শব্দের রয়েছে বিচিত্র রকম অর্থ, বিচিত্র রকম প্রয়োগ। তবে অনেক অর্থ, অনেক প্রয়োগ অভিধান সমর্থন করে না। শব্দের উৎস, অর্থ আর প্রয়োগবৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের এ আয়োজন...
সৈয়দ ঘণ্টন এবার হাটে গিয়ে বুঝেছেন, অঞ্চলবিশেষের ছাগলের বিশেষ কদর আছে। ছাগল নিয়ে আগে কখনো তাকে ভাবতে হয়নি। কারণ, প্রতিবার কয়েকজনের সঙ্গে ভাগে গরু কোরবানি দেন। ভাগে দেন বলে গরু নিয়েও আসলে তাকে ভাবতে হয়নি। গরু কেনা থেকে শুরু করে গরু বানানো পর্যন্ত সব কাজ অন্যরাই করেন। তিনি শুধু নিজের ভাগটুকু নিয়ে আসেন। করোনার কারণে গত বছর ভাগে কোরবানি দেওয়া হয়নি। তাই এ বছর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ছাগল কোরবানি দেবেন। ছাগল তো আর ভাগে হয় না, তাই ঠিক করলেন একাই যাবেন হাটে।
সৈয়দ ঘণ্টনের স্ত্রী জানতেন, তার স্বামী এ কাজে বিশেষ পারদর্শী নন। একটু গলা চড়িয়েই বললেন, 'তুমি তো কখনো গরু–ছাগলের হাটে যাওনি! আর ছাগলও ভালো চিনবে না।' তারপর গলা নামিয়ে যোগ করলেন, 'চলো, দুজনেই হাটে যাই।'
সৈয়দ ঘণ্টন মনে মনে ভাবলেন, ছাগল চেনা না–চেনার কী আছে। আর তিনি না হয় ছাগল চেনেন না। কিন্তু তার স্ত্রী কি ছাগল চেনেন? স্বামীকে চুপ থাকতে দেখে স্ত্রী নিজেই আলমারির ড্রয়ার থেকে টাকা বের করলেন। তারপর বললেন, 'টাকা নিয়েছি। চলো।'
'কত টাকা নিয়েছ?' সৈয়দ ঘণ্টন বুঝে উঠতে পারছেন না, একটা ছাগল কেনার জন্য কত টাকা নেওয়া যেতে পারে।
স্ত্রী বললেন, 'কোরবানির জন্য তোমার যত টাকা বাজেট ছিল, পুরোটাই নিয়েছি। এই টাকা দিয়ে এক জোড়া খাসি কেনা যাবে।'
'খাসি কেন? বকরি হলে হবে না?' সৈয়দ ঘণ্টন লক্ষ করলেন, তিনি নিজের মতো কিছু ভাবতে পারছেন না। স্ত্রীর কথা যেদিকে যাচ্ছে, তিনি সে অনুযায়ী কথা বলছেন।
'বকরি ছাগলেও কোরবানি হয়। কিন্তু ছাগল খাসি হলে ভালো হয়।' স্ত্রী হাসি হাসি মুখে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন।
স্ত্রীর চাহনিতে কিছু সময়ের জন্য নিজেকে ছাগল মনে হলো সৈয়দ ঘণ্টনের। কিন্তু এই মনে হওয়াকে প্রশ্রয় না দিয়ে তিনি স্ত্রীর পেছন পেছন রওনা দিলেন ছাগল কিনতে। রিকশায় করে যেতে যেতে ভাবলেন, স্বামী যদি কোনো কাজে বুদ্ধিশূন্য হয়, তবে ওই কাজের জন্য স্ত্রীর কাছে ছাগল হিসেবে গণ্য হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
রিকশায় স্বামীকে চুপ থাকতে দেখে স্ত্রী কোনো কথা বললেন না। তবে পথে লোকজনকে যত ছাগল নিয়ে যেতে দেখলেন, সৈয়দ বেগম সব কটির দাম জিজ্ঞেস করলেন। এরপর রিকশা থেকে নামার সময় খুশি খুশি গলায় বললেন, 'বলেছিলাম না? এই টাকা দিয়ে এক জোড়া খাসি ঠিক কিনতে পারব!' সৈয়দ ঘণ্টন মনে মনে ভাবলেন, সবাই খাসি কোরবানি দিতে চায়; অথচ এই ঈদের নাম হয়েছে 'বকরি ঈদ'!
ঘণ্টন সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন, ছাগলের হাট আলাদা। এদিকটায় মানুষের ভিড় আছে; তবে গরুর শিংয়ের ভয় নেই। সৈয়দ দম্পতিকে দেখে একজন ছাগলের ব্যাপারী একটা বড় ছাগলের পেছনে থাপড় দেয়। ছাগলটা 'ব্যা' করে উঠতেই স্ত্রী টান দেন সৈয়দ ঘণ্টনকে। ফিসফিস করে বলেন, 'ওগুলো রামছাগল! ওদিকে যাচ্ছ কেন?'
সৈয়দ ঘণ্টন অবশ্য কোনো দিকেই যাচ্ছিলেন না। তবে স্ত্রীর হাতের টানে তিনি সামনের দিকে সরে আসেন। বড় ছাগলকে রামছাগল বলে, এটা তিনি জানতেন। তারপর হঠাৎ নিজেকেই তার রামছাগল মনে হতে থাকে। ছাগলের মতোই স্ত্রী তাকে টেনে নিয়ে এগিয়ে যান। সামনে একজনকে দেখা যায় ১০–১২টা কালো ছাগল নিয়ে বসেছে। স্ত্রী সেদিকে তাকিয়ে বলেন, 'এগুলো ব্ল্যাক বেঙ্গল। এখান থেকে নাও।'
সৈয়দ ঘণ্টন নেবেন কী, তার আগেই স্ত্রী দরদাম শুরু করে দেন। ছাগলওয়ালা বোঝানোর চেষ্টা করে, এগুলো উত্তরবঙ্গের ছাগল। লোকটার কথা বিশ্বাস করতে হয়। কারণ, তার কথায় পাবনা–বগুড়ার টান আছে। সৈয়দ ঘণ্টন জানতে চান, 'উত্তরবঙ্গের ছাগলের দাম বেশি হবে কেন?'
ছাগলওয়ালা এবার পানখাওয়া দাঁত বের করে হাসি দেয়। স্ত্রী চোখ বড় বড় করে স্বামীর দিকে তাকান। ছাগলের হাটে এসে এত বোকামির পরিচয় দিলে ছাগল কেনা যায় না। সৈয়দ ঘণ্টন আর কথা বাড়ালেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, সব অঞ্চলের ছাগল এক রকম হয় না।
শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারীর কাছ থেকেই ছাগল কেনা হয়ে গেল। রিকশায় করে ছাগল নিয়ে আসতে আসতে সৈয়দ ঘণ্টন ভাবতে লাগলেন, এখন 'অঞ্চল' শব্দটি এলাকা অর্থে ব্যবহৃত হয়। অথচ, অঞ্চল শব্দের মূল অর্থ আঁচল। আর অঞ্চল প্রভাবে মাঝেমধ্যে স্বামীরাও ছাগল হয়।
* তারিক মনজুর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক
সৈয়দ ঘণ্টন এবার হাটে গিয়ে বুঝেছেন, অঞ্চলবিশেষের ছাগলের বিশেষ কদর আছে। ছাগল নিয়ে আগে কখনো তাকে ভাবতে হয়নি। কারণ, প্রতিবার কয়েকজনের সঙ্গে ভাগে গরু কোরবানি দেন। ভাগে দেন বলে গরু নিয়েও আসলে তাকে ভাবতে হয়নি। গরু কেনা থেকে শুরু করে গরু বানানো পর্যন্ত সব কাজ অন্যরাই করেন। তিনি শুধু নিজের ভাগটুকু নিয়ে আসেন। করোনার কারণে গত বছর ভাগে কোরবানি দেওয়া হয়নি। তাই এ বছর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ছাগল কোরবানি দেবেন। ছাগল তো আর ভাগে হয় না, তাই ঠিক করলেন একাই যাবেন হাটে।
সৈয়দ ঘণ্টনের স্ত্রী জানতেন, তার স্বামী এ কাজে বিশেষ পারদর্শী নন। একটু গলা চড়িয়েই বললেন, 'তুমি তো কখনো গরু–ছাগলের হাটে যাওনি! আর ছাগলও ভালো চিনবে না।' তারপর গলা নামিয়ে যোগ করলেন, 'চলো, দুজনেই হাটে যাই।'
সৈয়দ ঘণ্টন মনে মনে ভাবলেন, ছাগল চেনা না–চেনার কী আছে। আর তিনি না হয় ছাগল চেনেন না। কিন্তু তার স্ত্রী কি ছাগল চেনেন? স্বামীকে চুপ থাকতে দেখে স্ত্রী নিজেই আলমারির ড্রয়ার থেকে টাকা বের করলেন। তারপর বললেন, 'টাকা নিয়েছি। চলো।'
'কত টাকা নিয়েছ?' সৈয়দ ঘণ্টন বুঝে উঠতে পারছেন না, একটা ছাগল কেনার জন্য কত টাকা নেওয়া যেতে পারে।
স্ত্রী বললেন, 'কোরবানির জন্য তোমার যত টাকা বাজেট ছিল, পুরোটাই নিয়েছি। এই টাকা দিয়ে এক জোড়া খাসি কেনা যাবে।'
'খাসি কেন? বকরি হলে হবে না?' সৈয়দ ঘণ্টন লক্ষ করলেন, তিনি নিজের মতো কিছু ভাবতে পারছেন না। স্ত্রীর কথা যেদিকে যাচ্ছে, তিনি সে অনুযায়ী কথা বলছেন।
'বকরি ছাগলেও কোরবানি হয়। কিন্তু ছাগল খাসি হলে ভালো হয়।' স্ত্রী হাসি হাসি মুখে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন।
স্ত্রীর চাহনিতে কিছু সময়ের জন্য নিজেকে ছাগল মনে হলো সৈয়দ ঘণ্টনের। কিন্তু এই মনে হওয়াকে প্রশ্রয় না দিয়ে তিনি স্ত্রীর পেছন পেছন রওনা দিলেন ছাগল কিনতে। রিকশায় করে যেতে যেতে ভাবলেন, স্বামী যদি কোনো কাজে বুদ্ধিশূন্য হয়, তবে ওই কাজের জন্য স্ত্রীর কাছে ছাগল হিসেবে গণ্য হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
রিকশায় স্বামীকে চুপ থাকতে দেখে স্ত্রী কোনো কথা বললেন না। তবে পথে লোকজনকে যত ছাগল নিয়ে যেতে দেখলেন, সৈয়দ বেগম সব কটির দাম জিজ্ঞেস করলেন। এরপর রিকশা থেকে নামার সময় খুশি খুশি গলায় বললেন, 'বলেছিলাম না? এই টাকা দিয়ে এক জোড়া খাসি ঠিক কিনতে পারব!' সৈয়দ ঘণ্টন মনে মনে ভাবলেন, সবাই খাসি কোরবানি দিতে চায়; অথচ এই ঈদের নাম হয়েছে 'বকরি ঈদ'!
ঘণ্টন সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন, ছাগলের হাট আলাদা। এদিকটায় মানুষের ভিড় আছে; তবে গরুর শিংয়ের ভয় নেই। সৈয়দ দম্পতিকে দেখে একজন ছাগলের ব্যাপারী একটা বড় ছাগলের পেছনে থাপড় দেয়। ছাগলটা 'ব্যা' করে উঠতেই স্ত্রী টান দেন সৈয়দ ঘণ্টনকে। ফিসফিস করে বলেন, 'ওগুলো রামছাগল! ওদিকে যাচ্ছ কেন?'
সৈয়দ ঘণ্টন অবশ্য কোনো দিকেই যাচ্ছিলেন না। তবে স্ত্রীর হাতের টানে তিনি সামনের দিকে সরে আসেন। বড় ছাগলকে রামছাগল বলে, এটা তিনি জানতেন। তারপর হঠাৎ নিজেকেই তার রামছাগল মনে হতে থাকে। ছাগলের মতোই স্ত্রী তাকে টেনে নিয়ে এগিয়ে যান। সামনে একজনকে দেখা যায় ১০–১২টা কালো ছাগল নিয়ে বসেছে। স্ত্রী সেদিকে তাকিয়ে বলেন, 'এগুলো ব্ল্যাক বেঙ্গল। এখান থেকে নাও।'
সৈয়দ ঘণ্টন নেবেন কী, তার আগেই স্ত্রী দরদাম শুরু করে দেন। ছাগলওয়ালা বোঝানোর চেষ্টা করে, এগুলো উত্তরবঙ্গের ছাগল। লোকটার কথা বিশ্বাস করতে হয়। কারণ, তার কথায় পাবনা–বগুড়ার টান আছে। সৈয়দ ঘণ্টন জানতে চান, 'উত্তরবঙ্গের ছাগলের দাম বেশি হবে কেন?'
ছাগলওয়ালা এবার পানখাওয়া দাঁত বের করে হাসি দেয়। স্ত্রী চোখ বড় বড় করে স্বামীর দিকে তাকান। ছাগলের হাটে এসে এত বোকামির পরিচয় দিলে ছাগল কেনা যায় না। সৈয়দ ঘণ্টন আর কথা বাড়ালেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, সব অঞ্চলের ছাগল এক রকম হয় না।
শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারীর কাছ থেকেই ছাগল কেনা হয়ে গেল। রিকশায় করে ছাগল নিয়ে আসতে আসতে সৈয়দ ঘণ্টন ভাবতে লাগলেন, এখন 'অঞ্চল' শব্দটি এলাকা অর্থে ব্যবহৃত হয়। অথচ, অঞ্চল শব্দের মূল অর্থ আঁচল। আর অঞ্চল প্রভাবে মাঝেমধ্যে স্বামীরাও ছাগল হয়।
* তারিক মনজুর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক