আবেগীয় স্বাস্থ্য অধিকাংশ পাঠকের কাছে নতুন বিষয় মনে হলেও আবেগ কিন্তু আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন রকম আবেগের ভেতর দিয়ে আমরা প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্ত পার করি। এ ছাড়া প্রাত্যহিক কথাবার্তায়, শিল্প-সাহিত্যে, গানে, কবিতায়, সিনেমা, নাটকে আবেগ বা ইমোশন শব্দটি আমরা অহরহ ব্যবহার করে থাকি।
আবেগের অর্থ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে যেভাবেই দাঁড় করাক না কেন, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় আবেগ হলো কোনো ব্যক্তি, পরিস্থিতি কিংবা পরিবেশের প্রতি সাড়া দেওয়ার এক জটিল প্রক্রিয়া, যা আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আচরণ ও শারীরিক প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়। সুখ, দুঃখ, ভয়, বিরক্তি, রাগ, বিস্ময় হলো মানুষের মৌলিক আবেগ। প্রাত্যহিক জীবনে প্রকাশিত আবেগসমূহের ওপর আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় রকম আবেগের সঙ্গে খাপ খেয়ে চলতে পারলে আবেগীয় স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
যাদের আবেগীয় স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তারাও বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভুগতে পারে। তবে তারা জানে, সেসব জটিলতাকে ভারসাম্যপূর্ণ আবেগীয় প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উঠে আসতে হয়। এ ছাড়া একটির সঙ্গে আরেকটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে আবেগীয় স্বাস্থ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের মানসিক ও শারীরিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
প্রত্যেক মানুষের বেড়ে ওঠার সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্ব স্বতন্ত্র হওয়ার কারণে নিজ নিজ আবেগের সঙ্গে প্রত্যেকের বোঝাপড়ার ও খাপ খাওয়ানোর ধরনও আলাদা। তাই আবেগীয় স্বাস্থ্যের অবস্থা পরিমাপের জন্য সর্বজনীন কোনো মাপকাঠি নেই। তারপরও সাধারণ কিছু পূর্ব লক্ষণের ভেতর দিয়ে আবেগীয় স্বাস্থ্যের অবনতি প্রকাশিত হয়—
১. পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, যেটা ব্যক্তির স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের ধরনের মধ্যে পড়ে না।
২. স্বাভাবিকের চেয়ে কম শারীরিক ও মানসিক শক্তি অনুভব করা।
৩. অনেক বেশি ঘুম অথবা একেবারেই ঘুমহীন অবস্থা।
৪. অনেক বেশি খাওয়া-দাওয়া করা অথবা একেবারেই কমিয়ে দেওয়া।
৫. নেশা গ্রহণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া।
৬. চিন্তার অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া।
৭. কর্মদক্ষতা কমে যাওয়া।
৮. হঠাৎ করে আশপাশের মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বেড়ে যাওয়া।
৯. বিরক্তিবোধ, প্রতিক্রিয়াশীলতা, অপরাধবোধ, অযোগ্যতা, হতাশার অনুভূতি তৈরি হওয়া।
১০. নিজের প্রতি যত্ন না নেওয়া।
আবেগীয় স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কিছু কিছু পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আবেগ চিহ্নিতকরণ ও সাড়া প্রদান
দৈনন্দিন জীবনে নিজেদের ভেতর প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া আবেগসমূহকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও চিহ্নিত করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাগের অনুভূতিকে রাগ হিসেবে, ভালোবাসার অনুভূতিকে ভালোবাসা হিসেবে প্রথমে চিহ্নিত করে পরবর্তীকালে নামকরণ করতে হবে। এর ফলে আবেগসমূহ ব্যক্তির কাছে সরাসরি স্বীকৃতি পায় এবং আরও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। কোন বিষয়গুলো ব্যক্তির ভেতর দুঃখ তৈরি করে, কোনগুলো সুখ তৈরি করে ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। আত্মসচেতনতা যত বাড়বে, নির্দিষ্ট আবেগের প্রতি নিরপেক্ষভাবে সাড়া দেওয়ার সুযোগ তত বেশি তৈরি হবে। অনিয়ন্ত্রিত আবেগ জীবনের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। তাই আবেগের প্রতি নিরপেক্ষ সাড়া দেওয়ার মানসিক অভ্যাস বাস্তবিক জীবনে দীর্ঘদিন চর্চা করলে আবেগের ওপর ধীরে ধীরে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
অর্থ নির্মাণ
জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো কী, তা প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে এবং সেগুলো অর্জনের জন্য মনোনিবেশ করতে হবে। পেশাগত জীবন আমাদের অস্তিত্বের সামগ্রিক অর্থ নির্মাণের একমাত্র পথ নয়। তাই পেশাগত জীবনের বাইরে অন্যান্য যেসব কাজে গভীর টান অনুভব করেন, সেসব কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে জীবনের একটি সামগ্রিক অর্থ নির্মাণ করতে পারেন। যেমন আধ্যাত্মিকতার চর্চা, ভ্রমণ করা, বাগান করা, স্বেচ্ছাসেবীমূলক কাজ ইত্যাদি। তাই বলা যায়, সামগ্রিকভাবে অর্থপূর্ণ জীবন আবেগের মধ্যকার ভারসাম্য যেমন বজায় রাখে ঠিক তেমনি আবেগের ভারসাম্যের চর্চা একটি অর্থপূর্ণ জীবন গঠনেও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে।
ইতিবাচক সেলফ-ইমেজ
প্রায় সব মানুষই নিজের সম্পর্কে একটি স্পষ্ট কিংবা অস্পষ্ট ধারণা পোষণ করে থাকে, যাকে আত্ম-প্রতিচ্ছবি বলে। আত্ম-প্রতিচ্ছবি হলো একটি অভ্যন্তরীণ আয়না, যেখানে মানুষ নিজেকে দেখতে পায়। বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নির্মিত আত্ম-প্রতিচ্ছবি ইতিবাচক, নেতিবাচক কিংবা মিশ্র হতে পারে। ইতিবাচক আত্ম-প্রতিচ্ছবি যেকোনো আবেগকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ/মেনে নেওয়ার সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন আবেগের বিপরীতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রবণতা কমে আসে, কোন ধরনের আবেগের বিপরীতে কোন ধরনের সাড়া দেওয়া উচিত, সেটা ভেবে দেখার সুযোগ তৈরি হয়, যা আমাদের আবেগীয় স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত করে। ইতিবাচক আত্ম-প্রতিচ্ছবি নির্মাণের জন্য আমাদের শরীর, মন ও বাক্যের মাধ্যমে মৈত্রী ও করুণার চর্চা করতে হবে।
ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাত্রা
একটি ভারসাম্যপূর্ণ লাইফস্টাইল আমাদের আবেগীয় জগৎকে স্থির রাখতে সাহায্য করে। তাই আমাদের ব্যক্তিগত, কর্ম ও পারিবারিক জীবনের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে এবং ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রামসহ সব ধরনের কাজে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হবে।
সম্পর্কের যত্ন
মানুষ সামাজিক জীব আর সমাজ দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন রকম সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। চারপাশের মানুষের সঙ্গে যে ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়, সেটার ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন রকম আবেগ আমাদের মনোজগতে প্রতিনিয়ত আবির্ভূত হয়। তাই আবেগের যত্ন নিতে হলে চারপাশের সম্পর্কগুলোর সঙ্গে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সম্পৃক্ত থাকতে হয় এবং বড় ধরনের ব্যক্তিগত প্রত্যাশা না রেখে পারিপার্শ্বিক সম্পর্কগুলোর যত্ন নিতে হয়।
* লেখক: লিটন বড়ুয়া | মনোবিজ্ঞানী, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত