'চিল বাড়ি'র খোঁজে এসেছি পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারে। স্থানীয় লোকজনের অনেকেই এক নামেই বাড়িটি চেনেন। তাই বাড়ি খুঁজে পেলাম সহজেই। সাততলা বাড়ি। সিঁড়ি বেয়ে সোজা চলে গেলাম ছাদে। কারণ, ছাদে রাফিদ হক নামের এক তরুণ অপেক্ষা করছিলেন। ছাদে উঠতেই দেখলাম, হাতের ওপর চিল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাফিদ। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আরও তিনটি চিল।
রাফিদ বলেন, 'চিলগুলো আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেছি। এখন সেবা-যত্ন করে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছি। সুস্থ হয়ে উঠলেই ওদের ছেড়ে দেব।'
অসুস্থ কিংবা আহত কোনো চিলের খোঁজ পেলে ছুটে যান রাফিদ। এরপর চিল উদ্ধার করে নিজ বাড়িতে রেখে সেবা–শুশ্রূষা করেন। ক্ষত সেরে ওড়ার অবস্থায় এলেই প্রকৃতিতে ছেড়ে দেন। গত বছরের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৯টি চিল উদ্ধার করেছেন রাফিদ। এর মধ্যে ৫টি চিলকে সুস্থ করে ছেড়ে দিয়েছেন।
চিলও চেনে রাফিদকে
চিলের খোঁজে
পুরান ঢাকার আলু বাজারের এক ব্যক্তির পোষা চিল বৈদ্যুতিক শক খাওয়ায় তিনি সেটি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। এমন খবর পেয়ে কৌতূহলী হয়ে রাফিদ ওই চিল দেখতে যান। ততক্ষণে খাঁচাবন্দী সেই চিলের ডানা অকেজো হয়ে গেছে। আহত চিলের করুণ পরিণতি দেখে কিছু না ভেবেই চিলটি কিনে নেন রাফিদ। এরপর বাড়িতে নিয়ে এসে সেবা–যত্ন করতে থাকেন। নিয়মিত চিলের ভিডিও তাঁর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাণীপ্রেমীদের গ্রুপগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে আহত বা অসুস্থ চিল উদ্ধারের জন্য রাফিদের কাছে কল আসতে শুরু করে।
রাফিদ বলেন, 'মাস তিনেক আগে আগারগাঁওয়ের এক সরকারি দপ্তরের ছাদে বাস করে, এমন এক ভবঘুরে শিশু আমাকে ফোনে জানায়, সে একটি অসুস্থ চিল কুড়িয়ে পেয়েছে। সুস্থ করে তোলার জন্য চিলটি আমাকে দিতে চায়। সেখানে গিয়ে জানলাম, শিশুটির নিজের মুঠোফোন নেই। কিন্তু সে ইউটিউবে আমার ভিডিও দেখেছে। তাই সে ওই ভবনের নিরাপত্তাপ্রহরীর মুঠোফোন থেকে আমাকে কল করেছিল।' কিছুদিন আগে সেই চিল সুস্থ হলে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
রাফিদের ছাদে শুধু চিল নয়, আছে কুকুর, বিড়াল, কবুতর আর মুরগির বাস
প্রতিদিনের অতিথি
আলাপের ফাঁকেই হঠাৎ খেয়াল করলাম, মাথার ওপর গোটা দশেক চিল ঘোরাঘুরি করছে। চিলের উপস্থিতি টের পেয়ে রাফিদ খাবারের বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপর শূন্যে খাবার ছুড়ে দিতে শুরু করলেন। আর অমনি উড়তে থাকা চিলগুলো রাফিদের ছুড়ে দেওয়া খাবার খপ করে ধরে নিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের মাথার ওপর প্রায় শ খানেক চিল এসে হাজির হলো। উড়ন্ত অবস্থায় চিলের খাওয়ার দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল যেন রাফিদ সব চিলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে মন হলো, রাফিদের বাড়ির কথিত 'চিল বাড়ি' নামটি আসলেই সার্থক! রাফিদ জানান, নিয়ম করে প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টার সময় খাবারের সন্ধানে ভিড় জমায় এসব চিল। খাবার খেয়ে এরা আবার চলে যায়।
রাফিদের খরগোশ
ভেঙেছে মায়ের অভিমান
রাফিদের ছাদে শুধু চিল নয়, আছে কুকুর, বিড়াল, কবুতর আর মুরগি। বছর দশেক আগে ছাদেই গরু আর ছাগল পালন করতেন রাফিদের বাবা এনামুল হক। কিন্তু মা রুবিনা হকের ইচ্ছা ছিল, ছাদে তিনি বাগান করবেন। স্বামী ও ছেলের প্রাণিপ্রেমের কাছে রুবিনার ছাদবাগানের শখ আর পূরণ হয়নি। তাই তিনি অভিমান করে দীর্ঘ আট বছর ছাদেই যাননি। কিন্তু অবশেষে অভিমান ভেঙে দিন কয়েক আগে ছাদে গিয়েছিলেন রুবিনা। লাজুক হাসি দিয়ে বলেন, 'বাবা আর ছেলের জন্য আমি তো ছাদে জায়গা পেতাম না। তাই একটু অভিমান ছিল। তবে এখন আর অভিমান নেই। ছাদে না গেলেও রাফিদের চেয়ে ওদের (পশু–পাখি) জন্য আমার চিন্তা সব সময় বেশি থাকে। আমার পরিবারের তিনজনের জন্য রান্নার পাশাপাশি ওদের জন্য আমিই তো প্রতিদিন খাবার রান্না করি।'
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) বিবিএ পড়ছেন রাফিদ। পড়াশোনা আর টিউশনি করেন। এই সময়ের বাইরে পশু–পাখিদের দেখাশোনা করেই সময় কাটান তিনি। ইশরাক, আহাদ, ফয়সালসহ রাফিদের বেশ কিছু বন্ধুও তাঁর প্রাণীগুলো দেখাশোনা করেন। টিউশনি আর কোচিংয়ে পড়িয়ে যে টাকা পান, তার একটি অংশ দিয়ে পশু–পাখিদের জন্য খাবার কেনেন রাফিদ। প্রাণী অধিকার রক্ষা ও তাদের সেবায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
রাফিদ বলেন, 'আমার সাধ্যমতো আমি প্রাণীদের সেবা করার চেষ্টা করি। আমাদের আশপাশের পশু–পাখিদের আমাদের সমাজের সদস্য মনে করতে হবে। এলাকার কোনো মানুষের বিপদে যেমন অন্যরা এগিয়ে আসে, ঠিক তেমনই এলাকার কোনো কুকুর-বিড়ালের বিপদেও তাদের পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস করে তুলতে হবে। তাহলে আমরা সবাই মিলে ভালো থাকব।'
* জাওয়াদুল আলম | ঢাকা