‘চিনামাটির দেশে’ শব্দগুলো শুনতেই বেশ অবাক লাগছে। তাই না? বিষয়টা অনেকটাই ‘দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া’র মতো।
নীল জলের সোমেশ্বরী নদী
এমনই একটি জায়গা রয়েছে আমাদের অনন্য রূপসী বাংলাদেশের ভেতরেই।
ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলা থেকে মাইল সাতেক দূরবর্তী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি বিজয়পুর গ্রাম। এটি এক দিকে যেমন দর্শনীয় পর্যটন স্থান, পাশাপাশি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কোলঘেঁষা সীমান্তবর্তী এলাকা। এখানে আছে নীল জলের সোমেশ্বরী নদী।
বিজয়পুর নানান কারণে ইংরেজ আমল থেকেই জনপ্রিয়। বিজয়পুর অনেক উঁচু টারশিয়ারি সাদা মাটির পাহাড়ে সমৃদ্ধ। তবে এই মাটি আবার ‘চিনামাটি’ নামেও বিখ্যাত। প্রকৃতপক্ষে এই অঞ্চলের প্রায় সবটুকুজুড়ে সাদা মাটি পাওয়া গেলেও শসারপাড় এলাকায় উৎকৃষ্ট মানের চিনামাটির পাহাড় পাওয়া যায়।
বিজয়পুরের সাদা মাটির পাহাড়
সে মাটি একদমই মিহি নরম ট্যালকম পাউডারের মতো, যা সিরামিকশিল্পের প্রধান কাঁচামাল। ১৯৫৭ সাল থেকে এই চিনামাটি উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। প্রথম কোহিনূর অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে চিনামাটি উত্তোলন শুরু করে ১৯৬০ সালে। ১৯৭৩ সালে বিসিআইসি সে কাজে অংশগ্রহণ করে। আস্তে আস্তে বেড়ে মোট ৯টি প্রতিষ্ঠান চিনামাটি উত্তোলনের কাজ জড়িত হয়।
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের অন্যতম খনিজ অঞ্চল বিজয়পুর। পুরো এলাকা ঘিরে ছোট-বড় টিলা বা পাহাড় ও সমতল ভূমি মিলিয়ে দৈর্ঘ্যে ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও প্রস্থে ৬০০ মিটার খনিজ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।
চিনামাটি পুরোপুরি সাদা নয়
তবে চিনামাটিকে সাদা মাটি বলে আখ্যায়িত করলেও চিনামাটি পুরোপুরি সাদা নয়। বরং কোথাও লালচে, ধূসর, হালকা নীলাভ, গোলাপি, ঈষৎ বেগুনি, হলুদ কিংবা টিয়া রঙের হয়ে থাকে। নয়নাভিরাম ও বিচিত্র রঙের মাটির সংমিশ্রণে পাহাড়গুলোর নিচে রয়েছে আবার স্বচ্ছ নীল পানির হ্রদ। অনেকগুলো পাহাড় কেটে মাটি উত্তোলন করায় সৃষ্ট বড় বড় গর্ত বা ঢালুতে বৃষ্টির পানি জমে তৈরি হয়েছে এ হ্রদ।
বিকেলের হালকা রোদে সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড়গুলোর ছায়ায় ঈষৎ সবুজ ও পড়ন্ত বিকেলের ছেঁড়া ছেঁড়া এলোমেলো তুলার মতো সাদা মেঘের প্রতিচ্ছায়া হ্রদগুলো এক মনোমুগ্ধকর অনন্য বিস্ময়কর রূপ ধারণ করে। সেখানে পাহাড়ের পর পাহাড়ের বিচলিত নদীর সংখ্যাতীত তরঙ্গের মতো প্রকৃতির এক রহস্যময় আত্মহারা স্বতন্ত্র খেলা চলে। পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বেশ কিছু ছোট ছোট গুহা। ধারণ করা হয়, টঙ্ক আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময় বীর যোদ্ধারা সেখানে আত্মগোপন করে ছিলেন।
স্বচ্ছ নীল পানির হ্রদ
বিজয়পুরে সাদা মাটির পাহাড় বাদেও রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। এগুলোর মধ্যে টঙ্ক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধও অন্যতম। আন্দোলনে শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক এটি। এই অঞ্চলে মূলত গারো ও হাজং জনগোষ্ঠীর বাস। ১৯৪৬ সালে ময়মনসিংহ জেলার কৃষক সভার সাম্যবাদী নেতা মণি সিংহ ছিলেন টঙ্ক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ।
বিজয়পুর সীমান্ত ফাঁড়ির পাশেই উঁচু পাহাড়ের ওপর রয়েছে বিখ্যাত কমলাবাগান। তবে বর্তমানে সেখানে আর কমলা চাষ হয় না। এই উঁচু পাহাড় ও বিজিবি ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো এলাকার প্রায় সবটুকুরই দেখা মেলে। পাশাপাশি মেঘালয় রাজ্যের সৌন্দর্য অনেকটাই উপভোগ করা যায় সেখান থেকে। বাংলাদেশের বিজয়পুরের পাহাড়গুলো থেকে মেঘালয়ের পাহাড়গুলো তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় যেমন বেশি, উচ্চতাও।
দূরে মেঘালয়ের পাহাড়
বিজয়পুরের এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে দূরবর্তী মেঘালয়ের পাহাড় দেখলে মনে হবে যেন বিশাল বিশাল মেঘের বুক চিরে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। ওয়াচ টাওয়ারের প্রায় নিচেই রয়েছে সোমেশ্বরী নদী। বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা খরস্রোতা নদীটির মাঝখানে রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশের বিভাজক জিরো পয়েন্ট। খরস্রোতা এ নদী থেকে উত্তোলন করা হয় বালু। বালুর একেকটি বিশাল স্তূপও যেন পাহাড়ের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। সেখান থেকে সারা দেশে বালু সরবরাহ করা হয়।
এক সময় শুষ্ক মৌসুমে সোমেশ্বরী নদীতে বালুর সঙ্গে ভেসে আসত কয়লা। সে কয়লা আবার জ্বালানিশিল্পের চাহিদা পূরণ করত। সোমেশ্বরী নদী আবার প্রাকৃতিক মাছের বিশাল ভান্ডার। পর্যটক ও স্থানীয়রা নদী পার হয়ে বিজয়পুর যাতায়াত করে। ভোর থেকে ফুটে ওঠে সোমেশ্বরী নদীকেন্দ্রিক ব্যস্ত জনপদের সবাক বিস্ময়কর চিত্র।
এক সময় সোমেশ্বরী নদীতে ভেসে আসত কয়লা
সোমেশ্বরী নদীর কূল ঘেঁষেই পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত নীল–সবুজের সমারোহে আবৃত রানীখং খ্রিষ্টান মিশন। ১৯১০ সাল থেকে মিশনটির যাত্রা শুরু হয়। এটি মূলত একটি ধর্মপল্লি। দুর্গাপুর অঞ্চলের প্রায় ৬০ ভাগ গারো খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত এবং মিশনটি ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের একটি উপাসনালয়।
তবে মর্মান্তিক হলেও স্বীকার করতে হয় যে অনেকগুলো পাহাড়ই আজ নিশ্চিহ্ন, যা অবশিষ্ট রয়েছে তা–ও দেখতে টিলার মতো। সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি হওয়া সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে পর্যটকের সমাগম কম, পর্যটনব্যবস্থাও ততটা উন্নত নয়, উঁচু-নিচু খাদযুক্ত অসমতল রাস্তা যাতায়াতে ঝুঁকিপূর্ণ ছোট-বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিবছরই।