম খুব। বিশেষ করে মাসুদ রানা সিরিজের বই। বই কিনে পড়ার মতো সামর্থ্য হয়নি তখনও। পড়তাম ধার কর্জ করে। চেয়ে চিন্তে। কখনও সখনও চুরি চামারি করেও। কথায় বলে, এভরিথিং ইজ ফেয়ার, ইন লাভ এন্ড ওয়ার। ভালোবাসার জন্য যদি সব করা জায়েজ হয়, তাহলে বইকে ভালোবেসে সেটা চুরি করলে দোষ হবে কেন ? তবে পড়তে পড়তে মাসুদ রানার চেয়ে গিলটি মিয়ার ভক্ত হয়ে গেলাম বেশি। এ জন্য নয়, যে সে খুব চালাক চতুর ছিল। এ জন্যও নয় যে, সে গুলি মেরে টিকটিকির ডিমও উড়িয়ে দিতে পারত। বরং এই জন্য যে, সেও আমার মতো ছোট খাটো আর শুকনা পটকা ছিল। কেন যে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলাম ? বসে বসে রুগী দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। লম্বায় বাড়ার তো কোনো চান্স ছিল না। তাই আড়ে দিকে বাড়তে থাকলাম। বাড়তে বাড়তে, ফুলতে ফুলতে, এক সময় গিলটি মিয়া থেকে গাবলু মিয়াঁ হয়ে গেলাম।

খাটো এবং মোটা, এই দুটোর কম্বিনেশন যে কতটা খারাপ, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম প্লেন জার্নি করতে যেয়ে। ছোট ছোট সীট। ভালো মতো নড়াচড়াও করা যায় না। তার উপর খাটো বলে পা দুটো বিমানের মেঝে ছোঁয় না। খানিকটা উঁচুতে ঝুলে থাকে। ঝুলতে ঝুলতে ফুলে যায়। ফুলতে ফুলতে নিজের জুতাকে ছেলের জুতা বলে মনে হয়। একবার বের হলে কোনমতেই আর ঢুকতে চায় না। শেষে গাও গেরামের মানুষের মতো, জুতো বগলে নিয়ে বিমান থেকে নামার অবস্থা ! এর আগে ইরান ও সৌদি আরবে গিয়েছি। চার পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইট। কোনোমতে হাঁসফাঁস করে কাটিয়ে দিয়েছি। এবার ঢাকা টু লন্ডন, ডাইরেক্ট ফ্লাইট। বাংলাদেশ বিমান। ভাবলাম, গেট-লক সার্ভিসের মতো ফ্লাইট লক সার্ভিস। বিরতিহীন। কোথাও যাত্রী ওঠা নামার বালাই নাই। সোজা পৌঁছে যাবো ঢাকা থেকে লন্ডনে এক টানেই। তখন কে জানত, পুরা বারো ঘণ্টার জার্নি আমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে ?

দেরী করে রওনা দেয়া, এবং দেরী করে পৌঁছানো, বাঙালি জাতির ঐতিহ্য। আর বাংলাদেশ বিমান তো জাতির পতাকা বহনকারী। জাতিয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। যথারীতি তিন ঘণ্টা দেরী করে বিমান আকাশে উড়ল। এদিকে খিদেয় পেট চোঁচোঁ করছে। আরও ঘণ্টা দেড়েক পর মধ্য বয়সী বিমান বালারা এসে গোমড়া মুখে রাতের খাবার পরিবেশন করা শুরু করল। যেন বিনা দাওয়াতে বিয়ে বাড়িতে খেতে এসেছি। এখন অবশ্য বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো বেশ সুন্দরী, স্মার্ট, যুবতী মেয়েদের বিমান বালা হিসেবে নিয়োগ দেয়। আজ থেকে বিশ ত্রিশ বছর আগে, কোন যোগ্যতায় বাংলাদেশ বিমানে বিমান বালা নিয়োগ দেয়া হত, আমার জানা নেই। হয়ত যুবতী বয়সেই নিয়োগ পেত। কিন্তু লন্ডন গামী ফ্লাইটে সুযোগ পেতে পেতে তাঁদের যৌবনের সূর্য মধ্য গগণ পেরিয়ে যেত! তা না হয় গেল ! হাসতে তো আর বয়স লাগে না, পয়সাও লাগে না। কিন্তু বাংলাদেশে যে সব মেয়েরা সেবার কাজে নিয়োজিত, হোক যে বিমান বালা, রিসেপশনিস্ট কিংবা নার্স, তাদের যেন হাসতে মানা। নাকি বাঙালি মেয়েদের ধারণা, মিষ্টি করে হাসলে যাত্রী, কাস্টোমার, রুগী, সবাই তাদের প্রেমে পড়ে যাবে?

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে অনেকেই সীটটাকে পিছনে হেলিয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পরার আয়োজন করল। বিনা নোটিশেই সামনের সীটটা ঝট করে আমার নাকের ডগার উপর চলে এলো। আর একটু হলেই গোবদা নাকটা আমার থ্যাবড়া হয়ে যেত ! বাধ্য হয়ে আমাকেও পিছনে সরতে হল। তা নাহয় সরলাম। কিন্তু পা দুটো নিয়ে কী করি ? ও দুটোকে তো আর টেনে লম্বা করা যাচ্ছে না। মেঝের নাগালও পাওয়া যাচ্ছে না। মোটা বলে পা গুটিয়ে বসব, তারও উপায় নেই। ইতিমধ্যে পা ভারি হতে শুরু করেছে। সাথে টনটনে ব্যথা। ইস, পা দুটো খুলে যদি কোলে নিয়ে বসতে পারতাম ! উঠে যে একটু হাঁটাহাঁটি করব, তাতেও ঝামেলা। উইন্ডো সীটে বসেছি। হাঁটতে গেলে দুজনকে টপকে যেতে হবে। কতবার এ ভাবে যাওয়া যায় ? জানি, বিমানের জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যায় না। তারপরও মানুষ উইন্ডো সীটেই বসতে চায়। আমিও তাঁর ব্যতিক্রম নই। যেন বিমানের খোলা জানালা দিয়ে মেঘেদের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে, তারাদের সাথে গল্প করতে করতে পথটা কাটিয়ে দেব! শুরু হল জীবনের দীর্ঘতম যাত্রা। অবশ্য এই অভিজ্ঞতার পর আর কোনোদিন আইল সীট ছাড়া বসিনি।

সব রাতই এক সময় ভোর হয়। এক সময় বাংলাদেশ বিমানও লন্ডনের আকাশে উদয় হল। কিন্তু বাঁধ সাধল অন্য খানে। পাইলট জানাল, অত্যধিক ট্রাফিকের কারণে ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের আরও কিছু সময় আকাশেই ভেসে থাকতে হবে। হা কপাল ! এতদিন ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম দেখেছি। এখন দেখছি লন্ডনের আকাশেও ট্রাফিক জ্যাম! হবেই বা না কেন? পরে জেনেছি, হিথরো এয়ারপোর্ট হল ইউরোপের ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট। যেখানে প্রতিদিন গড়ে ১৩ শো ফ্লাইট ল্যান্ড করে। ব্যস্ত সময়ে কখনও কখনও প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে একটা করে বিমান নামে ! ভাগ্যিস, বিমানের পাইলটরা বাংলাদেশের ড্রাইভারদের মত না। নইলে এই ভিড়ের মধ্যে কে কার লেজে গুঁতা মেরে লেজে গোবরে পাকিয়ে ফেলত ! আর আমরাও বিলেতে নয়, সোজা স্বর্গে যেয়ে ল্যান্ড করতাম !

এতক্ষণে মনে হল, উইন্ডো সীটে বসার ফায়দাটা একটু নিই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, যেন এক গাঁদা ছাইয়ের মধ্যে প্লেনটা ডুবে আছে। ধূসর মেঘে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় আবার ঘোষণা হল, অত্যধিক তুষারপাতের কারণে জ্যাম আরও বেড়েছে। আজও মনে আছে, জানুয়ারির চার তারিখ ছিল সেদিন। ইংল্যান্ডে ভরা শীতের মৌসুম। মনে মনে শিহরিত হয়ে উঠলাম। এতদিন শুধু সিনেমাতেই লন্ডনের তুষারপাত দেখেছি। এবার স্বচক্ষে দেখব। সেই সাথে একটু শিউরেও উঠলাম। পাইলট ঠিকঠাক মতো ল্যান্ড করতে পারবে তো ?

চিলের মতো ঘণ্টা খানেক মেঘের রাজ্যে চক্কর কাটার পর শেষ পর্যন্ত আমরা সিরিয়াল পেলাম এবং নিরাপদে ল্যান্ডও করলাম। এই ফ্লাইটে প্রায় সবাই বাংলাদেশি। যদিও সবাই জানে, ল্যান্ড যখন একবার করেছে, তখন প্লেন থেকে সবাই বের হতে পারবে। তবু বাঙ্গালির যা স্বভাব, কে কার আগে নামবে, তা নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ! খেয়াঘাটে কারোই দেরী সহ্য হয় না। আমারও না। কিন্তু উপায় নাই গোলাম হোসেন। আমি তখন আমার গদা মার্কা পা দু'খানা অতি সাধের কেনা টিম্বারল্যান্ডের হেভি ডিউটি জুতোর মধ্যে ঠেসেঠুসে ঢুকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। আরে, পা কি তুলোর বস্তা যে চাপ দিলেই নরম হয়ে ঢুকে যাবে ? যদিও বা শেষ পর্যন্ত ঢুকাতে পারলাম, দাঁড়াতে গেলেই পা দুটো বলে উঠল, এতক্ষণ গুঁতাগুঁতি যা করার করছ, কিছু কই নাই। ভর দেয়ার কথা চিন্তাও কইরো না। তোমার ঐ গদাই মোড়ল শরীরের ওজন আমি বইতে পারব না। বললাম, বাপ, আর একটু সহ্য কর। বিলাতে আইস্যা কি বয়াতী বংশের পোলার ইজ্জত খুয়াবি? বাসায় নিয়া তরে ভালো কইরা তেল মালিশ কইরা দিমুনে।

জোট সরকারের মতো পায়ের সাথে একটা দায়সারা গোছের সমঝোতা করে, কেবিন ট্রলিটা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্লেন থেকে বের হলাম। বের হয়েই তো চক্ষু চড়ক গাছ। যত দূর চোখ যায়, ততো দূর লম্বা করিডোর ! পিঁপড়ার মতো মানুষের সারি। পিলপিল করে যাচ্ছে একদিকে। শুনেছি, এই এয়ারপোর্টে গড়ে প্রতিদিন দুই লক্ষ লোক ওঠা নামা করে। খাইছে আমারে ! এক পা, দুই পা'ই হাঁটতে পারি না। এই লম্বা পুলসিরাত পাড়ি দিমু কেমনে ? অবাক কাণ্ড ! কিছু মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। আবার মানুষ দাঁড়িয়ে থেকেও যাচ্ছে। মানে কী ? এতক্ষণে খেয়াল করলাম, করিডোরের এক পাশে রেলিং দেয়া। তার ভেতর চলন্ত রাস্তা। অর্থাৎ একটা মুভিং বেল্ট। মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পরে শুনেছি, এর নাম, ট্রাভেলেটর। যাক বাঁচা গেল। কিছুক্ষণের জন্য পা দুটোর নখরামি সহ্য করতে হবে না। না হেঁটেও পৌঁছে যাব গন্তব্যে !

পথ যেন শেষই হতে চায় না। হা, খোদা! এ কোথায় নামাল আমাদের ? মতিঝিলের কথা বলে গাবতলি নামিয়ে দিল না তো ? নাকি বাংলাদেশ বিমান বলে এয়ারপোর্টের শেষ মাথায় নামাল? বাঙালির প্রতি এই অবহেলা দেখেছি প্রায় সব দেশেই। আর কত ? এক ধরণের রাগ আর জিদ চাপে মনের ভেতর। ব্যাটারা দুশো বছর আমাদের রক্ত চুষেছিস। যদি সুযোগ পাই, তোদেরও রক্ত চুষে ছাড়ব। খোদা বোধহয় সেদিন আমার কথা শুনেছিলেন। পরবর্তীতে অনেক ব্রিটিশের উপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ হয়েছিল।

ইমিগ্রেশনে যেয়ে দেখি লাইন আরও লম্বা। ইউরোপিয়ানদের একদিকে, নন ইউরোপিয়ানদের আর একদিকে। ইউরোপিয়ানরা খরগোশের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর নন- ইউরোপিয়ানদের লাইন কচ্ছপের মতো এগুচ্ছে। একেক জনকে যে কত রকম প্রশ্ন করে। আরে বাবা, ভিসা দেয়ার সময় সওয়াল জওয়াব তো কম করো নাই। দাওয়াত দিয়া বাড়িতে আইনা এ ক্যামন ব্যবহার ? এক সময় আমার ডাক এলো। গাবদা গোবদা গোঁফ ওয়ালা এক মধ্য বয়সী ব্রিটিশ। বুঝলাম, আমার মতো বসে থেকে থেকে ওরও আমার মতো অবস্থা। সে একবার আমাকে দেখে, একবার পাসপোর্ট দেখে। আমি দু'চোখে বিরক্তি নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছি। হঠাৎ সে গোঁফে তা দিয়ে বলল,

- আর ইউ আ ডক্টর ?

- ইয়েস।

- ওয়েলকাম টু দা ইউকে।

বলেই ঠকাস করে এন্ট্রি সিল মেরে দিল। ব্যাস, হয়ে গেল? তেলেসমাতি কাণ্ড ! ডাক্তার হলেই সাত খুন মাফ ? পরে জেনেছি, ব্যাটাদের দেশে ডাক্তারের খুব অভাব। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যেমন বুদ্ধি হবার পর থেকেই ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখে, ওরা তা দেখে না। ডাক্তারি পড়ার প্রতি ওদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তাই তো বিদেশী ডাক্তারের উপর নির্ভর করতে হয়। ব্রিটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের এক তৃতীয়াংশ ডাক্তারই অন্য দেশ থেকে আসা।

লাগেজ বে'তে সারি সারি লাগেজ বেল্ট। ডিসপ্লে স্ক্রিনে দেখাচ্ছে কোন ফ্লাইটের লাগেজ কোন বেল্টে পাওয়া যাবে। সহজেই নির্দিষ্ট বেল্টটা খুঁজেও পেলাম। কিন্তু বেল্টে কোনো লাগেজ নেই ! বাংলাদেশে বেল্টে লাগেজ আসতে ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা লেগে যায়। তাই বলে বিশ্বের সর্বাধুনিক এয়ারপোর্টেও লাগেজ আসতে এত দেরী হবে ? হঠাৎ খটকা লাগল মনে। বেল্টের চারিদিকে তেমন কোনো বাংলাদেশীকে দেখতে পেলাম না। যারা আছে, তারা প্রায় সবাই সাদা চামড়া। ঠিক বেল্টে এসেছি তো ? প্রতিটা বেল্টের খাম্বার সাথে একটা ডিসপ্লে স্ক্রিন। তাকিয়ে দেখলাম, না, ঠিকই আছে। বিজি জিরো জিরো ওয়ান। তবে সাথে আরও একটা ফ্লাইট নম্বর। ধক করে ওঠে বুকের ভেতর। এমনিতেই ফ্লাইট থেকে দেরি করে নেমেছি। ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করতে করতে আরও ঘণ্টা খানেক লেগে গেছে। তাহলে কি কেউ আমার লাগেজ নিয়ে গেল ? ব্যাগ ভর্তি শীতের কাপড় চোপড়। বঙ্গ বাজার থেকে কেনা। শুনেছি, লন্ডনের তাপমাত্রা এখন শূন্যের কাছাকাছি। গরম কাপড় ছাড়া এই শীতে জমে সোজা বরফ হয়ে যাব। আর লন্ডনে কাপড় চোপড়ের যা দাম !

কাপড়ের কথা নাহয় বাদই দিলাম। কিন্তু বই ? মেডিকেলে ভর্তি হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত, যেখানেই গিয়েছি, বউ সাথে যাক বা না যাক, বই সাথে ঠিকই গিয়েছে। সে আমি পড়ি বা না পড়ি। সেই সব মোটা আর ভারি বই বইতে বইতে যাও আর একটু লম্বা হওয়ার কথা ছিল, তাও হওয়া হল না। এবারও সাথে করে মন দেড়েক উপর বই নিয়ে এসেছি। ভাগ্যিস, এয়ারপোর্টে একজন পরিচিত লোক ছিল। ওজন না করেই ট্যাগ লাগিয়ে বেল্টে তুলে দিল ! সে বই হারিয়ে গেলে তো আমার সারে সর্বনাশ ! সামনে কতগুলো পরীক্ষা। বই না পড়ে পরীক্ষা দেব কেমন করে ? ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। দেখে শুনে একজন এয়ারপোর্ট এটেন্ড্যান্টকে জিজ্ঞেস করলাম,

- ইজ ইট দা রাইট বেল্ট ফর বিজি জিরো জিরো ওয়ান ?

- ইয়াপ।

- বেল্টে লাগেজ আসা শুরু হয়নি এখনও ?

- হয়েছে এবং সবাই নিয়েও গেছে।

ব্যাটা কয় কী? নিয়ে গেছে মানে কী ? তাইলে আমারগুলা কই ? কাঁদো কাঁদো গলায় জিগাইলাম,

- ছার, আমার লাগেজ তো এখনও নিই নাই !

আমার গলায় বাংলা 'ছার' শুনেই হোক, কিংবা আমার রক্তশূন্য চেহারা দেখেই হোক, লোকটার মনে দয়া হল। আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,

- ডোন্ট ওরি। কাম উইথ মি।

বলে ছ' ফুটের উপর লম্বা মানুষটা আমাকে অনেকটা বগলদাবা করে নিয়ে গেল বেল্টের গোঁড়ার দিকে। দেখলাম, বেশ কিছু লাগেজ স্তূপাকারে পড়ে আছে অবহেলায়। চোখ নাচিয়ে বলল,

- হেয়ার ইউ গো। অল লেফট লাগেজেজ আর ডাম্পড হিয়ার।

একটু অবাক হলাম। লোকটা কষ্ট করে আমার সাথে না এলেও পারত ! আমাদের দেশের মতো দূর থেকেই "ওই হোথা" বলে দেখিয়ে দিলেও পারত ! দেখলাম, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চারা যেমন গলাগলি ধরে বসে থাকে, আমার লাগেজগুলোও তেমনই একই জায়গায় জড়সড় হয়ে বসে আছে। বুঝলাম, যে এয়ারপোর্টে প্রতি মিনিটে একটা করে ফ্লাইট ল্যান্ড করে, সেখানে বেল্টের নাগরদোলায় বাক্স পেটরার ঘণ্টা খানেক ধরে দোল খাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। মালিক সময় মতো নামিয়ে না নিলে ওরাই কান ধরে নামিয়ে রেখে দেয় এক কোনায়!

আমার কোনো কিছু ডিক্লেয়ার করার নাই। তাই, গ্রিন চ্যানেল দিয়েই বের হলাম। দেখলাম, পথের এক পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাস্টমস অফিসাররা। শ্যেন দৃষ্টিতে মাপছে সবাইকে। একটু সন্দেহ হলেই ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। অন্য পাশে তাকাতেই গলা শুকিয়ে তক্তা হয়ে গেল ! সাদা কালো পোশাক পরে, ঘাড়ে ভারি অস্ত্র নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু পুলিশ। না, আমি ক্রিমিনাল নই। পুলিশকে ভয়ও পাই না। ভয় পেলাম অন্য কিছু দেখে। প্রত্যেক পুলিশের হাতেই শিকল দিয়ে বাঁধা ভাল্লুকের মতো সাইজের এক একটা কুকুর। এত্তো বড় কুত্তা বাপের জন্মেও দেখি নাই। কী বীভৎস তাদের চেহারা। মুখটা এবড়ো থেবড়ো। যেন জন্মের পর হাতুড়ী মেরে কেউ থেঁতলে দিয়েছে। দশ আঙ্গুল জিভ বের করে জুলু জুলু চোখে দেখছে আমাকে। যেন ছেড়ে দিলেই এক লাফে এসে আমার কল্লাটা ছিঁড়ে নিয়ে যাবে। আমি কি শিয়াল প্রজাতির কেউ যে অমন লোভী দৃষ্টিতে দেখতে হবে ? ছেলেবেলায় কুত্তার কামড়ের কথা ভুলিনি আজও। সেই থেকে জমের মতো ভয় পাই ওদের। আমার হাত পা ভারি হয়ে গেল। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা ডাঙ্গায় তোলা টাকি মাছের মতো লাফাতে শুরু করল। অতি ভদ্র ব্রিটিশ জাতির এ কেমন অভদ্র অভ্যর্থনা ? পরে শুনেছি, ওরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর। কারও লাগেজে ড্রাগ আছে কিনা তা দূর থেকেই শুঁকে বুঝতে পারে। আমি ওদের চোখের দিকে আর না তাকিয়ে গুঁটি গুঁটি পায়ে এগুতে থাকলাম।

পঞ্চাশ গজের মতো পথ। মনে হল, ওইটুকু পথ পেরুতেই আমার পঞ্চাশ বছর লেগে গেল। বাইরে বেরুতেই শরীরটা পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে গেল ! আমি চোখ বন্ধ করে লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিলাম।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top