What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার (1 Viewer)

Bergamo

Forum God
Elite Leader
Joined
Mar 2, 2018
Threads
9,649
Messages
117,051
Credits
1,241,096
Glasses sunglasses
Berry Tart
Statue Of Liberty
Profile Music
Sandwich
বর্তমান দুনিয়ার এক প্রবল জনপ্রিয় লেখক হারুকি মুরাকামি। তাঁর সদ্য প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ 'ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার'। এ বছরের ৬ এপ্রিল বইটি প্রকাশিত হয়েছে নামকরা প্রকাশনা সংস্থা হারভিল সেকার (ইংল্যান্ড) এবং আলফ্রেড এ নফ (আমেরিকা) থেকে। গত বছরের জুন মাসে জাপানিজ ভাষায় বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। জাপানিজ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। আর বাংলা ভাষান্তর করেছেন আলভী আহমেদ।

dAoHkK3.jpg


স্যুট-টাই আমার খুব কম পরা হয়। পরিই না বলতে গেলে, মেরেকেটে বছরে দু-তিনবার। আসলে আমার জীবনে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয় না, যেখানে আমাকে এ ধরনের ফরমাল পোশাক পরতে হবে। মাঝেমধ্যে আমি ক্যাজুয়াল জ্যাকেট পরি, তা-ও বিশেষ কোনো উপলক্ষ এলে। জ্যাকেটের সঙ্গে টাই বা লেদার শু পরা হয় না।
এ ধরনের একটা জীবনই আমি নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলাম। এভাবেই আমার জীবন বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। ঠিকঠাকভাবে, কোনো ঝামেলা ছাড়া।
কিন্তু মাঝেমধ্যে কোনো প্রয়োজন ছাড়াই আমি স্যুট-টাই পরি। কেন পরি? আমি যখন বাসার ক্লজেট খুলি তখন চাই বা না চাই স্যুটগুলো চোখে পড়ে যায়। হ্যাঙ্গারে ঝুলছে সেগুলো। স্যুটের সঙ্গে পরব বলে কেনা শার্টগুলো প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়ানো। লন্ড্রি থেকে ওভাবেই এসেছে। সেই প্যাকেট আর খোলা হয়নি। দেখলে মনে হয় একেবারে নতুন, চকচকে। বোঝার উপায় নেই সেগুলো কোনো দিন আমি ব্যবহার করেছি কি না। তখন আমার ওই কাপড়গুলোর কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে।
আমি সেগুলো ক্লজেট থেকে বের করি এবং পরতে শুরু করি। আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখি। আমাকে কি মানায় স্যুট-টাইয়ে? টাইয়ের বিভিন্ন ধরনের নট বাঁধার চেষ্টা করি। কী করে নট বাঁধতে হয়, তা যেন ভুলে না যাই সে জন্য এই প্র্যাকটিস। পুরোটা সময় গালে টোল পড়া একটা হাসিও ঝুলিয়ে রাখি। এই অদ্ভুত কাজগুলো তখনই করি যখন আমি বাসায় পুরোপুরি একা। অন্য কেউ যদি সে সময় থাকে তাহলে তার কাছে আমাকে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে হবে। সে ধরনের কোনো ঝুঁকির মধ্যে আমি যেতে চাই না।

পুরো প্রক্রিয়াটাই বেশ সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টসাধ্য। এত আয়োজন করে স্যুট-টাই পরার পর সঙ্গে সঙ্গে তা খুলে ফেলার কোনো মানে নেই। সে চেষ্টাও করি না। তার বদলে সেগুলো পরা অবস্থায় আমি বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসি। শহরের এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াই। কাজটা করতে আমার বেশ ভালোই লাগে। টের পাই, সে সময় আমার মুখের অভিব্যক্তি এবং হাঁটার ভঙ্গিটা পর্যন্ত বদলে যায়। যেন অন্য একজন আমি হয়ে যাই। মনে হয়, প্রতিদিন যা করছি তার থেকে ভিন্ন কিছু একটা করা হচ্ছে। এতে করে নিজের ভেতর আশ্চর্য এক শক্তি টের পাই।

এক ঘণ্টা এভাবে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানোর পর এই অনুভূতি ম্লান হয়ে যায়। নতুন যেকোনো কিছুই সময়ের সঙ্গে পুরোনো হয়। হতে বাধ্য। স্যুট-টাইয়ে ক্লান্ত লাগতে শুরু করে। গলার যে জায়গায় টাই বাঁধা সেখানে চুলকায়। একটা পর্যায়ে গিয়ে মনে হয়, গলার মধ্যে ফাঁস আটকানো। হাঁসফাঁস লাগে নিজের কাছে। পায়ে লেদার শু জোড়া একটু বেশি শক্ত মনে হয়। ব্যথা টের পাই। ফুটপাত দিয়ে যখন হেঁটে যাই মনে হয়, জুতো জোড়া বড় বেশি শব্দ করছে।

তখন আমি খুব দ্রুত বাসায় ফিরে আসি। প্রথমেই জুতা-মোজা খুলি। তারপর স্যুট-টাই। পুরোনো রং জ্বলে যাওয়া সোয়েট শার্ট এবং প্যান্ট পরে নিই। ধপ করে সোফায় বসে পড়ি। শান্তি লাগে।

পুরো ব্যাপারটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এক ঘণ্টার এক নিজস্ব গোপন উৎসব? এই আমি চুপি চুপি এক ঘণ্টার জন্য অন্য এক আমি হয়ে বাইরে থেকে ঘুরে এসেছি? এটা কি খারাপ? এর মধ্যে দোষ আছে কোনো? আমি তো কারও কোনো ক্ষতি করিনি। আমার এ নিয়ে অপরাধবোধে ভোগার কিছু কি আছে? নেই।

যেদিনের গল্প এখন বলব সেদিনও আমি বাসায় একা। আমার স্ত্রী বিকেলের দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। চাইনিজ ফুড খাবে সে। এই খাবারটা আমি কখনো খাই না। আসলে খেতে পারি না। আমার ধারণা, চাইনিজ ফুডে এমন কিছু মসলাপাতি ব্যবহার করে যেগুলোতে আমার অ্যালার্জিক রি-অ্যাকশন হয়। আমার স্ত্রীর যখনই চাইনিজ ফুড খেতে ইচ্ছে করে তখন সে তার কোনো এক বান্ধবীকে ফোন দেয়। তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে চলে যায়।

সেদিন একটু আগেভাগেই ডিনার সেরে নিলাম। বাসায় বই পড়ার জন্য একটা বিশেষ চেয়ার আছে। জোনি মিচ্চেলের অনেক পুরোনো একটা অ্যালবাম চালিয়ে দিয়ে সেই চেয়ারে গা এলিয়ে বসলাম। একটা রহস্য উপন্যাস আমার হাতে। যে অ্যালবামটা বাজছিল, সেটা আমার বিশেষ পছন্দের। আর উপন্যাসটা আমার খুব প্রিয় লেখকের সর্বশেষ প্রকাশিত বই। কিন্তু কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে আমার মন কিছুতেই স্থির হচ্ছিল না। মিউজিক অথবা বই কোনো কিছুতেই মন বসছে না। ভাবলাম, একটা মুভি দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু এমন কোনো মুভি খুঁজে পেলাম না, যেটা দেখতে মন চায়।
কিছু কিছু দিন আছে এমন হয়। কিছুই করতে ইচ্ছে করবে না আপনার। হাতে প্রচুর সময় আছে, সেই সময়টুকুতে আপনি কী করবেন, ভেবে বের করতে পারবেন না। অসংখ্য জিনিস আপনি ওই ফাঁকা সময়ে করতে পারতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করা হবে না।

হঠাৎ আমার মাথায় একটা আইডিয়া এল। মনে হলো, অনেক দিন হয়ে গেছে স্যুট-টাই পরা হয় না। একবার ট্রাই করে দেখব নাকি?

ক্লজেট থেকে একটা পল স্মিথ স্যুট বের করে বিছানায় রাখলাম। এই স্যুটটা আমি বিশেষ এক প্রয়োজনে কিনেছিলাম। দুবার মাত্র পরেছি। একটা শার্ট আর টাই বেছে নিলাম ম্যাচ করে। শার্টের রং হালকা ধূসর, কলার একটু ছড়ানো। এরমেনিজিলদো জেনিয়া টাই পরলাম সঙ্গে। ব্রাইট কালারের টাই, নকশা কাটা। ওটা কিনেছিলাম রোম এয়ারপোর্ট থেকে।

আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বোঝার চেষ্টা করলাম আমাকে দেখতে কেমন লাগছে। নাহ, খুব একটা খারাপ না। অন্তত এই আউটফিটে আমাকে মানাচ্ছে না, এ কথা কেউ বলতে পারবে না।

হঠাৎ কী কারণে যেন মনের মধ্যে একটা বাজে ভাবনা এল। অস্বস্তিকর এক অনুভূতি টের পেলাম নিজের ভেতর। অনুশোচনার মতো। মনে হলো, কিছু একটা আমি করেছি, যা করা ঠিক হয়নি।

আমি সেগুলো ক্লজেট থেকে বের করি এবং পরতে শুরু করি। আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখি। আমাকে কি মানায় স্যুট-টাইয়ে? টাইয়ের বিভিন্ন ধরনের নট বাঁধার চেষ্টা করি। কী করে নট বাঁধতে হয়, তা যেন ভুলে না যাই সে জন্য এই প্র্যাকটিস। পুরোটা সময় গালে টোল পড়া একটা হাসিও ঝুলিয়ে রাখি। এই অদ্ভুত কাজগুলো তখনই করি যখন আমি বাসায় পুরোপুরি একা।

ব্যাপারটা কী করে ব্যাখ্যা করব? এমন অনেক কাজ আপনি পাবেন, যেগুলো আইন করে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু সে কাজগুলো করলে মনের মধ্যে খচখচ করবে। নৈতিকতাবোধ বলে যে একটা বিষয় আছে, সেখানে প্রশ্ন জাগবে। আপনি নিজে থেকেই অদ্ভুত এক উপায়ে জেনে যাবেন, যে কাজটা আপনি করেছেন, তা ভুল। সে কাজ থেকে ভালো কোনো ফল আপনি পাবেন না। বিবেক খোঁচা মারবে।
পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভুত। নিজের কাছেই অবাক লাগল যে আমি এ রকম ভাবছি। এসব ছেলেমানুষি ভাবনা মাথায় নিয়ে ঘোরার কথা না আমার। আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। নিয়মিত ট্যাক্স দিই। কখনো কোনো আইন ভাঙিনি। ভাঙার মধ্যে কেবল ট্রাফিক রুল ভেঙেছি দু-একবার। এবং সে জন্য আমার হাতে নগদে টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা সেখানেই চুকে গেছে।

হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে কালচারড মানুষ বলতে যা বোঝায়, আমি হয়তো সে রকম না। কিন্তু আমি অসৎ নই। মনের মধ্যে কোনো পাপ নেই। শুদ্ধ মানুষ না হলেও অশুদ্ধ কেউ নই। জ্ঞান-বুদ্ধি একেবারে খারাপ না। মিউজিকের দুই কিংবদন্তি বারটক ও স্ট্রাভিনস্কির মধ্যে বয়সে কে বড়, আমি তা বলে দিতে পারব। আমার ধারণা খুব কম লোকই এটা পারবে। যে কাপড়গুলো আমি পরেছি, সেগুলো আমার নিজের টাকায় কেনা। প্রতিদিন কষ্ট করে কাজ করি। বৈধ উপায়ে টাকা রোজগার করি। সেই টাকায় আমি আমার নিজের জন্য স্যুট-টাই কিনেছি। সুতরাং আমি সেগুলো পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেই পারি। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই।

তাহলে আমার মনের মধ্যে এই অপরাধবোধ কেন জাগল? কারণটা কী? কেন বারবার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ভুল আমি করেছি? আমার নৈতিকতাবোধ, বিবেক কেন আমাকে এ কথা বলছে?

সবারই বোধ হয় এমন হয়। কোনো কোনো দিন মাথার মধ্যে প্যাঁচ লেগে যায়। জ্যাঙ্গো রেইনহার্ট সেদিন গিটার বাজাতে গেলে দু-একটা কর্ডে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। নিকি লাওডা ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন হতে পারে কিন্তু তারও সেদিন গাড়ির গিয়ার চেঞ্জ করতে ভুল হয়ে যায়।

আমি মনে মনে সিদ্ধান্তে চলে এলাম যে এ নিয়ে আর ভাবব না। পায়ে লেদার শু গলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম।

কিন্তু আমি ভুল করেছিলাম। মারাত্মক ভুল। মনের মধ্যে যে কু-ডাক দিচ্ছিল, সেই ডাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল আমার। বাসায় বসে মুভিটুভি কিছু একটা দেখলেই পারতাম। তখনো জানতাম না, এমন এক ঘটনা ঘটতে চলেছে, যে ঘটনা আমাকে অসম্ভবের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে।

তখন ছিল বসন্তকাল। সন্ধ্যাটাও দারুণ। আকাশে গোল থালার মতো বিরাট এক চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমা ছিল বোধ হয়। রাস্তার দুধারের গাছগুলোতে নতুন মুকুল সবে দেখা দিতে শুরু করেছে।

এ রকম আবহাওয়ায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াতে খুব ভালো লাগে। আমি ঢিমেতালে কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। তারপর মনে হলো, কোনো একটা বারে গিয়ে বসি, ককটেল খাই। বাসার কাছেই একটা বার আছে, যেখানে আমি নিয়মিত যাই। কিন্তু সেদিন গেলাম না সেখানে। হেঁটে হেঁটে একটু দূরে একটা বারে গিয়ে পৌঁছালাম। এই বারটাতে আমি আগে কখনো আসিনি। বাসার পাশের বারে একটা বিপদের আশঙ্কা ছিল। বারটেন্ডার হয়তো আমাকে বলে বসত, কী ব্যাপার? আপনি আজ স্যুট-টাই পরেছেন যে! এই গেটআপ নেওয়ার কারণ কী?

কী উত্তর দিতাম তার কথার? আসলেই কি কোনো কারণ আছে যা আমি বলতে পারি?
সন্ধ্যাটা মাত্র শুরু হয়েছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে বিল্ডিংয়ের একদম নিচে নেমে গেলাম। বারটা বেসমেন্টে। যখন দরজা দিয়ে ঢুকলাম তখন সেখানে মাত্র দুজন কাস্টমার বসা। তাদের বয়স চল্লিশের আশপাশে হবে। একটা টেবিলে দুজন মুখোমুখি। কোম্পানিতে কাজ করে এ রকম লোক বলে মনে হয় তাদের দেখে। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটু গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে। পরনে ডার্ক স্যুট ও টাই। টাইয়ের রং এমন যে সেটা আপনার মনে থাকবে না। একবার দেখবেন, তারপর ভুলে যাবেন।

তারা দুজন সোজা হয়ে বসেছিল। মাথা দুটো কাছাকাছি। নিচু স্বরে কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছে। টেবিলে তাদের সামনে বেশ কিছু কাগজপত্র ছড়ানো-ছিটানো। সম্ভবত ব্যবসাসংক্রান্ত জরুরি কোনো আলাপ তারা সারছে। অথবা আমি ভুলও হতে পারি। হয়তো তারা ঘোড়দৌড়ের রেজাল্ট কী হবে, তা নিয়ে কথা বলছিল।

সে যা-ই হোক, তাদের দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই। যা খুশি করুক তারা। সোজা গিয়ে একদম কাউন্টারের সামনে একটা টুলে বসে পড়লাম। জায়গাটায় বেশ আলো। বাসা থেকে পকেটে করে নিয়ে এসেছি অসমাপ্ত উপন্যাসটা। সেটা বের করলাম।
আমার সামনে দাঁড়ানো বারটেন্ডার মাঝবয়সী, গলায় একটা বো-টাই ঝোলানো। তাকে ডেকে একটা ভদকা গিমলেট অর্ডার করলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ড্রিংক চলে এল আমার। বরফকুচি দিয়ে ঠান্ডা করা সেই গ্লাসে চুমুক দিয়ে বই পড়তে শুরু করলাম। উপন্যাসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পড়া তখনো বাকি। আপনাদের আগেই বলেছি এই উপন্যাস যিনি লিখেছেন, তিনি আমার খুব প্রিয় একজন লেখক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বইয়ের প্লট আমাকে টানেনি। একেবারেই না। পড়া শুরু করেছি কয়েক দিন আগে। শেষই হচ্ছে না। তার চেয়ে ভয়ের কথা, বইটা যখন অর্ধেকমতো পড়ে শেষ করে ফেলেছি তখন আবিষ্কার করলাম বইয়ের চরিত্রগুলোর পরস্পরের মধ্যে কী সম্পর্ক, তা আমি আর মনে করতে পারছি না। কী ভয়ংকর ব্যাপার! তবু পড়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

আসলে প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়া আমার অভ্যাস। অভ্যাসবশেই কর্তব্য করে যাচ্ছি। তা ছাড়া কোনো একটা বই শুরু করার পর মাঝপথে ছেড়ে দেওয়াটা আমার স্বভাবে নেই। সব সময় আমার মধ্যে এ ধরনের একটা আশা কাজ করে যে বইয়ের শেষে গিয়ে এমন কিছু একটা ঘটবে, যা আমাকে অবাক করে দেবে। যদিও সে ধরনের ব্যাপার কখনো ঘটে না। প্রতিবার হতাশ হই। এ বইয়ের ক্ষেত্রেও হতাশ হতে হবে, মোটামুটি নিশ্চিত আমি।

আমি ধীরে ধীরে আমার ভদকা গিমলেটে চুমুক দিচ্ছি আর একটা একটা করে পাতা উল্টাচ্ছি। কিছুতেই মন বসছে না। উপন্যাসটা পড়ার মতো নয়, সেটা একটা কারণ অবশ্য। কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। আমি ভালো করে চারপাশে তাকালাম। বারের পরিবেশের মধ্যে এমন কিছু নেই যে সেখানে বসে ঠান্ডা মাথায় একটা বই আমি পড়তে পারব না। কোনো গোলমাল বা হইহট্টগোল নেই। মৃদু লয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। পর্যাপ্ত আলো আছে। বই পড়ার জন্য একেবারে আদর্শ পরিবেশ। তাহলে সমস্যাটা কী? আমি কেন পড়তে পারছি না?

IWetXXh.jpg


হারুকি মুরাকামি, সংগৃহীত

বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার মনের মধ্যে অস্বস্তিকর যে অনুভূতিটা এসেছিল, সেটা রয়ে গেছে। বারবার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঠিক নেই। ভুল হচ্ছে। সে কারণেই আমি বইয়ে মনোযোগ দিতে পারছি না। কীভাবে ব্যাখ্যা করব পুরো ব্যাপারটা? কিছু একটা খাপে খাপে মিলছে না। দুইয়ে দুইয়ে চার হচ্ছে না। ব্যাগের মধ্যে কোনো একটা জিনিস ঢোকাতে গিয়ে আপনি আবিষ্কার করলেন সেই জিনিসটা ব্যাগে আঁটছে না। সে রকম একটা অনুভূতি মনের মধ্যে টের পেলাম।

বারের একদম পেছন দিকে একটা শেলফে সারিবদ্ধভাবে দামি কিছু বোতল রাখা। ইমপ্রেসিভ কালেকশন, সন্দেহ নেই। তারও পেছনে একটা বড় আয়না। সেই আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকালাম। আয়নার আমিও একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ মনে হলো, জীবনের দীর্ঘ পথে কোনো একটা বাঁকে আমি পথ ভুল করেছি। কিছু একটা করেছি, যা করা উচিত হয়নি। ভুল পথে বাঁক নিয়েছি। দীর্ঘক্ষণ আয়নায় তাকিয়ে রইলাম। যতই দেখলাম নিজেকে ততই আয়নার মানুষটাকে অন্য আরেকজন মানুষ বলে মনে হলো। সে-ই মানুষটাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। সে অন্য কেউ। আমি নই। অন্য আরেকজন মানুষ। কিন্তু কে সে?

অন্য আর দশটা মানুষের ক্ষেত্রে যেমন হয়, আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। জীবনে চলার পথে এমন অনেক মোড় আমি পেয়েছি, যেখান থেকে রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমি ডানে বা বাঁয়ে যেতে পারতাম। কখনো এমন হয়েছে যে আমি জানতাম আমাকে ডানে বা বাঁয়ে কোন দিকে যেতে হবে। আমি সেই পথ সরাসরি বেছে নিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জানতাম না কোন পথটা ঠিক। ডানে গেলে ভালো নাকি বাঁয়ে গেলে ভালো। সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা আমার চোখে পড়েনি।

এবং এইখানে এ মুহূর্তে আমি টুলের ওপর বসা। এই আমি কেবল আমি। ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার। এককভাবে আমি। বহুবচন বা সমষ্টি নই। আমার আর কোনো সত্তা নেই। আমি যদি সে সময় ডানে না গিয়ে বাঁয়ে যেতাম তাহলে এই আমি হয়তো অন্য আমি হয়ে যেতাম। এখানে বসে বসে ভদকা গিমলেট গিলতাম না। তাহলে আয়নার মধ্যে ওই যে মানুষটা আমাকে দেখছে সে কে? কী তার পরিচয়?

বইটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে রাখলাম। আয়না থেকে চোখ দুটো সরালাম। গভীরভাবে শ্বাস নিলাম।

বারটা ধীরে ধীরে জমে উঠছে। আমার ডান দিকে দুটো টুল পরে এক মহিলা এসে বসেছেন। তার হাতে একটা গ্লাস। ভেতরের ড্রিংকের রং ফ্যাকাশে সবুজ ধরনের। কোনো ধরনের ককটেল হবে বোধ হয়। নাম বলতে পারব না সেই ককটেলের। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি একা এসেছেন। অথবা এমনও হতে পারে, তিনি এখানে বসে কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। হয়তো তার কোনো বন্ধুর জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে-ই বন্ধু এসে হাজির হবে।

মহিলা কম বয়সী নন। বয়স পঞ্চাশের আশপাশে। পোশাকে বা সাজগোজে সেই বয়সটাকে লুকোনোর কোনো চেষ্টা তার মধ্যে নেই। বেশ আত্মবিশ্বাসী চেহারা। ছিপছিপে গড়ন, দেখতে বেশ সুন্দর। চুলগুলো মাপমতো সাইজ করা। মনে হয়, হিসাব-নিকাশ করে বের করা হয়েছে কোন সাইজের চুলে তাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখাবে। পোশাক-আশাক পরিপাটি। নরম কাপড়ের একটা স্ট্রাইপড ড্রেস পরা। তার ওপরে বাদামি রঙের কাশ্মীরি কার্ডিগান চাপানো। তার মধ্যে আলাদাভাবে কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে না, কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে তিনি সুন্দর, মার্জিত। যখন তার বয়স কম ছিল তখন তিনি নিশ্চয়ই ছেলেদের মাথা নষ্ট করার মতো সুন্দরী ছিলেন। ছেলেরা লাইন ধরে তার সঙ্গে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করত। আমি যেন চোখ বন্ধ করে সেই সব দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পেলাম।

বারটেন্ডারকে ডেকে আমি আমার দ্বিতীয় গ্লাস ভদকা গিমলেট অর্ডার করে ফেলেছি ততক্ষণে। একমুঠো বাদাম চিবুতে চিবুতে বইটা আবার পড়ার চেষ্টা করলাম। মাঝেমধ্যে নিজের অজান্তেই হাত চলে যাচ্ছিল টাইয়ে। দেখে নিতে চাচ্ছিলাম, নট এখনো ঠিকভাবে বাঁধা আছে কি না।

১৫ মিনিট পর আবিষ্কার করলাম, মহিলা ঠিক আমার পাশের টুলে বসে আছেন। বারে তখন অনেক লোক। ভিড় বেড়ে গেছে। নতুন কাস্টমার যারা এসেছে তাদের জায়গা ছেড়ে দিতে ওই মহিলা একটু একটু করে আমার কাছে চলে এসেছেন। আমি এবার নিশ্চিত হয়ে গেলাম, তিনি একা। তার সঙ্গে আর কেউ নেই।

বইটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আর মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা বাকি। কিন্তু আমি আবিষ্কার করলাম তখনো ঠিক গল্পের ভেতর ঢুকতে পারিনি।
এক্সকিউজ মি, মহিলা হঠাৎ বলে উঠলেন।
আমি ঘুরে তার দিকে তাকালাম।

আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি বললেন, আপনি বইটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। বিরক্ত করছি হয়তো। কিছু মনে করবেন না। আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।
মহিলার গলার স্বর নিচু, কিন্তু গভীর। নিরুত্তাপ, ঠান্ডা কণ্ঠস্বর নয়। কিন্তু এমন স্বরও বলা যাবে না, যা খুব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ বলে মনে হবে।

বুকমার্ক দিয়ে বইটা রাখতে রাখতে বললাম, আসলে বই পড়ে খুব একটা মজা পাচ্ছি না। টানছে না আমাকে। আপনি বলুন। আমি শুনছি।
এগুলো করার মধ্যে কী মজা পান? তিনি জানতে চাইলেন।

আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। তার প্রশ্নটা ঠিকভাবে বুঝতে পারলাম না। সোজা হয়ে তার দিকে ঘুরে বসলাম। উনি এমনভাবে কথা বলছেন যে মনে হচ্ছে, আমি তার পরিচিত। এই মুখ কি আমি আগে কখনো দেখেছি? মনে পড়ল না। কোনো কিছু আমার সহজে মনে পড়ে না। বিশেষত কারও চেহারা। তবে আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আমাদের আগে কখনো দেখা হয়নি। দেখা হলে আমার নিশ্চয়ই মনে থাকত। উনি ভুলে যাওয়ার মতো মহিলা নন।

তিনি আমার কাছে জানতে চাইছেন, এগুলো করার মধ্যে আমি কী মজা পাই? আমি তার প্রশ্নটাই একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিলাম। বললাম, এগুলো মানে কোনগুলো?
তিনি একমুহূর্ত দেরি না করে উত্তর দিলেন, এই যে এভাবে স্যুট-টাই পরে বসে আছেন বারের মধ্যে, একেবারে একা, গিমলেট খাচ্ছেন আর নীরবে একটা বই পড়ছেন।
এবারও পরিষ্কার হলো না তিনি আসলে কী বলতে চাইছেন। যদিও তার কথার টোনে একধরনের বিদ্বেষ মিশে আছে। মনে হচ্ছে, তিনি আমাকে শত্রুপক্ষ ধরে নিয়ে কথা বলছেন। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। অপেক্ষা করে রইলাম যেন তিনি তার বাকি কথা শেষ করতে পারেন।

মহিলার চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি নেই। যেন প্রতিজ্ঞা করেছেন কোনোভাবেই মুখের রেখায় কোনো আবেগ-অনুভূতি ফুটে উঠতে দেবেন না। তিনি কোনো কথা বললেন না। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলেন। প্রায় এক মিনিটের কাছাকাছি।

তার মধ্যে আলাদাভাবে কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে না, কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে তিনি সুন্দর, মার্জিত। যখন তার বয়স কম ছিল তখন তিনি নিশ্চয়ই ছেলেদের মাথা নষ্ট করার মতো সুন্দরী ছিলেন। ছেলেরা লাইন ধরে তার সঙ্গে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করত। আমি যেন চোখ বন্ধ করে সেসব দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পেলাম।

নীরবতা অসহ্য হয়ে উঠছিল। বললাম, জিনিসটা হলো ভদকা গিমলেট।
কী! কী বললেন? মহিলা বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইল।

আপনি কিছুক্ষণ আগে বলেছিলেন, আমি গিমলেট খাচ্ছি। আপনার কথায় ছোট্ট একটা কারেকশন দরকার আছে। জিনিসটা আসলে গিমলেট না। ভদকা গিমলেট।

আমার কথা শুনে মহিলা মাথা নাড়লেন। খুব সামান্য। মনে হলো, মাথার চারদিকে ভনভন করে ঘুরতে থাকা একটা মাছি মাথা ঝাঁকিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
আচ্ছা, তিনি বললেন, মেনে নিচ্ছি ভদকা গিমলেট। তাতে কিছু যায় আসে না। আমার প্রশ্নও সেটা নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার কি মনে হয় আপনি যে কাজগুলো করছেন, এগুলো খুব ভালো? এগুলো করে কী প্রমাণ করতে চাইছেন? আপনি খুব স্টাইলিস্ট, আরবান কালচারটা ধরতে পেরেছেন, স্মার্ট—এ রকম কিছু?সম্ভবত আমার এ ধরনের কথার পর সেখানে আর বসে থাকা উচিত ছিল না। বিল মিটিয়ে সেখান থেকে দ্রুত কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হতো। ওই মহিলা কোনো কারণ ছাড়াই আমার সঙ্গে একটা ঝগড়া বাধাতে চাইছেন। শুধু শুধু আমাকে চ্যালেঞ্জ করছেন। কেন এই কাজটা করছেন তিনি? কিছু কি তাকে কাজটা করতে বাধ্য করেছে?

জানি না। এমনও হতে পারে, অকারণেই আজ তার মেজাজ খারাপ। কিছু একটা হয়েছে, যা নিয়ে তিনি বেশ বিরক্ত। আর সেই বিরক্তির ঝাল আমার ওপর ঝাড়ছেন। এ ধরনের মহিলার সঙ্গে ঝগড়া করে আমার কোনো লাভ হবে, সে সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। মানে মানে সেখান থেকে কেটে পড়াই ভালো। আমার জন্য সেটাই স্বাভাবিক। আমি সে ধরনের মানুষ না যে ঠিক করেছে, প্রতিটা তর্কে তাকে জিততেই হবে। অকারণে কারও সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চাই না আমি। এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে নীরবে হার মেনে নিয়ে যারা কেটে পড়ে—আমি তাদের একজন।

কিন্তু কোনো এক কারণে আমি সেখান থেকে উঠে গেলাম না। কিছু একটা আমাকে আটকে রাখল। সম্ভবত কৌতূহল। ওই মহিলা কেন গায়ে পড়ে এসে আমার সঙ্গে ঝগড়া করছে, সেটা জানতে হবে।

আমাকে মাফ করবেন, আমি বললাম, কিন্তু আমরা কি একজন আরেকজনকে চিনি? আগে কখনো আলাপ-পরিচয় হয়েছিল?

চোখ দুটো সরু করে তিনি আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালেন। বললেন, পরিচয়! মানে আমরা পরিচিত কি না? আজব কথা বলছেন।

আমি আবার আমার মাথার মধ্যে খুঁজতে শুরু করলাম। মহিলার ভাব দেখে মনে হচ্ছে তাকে আমার চেনার কথা। কোথায় দেখেছি তাকে? দেখেছি? না। আমি নিশ্চিত, এটাই প্রথম দেখা।

সম্ভবত আপনার কোনো ভুল হচ্ছে, বললাম আমি, আপনি অন্য কারও সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন।

কথাটা বলতে গিয়ে নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই চমকে গেলাম। নিজের গলার স্বর অচেনা মনে হলো।

তিনি মৃদু হাসলেন। ফ্যাকাশে এবং ঠান্ডা একটা হাসি। হাতের ককটেল গ্লাস নামিয়ে রেখে বললেন, আপনার তা-ই মনে হচ্ছে? ভালো কথা। খুব ভালো। বাই দ্য ওয়ে, আপনার স্যুটটা সুন্দর হয়েছে। যদিও আপনার শরীরে মানাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, অন্য কারও কাছ থেকে ধার করে এনে পরেছেন। আর টাইটা এই স্যুটের সঙ্গে একদমই যায় না। ওটা ইতালিয়ান টাই। স্যুটটা ইংল্যান্ডে তৈরি। তেলে-জলে মিশ খাচ্ছে না।

কাপড়চোপড় সম্পর্কে আপনি তো বেশ ভালো জানেন বলে মনে হচ্ছে, আমি বললাম।
আমার কথা শুনে তার ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁকা হলো। তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। চোখে অভিযোগ। বললেন, বেশ ভালো জানি! কাপড়চোপড় সম্পর্কে! এটা কী ধরনের কথা? আলাদাভাবে এটা বলার কী আছে? আমি যে কাপড়চোপড় সম্পর্কে ভালো জানব, এটাই তো স্বাভাবিক, না?
স্বাভাবিক! অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম।

মনে মনে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত এমন কাউকে চিনি কি না? পোশাক-আশাক বা ডিজাইন নিয়ে আমার পরিচিত কে কে কাজ করে? হ্যাঁ, কয়েকজনকে আমি চিনি। কিন্তু তারা সবাই পুরুষ। মহিলা যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হচ্ছে, তিনি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির কোনো হোমরাচোমরা। আমার তাকে চেনা উচিত ছিল।

একবার ভাবলাম তাকে খুলে বলি আজ আমি কেন স্যুট-টাই পরেছি। পরমুহূর্তেই মনে হলো, বলে কোনো লাভ নেই। তাকে আমি যে ব্যাখ্যাই দিই না কেন, তিনি সেটা মানবেন না। তার আক্রমণাত্মক মনোভাবের কোনো উনিশ-বিশ হবে না। বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনও হতে পারে যে এ কথা বলায় তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে আমাকে আক্রমণ করতে শুরু করলেন। আগুনে ঘি ঢালা হবে।

আমি খুব দ্রুত আমার ভদকা গিমলেট শেষ করে ফেললাম। টুল থেকে নেমে দাঁড়ালাম। এবার যাওয়ার পালা।

মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সম্ভবত এখনো আপনি আমাকে চিনতে পারেননি।

আমি মাথা নেড়ে তার সঙ্গে সম্মতি জানালাম।
সরাসরি আমাদের মধ্যে সেভাবে আলাপ-পরিচয় হয়নি, তিনি বললেন, আমাদের একবার মাত্র দেখা হয়েছিল। সেবার আমরা খুব বেশি কথাও বলিনি। তা-ই সম্ভবত ভুলে গেছেন। আর সে-ই সময়ে আপনি অন্য আরেকটা ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন। যেমনটা বরাবর থাকেন।

অন্য আরেকটা ব্যাপার? বরাবর ব্যস্ত থাকি! আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম।
আপনার এক বন্ধুর বন্ধু আমি। সেভাবেই আমাদের আলাপ। আমাদের দুজনের ওই কমন ফ্রেন্ড সেদিন খুব আপসেট ছিল। অবশ্যই তার আপসেটের কারণ ছিলেন আপনি। এবং এ কারণে আমিও আপনার ব্যাপারে সেদিন খুব বিরক্ত ছিলাম। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আমি কোন প্রসঙ্গে কথা বলছি। ভালো করে ভাবুন। তিন বছর আগের কথা। বেশি দিন কিন্তু হয়নি। ভুলে যাওয়ার কথা নয়। জলের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। একদম কিনারে। কী জঘন্য একটা কাজ আপনি সেদিন করেছিলেন! আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।

আমার কাছে মনে হলো, যথেষ্ট হয়েছে। বইটা জ্যাকেটের পকেটে ভরে নিলাম। খুব দ্রুত বিল ক্লিয়ার করে বার থেকে বের হয়ে এলাম।

ওই মহিলা আমার সঙ্গে আর কোনো কথা বলল না। আমি অনুভব করলাম, যখন আমি বারের দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তার চোখ দুটো আমাকে অনুসরণ করছে। আমি একবারের জন্যও পেছনে ফিরে তাকাইনি। কিন্তু আমি জানতাম, নিশ্চিতভাবে জানতাম, তিনি আমাকে দেখছেন। আমার পিঠে তার চোখের তীব্র দৃষ্টি অনুভব করছিলাম। সুচের মতো এসে বিঁধছিল সেই দৃষ্টি, আমার পল স্মিথ স্যুটে। যেন একটা স্থায়ী দাগ সেখানে ফেলে যেতে চায়।

বেসমেন্ট থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় এলোমেলো ভাবনাগুলো এক করার চেষ্টা করলাম। আমার আসলে কী করা উচিত ছিল? আমার কি তাকে বলা উচিত ছিল, আপনি এসব আবোলতাবোল কথা কেন বলছেন?

তাতে লাভ হতো কোনো? তিনি যে কথাগুলো বলেছেন, সব বানোয়াট। এ ধরনের কোনো স্মৃতি আমার মধ্যে নেই। আমার উচিত ছিল, তাকে দুটো কথা শুনিয়ে আসা। কিন্তু আমি পারিনি। কেন পারিনি?

সম্ভবত আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিছু একটা ভয় আমাকে পেয়ে বসেছিল। ভয় হচ্ছিল, আমার মধ্যে আরেকটা যে আমি আছি, সে-ই আমি সত্যিই কোনো দিন জলের ধারে গিয়েছিলাম। তিন বছর আগে। কিনারে দাঁড়িয়ে আমি সেদিন ভয়াবহ কোনো অন্যায় করেছি। কোনো এক মেয়ের সঙ্গে। এই আমি সে-ই মেয়েকে চিনি না। আমার ভয় হচ্ছিল, মহিলার সঙ্গে বেশি কথা বললে সেই মেয়েটাকে হয়তো আমি চিনতে শুরু করব। আমার ভেতরে যে অন্য এক আমি লুকিয়ে আছে সে-ই আমিকে লেজ ধরে টেনে ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসব। অন্ধকার থেকে সে-ই আমি আলোর মুখ দেখবে। নিজের এমন এক সত্তার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, যাকে আমি চিনি না। একেবারেই না। সে-ই ব্যাপারটার মুখোমুখি দাঁড়ানো ভয়ংকর। এর চেয়ে বার থেকে যে বেরিয়ে এসেছি, সে-ই ভালো হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কি ঠিক করেছি নাকি ভুল? আবারও যদি একই ধরনের ঘটনা ঘটে আমি কি একই কাজ করব?

D93mABQ.jpg


হারুকি মুরাকামির 'ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার' গল্পগ্রন্থের প্রচ্ছদ

মহিলা আমাকে বলেছেন, আমরা তিনজন জলের ধারে দাঁড়িয়েছিলাম। ঠিক কিনারে।
সেটা কিসের কিনার? সাগর? নদী? লেক? নাকি অন্য কোনো কিছু? তিন বছর আগে আমি জলের ধারে গিয়েছিলাম? কিছুই মনে পড়ছে না। তিন বছর আগে কী ঘটেছিল, সে তো অনেক পরের কথা, তিন বছর কখন পার হলো সে ব্যাপারেও কোনো ধারণা করতে পারছি না।

ওই মহিলা এমনভাবে কথা বলছিলেন যে মনে হচ্ছিল, সবকিছু খুব নিশ্চিতভাবে বলছেন। স্পেসিফিক, কিন্তু সাংকেতিক। তার কিছু কথা খুব পরিষ্কার আর কিছু কথার মধ্যে সংকেত লুকিয়ে আছে। সিম্বলিক বলা যায়। এই সিম্বলগুলো পরিষ্কার নয় বলেই তার কথার একটা সামগ্রিক ছবি আমার চোখে ধরা পড়ছে না। পুরো ব্যাপারটা আমার নার্ভের ওপর প্রেশার ফেলছে।

মনে হলো, মুখের মধ্যে একটা বাজে স্বাদ পাচ্ছি। একবার সে-ই স্বাদ গিলে ফেলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। থুতু দিয়ে মুখ থেকে বের করে দিতে চাইলাম। হলো না। তেতে ওঠার চেষ্টা করলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাকে কেন পড়তে হবে? মহিলা আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করল, তা খুবই অন্যায্য ব্যবহার। আমি বিনা কারণে এ ধরনের ব্যবহার কেন পাব? ওই মহিলার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগপর্যন্ত কী সুন্দর কাটছিল সন্ধ্যাটা। একটা শান্ত, আনন্দময় বসন্তসন্ধ্যা। অথচ উনি এসে সবকিছু ভজকট করে দিয়ে গেলেন। আমার রেগে যাওয়া উচিত। আশ্চর্যজনকভাবে নিজের মধ্যে কোনো ধরনের রাগ জাগাতে ব্যর্থ হলাম।

একটা দ্বিধা জাগল মনে। যেন বিভ্রান্তির একটা ঢেউ আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেল। সে-ই ঢেউ এসে আমার মধ্যকার সব যৌক্তিক ভাবনাগুলো ভাসিয়ে নিয়ে গেল।


সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এসেছি ততক্ষণে। বিল্ডিংয়ের বাইরে বের হয়ে এলাম। যে বসন্তসন্ধ্যায় এই বিল্ডিংয়ের ভেতরে এসে ঢুকেছিলাম, বাইরে সেই সন্ধ্যার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বসন্ত চলে গেছে। আকাশে চাঁদ নেই। সামনের রাস্তাটা আমি আর চিনি না। রাস্তার দুপাশে সারবাঁধা যে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো আগে কখনো দেখিনি। মোটা মোটা আঠালো সব সাপ গাছের গুঁড়িতে কিলবিল করছে। গাছের বাকলে তাদের ঘষা খাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে, শুকনো খসখসে এক মাতাল ধ্বনি।
ফুটপাতে ছাই জমে আছে, সাদা রঙের। গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে যাবে সেখানে। রাস্তায় মানুষ হাঁটছে। পুরুষ ও নারী। কারও মুখ নেই, ফেসলেস। তারা গলা দিয়ে গভীর শ্বাস ফেলছে। হলুদ রঙের সালফার মেশানো নিশ্বাস।

বাতাস ভয়ংকর ঠান্ডা। মনে হচ্ছে, জমে যাব। স্যুটের কলার টেনে দিলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে অদৃশ্য কোনো জায়গা থেকে মহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top