What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

প্রত্ননিদর্শন দর্শনে ভ্রমণ (1 Viewer)

Bergamo

Forum God
Elite Leader
Joined
Mar 2, 2018
Threads
9,649
Messages
117,051
Credits
1,241,096
Glasses sunglasses
Berry Tart
Statue Of Liberty
Profile Music
Sandwich
sKJIHO5.jpg


দেয়াঙ পরগনাখ্যাত চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা প্রত্নসম্পদে ভরা ঐতিহাসিক জনপদ। কর্ণফুলী উপজেলাও দেয়াঙ পাহাড়ঘেঁষা। দেয়াঙ পাহাড়কে ঘিরেই বিস্তৃতি ঘটে এ জনপদের। আনোয়ারা-কর্ণফুলী দুই উপজেলা ভৌগোলিক অবস্থানে অনন্য রূপ ও গুণের অধিকারী। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ কূল ঘেঁষে এ দুই উপজেলার অবস্থান।

শুধু কি কর্ণফুলী নদী? আনোয়ারার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের উপকূল—আনোয়ারার গহিরা, রায়পুর, পারকিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। আনোয়ারার দক্ষিণে বয়ে গেছে শঙ্খ নদ। পূর্বে চানখালী ও ইছামতী খাল। অর্থাৎ, এ আনোয়ারার চারপাশ সাগর, নদী ও খালে ঘেরা। মাঝখানে—তার সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত খুঁটি 'দেয়াঙ পাহাড়'। যে দেয়াঙ পাহাড়ে ঝিওরি অংশে হাজার বছর আগে পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল বলে মনে করেন ইতিহাস-গবেষকেরা। এ বিস্তীর্ণ দেয়াঙ পাহাড়ের দক্ষিণাংশে বিশ শতাব্দীর আশির দশকে স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর রাডার কেন্দ্র। আমাদের স্কুল চাঁপাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমরা ঘুরে বেড়াতাম দেয়াঙ পাহাড়ের বুকজুড়ে। পাহাড়ঘেঁষা আমাদের স্কুল। সম্ভবত আটাশি সালের দিকে। হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় পাহাড়ে ওঠা। পাহাড়ে ছোটাছুটি করা। কারণ, এখানে রাডার কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। বিমানবাহিনীর সদস্যরা তখন কর্ণফুলীর ওপাড়ে বিমানঘাঁটি থেকে প্রতিদিন কয়েকবার করে পাহাড়ে আসা-যাওয়া করতেন বিমানে। বিমান ওঠানামার দৃশ্য দেখতাম দূর থেকে। বিমানের পাখার হাওয়ায় পাহাড়ের ছোট ছোট গাছের দোল খাওয়া দেখতাম। এভাবেই দেয়াঙ পাহাড়ের বিরাট একটি অংশ সংরক্ষিত এলাকায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল চোখের সামনে; যে দেয়াঙে আমরা হেঁটেছি, খেলেছি, ঘুরেছি—আমাদের শৈশবে। বর্ষা শেষে শরৎ-হেমন্তে কুড়িয়েছি জীবন্ত নুড়িপাথর। সে জীবন্ত নুড়িপাথরগুলো এখন আর নেই। কারণ দেয়াঙের বুক এখন ক্ষতবিক্ষত। আমাদের গ্রামও দেয়াঙের পাদদেশে।

দেয়াঙের উত্তর পাশে বিশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে শুরু হয় কোরিয়ান ইপিজেড স্থাপনের কাজ। যেখানে এখন বিভিন্ন কলকারখানায় জীবিকা অর্জনে নিয়োজিত প্রায় অর্ধলক্ষ নারী-পুরুষ। উত্তর বন্দর এলাকায় দেয়াঙের পাদদেশেই এ দেশের নৌ-প্রকৌশল শিক্ষার উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'মেরিন একাডেমি'র অবস্থা। দেয়াঙের দক্ষিণ পাশে রাডার কেন্দ্রের বাইরে যে জায়গা খালি ছিল, সেখানে এখন চায়না অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে। আরও দক্ষিণে একেবারে পাহাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আরেক বিদ্যাপীঠ বটতলী শাহ মোহছেন আউলিয়া কলেজ, যেখানে আমরা উচ্চমাধ্যমিক পড়েছি। বলতে গেলে দেয়াঙ পাহাড়ের পাদদেশে আনোয়ারাবাসী সরাসরি উপকার ভোগের প্রধান প্রতিষ্ঠান এ কলেজ। কলেজটিতে অনার্স কোর্স চালুসহ সরকারীকরণ এখন সময়ের দাবি। এক ফাঁকে বলে রাখলাম এই প্রাণের দাবির কথা।

দেয়াঙ অঞ্চল অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের অধিকারী। হাজার বছরের বেশি সময়ে এখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, শাসকশ্রেণি গড়ে তোলে অসংখ্য ইমারত, প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, মসজিদ, দিঘি ও সমাধিসৌধ। এসব ঐতিহ্যের অধিকাংশই পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কালের গর্ভে বিলীন হলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সংস্কৃতিচিহ্ন দেয়াঙের বিভিন্ন এলাকায় আজও টিকে আছে, যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সমধিক পরিচিত। এসব প্রত্ননিদর্শনের অনুসন্ধানে নিজেকে সদা নিয়োজিত রাখেন, এমন ব্যক্তিত্বদের একজন ইতিহাস-গবেষক জামাল উদ্দিন। সচরাচর আমরা ঘুরে বেড়াই বিনোদনের জায়গায়। আনোয়ারায় এমন বিনোদনমূলক জায়গা পারকি সৈকত, গহিরা প্যারাবন ও সৈকত। এ ছাড়া শঙ্খ নদের পাড় ও ইছামতীর পাড়। কিংবা ইছামতীতে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো। সেদিন ছিল মধ্য ফাগুনের দিন। ১ মার্চ ২০২১ সোমবার। সারাটা দিন ঘুরে বেড়িয়েছি আনোয়ারা-কর্ণফুলীর নানা প্রত্নসম্পদ দেখতে দেখতে। সে এক চমৎকার দিন কাটিয়েছি আমরা।

প্রথমেই আমাদের গাড়ি প্রবেশ করে কোরিয়ান ইপিজেডের উত্তর গেট দিয়ে দেয়াঙ পাহাড়ে। কোরিয়ান ইপিজেডের মনোরম সড়ক দিয়ে পথ চলতে চলতে মনে হবে, এটা কোন দেশে এলাম! বিদেশ নয় তো? হ্যাঁ, এমনই চমৎকার সুন্দর কোরিয়ান ইপিজেডের ভেতরের সড়কগুলো। আনোয়ারার বাইরের মানুষ আমাদের দলের অন্যতম সদস্য লেখক-গবেষক শিমুল বড়ুয়া, কবি শেখ ফিরোজ আহমদ ও লেখক রেবা বড়ুয়া সেই মুগ্ধতার কথা বারবার প্রকাশ করেছেন। প্রথমেই আমরা গেলাম 'মরিয়ম আশ্রম'। শত বছরের অধিক পুরোনো প্রার্থনালয়, পল্লি, স্কুল, জপমালার বাগান, সাংস্কৃতিক মঞ্চ, বিশালাকার মাঠসহ চট্টগ্রামের খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী এক স্থান এ মরিয়ম আশ্রম। কোরিয়ান ইপিজেড অঞ্চলের ভেতরে থাকলেও ঐতিহ্যবাহী স্থানটি খ্রিষ্টানদের দখলেই আছে। মরিময় আশ্রম দেখা শেষ করে আমরা গেলাম ঐতিহাসিক 'চাঁদ সওদাগরের দিঘি' দেখতে। 'মনসামঙ্গল-এর কাহিনিতে উল্লিখিত চাঁদ সওদাগরের দিঘি এটি। ছায়াশীতল দিঘির পাড়ে ছবি তোলাতুলি করে আর পাশে উত্তর বন্দর গ্রামের খোট্টা গোষ্ঠীর খোট্টা ভাষা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলাম।

বিশেষ করে আমাদের দলের অন্যতম সদস্য ঢাকা থেকে আগত বাবু ভাইকে (কবি ও নাট্যনির্দেশক শেখ ফিরোজ আহমদ) খোট্টা ভাষা সম্পর্কে ধারণা দিলাম। চাঁদ সওদাগরের দিঘি ও খোট্টাদের গ্রাম আমাদের বৈরাগ ইউনিয়নে হলেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, চাঁদ সওদাগরের দিঘি প্রথমবার দেখতে গিয়েছিলাম মাত্র ছয় মাস আগে, তাও আরেক শিক্ষাবিদ-লেখক শামসুদ্দিন শিশিরের সঙ্গে। তাই বিজ্ঞ জামাল ভাইয়ের সঙ্গে আমারও কিঞ্চিৎ ধারণা থাকায় আগত নতুন অতিথিদের সঙ্গে একটু পণ্ডিতি ভাব দেখাতে পেরেছি আরকি!

খোট্টা গোষ্ঠী সম্পর্কে জানা দরকার

বাবু ভাইকে জানালাম যখন, আপনাদেরও সামান্য জানানো দরকার খোট্টা গোষ্ঠী সম্পর্কে। খোট্টারা নিজের মধ্যে কথা বলে খোট্টা ভাষায়, যা আমরা একদমই বুঝতে পারি না। তবে যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলে, তখন চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ভাষা বা প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলে। তাদের পড়ালেখাও আমাদের সঙ্গে। শুধু নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিজেদের ভাষায়। যে ভাষা এখনো প্রচলন আছে তাদের মধ্যে। চট্টগ্রাম কলেজে পড়ালেখা করেন—এমন এক শিক্ষার্থী সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা বাংলা ভাষায় প্রশ্ন করেছি, সে উত্তর দিয়েছে সম্পূর্ণ খোট্টা ভাষায়।

পরে অবশ্যই তরজমা করে দিয়েছিলেন তিনি। এতে বুঝেছি, তারা তাদের নিজস্ব ভাষাকে ভালোবাসে গভীরভাবে। ঐতিহ্য হিসেবেই হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছে মাতৃভাষাটি। চট্টগ্রামের ভাষাকে যদি আঞ্চলিক ভাষা বলি, খোট্টা ভাষাকে আমরা একটি উপভাষা বলতে পারি। এটা এখানে বড় কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষা নয়, ছোট্ট একটা গ্রামের জনগোষ্ঠীর ভাষা। তারা নিজেদের ভারতের বেনারস থেকে আগত বলে জানায়। গবেষক জামাল উদ্দিনের মতে, খোট্টারা মোগল সৈনিক ছিলেন। পাশের গ্রামের স্থানীয় শিক্ষিত মুরুব্বিদের মত ভিন্ন। তাই কোনটা যে সত্যি, তা জানতে হলে ইতিহাসের বই পড়তে হবে। এসব ইতিহাসের সত্যতা জানতে হলে একই বিষয়ে একাধিক বই পড়া দরকার। এটা শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বটে। জামাল উদ্দিনের 'দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস' গ্রন্থটিও পড়তে পারেন খোট্টা গোষ্ঠীর ইতিহাস জানতে।

কিল্লার পাহাড় ও বওটা লরি

চাঁদ সওদাগরের দিঘির পাড় থেকে কাছেই কিল্লার পাহাড়। দিঘির পাড় থেকে একটু হেঁটে পাহাড়ে ওঠার পর দেখা গেল চার টিলার মাঝখানে থলেতে মাটি কেটেকুটে মাঠ বানিয়ে ফুটবল খেলছে স্থানীয় কিশোরেরা। তাদের কাছে কিল্লার পাহাড় কোনো দিকে জিজ্ঞেস করতেই তারা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল। ওদের একজনকে আমাদের সঙ্গে আসার অনুরোধ করলে দেখি খেলা ভেঙে পুরো দলই পথ দেখাতে ছুটে এল। বোঝা গেলা খেলতে খেলতে ক্লান্ত প্রায়। তাই সহজেই খেলা ভেঙে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এল। তাদের সঙ্গে উঠলাম কিল্লার পাহাড়। এ কিল্লার পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বিস্মিত চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েক শ বছর পুরোনো এক স্মৃতিচিহ্ন দেখে।

খুব পুরোনো এক দালান দাঁড়িয়ে আছে এখানে। যেটি স্থানীয়ভাবে বওটা লরি নামে পরিচিত। বওটা শব্দের প্রমিত শব্দ পতাকা, লরি অর্থ নড়াচড়া। অর্থাৎ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে দেশি-বিদেশি জাহাজের যাওয়া-আসার সময় এ পাহাড় থেকে বিশালাকারের বিভিন্ন পতাকা নড়াচড়া করে নানা সংকেত দেওয়া হতো জাহাজ চালকের উদ্দেশ্যে। পতাকার সংকেত পেয়েই তখন চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজের প্রবেশ ও বহির্গমন হতো। এই বওটা লরি আমাদের প্রত্নসম্পদের অংশবিশেষ নিঃসন্দেহে।

দুঃখের বিষয়, এই প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণে দেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কোনো উদ্যোগ নেই বলে মনে হয়েছে। সেখানে ভবনে ওপরে উঠে দেখা গেল আরামে বিভোরে ঘুমিয়ে আছেন এক মাদকসেবী। স্থানীয় কয়েকজন জানান, সন্ধ্যা নামলে ভবনটি মাদকাসক্তদের আখড়ায় পরিণত হয়। এমন একটি নিদর্শন এখানে আছে, সে খবর আমাদের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আছে কি না জানি না। সেখান থেকে খোট্টাপাড়ার দিকে নিচে নামার সময় দেখলাম পাহাড়ের পাদদেশে বড় প্রস্তের বিশাল প্রাচীর। এই সীমানাপ্রাচীর বা পাহাড় রক্ষাদেয়ালটাও প্রত্নসম্পদ বলে মনে হলো।

dVy3Q0s.jpg


নিচে নেমে স্থানীয় টং দোকানে দাঁড়িয়ে শীতের শেষে প্রথম কোমল পানি পান করলাম। আমরা মানে প্রখর রোদেও গরম চা পছন্দ করা আমি ছাড়া অন্য সবাই। তারপর গাড়ি চলল কর্ণফুলীর এপাড়ের নতুন শহর বন্দর কমিউনিটি সেন্টারের দিকে। কমিউনিটি সেন্টারের পাশেই 'বন্দর বধ্যভূমি স্মৃতি কমপ্লেক্স'। একাত্তরের ২০ মে যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছিল ১৫৬ জন নিরীহ বাঙালিকে। আনোয়ারার প্রয়াত সাংসদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর উদ্যোগে ও স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ বাবু, বীর মুক্তিযোদ্ধা সামশুল আলম মাস্টার ও তাঁদের সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকায় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির দখল থেকে বধ্যভূমির জায়গাটি উদ্ধার করে একটি আধুনিক স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। কমপ্লেক্সটির চমৎকার নির্মাণশৈলী দেখে যথারীতি মুগ্ধ হলেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর থেকে আসা অতিথিরা।

সেখান থেকে গাড়িতে বসে বসে বধ্যভূমির পাশের কস্তুরি রেস্তোরাঁর শিঙাড়া-সমুচা খেতে খেতে চলছি সিইউএফএল সড়ক হয়ে। পথে বৈরাগ গ্রামের বিলের মাঝখানে নির্মাণাধীন কর্ণফুলী টানেলের সংযোগ সড়কের নির্মাণযজ্ঞ হাত ইশারা করে দেখালাম অতিথিদের। চাতরী চৌমুহনী হয়ে কালাবিবির দিঘি, কালাবিবি চৌধুরানীর বাড়ি ও মোগল আমলে নির্মিত কালাবিবি মসজিদকে পাশ কাটিয়ে আমরা গেলাম পশ্চিম শোলকাটা মনু মিয়ার দিঘির পাড়ে। এখানে বলে রাখি, কালাবিলি চৌধুরানী হচ্ছেন জমিদার শেরমস্ত খাঁর মেয়ে, আরেক জমিদার রুস্তম আলী খাঁর স্ত্রী (যাঁর নামে বটতলী রুস্তম হাটের নামকরণ এবং তিনিই এই হাটের প্রতিষ্ঠাতা) এবং মনু মিয়ার (জবরদস্ত খাঁ) বড় বোন। আর এই মনু হলেন সেই মনু মিয়া, যাঁকে সমগ্র বাঙালি সমাজ মলকা বানুর প্রেমিক ও স্বামী হিসেবে জানেন। রূপ দেখে পাগল হয়ে বাঁশখালী জলদী গ্রামের সওদাগরকন্যা সুন্দরী মলকা বানুর সঙ্গে প্রেম ও পরে বিয়ে করেন মনু মিয়া। মলকা বানু-মনু মিয়ার প্রেম ও বিয়েকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট লোকগীতিটা এখনো আমরা গ্রামবাংলায় লোকমুখে শোনতে পাই। বাংলা নাটক-সিনামাতেও বিয়ের দৃশ্যে বাজানো হয় এই লোকসংগীত। মলকা বানু-মনু মিয়ার লোকগীতিটা—

'মলকা বানুর দেশে রে
বিয়ের বাদ্যবালা বাজা রে।
সাজে রে মনুমিয়া ২
বিয়ের সাজন সাজে রে।।
মনুমিয়া লইল সাজ
মাথায় দিল সোনার তাজ
সাজিল মনুমিয়া ২
যাইবো হউসের মলকার দেশে রে।
দইনও বিলের মাঝে রে
চ-কুড়ি নাউট্যা নাচে রে
মলকার বিয়া হইব ২
মনুমিয়ার সাথে রে।'

মনু মিয়া পরনারীতে আসক্ত ছিলেন বলে ঐতিহাসিকদের মত। পালকি থেকে অপরের নববধূ ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও উল্লেখ আছে মনু মিয়ার কাহিনিতে। কয়েক শ বছরের পুরোনো এসব শোনা-পড়া কাহিনি বাদ দিয়ে এবার চোখে দেখা মনু মিয়ার দিঘি-মসজিদের কথা বলি। বিশাল মনু মিয়ার দিঘিটি দেখে ছোটখাটো একটা নদীই মনে হয়েছে প্রথমে। কারণ, এই শুষ্ক মৌসুমেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জলে টইটম্বুর দিঘি।

দিঘির চারদিকে তাকিয়ে খোঁজাখুঁজি করি একালের কোনো মলকা বানু দিঘির জলে গোসল করতে এসেছে কি না। দেখা মেলেনি কোনো মলকার!
দিঘির ঘাটে জলে ভাসছে চমৎকার একটি নৌকা। পুকুরে মাছচাষিরা দিঘির জলে ভেসে ভেসে মাছের খাবার ছিটানোর জন্য হয়তো নৌকা রেখেছেন। কিন্তু একটু লম্বা ধরনের নৌকাটা দেখতে সুন্দর হওয়ায় মন কেড়েছে। ঘাটের পাশে পাড়ে ছায়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো তেঁতুলগাছ। মনু মিয়া তাঁর ভালোবাসার বধূর জন্য দিঘির পাড়ে এ তেঁতুলগাছ রোপণ করেছিলেন কি না জানা সম্ভব হয়নি আমাদের। চারপাশে গাছপালায় ঘেরা কয়েক শ বছরের পুরোনো এই দিঘি। পাশেই হাজিগাঁও হয়ে বটতলীর দিকে চলে গেছে গ্রাম্য ছোট্ট পাকা সড়ক। সড়কের ওপাশে ঐতিহাসিক মনু মিয়ার মসজিদ। মসজিদটি স্থাপিত হয় ১৬৬৫ সালে। চারদিকে একেবারে প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানে। শোলকাটার কাছেই ঝিওরী গ্রাম। যে গ্রামে ১৯২৭ সালে ৬৬টি প্রাচীন বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। এই ঝিওরী গ্রামেই হাজার বছর আগে পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল বলে ইতিহাস-গবেষক জামাল উদ্দিনের মত। যদিও সেখানে এখন কোনো স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট নেই। দেয়াঙ পাহাড়ের ঝিওরী এলাকায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল, তাই পাহাড়ের এই অংশে হেঁটে হেঁটে সেই মাটি স্পর্শ করে এলাম, এই যা।

'চট্টগ্রাম পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়' নামে লেখক জামাল উদ্দিন একটি ইতিহাস গ্রন্থও রচনা করেছেন। সেটি চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের সাহিত্য 'চর্যাপদ' লেখা হয়েছে বলে সমকালীন সাহিত্য-গবেষকদের মত।

কিছুদিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধেও পড়েছি এ রকম। সে প্রবন্ধের লেখক ছিলেন ড. মোহাম্মদ আমীন। পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজতে গিয়ে ঝিওরী গ্রামের পাশে হাজিগাঁও গ্রামের পাহাড়ের ভেতরে গুচ্ছগ্রামও দেখে এলাম আমরা। গুচ্ছগ্রামে নারী কর্তৃক পরিচালিত টং দোকানে চা-বিস্কুটও খাওয়া হয়েছে।

dMIr9fQ.jpg


সেখানে যেহেতু হাজার বছর আগে পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল, তাই লেখক-শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ শিমুল বড়ুয়া সেখানে টং দোকানে বসে চা খাওয়ার সময় তোলা ছবির ক্যাপশন ঠিক করলেন, 'পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস-ক্যানটিনে চা পান'! তখন সময় ঠিক দুপুর। আমরা চললাম বড়উঠান মিয়াবাড়ির দিকে। যেখানে যেতে ২০ মিনিট মতো সময় লেগেছে। এই ২০ মিনিট গাড়িতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সুরে-বেসুরে মাতিয়ে রেখেছিলেন ট্যুর দলের স্থায়ীয় সঙ্গী মোরশেদ (আনোয়ারা সাহিত্য পরিষদ-আসাপর সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন)। তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন রামচন্দ্র, সাঁতারু নীল জামশেদ ও সুমন মেম্বার।

বড়উঠান জমিদার

গানে গানে বড়উঠান জমিদার আনোয়ার আলী খানের জমিদারবাড়ি পৌঁছে যাই। জমিদারবাড়ির বিশালাকারের জরাজীর্ণ দেয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

বাড়িজুড়ে লতাপাতা-আগাছার রাজত্ব চলছে মানবরাজাহীন জমিদারবাড়িতে। ফটক পেরিয়ে মূল বাড়ির সামনেই সবুজ ঘাসের উঠোন। সবুজ উঠোনে দাঁড়িয়ে পেছনে জীর্ণ জমিদারবাড়ি রেখে ছবি তোলার কর্ম ও জমিদারবাড়ি পরিদর্শন শেষে সেখানেই জমিদার পরিবারের বংশধর সাজ্জাদ খান মিটু ভাইয়ের আমন্ত্রণে দুপুরে খেলাম আনন্দের সঙ্গে। টিনের চালের মাটির বড় বড় দেয়ালওয়ালা পুরোনো এক ঘরে আয়োজন হয়েছে খাবারের। চৌচালা ঘরটি দেখতে অনেক সুন্দর। জীর্ণ জমিদারবাড়ির পেছনেই এ ঘরের অবস্থান। উৎসবের আমেজে খাওয়াদাওয়া শেষে পিএবি সড়কের পূর্ব পাশে দুটো বড় বড় দিঘিও দেখা হলো। জমিদারবাড়িতে স্থানীয় বড়উঠান ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রফিক উল্লাহ সাহেবের আতিথেয়তা ছিল মনে রাখার মতো। জমিদার আনোয়ার আলী খান হলেন বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁর মেয়ের জামাই দেওয়ান মনোহর আলী খানের বংশধর (সূত্র: 'দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস', আদিকাল, জামাল উদ্দিন)। হাসির ছলে বলতেই পারি, আমরা মধ্যাহ্নভোজ করলাম নবাব শায়েস্তা খাঁর মেয়ের বাড়িতে!
বড়উঠান জমিদারবাড়ি থেকে সোজা চলে গেলাম পূর্ব আনোয়ারার পরৈকোড়া গ্রামে। যাওয়ার পথে শোলকাটা গ্রামে দেখলাম ঐতিহাসিক ছুরুতবিবি মসজিদ ও দিঘি।

'দেয়াঙ পরগণা ইতিহাস' গ্রন্থের তথ্যানুসারে এ ছুরুতবিবি হলেন মধ্যযুগের অন্যতম কবি আলাওলের দ্বিতীয় কন্যা। তাঁর বিয়ে হয়েছিল শোলকাটা গ্রামের দেওয়ান আমীর মোহাম্মদ চৌধুরীর সঙ্গে। এটাও এক বিশাল ব্যাপার, কবি আলাওলকন্যার স্মৃতিধন্য স্থাপনা ঘুরে দেখা। পরৈকোড়া যাওয়ার পথে মাঝখানেই আনোয়ারা উপজেলা সদর। সেখানে আনোয়ারা থানা, আনোয়ারা সরকারি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়, আনোয়ারা সরকারি কলেজ দেখা যায় পথ চলতে চলতে। আনোয়ারা উচ্চবিদ্যালয় আবার আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের স্মৃতিধন্য প্রতিষ্ঠান। 'আনোয়ারা স্কুল' উচ্চবিদ্যালয় হওয়ার আগে 'আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি স্কুল' ছিল। সেই সময় ১৮৯৯-১৯০৫ সাল পর্যন্ত আবদুল করিম স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ স্কুলে শিক্ষকতা করাকালেই আবদুল করিম পুঁথিসংগ্রাহক ও লেখক হিসেবে খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন।

vErP8lN.jpg


'পদ্মাবতী' পুথিটি তিনি স্কুলের পাশের গ্রাম ডুমুরিয়া থেকেই সংগ্রহ করেন (সূত্র: 'দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস'। ডুমুরিয়া গ্রামের ওপর দিয়েই আমরা গেলাম ঐতিহাসিক পরৈকোড়া গ্রামে। ডুমুরিয়া গ্রামের ওপর দিয়ে যাওয়া রাস্তাটা চরম আঁকাবাঁকা। ধীরে চলতে হয় গাড়ি। মোড়ে মোড়ে দেখা মেলে পুকুর। ডানে পুকুর বাঁয়ে পুকুর।
পরৈকোড়ায় যোগেশ চন্দ্র রায়ের বিশাল জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, ওয়াচ টাওয়ার, জমিদারবাড়ির দুই দৃষ্টিনন্দন ফটক, নাচখানা দেখে বিমুগ্ধ হওয়ার মতো। দেখে বোঝা যায় এগুলো কয়েক শ বছরের পুরোনো স্থাপনা। এটা এক বিশাল জমিদারবাড়ি। ওয়াচ টাওয়ারে ওঠার ফটকটি খুবই সরু। সরু ফটক দিয়ে প্রবেশ করে লতাপাতা ও নানা আগাছায় ঘেরা ওয়াচ টাওয়ারে উঠে মনে হলো অ্যাডভেঞ্চারে আছি। চাইলে এ জমিদারবাড়িটাকে গড়ে তোলা যায় দর্শনীয় স্থান হিসেবে। একইভাবে পাশেই আছে জমিদার রায়বাহাদুর প্রসন্ন কুমারের বাড়ি। সেটাও ধ্বংসাবশেষ। জমিদারবাড়িতে যাওয়ার পথে দেখা গেল শতবর্ষের অধিক পুরোনো বুড়াঠাকুর দিঘির দক্ষিণ ও পশ্চিম পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পরৈকোড়া নয়নতারা উচ্চবিদ্যালয়।

পরৈকোড়ায় গাঁয়ের রেস্তোরাঁয় বৈকালিক নাশতা—পিঠা ও চা পান করেছি। আনোয়ারায় দেখার মতো আরও অনেক প্রত্নসম্পদ পড়ে আছে। পরৈকোড়া থেকে আরেকটু পূর্বে গেলেই ওসখাইন গ্রামে মধ্যযুগের অন্যতম কবি আলী রাজা প্রকাশ কানু ফকিরের মাজার। আলী রাজা ১৮০০ শতাব্দীর অন্যতম কবি। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ 'জ্ঞানসাগর' ১৯১৭ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমরা যখন পরৈকোড়ায় জমিদারবাড়ি দেখা শেষ করলাম, তখন দিনের আলো হারিয়ে গিয়ে সন্ধ্যা নেমে এল গাঁয়ে। আকাশের বুকে তখন চাঁদের আগমন ঘটেছে। তাই সেদিন কবি আলী রাজার মাজারে যাওয়া হয়নি। আর কোনো দর্শনীয় স্থান দেখা হলো না। প্রত্নসম্পদ দেখার ভ্রমণ সেদিনের মতো সাঙ্গ করতে হলো। আবারও কোনো একদিন আমরা ঘুরে বেড়াব এই অঞ্চলের বাকি প্রত্ননিদর্শনগুলো দেখার মানসে।

আমাদের সেদিনের প্রত্ননিদর্শন দর্শনে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে জামাল উদ্দিন, যিনি আলো-আঁধারে হাতড়ে হাতড়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ প্রত্নসম্পদ, প্রত্ননিদর্শনগুলোর সারকথা তুলে আনেন পাঠকের সামনে, ইতিহাসের লেখক-গবেষক-পাঠকদের জন্য মণিমুক্তা হয়ে ওঠে তাঁর লেখা ও গ্রন্থসমূহ; অধ্যক্ষ শিমুল বড়ুয়া—তিনি সাহিত্য গবেষণার পাশাপাশি ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিকে ঝুঁকে রেখেছেন নিজের লেখক সত্তা; কবি-প্রাবন্ধিক শেখ ফিরোজ আহমদ—যিনি যা দেখেন তার সারবিষয় হৃদয়ের জমিনে রাখতে পারেন এবং পরে লেখায় ফুটিয়ে তোলেন; একমাত্র নারী সদস্য আইনজীবী-লেখক রেবা বড়ুয়া, সাংবাদিক মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন, রামচন্দ্র দাশ চন্দন ও লাল জামা গায়ে নীল জামশেদ।

* লেখক: রফিক আহমদ খান, প্রাবন্ধিক ও ছড়াকার।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top