রক্ত জমাট বাঁধা চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি পরিচিত সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থার (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে প্রতিবছর প্রতি হাজারে এক বা দুইজনের রক্ত জমাট বাঁধে। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর লাখো মানুষের (মূলত বয়স্ক) মৃত্যুর কারণ এই রক্ত জমাট বাঁধা। তবে এ সমস্যা এখন আলোচনায় উঠে এসেছে ভিন্ন একটি কারণে। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের যেসব টিকার প্রয়োগ চলছে, তার কয়েকটির ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দুই–একজনের রক্ত জমাট বাঁধায় এ নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের রক্ত সংবহনতন্ত্রে তরল রক্ত বাধাহীনভাবে চলাচল করে। রক্তের কিছু উপাদান ও বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি জমাট বাঁধে না। তবে কিছু কিছু স্বাস্থ্যসমস্যায় রক্তের তরল প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ফলে রক্ত জমাট বেঁধে দানার মতো বা ক্লট হয়ে রক্তনালিতে আটকে যায়। ফলে রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। এর থেকে হতে পারে সেরিব্রাল ভেনাস থ্রম্বোসিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ডিভিটি (পায়ের শিরা বন্ধ হয়ে যাওয়া) ইত্যাদি। সব কটিই গুরুতর জটিলতা।
ইউরোপে এ পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছে। এর মধ্যে গত ৮ মার্চ পর্যন্ত মোটের ওপর ৩৭টি রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা সম্পর্কে জানা গেছে। করোনার অন্যান্য টিকা যেমন ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার ক্ষেত্রেও এ ধরনের ঘটনার কথা শোনা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ আর করোনার টিকা—দুই ক্ষেত্রেই অ্যান্টি প্লাটিলেট ফ্যাক্টর-৪-এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় বলেই এমন ঘটনা ঘটছে।
চলতি মাসে প্রকাশিত যুক্তরাজ্যের একটি বড় গবেষণার ফলাফল বলছে, করোনায় সংক্রমিত হলে রক্ত জমাট বাঁধার ও মৃত্যুর ঝুঁকি টিকা নেওয়ার পর রক্ত জমাট ও মৃত্যুর ঝুঁকির তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। করোনায় রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটে প্রতি ১০ লাখে ৩৯ জনের। শুধু তা-ই নয়, করোনায় সংক্রমিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এদিকে করোনার টিকায় রক্ত জমাট বাঁধার খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রতি ১০ লাখে ৪ জনের। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ টিকা নিলেও এর অন্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত কারও মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে করোনা মোকাবিলায় যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি টিকা নেওয়া ছাড়া আপাতত কোনো হাতিয়ার মানুষের কাছে নেই। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, করোনার টিকা এই ভাইরাসের সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। কাজেই সব ধরনের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে করোনার টিকা নিন। বিশেষ করে, যাঁদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগ রয়েছে, যাঁরা প্রবীণ এবং যাঁরা সংক্রমণের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছেন, তাঁদের অবশ্যই টিকা নিতে হবে।
কিন্তু রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কায় কেউ কেউ করোনার টিকা নিতে চাইছেন না। আবার কেউ কেউ টিকা নেওয়ার পর বা করোনায় সংক্রমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের রক্ত তরলীকরণ ওষুধ সেবন শুরু করেছেন। এসব ওষুধ সাধারণত স্ট্রোক, হৃদ্যন্ত্রের অস্ত্রোপচার, রক্ত জমাট বাঁধে এমন রোগ, রক্তনালি ও হৃদ্রোগসম্পর্কিত চিকিৎসায় খুবই সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ ধরনের ওষুধ কিছুতেই নিজে নিজে সেবন করা ঠিক নয়। এতে ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
* ডা. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান | বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ