What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেপান্তরের মেয়ে ১ (1 Viewer)

দেখা বাসে উঠতে গিয়ে। বাড়িয়ে দেওয়া হাতের সেই হ্যাঁচকা টানটাই বদলে যায় অমলিন বন্ধুতার হ্যান্ডশেকে। যেচে শুরু আলাপের, গড়ায় অন্তরঙ্গতায়। জীবন রসে টইটম্বুর, জীবনকে উদ্‌যাপন করতে জানা মেয়েটিই একদিন ভোজবাজির মতোই উড়ে যায়। ফিরে যায় তার দেশে; অন্য বেশে। চারপাশে ছড়িয়ে অসংখ্য স্মৃতি আর সম্পর্কের পালক।

AxMetNi.jpg


ক্যাম্পাস, হেল্মহোল্টজ রিসার্চ সেন্টার, মিউনিখ


শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে বাস ধরলাম। বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা এক ঝটকায় ভেতরে টেনে নিল। নইলে বাসের দরজায় চাপা খাওয়া কেউ ঠেকাতে পারত না। দরজায় আবার সেন্সর কাজ করে না। নালিশ করতে গেলে ড্রাইভার খ্যাক করে ওঠে। সঙ্গে দু–তিনটা চোস্ত জার্মান গালি ফ্রি। তাই এভাবেই চলছে।

টাল সামলে নিয়ে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য চারপাশে কাউকে খুঁজলাম। বাসের ভিড়ে সে কখন মিশে গেছে। ধন্যবাদটা গিলে নিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সোমবারের সাড়ে আটটার ল্যাব মিটিংটা বড্ড ভোগায়। সময়মতো পৌঁছোতে পারলে হয়। না চাইতেও বারবার হাত চলে যাচ্ছে ঘড়ির দিকে।

'কবজিতে তো ঘড়ি নেই। তাহলে দেখছ কী, বলো তো?' অপ্রস্তুত হেসে আড়ষ্ট মাথা নাড়লাম। ঘড়ি নষ্ট আজ দুই সপ্তাহ। কিন্তু খালি কবজি হাতড়ে সময় দেখা থেমে নেই। 'তোমার কোথাও লাগেনি তো?'

আরে, ঝটকা হাত নয় তো? ভাবনাটা শেষ হওয়ার আগেই হাতটা আরেকবার এগিয়ে এল, 'বেশি জোরে টানিনি তো আবার? হাই, আমি জিসেল।' ভালো করে তাকিয়ে দেখি একেবারে খাঁটি বাঙালি চেহারার একটা মেয়ে। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের সঙ্গে কালো চুলের লম্বা বেণির যুগলবন্দী ভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। কেন যেন মনে হচ্ছে এই মেয়ের নাম ফারজানা কি ফারহানা। ভিনদেশি জিসেল নামটা একেবারেই যায় না।

কজন নামছে পরের স্টপে। এই ফাঁকে জিসেল চট করে হাত টেনে খালি আসনে বসিয়ে দিল। এই মেয়ের দেখি হাতটানের স্বভাব আছে। অস্বস্তিটা আড়াল করে ভদ্রতার শুকনো হাসি দিয়ে আলাপ-পরিচয়ে ইতি টানতে চাইলাম। কিন্তু ওপাশ থেকে সবে শুরু। 'তোমাকে ইনস্টিটিউটের সেমিনারে দেখেছি। তুমি কি অমুক ল্যাবে কাজ করো?' মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দায় সারতে চাইলাম। মিউনিখ শহরের শেষ প্রান্তে সুবিশাল হেল্মহোল্টজ ক্যাম্পাস। অগুনতি বিভাগ আর শ খানেক ল্যাব। তার ভেতরে সে যখন আমার ঠিকানা বলতে পেরেছে। তার মানে চেহারায় সে খুব চেনে আমাকে। চিনুকগে, আমার কী।

বাস এসে থেমেছে গন্তব্যে। খালি কবজিতে স্বভাবসুলভ সময় দেখে আঁতকে উঠে হুড়মুড়িয়ে নামলাম। ব্যাগটা দুকাঁধে নিয়ে ঝেড়ে দৌড়াতে পারলে দশ মিনিটের হাঁটাপথ পাঁচ মিনিটে উড়িয়ে দিতে পারব। পেছন থেকে জিসেল বলে উঠল, 'আরে, নাম বলে গেলে না যে?' পড়িমরি ছুটতে ছুটতে দাঁড়ি-কমা ছাড়া জবাব ছুড়ে দিলাম, 'সাবরিনা-মিটিং-স্যরি-পরে কথা হবে...'। বাতাসে মিলিয়ে গেল বাকিটা।


পরের সপ্তাহ।
'সেদিন যে বাঁই বাঁই করে দৌড়টা দিলে! তুমি কোন দেশের বলো তো? ইথিওপিয়া-সোমালিয়া নয় তো? ওরা কিন্তু অলিম্পিকে সে রকম দৌড়ায়।' জিসেলের একান–ওকান হাসিসমেত কথাগুলো শুনে পিত্তি জ্বলে গেল। সে বকেই চলছে, 'তোমাকে কিন্তু দেখায়ও ইথিওপিয়ানদের মতো, মাইরি।' নির্বিকার গলায় বললাম, 'ইথিওপিয়ার মেয়েদের চেহারা আমার মতো হলে সে দেশের ছেলেদের কপাল খারাপ।' হো হো করে হেসে উঠল মেয়েটা, 'উফ্‌, সাবরিনা, তুমি দেখি দারুণ পাজি। তোমার দেশের ছেলেরাও কি তোমার মতো দুষ্টু?'

একই রকম নির্লিপ্ত সুরে জবাব দিলাম, 'দুষ্টু মানে দুষ্টু। একবার বাংলাদেশের ছেলের হাতে পড়ে দেখো। জীবন তামা তামা করে ছেড়ে দেবে।' জিসেল ঘাবড়ে না গিয়ে উল্টো বলল, 'হন্ডুরাসের মেয়ে আমি, কোনো দেশের ছেলেকে ডরাই না। এমন ঘাড় মটকানি দেব না...।' চকিতেই চোখে ভেসে উঠল দেশি ভাইয়েরা কোন দূরের দ্বীপদেশ হন্ডুরাসের গাট্টাগোট্টা মেয়েদের হাতে কেনু-গুঁতো খাচ্ছে আর বাবা গো, গেছি রে বলে কোঁকাচ্ছে। কী চমৎকার ছবি। আহা রে!

হাসিঠাট্টায় পরিচয়টা জমে উঠতে সময় লাগল না। জিসেলের ভেতর অদ্ভুত কিছু একটা আছে। কথায় আর হাসিতে তার চারপাশে আলো ঠিকরে পড়ে। জার্মানি আসা অবধি এই কয় মাসে বন্ধু তেমন জোটেনি। স্বভাবটাও ঠিক হল্লা করে বেড়ানো টাইপ না। কারও সঙ্গে দুটো কথা বললে যে কত হালকা লাগে, সে আনন্দ প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। আজ অনেক দিন বাদে মনের বদ্ধ জানালা খুলে দমকা হাওয়া হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল যেন।

ঠিক হলো সামনে কোনো এক দিন লাঞ্চ করব ক্যাফেটেরিয়ায়। চুটিয়ে আড্ডা হবে তখন। যাওয়ার সময়ে জিসেল থিয়েটারি কায়দায় তিনবার হাত ঘুরিয়ে একটা বাউ করে ফেলল, 'আসি। আবার দেখা হবে। তত দিনে তোমার দেশি একটা ছেলে দেখে রেখো। টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম, হা হা হা...'। উত্তরে পুরোদস্তুর আদম ব্যবসায়ীর মতো চোখ টিপে কপট আশ্বাস দিলাম, 'হয়ে যাবে। এক হাতের খেল।'


ল্যাবে একের পর এক্সপেরিমেন্ট চলছে। জিসেলের সঙ্গে লাঞ্চে যাওয়ার ফুরসত আর মেলে না। আসতে যেতে দেখা হলে দু–দশ কথা হয়, এই যা। সেদিনও সময়টা টায় টায়। বাসস্টপ থেকে নামলেই বিরাট মাঠ। তেপান্তরের সাইজও বোধ হয় এর চেয়ে ছোট হবে। খুব দ্রুত হাঁটছি। হঠাৎ দেখি পাশে জিসেল। সমান তালে পা চালাতে চালাতে বলছে, 'এই মাইনাস পাঁচে চপ্পল পরে ঘর ছেড়েছ কী মনে করে?' চট করে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেলাম। পাতলা মোজার সঙ্গে ফিতেওয়ালা স্যান্ডেল গলিয়ে চলে এসেছি। গতকালের আঠারো ডিগ্রির কুসুম কুসুম ওম আজকে এক ধাক্কায় শূন্যের কয় হাত নিচে নেমে গেছে। কচি ঘাসেরা সব গা ঢাকা দিয়েছে তুষারের আড়ালে। ময়না, চড়ুই তাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়কাকেরা আবার রো ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শীতের শেষ কামড়ে বসন্ত পালিয়ে ফুড়ুৎ। কে জানত এপ্রিলের জার্মান আবহাওয়া এমন খ্যাপাটে।

শুধু আবহাওয়া নয়, জিসেল মেয়েটাও পাগলাটে গোছের। সে একটু থেমে বুট ঠুকে প্রস্তাব দিল, 'বাজি লাগবে?' দেখি কে আগে মাঠের ওধারের ল্যাম্পপোস্টে পৌঁছায়। পলকা চপ্পল বনাম উইন্টার বুট। এক, দুই, তিন...'। কিছু বুঝে ওঠার আগে জিসেল ছুট লাগাল। হিমেল বাতাসে লাল শাল উড়ছে দুর্বার। আমিও কানটুপি টেনে নিয়ে বাজিতে নেমে পড়লাম। নরম পেঁজা তুলোর পথ ফুঁড়ে ছুটছি ভিন দেশের দুই রাজকন্যা। যেন যে জিতবে, সে হবে এই তুষাররাজ্যের নতুন রানি। পাল্লা দিয়ে ছুটতে ছুটতে আশ্চর্য হয়ে জিসেলকে দেখছি। মেয়েটার একটা মারাত্মক রোগ আছে। যার নাম ছেলেমানুষি। বাধ না মানা খিলখিল হাসিটা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে শ্বেতশুভ্র তেপান্তরের ইথারে ইথারে। (চলবে)

* লেখক: রিম সাবরিনা জাহান সরকার | পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক; ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি
 
These are the rules that are to be followed throughout the entire site. Please ensure you follow them when you post. Those who violate the rules may be punished including possibly having their account suspended.

যারা কমেন্ট করবেন, দয়া করে বানান ঠিক রাখুন। উত্তেজিত অবস্থায় দ্রুত কমেন্ট করতে গিয়ে বানান ভুল করবেন না। আমরা যারা কমেন্ট পড়তে আসি, আমাদের কমেন্ট পড়তে অনেক অসুবিধা হয়।

Users who are viewing this thread

Back
Top