What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

জীবনানন্দের আলোকচিত্র: মুখোশের আড়ালে মুখ (1 Viewer)

আজীবন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একাকী কবিতাচর্চা করে গেছেন জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু জীবদ্দশায় যে অল্প কয়েকটি আলোকচিত্রে ধরা পড়েছেন তিনি, সেখানে অনেকের মধ্যে থেকেও কেন তিনি একা? জীবনানন্দ দাশের বিভিন্ন সময়ের ছবির সঙ্গে তাঁর জীবনকে মিলিয়ে এক অনবদ্য অবলোকন।

0lBwbXz.jpg


এখন বইপত্রে জীবনানন্দ দাশের যে প্রতিকৃতিখানা দেখা যায়, সেটি মূলত একটি গ্রুপ ছবি দেখে আলাদা করে ছাপানো হয়েছিল, মৃত্যুর পরে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের ব্যানার তৈরি এবং 'ময়ূখ' পত্রিকার জীবনানন্দ সংখ্যার জন্য। মৃত্যুর পরে গত সাড়ে ছয় দশকে তাঁর হাতে গোনা কয়েকটি একক, দ্বৈত ও দলবদ্ধ ছবির বাইরে আর কিছুর সন্ধান মেলেনি। ছবি তোলার ব্যাপারে তাঁর খুব একটা আগ্রহও ছিল না।

বোন সুচরিতা দাশের একটি ক্যামেরা ছিল এবং সেই ক্যামেরায় তিনি জীবনানন্দের অনেক ঘনিষ্ঠজনের ছবি তুললেও মৃত্যুর পরে যখন জীবনানন্দের একটি একক ছবির প্রয়োজন দেখা দেয়, সুচরিতা তা দিতে পারেননি। জীবনানন্দের স্নেহভাজন এবং 'ময়ূখ' পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ভূমেন্দ্র গুহ (১৯৩৩-২০১৫) সুচরিতার কাছে গিয়ে একটি ছবি চাইলে তাঁর জবাব ছিল, 'একে তো তাঁর মুখ নাকি তেমন ফটোজেনিক ছিল না, তার ওপর আবার হালকা টাক পড়তে শুরু করেছে। তিনি ছবি তুলতে দেন কখনো!' স্ত্রী লাবণ্য দাশের কাছে গিয়েও ভূমেন্দ্র যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁর কাছে কোনো ছবি আছে কি না, লাবণ্য তখন কিছুটা অবজ্ঞার সুরেই বলেছিলেন, 'ছবিটবি তোলানো নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা বিশেষ ছিল না। তোমাদের দাদা দেখতেও তো তেমন কিছু রাজপুত্তুর ছিলেন না।' এই যে দেখতে 'রাজপুত্তুর' ছিলেন না এবং চেহারা তেমন 'ফটোজেনিক' ছিল না—সে কারণেই বোধ হয় জীবনানন্দ দাশ কবিতায় বাংলার রূপপ্রকৃতি নিয়ে চিত্রের পর চিত্র সাজালেও তাঁর নিজের একখানা ভালো আলোকচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না।

76iVi0Q.jpg


ছবিটা দিল্লির রাজঘাটে, পরিবারের সঙ্গে

সেই প্রতিকৃতি

অন্যমনস্ক বা ক্যামেরায় লুক না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা জীবনানন্দের যে ছবিটা এখন সর্বত্র ব্যবহৃত হয়, সেটি ছিল একটি দলগত ছবি। ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে দিল্লিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন সপরিবার। ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশ তখন সেখানে আবহাওয়া অফিসে কাজ করেন। এই গ্রুপ ছবিটা অম্বুজ বসুর 'একটি নক্ষত্র আসে' (প্রথম প্রকাশ কার্তিক ১৩৭২) বইয়ের ভূমিকার আগে সংযুক্ত রয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে বাঁ দিকে থেকে দাঁড়িয়ে আছেন স্ত্রী লাবণ্য দাশ, কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ, ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশের ছেলে অমিতানন্দ দাশ। ধুতি ও পাঞ্জাবি পরা জীবনানন্দ দাশ এবং তাঁর পাশে ছেলে সমরানন্দ দাশ। ছবিটা দিল্লির রাজঘাটে তোলা।

কীভাবে এই গ্রুপ ছবি থেকে জীবনান্দকে আলাদা করে পোর্ট্রেট তৈরি করা হলো, সে কথা জানাচ্ছেন ভূমেন্দ্র গুহ। কালো বাক্সের 'গুপ্ত কাগজপত্র' খুঁজে তিনি দুটি ছবি আবিষ্কার করলেন। একটি হলুদ রঙের মোটা কাগজের খামের ভেতর অন্যান্য কাগজপত্রের চিঠিপত্রের সঙ্গে। একটি চাপা ঠোঁটের হাসিমুখ, শুধু ঊর্ধাঙ্গের, কোনো একজন অজ্ঞাতনামা অনুরক্ত পাঠককে লেখা একটা দীর্ঘ চিঠির সঙ্গে জেমস ক্লিপ দিয়ে আঁটা এবং আরেকটি দিল্লিতে কুতুব মিনারের পাশে অনেকের সঙ্গে তোলা।

ভূমেন্দ্র গুহ ('আলেখ্য জীবনানন্দ', বাংলাদেশ সংস্করণ, প্রকাশ ২০১১, পৃষ্ঠা ৭৫) বলছেন, ছবি তোলার বিষয়ে জোরালো এবং ধারাবাহিক অনীহার যেসব গল্প তাঁর ভাইবোনের কাছে শুনেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই হয় যে, দিল্লির ছবিটি তার একগুচ্ছ আত্মীয়স্বজনের জোরাজুরিতে নিশ্চয়ই তোলা। কিন্তু তার কোনো একজন অনুরক্ত পাঠককে (সম্ভবত সুরজিৎ দাশগুপ্ত) যে ছবিটি তিনি পাঠাতে চেয়েও পাঠাননি, সেটি স্টুডিওতে গিয়ে নিজেই তুলেছিলেন কি না, তা নিশ্চিত নয়।

Nkq9nqt.jpg


জীবনানন্দের কম ব্যবহৃত ছবি

অবশেষে এই ছবি দুটি নিয়েই ভূমেন রওনা হলেন কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ডি. রতনস স্টুডিওর দিকে। এর চেয়ে ভালো ছবির দোকান তখন কলকাতায় ছিল বটে, কিন্তু ভূমেন গোলদিঘি পাড়ের যে এঁদো গলিতে থাকতেন, ওই দোকানটির সাইনবোর্ডটি তার চলাফেলার কালে নজরে আসত। স্টুডিওর লোকজন দিল্লিতে তোলা গ্রুপ ছবি থেকে জীবনানন্দের ছবিটা কেটে বের করে মেজেঘষে রিটাচ করে দুটি ছবি তৈরি করে দেন। সেই ছবি দুটির একটি বড় করে বাঁধিয়ে যে ছবিটি হলো, তা দিয়েই পারলৌকিক অনুষ্ঠানের কাজটি সম্পন্ন হয়। অন্য ছবিটি যাকে বলে এক্সক্লুসিভ, তা রয়ে গেল ভূমেনের কাছে—যা পরে ছাপা হয় 'ময়ূখ'-এর জীবনানন্দ সংখ্যার আগে হেমন্ত সংখ্যায়।

এই ছবি দুটিই এখন সাধারণভাবে জীবনানন্দবিষয়ক সর্বপ্রকাশনায় জড়িয়ে রয়েছে। তাঁর সময়ের এমনকি তাঁর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও অজস্র ছবি যেখানে দেখা যায়, জীবনানন্দ সেই ভিড়ের ভেতরে একা। ব্যক্তিজীবনে যে একাকিত্ব—ছবির ক্ষেত্রেও তা–ই।

কীভাবে এই গ্রুপ ছবি থেকে জীবনান্দকে আলাদা করে পোর্ট্রেট তৈরি করা হলো, সে কথা জানাচ্ছেন ভূমেন্দ্র গুহ। কালো বাক্সের 'গুপ্ত কাগজপত্র' খুঁজে তিনি দুটি ছবি আবিষ্কার করলেন। একটি হলুদ রঙের মোটা কাগজের খামের ভেতর অন্যান্য কাগজপত্রের চিঠিপত্রের সঙ্গে। একটি চাপা ঠোঁটের হাসিমুখ, শুধু ঊর্ধাঙ্গের, কোনো একজন অজ্ঞাতনামা অনুরক্ত পাঠককে লেখা একটা দীর্ঘ চিঠির সঙ্গে জেমস ক্লিপ দিয়ে আঁটা এবং আরেকটি দিল্লিতে কুতুব মিনারের পাশে অনেকের সঙ্গে তোলা।

যিনি আজীবন নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছেন, শনাক্ত হতে চাননি, স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে প্রশ্রয় দিয়েছেন নিজের প্রসঙ্গে নানা কৌতূহলোদ্দীপক বিভ্রান্তিকে—তিনি ছবি তোলার সময়ে যে ক্যামেরায় তাকাবেন না—সেটিই তো স্বাভাবিক। কল্যাণকুমার বসুর (রবীন্দ্রনাথ অতুলপ্রসাদ জীবনানন্দ এবং একজন প্রবাসী বাঙালী, পৃষ্ঠা ৭৭) ভাষায়, 'জীবনানন্দ নার্ভাস প্রকৃতির ছিলেন। চোখের দিকে তাকাতে পারতেন না। গলা নিচু ছিল, সেই কারণে ছেলেদের পড়াতে একটু অস্বস্তি বোধ করতেন। একাকী নিঃসঙ্গ কবি। তাঁর হাঁটাচলা দেখেও মনে হতো তিনি বড় নিঃসঙ্গ।'

TWVVT9P.jpg


মা কুসুমকুকামীর মৃতদেহের পাশে জীবনানন্দ ও পরিবারের লোকজন

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় (হ্যারিসন রোডে আরও গভীর, অসুখ, এই পোর্টেট ছবিটার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, 'আমাদের সাহিত্যে যাঁরা তাকে নিঃসঙ্গ ও একাকী অস্তিত্ব ভাবতেন, তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন এই কবির মেধাবী মুখোশে। এই মুখোশের আড়ালে আছে মুখ। আত্মা যেমন ছলনা করে যায় শরীরকে, এই মুখ তেমন পরিহাস করেছে মুখোশকে। বাস্তবিক এই আলোকচিত্রটিই আজ যাবতীয় গোপনীয়তা থেকে তাঁকে ডেকে আনছে রৌদ্রে, চৈত্রের প্রখর চরাচরে। প্রচলিত অভ্যাসের বাইরে থেকে দেখলে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, দর্শকের পরিপ্রেক্ষিতে তার সম্মুখবর্তিতা নেই। এই দৃষ্টি কেন্দ্রাভিমুখী নয়, নিবদ্ধ ও মনোযোগী কিন্তু চকিত। এই চোরা চাহনিতে একটু অন্যমনস্ক থাকার, ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা আছে।'

সুরজিতের বক্স ক্যামেরা

M7Z8N8J.jpg


সুরজিতের ক্যামেরায় জীবনানন্দ

এ–যাবৎ উদ্ধার করা চিঠিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জীবনানন্দ সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছেন স্নেহাস্পদ সুরজিৎ দাশগুপ্তকে (১৯৩৪-২০২০); যিনি 'জলার্ক' নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এ পর্যন্ত তাঁকে লেখা জীবনানন্দের ২১টি চিঠির সন্ধান মিলেছে (প্রভাতকুমার দাস, পত্রালাপ জীবনানন্দ দাশ, প্রকাশ ২০১৭, পৃষ্ঠা ৭৪)।
সুরজিৎকে জীবনানন্দ প্রথম চিঠিটি লেখেন ১৯৫১ সালের ২৮ মে। আর সবশেষ চিঠি মৃত্যুর মাত্র ১২ দিন আগে ১৯৫৪ সালের ১০ অক্টোবর। এর পরে জীবনানন্দ আর কাউকে চিঠি লিখেছেন, তার প্রমাণ মেলে না। কেননা, এই চিঠি লেখার চার দিন পরেই তিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আট দিন পরে সেখানেই মারা যান।

সুরজিতের (স্মৃতির দর্পণে তিন কবি, প্রকাশ ২০১০, পৃষ্ঠা ৫৪) ভাষ্যমতে, জীবনানন্দের কবিতার প্রশংসা করে প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও জলপাইগুড়ি থেকে তিনি যেসব ছবি পাঠিয়েছিলেন, সেগুলো দেখে জীবনানন্দের মনোজগতের ঝলক প্রকাশিত হয়েছিল। সুরজিৎকে লিখেছেন: 'জলপাইগুড়ির ঝিল, হাঁস ও শিরীষগাছের যেসব ছবি পাঠিয়েছ—অপূর্ব বোধ হলো। এখুনি ঝিলের পারে ঘাসের ওপরে আকাশের মুখোমুখি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নদী, ঝিল, পাহাড়, বন, আকাশ—কোনো নিরালা জায়গা থেকে এসবের নিকট সম্পর্কে আসতে ভালো লাগে আমার। বসে থাকতে পারা যায় যদি এদের মধ্যে, কিংবা হেঁটে বেড়াতে পারা যায় সারা দিন, তা হলেই আমাদের সময় একটা বিশেষ দিক দিয়ে (আমার মনে হয়) সবচেয়ে ভালোভাবে কাটে।'

5kd7c4J.jpg


জীবনানন্দের মা, স্ত্রী, ভাই ও অন্যরা

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েই কলকাতায় চলে আসেন সুরজিৎ। সঙ্গে একটি বক্স ক্যামেরা, যেটি দিয়ে তিনি জলপাইগুড়ির কিছু ছবি তুলে জীবনানন্দকে পাঠিয়েছিলেন। সুরজিৎ ভাবলেন এই ক্যামেরা দিয়েই তিনি বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের ছবি তুলে 'জলার্ক'-তে ছাপবেন। এ কারণে জীবনানন্দের ছবি তুলতে চান শোনার পরে তিনি সুরজিৎকে গম্ভীরভাবে বলেন, কবিতার সঙ্গে ছবিটা মেলাতে চাও? এটা কি একটা ভালো মিল হবে? তবে এ কথা বললেও সুরজিতের ক্যামেরায় নিজেকে ধরা দিতে আপত্তি না করে ইস্ত্রি ভেঙে একটা পাঞ্জাবি পরে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক আছে? বাইরে রোদের তেজ। তাই ঘরের ভেতরেই বসলেন। জানালার সামনে। ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ ছিল না। তাই জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে থেকেই কয়েকটা ছবি তুললেন সুরজিৎ দাশগুপ্ত।

সূর্য অস্ত গেল। ঘরের ভেতরে অন্ধকার ঘনাতে শুরু করেছে। ছবি তোলার জন্য পাটভাঙা সাদা পাঞ্জাবি পরে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন জীবনানন্দ। অন্ধকারে দুজন অনেকক্ষণ বাক্যহীন। শেষে সুরজিৎকে জিজ্ঞেস করলেন, কলকাতায় কত দিন আছ? 'আছি আরও দিন পাঁচেক। যাওয়ার আগে দেখা করে যাবে' বলে সুরজিৎ বিদায় নেন।

ছবিগুলো ছাপা হওয়ার পরে দেখা গেল খুবই খারাপ হয়েছে। জীবনানন্দ ছবি তোলার সময়েই সুরজিতের কাছে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন যে, ফ্ল্যাশ ছাড়া এই আলোতে ছবি ভালো হবে কি না? সুরজিতও মানছেন যে, ঘরের ভেতরে বক্স ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি তোলার চেষ্টাটাই বোকামি ছিল। কিন্তু জীবনানন্দের আগ্রহে সেই 'খারাপ' ছবিগুলোই পাঠাতে হয় সুরজিৎকে। সুরজিৎ বলছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছবিগুলো পাঠিয়েছিলাম। তবে আবার ছবি তোলার কথাও জানান। ছবি পাওয়ার পরে জীবনানন্দ ফিরতি পত্রে লেখেন, 'ফটো আবার তুলবে বলেছ; এগুলো নানা কারণে মোটেই ভালো হয়নি।'

তবে ছবিগুলো ছাপা হওয়ার পরে দেখা গেল খুবই খারাপ হয়েছে। জীবনানন্দ ছবি তোলার সময়েই সুরজিতের কাছে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন যে, ফ্ল্যাশ ছাড়া এই আলোতে ছবি ভালো হবে কি না? সুরজিতও মানছেন যে, ঘরের ভেতরে বক্স ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি তোলার চেষ্টাটাই বোকামি ছিল। কিন্তু জীবনানন্দের আগ্রহে সেই 'খারাপ' ছবিগুলোই পাঠাতে হয় সুরজিৎকে। সুরজিৎ বলছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছবিগুলো পাঠিয়েছিলাম। তবে আবার ছবি তোলার কথাও জানান। ছবি পাওয়ার পরে জীবনানন্দ ফিরতি পত্রে লেখেন, 'ফটো আবার তুলবে বলেছ; এগুলো নানা কারণে মোটেই ভালো হয়নি।'

aqhjYrm.png


বিয়ের আসরে লাবণ্য ও জীবনানন্দ

অন্যান্য ছবি

প্রভাতকুমার দাস-এর বইয়ের (জীবনানন্দ দাশ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশ ২০১৩) ৪১ পৃষ্ঠায় স্ত্রী লাবণ্য দাশের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসা একটি ছবি রয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে নবপরিণীতাকে ডান পাশে রেখে বসে আছেন তরুণ জীবনানন্দ। গায়ে সাদা পাঞ্জাবির ওপর চাদর। স্ত্রী লাবণ্যর গলায় মালা। লাবণ্যর চোখ সরাসরি ক্যামেরার লেন্সে। জীবনানন্দের চোখও ক্যামেরায়। তবে সেখানেও যেন কিছুটা আনমনা।
এই বইয়ের ৮৯ পৃষ্ঠায় আরেকটি ছবি শেষ বয়সের। এটি দেখে হঠাৎ করে বোঝা যায় না যে ইনি জীবনানন্দ দাশ। এই ছবিতেও ক্যামেরায় চোখ নেই। অন্য দিকে তাকানো। তবে রাশভারী গম্ভীর শিক্ষকের অবয়ব। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। সাদা পাঞ্জাবি। পকেটে কলম।

মৃত্যুর বছর কয়েক আগে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে শরীর যে ভেঙে যাচ্ছিল, তা স্পষ্ট ১৯৫৩ সালে নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনের পুরস্কার গ্রহণের ছবিতে। 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থের জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখকে ঘিরে সম্মেলনের উৎসব চলত সাত দিন ধরে। সে বছরই প্রথমবারের মতো এই সম্মেলন থেকে পুরস্কার ঘোষিত হয়। পুরস্কার হিসেবে জীবনানন্দকে দেওয়া হয় ১০১ টাকা (শূন্য দিয়ে শেষ হওয়া সংখ্যা অশুভ বলে এক টাকা যোগ করা হয়), একটি নারকেল (শুভ প্রতীক) এবং একটি শাল (তসরের চাদর)। ক্লিন্টন বি সিলি (অনন্য জীবনানন্দ, ফারুক মঈনউদ্দীন অনূদিত, পৃষ্ঠা ৩১৫) জানাচ্ছেন, পুরস্কারের মধ্যে ছিল ১০১ টাকা এবং এক ঝুড়ি ফল, যেখানে ছিল আপেল, বেদানা, একটি নারকেল, পাকা পেঁপে ইত্যাদি।

lgTyHTT.jpg


পারিবারিক ছবির মধ্যমণি জীবনানন্দ

কলকাতা শহরের মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠানে সভাপতি অতুলচন্দ্র গুপ্তর (১৮৮৪-১৯৬১) হাত থেকে তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন। তবে প্রায় দুই হাজার দর্শকের উপস্থিতি দেখে জীবনানন্দ আশ্চর্য হয়েছিলেন। কারণ, তাঁর ধারণা ছিল, খুব বেশি লোক তাঁর কবিতা পড়েন না। প্রভাতকুমার দাস (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৫) জানাচ্ছেন, এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে তিনি খুশি হয়েও চার বছর আগে প্রকাশিত তাঁর নবতম গ্রন্থ 'সাতটি তারার তিমির'কে বাদ দিয়ে 'বনলতা সেন'–কে পুরস্কৃত করায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। সুরজিৎকে বলেছিলেন, 'এ তো কবিকেও নয়, কবিতাকেও নয়, পাবলিকেশন্সকেই পুরস্কার দেওয়া।' উল্লেখ্য, জীবনানন্দের মৃত্যুর পরের বছর তাঁর 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' গ্রন্থটি সাহিত্য অকাদেমির প্রথম পুরস্কার লাভ করে।

MKuM0t9.jpg


জীবনানন্দের রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন পুরস্কার গ্রহণ

প্রভাতকুমারের এই বইয়ের ৯ পৃষ্ঠায় জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশের একটি ছবি রয়েছে। এটি একটি দুর্লভ ছবি। কেননা, সত্যানন্দের এ রকম স্পষ্ট এবং একক ছবি খুব একটা চোখে পড়ে না। পরের পৃষ্ঠায় মা কুসুমকুমারীও বৃদ্ধ বয়সের একটি ছবি রয়েছে।
প্রভাতকুমার সম্পাদিত 'পত্রালাপ'-এর ৩১৪ পৃষ্ঠায় সাদা পাঞ্জাবি পরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা মধ্যবয়সী জীবনানন্দের একটি ছবি রয়েছে। সম্ভবত ছবিটি সুরজিৎ দাশগুপ্তর তোলা। এটি কলকাতায় ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ির ভেতরে। আগের পৃষ্ঠায়ও অনেকটা একই ভঙ্গিতে আরেকটা ছবি। ক্যামেরায় লুক নেই। মুখের একপাশ স্পষ্ট। ডান দিকে তাকানো। ৩১৬ পৃষ্ঠার ছবিটি বেশ দুর্লভ এই অর্থে যে, এই ছবিটা খুব বেশি প্রকাশিত নয়। সাদা পাঞ্জাবি পরে চেয়ারে বসে আছেন জীবনানন্দ। পেছনে বই-খাতার স্তূপ। সুরজিৎ দাশ যে রকম পরিপাটি পাঞ্জাবি এবং আলোস্বল্পতার কথা লিখেছেন, তাতে ধারণা করা যায়, এটি সুরজিতের তোলা সেই ছবিগুলোর একটি। অর্থাৎ ল্যান্সডাউন রোডের বাসার ভেতরে। ১৯৫২ সালে।

3IztYSS.jpg


কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ট্রাম দুর্ঘটনাস্থল

জীবনানন্দ রচনাবলির (ঐতিহ্য, ২০০৬) চতুর্থ খণ্ডে স্থান পেয়েছে ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে দিল্লি ভ্রমণের সময়ের একটি পারিবারিক ছবি যেখানে দেখা যাচ্ছে কোনো একটি পার্কে একটা উঁচু জায়গা, সম্ভবত টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনানন্দ, একটু নিচে স্ত্রী লাবণ্য দাশসহ পরিবারের আরও তিন সদস্য।
এই গ্রন্থে কবির মা কুসুমকুমারী দাশের মরদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারের সদস্যদের একটি ছবিও রয়েছে, যেখানে গায়ে চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনানন্দ দাশ। কুসমকুমারী মারা যান ১৯৪৮ সালে কলকাতায়। এর আগের বছরই কবি চূড়ান্তভাবে বরিশাল থেকে কলকাতায় গিয়ে থিতু হন। এই ছবিতে কবির স্ত্রী, ভাই, বোন, ছেলে, মেয়েসহ পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যকে দেখা যাচ্ছে।

LhshCgn.jpg


জীবনানন্দের মরদেহ

রচনাবলির পঞ্চম খণ্ডে স্থান পেয়েছে কবির একটি পারিবারিক ছবি। তবে এই ছবিতে তিনি অনুপস্থিত। রয়েছেন মা কুসুমকুমারী দাশ, ছেলে-মেয়ে, ভাই ও বোন, ভাইয়ের স্ত্রী। কুসুমকুমারী মাঝখানে একটি চেয়ারে উপবিষ্ট। সেই চেয়ার ধরে দাঁড়ানো ভাই অশোকানন্দ। কুসুমকুমারীর বাঁ পাশে স্ত্রী লাবণ্য দাশ। মুখে স্মিত হাসি।
এই গ্রন্থে আরেকটি পারিবারিক ছবি, যেখানে অনেক মানুষ। তরুণ মাঝবয়সী জীবনানন্দ এই ছবির মধ্যমণি। পাঞ্জাবি পরা। ঠোঁটের ওপরে হালকা গোঁফ। পাঁচ সারিতে তাঁরা দণ্ডায়মান ও উপবিষ্ট। সামনের সারিতে বেশ কয়েকজন শিশু। পেছনের দুই সারিতে বাবা সত্যানন্দ, কাকা ও কাকিরা। এই ছবিটা বরিশালের বাড়ি সর্বানন্দ ভবনের সামনে তোলা। তবে সঠিক তারিখ জানা মুশকিল। ছবির ধরন দেখে আন্দাজ করা যায়, ছবিটি হয়তো ১৯২৯-৩০ সালের দিককার হবে। এই ছবিতে জীবনানন্দের প্রথম প্রেমিকা খুড়তুতো বোন বেবি বা শোভনা এবং তাঁর পাশে বোন সুচরিতা দাশকেও দেখা যাচ্ছে। পরিবারের এত বেশি সদস্যের সঙ্গে জীবনানন্দের আর কোনো ছবি দেখা যায় না।

ZWEfzeg.jpg


জীবনানন্দের মরদেহ ঘিরে স্ত্রী ও অন্যরা

রচনাবলির ষষ্ঠ খণ্ডে স্থান পেয়েছে কলকাতা শহরের রাসবিহারী অ্যাভিনিউর যে জায়গাটিতে ট্রাম দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলেন, সেই জায়গাটির ছবি। ছবিতে জায়গাটিকে গোলচিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। সবুজ ঘাস। পাশে দাঁড়ানো দুটি বাস। এই বইতেই রয়েছে কবির অন্তিম শয়ানের ছবি। কফিনে শোয়ানো। তার ওপর অনেক ফুল। কবির মুখটি খোলা। যেন ঠোঁট দুটি চেপে ধরে আছেন। নির্বাক। নির্ভার। নির্লিপ্ত। যে নিস্তরঙ্গ জীবন তিনি যাপন করেছেন, সেই জীবনেরই একটি স্থিরচিত্র।
এর পরের পৃষ্ঠায় কবির মরদেহ ঘিরে থাকা পরিবারের লোকদের ছবি। সেখানে অন্যান্যের মধ্যে দেখা যাচ্ছে স্ত্রী লাবণ্য দাশ, ভাই অশোকানন্দ দাশ, বোন সুচরিতা দাশ, কন্যা মঞ্জু্শ্রী দাশ ও পুত্র সমরানন্দকে। স্ত্রী লাবণ্য দাশ তাকিয়ে আছেন কবির মুখের দিকে।

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

১. লাবণ্য দাশ। স্ত্রী। জন্ম ১৯০৯। জীবনানন্দের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ১৯৩০ সালে। জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় শিশু বিদ্যাপীঠে (পরবর্তীকালে শ্রীমতী জহরনন্দী স্কুল) যোগ দেন। শেষ দিকে সহকারী প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। বরিশালে থাকতেও তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। কলকাতায় যাওয়ার পরে ১৯৪৮-৪৯ সালে দেশপ্রিয় পার্কের কাছে কমলা গার্লস স্কুলে এবং ১৯৫০-৫১ সালে ডেভিড হেয়ার ইনস্টিটিউশনে পড়ার পর ১৯৫২ সালে কয়েক মাসের জন্য দেশপ্রাণ স্কুলেও পড়ান। ওই বছরের নভেম্বরে বিটি ডিগ্রি লাভ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আরও ২০ বছর বেঁচেছিলেন লাবণ্য। ১৯৭৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। অ্যাজমা ছিল।
২. অশোকানন্দ দাশ। জীবনানন্দের একমাত্র ভাই। ডাকনাম ভেবলু। জন্ম ১২ অক্টোবর ১৯০১। মৃত্যু ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২।
৩. সুচরিতা দাশ। জীবনানন্দের একমাত্র বোন। ডাকনাম খুকু। জন্ম ১ এপ্রিল ১৯১৫। মৃত্যু ২২ মে ১৯৮০। চিরকুমারী। তমলুকের রাজকুমারী সান্ত্বনাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
৪. মঞ্জুশ্রী দাশ। জীবনানন্দের একমাত্র মেয়ে। ডাকনাম মঞ্জু। জন্ম ১৯৩১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। শেষ বয়সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং মানসিক রোগের চিকিৎসালয়ে ১৯৯৫ সালের ১৯ মার্চ মৃত্যু হয়।
৫. সমরানন্দ দাশ। জীবনানন্দের একমাত্র ছেলে। ডাকনাম রঞ্জু। জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৯ নভেম্বর। তিনিও মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। মৃত্যু ১৯৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
৬. অমিতানন্দ দাশ। জীবনানন্দের একমাত্র জীবিত নিকটাত্মীয়। ছোট ভাই অশোকানন্দের ছেলে। জন্ম ১৯৪৭। থাকেন কলকাতা শহরের ১৭২/৩ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে—যে বাড়িতে জীবনানন্দের অনেক স্মৃতি।

* আমীন আল রশীদ
 

Users who are viewing this thread

Back
Top