What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

buJtUl0.jpg


পশু উৎসর্গ করার রীতি অনেক ধর্মেই আছে, আছে মোটামুটি সব সমাজেই। তবে ঈদুল আজহার আগে এই পশু কোরবানিকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বেই পরিবার- পরিজন নিয়ে, সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যেভাবে ঈদের ভোজের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে, তা এক অতুলনীয় সর্বজনীন ব্যাপার। আমাদের দেশে যেদিনটি সবার মুখে মুখে কোরবানির ঈদ নামে খুশির বন্যা নিয়ে আসে, সেদিনটিই আবার ভারত ও পাকিস্তানে বাকরা ঈদ (খাসির ঈদ), আরব দেশগুলোতে ঈদ আল লাহম (মাংসের ঈদ)।

আমাদের দেশের পটভূমিতে গ্রামীণ সমাজে বাড়িতে কেবল মেহমান এলেই ঘরের পোষা মোরগ দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো আর গরু ও খাসির মাংস বিয়েশাদির দাওয়াত ছাড়া সেই বছরে একবারই, কোরবানির ঈদের সময়ে খাওয়া হতো। তাই ঈদ উপলক্ষে গরুর বা খাসির মাংসের বহু রকম স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় সব পদের চল হয়েছে দেশের সব অঞ্চলেই। কোরবানির পরেই সক্কাল সক্কাল বেশ ঝাল ঝাল করে মাংস, কলিজা, গুর্দা—সব মিলিয়ে চড়িয়ে দেওয়া হয় মোটামুটি সব বাড়িতেই। আবার পেঁপে বাটা মাখিয়ে মাংসের রোয়া নরম করে চটজলদি কাবাবও বানিয়ে নেওয়া হয়। মাত্র চুলা থেকে নামানো মাংসের মাখা ঝোলে চুবিয়ে বৃহত্তর নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ বহু অঞ্চলে খাওয়া হয় চালের আটার ধবধবে নরম রুটি। নোয়াখালীর বিখ্যাত খোলাজা পিঠাও খাওয়া হয় মাংস দিয়ে। আবার এদিকে বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলে ঈদের প্রথম মাংস সাদাভাত বা পোলাও দিয়ে খাওয়ার প্রচলন আছে। মুড়ি ছিটিয়েও খাওয়া হয় ঝাল ভুনা মাংস। আবার এদিকে পুরান ঢাকায় অনেক বাড়িতেই ঈদের দ্বিতীয় দিন ঝাল মাংসের সঙ্গে ল্যাটকা খিচুড়ি খাওয়া হয়। ঈদের মাংসের নানা বিশেষ পদের যেন শেষ নেই।

জামালপুরের মাংসের পিঠালি, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান মাংস, পুরান ঢাকার বটি বা মুঠা কাবাব, মোটামুটি সব অঞ্চলেই জনপ্রিয় কাটা মসলার মাংস, রেজালা, কোর্মা ইত্যাদি নানা জিবে জল আনা পদের নাম নিতে গেলে দিন কাবার হয়ে যাবে৷
কোরবানির ঈদের আরেকটি বিশিষ্ট ব্যাপার হলো, এই সময়ে খাসি বা গরুর মাংস ছাড়াও অন্যান্য অংশ দিয়েও বহু সুস্বাদু খাবার তৈরি করা হয়। প্রথমেই চলে আসে পায়ের নলির হাড় আর অস্থিমজ্জা দিয়ে তৈরি অনন্য সুখাদ্য নেহারি বা পায়া। সারা রাত ধরে বিভিন্ন সুগন্ধযুক্ত আর বিশেষ মসলায় জ্বাল দিয়ে বানানো হয় নেহারি।

D1HE9T9.png


নেহারি

অঞ্চলভেদে একে নলার খাটাও বলা হয় যাতে তেঁতুল গোলা জল দেওয়া হয়। সারা রাত রান্না করে সকালে রুটি বা তন্দুর রুটি দিয়ে এই নেহারি খাওয়া হয় সবাই মিলে। গরুর মাথার হাড়যুক্ত মাংস আর জিহ্বা দিয়ে ছোলার ডালও এই সময়ে সবার প্রিয়। মগজ ভুনা বা ফ্রাই, চর্বির ডাল, কলিজা-গুর্দা-ফুসফুস-হৃদ্‌পিণ্ড-প্লীহা—সব মিলিয়ে আগুন ঝাল ভুনা, লেজের অংশের মাংস তো আছেই, তবে রাঁধতে সবচেয়ে কঠিন অথচ খেতে ধুন্ধুমার মজাদার ভুঁড়ি বা বট ভুনার আবেদন একেবারেই অন্য রকম কোরবানির ঈদের সময়ে। কিছুটা অপ্রচলিত হলেও চামড়াও পশম ছাড়িয়ে ভেজেভুনে খাওয়ার চল আছে কোনো কোনো অঞ্চলে।

কোরবানির মাংস সংরক্ষণেরও নানা পদ্ধতি আছে নানা এলাকায়। বিদ্যুৎ–সংযোগ বা ফ্রিজ না থাকায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ নিজের মতো করে অত্যন্ত কার্যকর সব উপায়ে মাংস সংরক্ষণের কায়দা–কানুন বের করেছে যুগে যুগে। কোরবানির পশুর চাকা মাংস অল্প মসলায় বিশেষ কায়দায় প্রক্রিয়াজাত করে কোয়াবের মাংস হয় চট্টগ্রামে। ঠিক একই রকমভাবে মাংসের চাকা টুকরো জ্বাল দিয়ে দিয়ে চর্বিতে জড়িয়ে শুকিয়ে ঢাকায় হয় খোরমা গোস্ত। সিলেট, উত্তরবঙ্গসহ অনেক অঞ্চলে করা হয় গরুর মাংসের শুঁটকি৷

কমবেশি সব বাড়িতেই দুবেলা জ্বাল দেওয়া হতো ঈদের মাংস। সেই মাংস এইভাবে বেশ কয়েক দিন ভালো থাকে ফ্রিজ ছাড়াই। এ রকমই এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় সাদা করে আস্তে আস্তে কয়েক দিন জ্বাল করা মাংসের টুকরো আবার আলাদা করে হলুদ মরিচ আদা রসুন আর সুগন্ধি মসলায় ভুনে নিলেই ওপরে গাঢ় রঙের ভুনা মসলা আর ভেতরে রসাল নরম রোয়ার অনন্য পদ কালাভুনা তৈরি হয় চট্টগ্রামে। আবার সাধারণত বারবার জ্বাল দিতে গিয়ে ঝুরা হয়ে যাওয়া মাংস দিয়ে মুড়ি বা গরম সাদা ভাত খাওয়ার স্বর্গীয় স্বাদ মুখে বলে বোঝানোর নয়। গরুর চর্বিও জ্বাল দিয়ে গলিয়ে জেরে ভরে রাখা হতো গ্রামবাংলায়। সেই চর্বির তেলে ভেজে চর্বির পিঠা, পেঁয়াজু, বেগুন ভাজা সারা বছরই খাওয়া হতো।

পৃথিবীর সব দেশেই ঈদুল আজহার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কোরবানির মাংস ঘিরেই। আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই ঈদকে ঈদ আল লাহম বা মাংসের ঈদ বলা হয়ে থাকে। কাবসা, মান্দি ইত্যাদি বিরিয়ানি ধরনের পদের পাশাপাশি মানসাফ আল ঈদ বা ঈদ এর মাংস দিয়ে রান্না দই দেওয়া কোর্মা আর আস্ত ভেড়া গ্রিল করে বানানো মেশউয়ি (Mechoui) নামের ডিশ খেয়ে থাকে সবাই সেখানে এই দিনে। মেশউয়ি অবশ্য উৎপত্তিগতভাবে আসলে মরোক্কান খাবার।

wGr2RXt.jpg


আস্ত ভেড়া গ্রিল করে বানানো মেশউয়ি, ছবি: উইকিপিডিয়া

এই মরক্কোর ঈদুল আজহা মানেই আবার ল্যাম্ব তাজিন (Tagine)। ওপরে ফুটোযুক্ত উঁচু ঢাকনা দেওয়া বিশেষ পাত্রে লম্বা সময় ধরে ঢিমে আঁচে বানানো তাজিনে শুকনা অ্যাপ্রিকট, আমন্ড বাদাম আর জাফরান দেওয়া হয়।

gqMySa5.png


সাক কাভুরমা

তুর্কিরা কোরবানির ঈদকে বলেন কুরবান বাইরাম। সেখানে বিভিন্ন কাবাবের পাশাপাশি তাওয়ায় গ্রিল করা তেমন কোনো মসলাপাতি না দেওয়া সাক কাভুরমা (sac kavurma) নামের মাংসের পদ খুব জনপ্রিয় ঈদুল আজহার দিনে। ইরানে কোরবানির ঈদকে নোনতা ঈদ বলে সবাই। কারণ, ঈদের ভোজে মাংসের বিভিন্ন পদ বেশি থাকে মিষ্টান্নের তুলনায়। সেখান বিভিন্ন কাবাব ও হালিম খাওয়া হয় এদিনে।

মালয়েশিয়ার মুসলিমরা কোরবানির ঈদকে বলেন হারি রায়া হাজি। এদিনে লেমন গ্রাস, তেঁতুল, গালাংগাল আদা আর তাজা লাল মরিচ দেওয়া বিফ রেন্ডাং (Rendang) কারি সবার পছন্দের শীর্ষে থাকে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়াতে৷ আমাদের কাছাকাছি ভারত ও পাকিস্তানে বাকরা ঈদ বলে পরিচিত এই দিনে বিভিন্ন কাবাব, বিরিয়ানির পাশাপাশি কলিজা ভুনা আর নলির ঝোল খুব জনপ্রিয় আমাদের মতোই।

Ac81DvW.png


বিফ রেন্ডাং

কোরবানির ঈদের সবচেয়ে বড় আবেদনটি হলো পরিবার, আত্মীয়পরিজন, প্রতিবেশী, আশপাশের অভাবী গরিব দুঃখী মানুষের সঙ্গে মাংসের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। অনেক পরিবারে এই করোনার ভয়াবহ দুঃসময়ে হয়তো পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের কারণে কোরবানি দেওয়া হচ্ছে না। হয়তো স্বজন হারানোর বেদনায় দিশেহারা অথবা অসুস্থতায় বিপর্যস্ত অনেক পরিবার কোরবানির আয়োজন করার অবস্থাতেই নেই।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে খামার থেকে অনলাইনে পশু কেনা এমনকি কোরবানির মাংস পৌঁছে দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে এ বছর৷ সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে কোরবানির মাংস আমাদের তরফ থেকে পৌঁছে দেওয়ার প্রত্যয়ে অনুদান নিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান ও দাতব্য সংস্থা। সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী যদি কোরবানি দেওয়ার পরিকল্পনা থেকেই থাকে, তবে একজন সুনাগরিক হিসেবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে আর অভাবী ও অসুস্থ, বিপর্যস্ত মানুষের ঘরে কোরবানির মাংস পৌঁছে দিতে পারলে তবেই কোরবানির ঈদের সার্থকতা আসবে আমাদের জীবনে।

* তানিয়া ফেরদৌস
 

Users who are viewing this thread

Back
Top