'কেউ কথা রাখেনি' কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভালোবাসার মানুষের জন্য কী কী করেছেন, তা বলতে গিয়ে ষাঁড়ের চোখে লাল কাপড় বাঁধার প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। প্রশ্ন জাগছে, এত কিছু থাকতে সুনীল কেন ষাঁড়ের চোখে লাল কাপড় বাঁধার কথা বলেছিলেন? অন্য রঙের কাপড় নয় কেন? আচ্ছা, সুনীলের জায়গায় আপনি নিজেকেই কল্পনা করুন না। লাল কাপড় হাতে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। অদূরেই একটি ষাঁড়। কল্পনায় কী দেখছেন? ষাঁড় কি অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আধবোজা নয়নে জাবর কাটছে? অধিকাংশই হয়তো বলবেন, মোটেও না! ষাঁড় তেড়েফুড়ে আসছে। কেন বলবেন? কারণ, আমরা মোটামুটি সবাই শুনেছি, ষাঁড় লাল রঙের কাপড় দেখলে রেগে যায়। আর এ কারণেই কি তাহলে কাঙ্খিত নারীর কাছে নিজের বীরত্ব জাহির করতে সুনীল লিখেছিলেন, 'ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি, দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়...'? ষাঁড় কি আসলেই লাল রং দেখলে রেগে যায়?
কোথা থেকে এল এই ধারনা
উত্তর খোঁজার আগে ষাঁড় যে লাল রং দেখলে রেগে যায়, এই ধারনা কোত্থেকে এল তা জেনে নেওয়া যাক। ষাঁড়ের লড়াই সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন। ইংরেজিতে যাকে বলে 'বুলফাইটিং'। যেখানে ষাঁড়ের চোখের সামনে এক সাহসী মানুষ (যাকে বলা হয় ম্যাটাডর) লাল রঙের একপ্রস্থ কাপড় নাড়াচাড়া করেন। আর তা দেখে ষাঁড় তেড়ে আসে নাক ফুলিয়ে প্রচণ্ড গতিতে।
গ্রীষ্মে স্পেনের মানুষজন গ্যালারিতে বসে পড়ে বুলফাইটিং দেখতে
এই ষাঁড়ের লড়াই নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। তবে এটা মানতেই হবে যে দুনিয়ার নানান দেশে বুলফাইটিং প্রচলিত এবং জনপ্রিয়। আর স্পেনের বুলফাইটিংয়ের কথা কে না জানেন! গ্রীষ্মকাল এলেই দেশটিতে মানুষজন লাল রঙের জামা পরে গ্যালারিতে বসে পড়ে এই লড়াই দেখতে। মোটকথা, এই ষাঁড়ের লড়াই বা বুলফাইটিংয়ে লাল রঙের কাপড় ব্যবহার করা হয় বলেই সবাই ধরে নেয়, ষাঁড় লাল রং দেখলে রেগে যায়।
বিজ্ঞান যা বলে
বিজ্ঞান বলছে ভিন্ন কথা। তৃণভোজী প্রাণীরা লাল রঙ দেখতে পায় না। অর্থাৎ ওরা বর্ণান্ধ। ষাঁড়ও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। যেহেতু এরা লাল রং দেখতেই পায় না, তাই তা দেখে রেগে যাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। মার্কিন বিজ্ঞানী টেম্পল গ্র্যান্ডিনের লেখা 'ইমপ্রুভিং এনিমেল ওয়েলফেয়ার' বইয়ে বলা হয়েছে, গবাদিপশুদের চোখের রেটিনায় লাল রং গ্রহণ করার মতো 'রিসেপ্টর' নেই। সোজা বাংলায় বললে লাল রং গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা ওদের চোখের রেটিনায় নেই প্রাকৃতিকভাবেই।
লাল রঙকে ষাঁড় দেখে অনেকটা হলুদাভ ধূসর রং হিসেবে
এ কারণে ওরা শুধু হলুদ, সবুজ, নীল ও বেগুনী রং দেখতে পায়। সুস্থ মানুষের চোখের পেছনের দিকে রং শনাক্ত করার জন্য তিন ধরনের 'কোন সেল' (Cone Cell) রয়েছে। যেগুলো লাল, সবুজ ও নীল রঙ শনাক্তে সাহায্য করে। ষাঁড়ের ক্ষেত্রে লাল রং শনাক্তের 'কোন সেল' না থাকায় এরা রঙটি দেখতে পায় না। এই অবস্থাকে বলা হয় প্রোটানোপিয়া। যার ফলে লাল রঙের কাপড়কে ওরা অনেকটা হলুদাভ ধূসর রঙের দেখে।
তাহলে ষাঁড় কেন রেগে যায়
ম্যাটাডর যখন লাল রঙের কাপড়টা নাড়াচাড়া করে, তখন ষাঁড়ের সামনে আসলে হলুদাভ ধূসর রঙের এক কাপড়ই নড়ে ওঠে। এটা ঠিক যে এতে ষাঁড়ের মনে এক ধরনের বিভ্রম তৈরি হয়। সবচেয়ে বড় কথা, বুলফাইটিংয়ের জন্য ষাঁড়গুলোকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। আর ক্ষিপ্র প্রজাতির ষাঁড়ই বেছে নেওয়া হয় বুলফাইটিংয়ের জন্য। এরা এতটাই চড়া মেজাজের হয় যে, চোখের সামনে যা–ই ধরা হোক না কেন, তেড়ে আসবেই। আর ম্যাটাডররাও ষাঁড়দের রাগিয়ে তোলাতে ওস্তাদ।
ম্যাটাডররা জানেন, কীভাবে একটা ষাঁড়কে রাগাতে হয়
২০০৭ সালে ডিসকভারি চ্যানেলের 'মিথবাস্টার্স' অনুষ্ঠানে ষাঁড়দের ওপর তিন ধরনের পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। প্রথম পরীক্ষায় লাল, নীল ও সাদা রঙের তিনটি পতাকা রাখা হয়েছিল। ষাঁড় পর্যায়ক্রমে সবগুলোকেই আক্রমণ করে। দ্বিতীয় পরীক্ষায় তিনটি পুতুলকে লাল, নীল ও সাদা রঙের জামা পরিয়ে রেখে দিলে সবগুলোকেই আক্রমণ করে। বরং ষাঁড়গুলো লালা জামা পরা পুতুলটিকে আক্রমণ করে সব শেষে! আর তৃতীয় পরীক্ষায় তিন ম্যাটাডরকে তিন রঙের জামা পরিয়ে ষাঁড়ের সামনে দাঁড় করানো হয়। যাদের মধ্যে লাল জামা পড়া ব্যক্তিটি স্থির দাঁড়িয়ে ছিলেন আর অন্য দুজন এদিক সেদিক নড়াচড়া করছিলেন। দেখা যায়, অন্য দুজন ম্যাটাডরকে আক্রমণ করতে ষাঁড় তেড়ে গেলেও লাল জামা পড়া ব্যক্তির দিকে ঘুরেও তাকায় না! এই পরীক্ষা থেকেই বোঝা যায়, ষাঁড় আসলে লাল রঙের জন্য রেগে যায় না। বরং কাপড়ের নড়নচড়ন ওদের রাগিয়ে তোলে, সেটা যে রঙের কাপড়ই হোক না কেন।
ষাঁড়কে বিরক্ত না করাই ভালো
শেষ করার আগে একটা কথা। এটা তো জানা গেল যে ষাঁড় লাল রঙের জন্য রেগে যায় না। তাহলে কি লাল জামা পড়ে ষাঁড়ের সামনে যাওয়া ঠিক হবে? একদমই না। শিশুদেরও এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া জরুরি। মনে রাখবেন, জামা আপনি যে রঙেরই পরুন না কেন, ষাঁড়ের সামনে এমন আচরণ করা যাবে না, যা ওদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাবধানে মার নেই!
* সূত্র: সায়েন্স কোয়েশ্চেনস উইদ সারপ্রাইজিং আনসারস, লাইভ সায়েন্স ও সায়েন্স এবিসি