যাঁরা মা–বাবা হয়েছেন, সবারই একটা কথা শুনতে হয়েছে কমবেশি—মা–বাবা হওয়া এত সহজ নয়। এই কথার জন্য কঠিন কাজকে সহজ করার দৌড়ে জিততে গিয়ে আমাদের জীবনটাই শেষ; অথচ শেষ অব্দি কারও ভাগ্যে 'মা–বাবা' হয়েছেন আর
শোনা হয় কি না সন্দেহ আছে।
আমাদের সব চিন্তা আবর্তিত হয় অন্য কোনো মানুষের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে। অথচ হিসাবটা তার উল্টো হওয়ার কথা ছিল। আর এই হিসাবের ঘূর্ণিপাকে আমরাও প্রতিনিয়ত বাচ্চাকে শেখাই এমন কিছু জিনিস, যাতে সেও বড় হয়ে সেই চক্রব্যূহ থেকে বের হতে না পারে। আর এভাবেই ক্রমশ এই চক্র বংশপরম্পরায় সমাজ, রাষ্ট্র ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে।
মা–বাবা হওয়াটা যেমন সহজ নয়, তেমনি কঠিনও নয়। তবে তার সঙ্গে জন্মদানের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকেই বাচ্চা জন্ম না দিয়েও বাবা অথবা মায়ের ভূমিকা পালন করছেন। বিষয়টা নির্ভর করছে আপনি কীভাবে একটা বাচ্চার দায়িত্ব পালন করছেন তার ওপর। যাঁরা একটা বাচ্চার জন্মসূত্রে বাবা অথবা মা হন, তাঁরা সবকিছুতেই অতিরিক্ত মাত্রায় অধিকার খাটাতে পছন্দ করেন।
আমার বাচ্চা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে, বাংলা মাধ্যমে পড়বে নাকি ইংরেজি মাধ্যমে পড়বে, গান শিখবে না আবৃত্তি করবে, নাচবে নাকি ছবি আঁকবে—এসব নিয়ে কম বাড়াবাড়ি হয় না। এত কিছু চিন্তা জন্মের ঠিক পরপর তা বাস্তবায়নে কোমর বেঁধে নেমে যাওয়ায় বাচ্চারা তাদের সুন্দর শৈশব হারিয়ে ফেলছে। প্রত্যেক বাচ্চার মধ্যে প্রতিযোগিতা, হিংসা, স্বার্থপরতা এত বেশি ভর করছে যে সেটি ভবিষ্যতে তার জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। তারা জানে না আকাশ দেখতে কেমন, খালি পায়ে ঘাসের ওপর হাঁটতে কেমন লাগে, বৃষ্টিতে ভেজা, ফুল কুড়ানো, গাছে চড়া, চড়ুইভাতি খেলা, কানামাছি, বউচি—এগুলো তাদের কাছে এক মহাবিস্ময়।
কিছুকাল আগেও বলতাম, আমরা বাবাকে ভয় পাই; কারণ, বাবা ব্যস্ত থাকেন। মা বাসায় থাকেন, তাই সব আবদার মায়ের কাছেই। বর্তমান সময়ে এই ব্যস্ততা বাবা-মা দুজনেরই। কেউ সময় দিতে পারেন না বাচ্চাকে। তবে দূরত্বের ফারাক আগে যা ছিল, এখনো তাই। আগে এটা বোঝা যেত না, এখন বুঝি। তবে উপায় কী? বাচ্চাকে সময় দিন। অফিস থেকে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় হাতে নিয়ে বাসায় ঢোকার চেষ্টা করুন। বাচ্চা সারা দিন যার কাছেই থাকুক, তাকে এ জিনিসটা শেখান যে মা–বাবা প্রতিদিনই হাতে করে তার জন্য কিছু আনবে, তাতে বাচ্চার মা–বাবার বদলে কোনো উপহার পাবার মনোভাব থাকবে না।
মা–বাবার বদল কোনো বৈষয়িক জিনিসের বিনিময়ে নয়, সেটা যা–ই হোক, এটা শেখানোর জন্য মা–বাবার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। মায়েরা চাকরি করতে গিয়ে বাচ্চাকে সময় দিতে পারেন না বলে অনুশোচনা করেন; কিন্তু আপনি সংসারের সবার জন্য উপার্জন করছেন। এমনটা চিন্তা করলে অনুশোচনা নয়, বরং অনুপ্রাণিত হবেন। সংসারে বাচ্চার দায়িত্ব একলা মায়ের নয়, এটা বাবাদেরও বোঝা জরুরি। বাচ্চার জন্মদানের জন্য মা–বাবা দুজনকেই যেমন দরকার, তেমনি সন্তান লালন-পালনের জন্যও দুজনের ভূমিকা সমান। মায়ের শিক্ষা এবং বাবার শিক্ষা—দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
সন্তানের সঙ্গে গল্প করুন, সারা দিনের কথা জানতে চান, খেয়াল রাখুন যেন কোনো কিছু না লুকায়। লুকানো, মিথ্যা বলা থেকেই দূরত্ব তৈরি হয়। আপনার জীবনের অপূরণীয় ইচ্ছা জোর করে তাকে দিয়ে পূরণ করতে যাবেন না। সবারই পছন্দের একটা ধাঁচ আছে। জোর করে কিছুই হয় না। তাকে ছেড়ে দিন তার নিজস্ব জায়গায়। সৃজনশীল কাজে তাকে উৎসাহ দিন, ছোট ভুলগুলো সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়ে সঠিক জিনিসটা হাতেকলমে শিখিয়ে দিন। কখনোই অন্য কারও কীর্তির সঙ্গে তাকে তুলনা করবেন না এবং বকা দেবেন না। বাড়িতে সন্তানের সামনে ঝগড়া করবেন না এবং অযাচিত ভাষা প্রয়োগে সংযত হোন। তাকে ছোট থেকেই ভেদাভেদ, অনৈতিকতা, অশ্রদ্ধা, অসহনশীলতা শেখানো থেকে বিরত থাকুন।
প্রতি মুহূর্তে আদর দিন এবং আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করুন। অযথাই গায়ে হাত তুলবেন না। ছোটবেলা থেকেই টাকার ব্যবহার শেখান, তাহলে অযথাই বায়না ধরবে না এবং টাকার মূল্য বুঝবে। তাকে নিয়ে ঘুরতে যান এবং মাঝেমধ্যে পরিবারের সবাই মিলে আনন্দ করুন, ফলে পারিবারিক বন্ধন সম্পর্কে জানবে। পৃথিবীতে অনেক খারাপ বিষয় আছে, যার ওপর আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই। সময়মতো সেগুলো থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার কৌশল শিখিয়ে দিন।
আপনার সন্তান কেমন মানুষ হবে, তা নির্ভর করে আপনি তাকে কীভাবে গড়ে তুলছেন তার ওপর। আপনার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা তার সারা জীবনের সম্বল। সে ক্ষেত্রে তার খারাপ হওয়া এবং ভালো হওয়া দুটোর নেপথ্যের গল্পটাও আপনার নিজের হাতেই লেখা।
* সৈয়দা জুলফা হক