What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected নোনা নদীর নারীর নিয়তি (1 Viewer)

dUhcvWV.jpg


ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আট মাস পর সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে নদীর চরিত্র পাল্টেছে। জোয়ারে এখন পানি আরও তীব্র বেগে ছুটে আসে। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বেড়েছে আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লবণাক্ততা। খোলপেটুয়া আর কপোতাক্ষ মিশে হয়েছে সমুদ্রের মতো। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাবে ভুক্তভোগী উপকূলীয় অঞ্চলের সব মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা এ নোনাপানিতে যাঁরা আটকা পড়েছেন, তাঁদের। এর মধ্যে সন্তানসম্ভবা নারীদের অবস্থা আরও করুণ। গ্রাম আছে কিন্তু পথ নেই এখন কোথাও। থকথকে কাদায় স্বাভাবিক হাঁটাচলার সুবিধাটুকুও নেই। গত ২০ থেকে ২২ নভেম্বর এ অঞ্চলে ঘুরে হলো এই অভিজ্ঞতা।

নদীর গতিপথ বা চরিত্র পাল্টে যাওয়ার উদাহরণ আজকের নয়। যশোহর খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে কিছু লোকগাথা তুলে ধরেছেন ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্র। নদীর গতিপথ বদলে এক রাতের মধ্যে মন্দিরের মুখ ঘুরে যাওয়ার এমন গল্প শোনা যায় বাগেরহাটের ফকিরহাটের মানসা কালীবাড়ি নিয়েও। নড়াইলের ভক্ত তারকনাথ ঠাকুরের জন্য কালী নিজেই মন্দিরের মুখ পশ্চিম দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বলে গল্প আছে। অনুমান করা যায়, এসব জনশ্রুতি তৈরিই হয় আকস্মিক নদীর গতিপথ পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে। কয়েক শ বছর আগের হঠাৎ নদীর দিক পরিবর্তনের ঘটনা এখন আরও বেশি ঘটে। তবে এখনকার গল্পে আর ভক্তি আর ভক্তের উপস্থিতি থাকে না। রয়ে যায় সময়ের অভিঘাত। নোনাপানিতে আটকে পড়া মানুষ বিশেষত নারীর দুর্ভোগ।

জোয়ার–ভাটার জীবন

সাতক্ষীরার আশাশুনির প্রতাপনগর নামটি রাজা প্রতাপাদিত্যের নামে। এ গ্রামের জোবায়দা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। জোবায়দা জানালেন, এ কয় মাসে তিনি একটি ওষুধও খাননি, কোনো টিকা নেননি। ডাক্তার দেখাতে হলে যেতে হবে চার ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে সাতক্ষীরার শ্যামনগর অথবা খুলনার কয়রার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তার চেয়ে বড় সমস্যা সুপেয় পানির অভাব। আমাদের বসিয়ে রেখেই জোবায়দা রান্না শুরু করছিলেন। সবজি ধুয়ে যে পানিটুকু ফেলে দিলেন, তা কয়েকবার ব্যবহারে বহু আগেই জীবন বাঁচানোর সততার গুণ হারিয়েছে।

প্রতাপনগরের নারীরা জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করেন। বাদাবনের কাদায় কলসি নিয়ে সাঁতরে পানি আনতে যাওয়া সহজ নয়। এক কলসি পানি নিয়ে ফেরার সময় জীবন বিপন্ন করে হলেও খেয়াল রাখতে হয়, যেন এক ফোঁটা নোনাপানি কলসিতে মিশে না যায়। জোবায়দার প্রতিবেশী রাবেয়া আক্তার। ১৮ বছরের রাবেয়ার ছেলের বয়স চার মাস। আইলা–ঝড়ে গাছচাপা পড়ে বাবা মারা যাওয়ায় অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছে। প্রসববেদনা যখন উঠেছে, তখন ভরা জোয়ার। খাটটি পানিতে প্রায় ডুবে যায় অবস্থা। মা হওয়ার আগে–পরে রাবেয়ার বাথরুমের ব্যবস্থা ছিল জোয়ারের পানি। ঘরের ভেতর পানি বাড়লে সেখানে তাঁকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিতেন তাঁর মা। ভয় হতো পানির বেগে সন্তান না আবার ভূমিষ্ঠ হয়, ভেসে যায়।

শেষ রক্ষা হলেও রাবেয়ার হাতে–পায়ে আছে নোনাপানির ক্ষতের চিহ্ন। জোবায়দার মতো সেও চিকিৎসা পায়নি। অভাবের সংসারে শরীর খুব দুর্বল, চার মাসেও মা হওয়ার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি রাবেয়া। সুষম খাবারের কথা তিনি কখনো শোনেননি। কোনো দিন দুই বেলা ভাত পেলেই সেদিন রাজভোজ মনে হয়। আম্পান ঝড়ের পর পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছোট ভাইটি কাজ খুঁজে পাচ্ছে না। রাবেয়া তাঁর মায়ের সঙ্গে এখানে–সেখানে সামান্য হাতের কাজ করে সংসার চালান।

আশপাশের কয়েকটি গ্রাম লবণাক্ততার জন্য পুরো জনশূন্য হয়ে নির্জন দ্বীপের মতো জেগে আছে। নোনাপানির প্রবল জোয়ারে দুই বেলা ভেসে যায় গ্রাম। দ্রুতই মারা যাচ্ছে এখানকার গাছপালা। যাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে, অন্য জায়গায় সরে যাওয়ায় তাঁরা হয়তো ভাগ্যবান।

KVOS2xM.jpg


হীরা মণ্ডলের স্বামীর মিষ্টির দোকান ঘূর্ণিঝড় আম্পানে নদীতে বিলীন

বিনোদিনীদের সংকোচ

উপকূলের নারী কায়িক শ্রমে কোনো অংশে কম নয় পুরুষের চেয়ে। কয়রার উত্তর বেদকাশিতে যেতে হয় নদীপথে। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পরই দেখা গেল দুজন নারী কোলে বিশাল এক বস্তা নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। নৌকায় থাকা স্থানীয় সহযাত্রীরা জানালেন, বস্তায় অন্তত ২০ থেকে ২৫ কেজি করে শামুক। ভাটায় এ শামুক খুঁটেছেন নারীরা। এখন জোয়ার আসার আগেই ঘরে ফেরার তাড়া। হাঁটু কাদায় গেঁথে যাচ্ছে পা। টেনে তোলার আগেই আরেক পা যেন ডুবছে। এমন যুদ্ধ করে টেনে নেওয়া ওই শামুক ধরতে হয় ভাটায় রেখে যাওয়া নোনাপানির কাদার ভেতর। নৌকাযাত্রীদের হাত–পায়ের অবস্থা দেখেই অনুমান করা যায় এর ভয়াবহ ফলাফল। লবণাক্ততায় চামড়ায় ঘা শুরু হয়েছে। পোড় খাওয়া রোদে পোড়া মুখগুলোতে সময়ের করুণ দাগ স্পষ্ট। পানি কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। কথা বলার সুযোগ আছে বুঝে এতক্ষণ চুপ করে থাকা এক অল্প বয়স্ক নারী এবার নড়েচড়ে বসলেন।

হীরা মণ্ডল নামের নারী ছয় মাসের সন্তানসম্ভবা। তালা থেকে বাবার বাড়ির কোনো এক আত্মীয় কয়রায় এসেছিল কিছু চাল-ডাল নিয়ে। তাই নিতে এসেছিলেন হীরা। হীরার স্বামীর মিষ্টির দোকান ঘূর্ণিঝড় আম্পানে নদীতে বিলীন। ঘরবাড়ি হারিয়ে কাশিরহাটখোলা বাঁধে থাকেন। হীরা সকালবেলা গজা নামের একধরনের মিষ্টি বানিয়ে দোকানে দোকানে ফেরি করেন। লবণপানিতে ভিজে, রোদে পুড়ে পেটে ছয় মাসের সন্তান নিয়ে দুপুরে নদীতে চিংড়ি ধরতে নামেন। কোনো কোনো দিন একটি পয়সাও আয় হয় না। হীরার স্বামী বাঁধ সংস্কারের কাজে দিনমজুর হওয়ার চেষ্টা করছেন, তবে সেখানেও তদবিরের ব্যাপার আছে বলে জানালেন তিনি।

প্রতাপনগরের জোবায়দার মতো উপকূলের এই নারীরও এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য হয়নি। সন্তান প্রসবে জটিলতা হলে কী করবেন জানতে চাইলে বাঁধে বসতি করা হীরা বললেন, গ্রাম্য কবিরাজই একমাত্র ভরসা। হীরার দেখানো পথেই আমরা কাশিরহাটখোলা বাঁধে উঠলাম। বিনোদিনী সরকার নামে এক কিশোরী মেয়ে ঘোমটা মাথায় দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সিঁথির গাঢ় সিঁদুর জানান দিচ্ছে সদ্য বিবাহিত সে। এক পাশে ডেকে জানতে চাইলে বিনোদিনী লজ্জা–সংকোচে যেন মাটিতে মিশে যেতে চায় অবস্থা। একটি ঝুপড়িঘরে স্বামীর পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে থাকে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় প্রতি মাসে পিরিয়ডের সময়। নোনাপানিতেই পরিচ্ছন্ন হওয়ার ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত জীবনের সামান্য আড়ালের কোনো সুযোগ নেই তার জন্য।

RJBxDbb.jpg


গীতা মুন্ডা নীল ছোট জালি নিয়ে কাঁকড়া খুঁজতে এসেছেন

শেষ লড়াইটা নারীর

দিন শেষ হয়ে আসার আগেই উপকূলের নদীতে ডুবে যেতে চায় সূর্য। গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে উপকূল এলাকায় ঠান্ডা–গরমের বৈপরীত্য। দুপুরের গরম যেমন বেশি, তেমনি শীতের হাওয়ার জোর। ম্রিয়মাণ আলোতে দেখা যায়, নৌকার কয়েক হাত সামনেই সামান্য উঁচু জায়গায় সন্ধ্যার আগে নোনাপানিতে নেমেছেন এখানকার গীতা মুন্ডা। নীল ছোট জালি নিয়ে কাঁকড়া খুঁজতে এসেছেন। ঝড়ের পর থেকে সমুদ্রের নোনাপানি নদীতে আরও বেশি মিশে যাওয়ায় মিঠাপানির মাছ আর মুন্ডাদের আমিষের জোগান ইঁদুর হারিয়ে গেছে। শুধু কাঁকড়াই তাদের একমাত্র ভরসা। আম্পান ঝড়ের আগে নদী এত বিস্তৃত ছিল না। পানির লবণাক্ততাও ছিল সহনশীল।

এখনো নদী আকস্মিক বদলে যায়। বর্তমান বাস্তবতায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সহনশীলতার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে চলেছেন উপকূলের নারীরা। ঝড় এলে ঘরের শেষ সম্বলটুকু রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত থেকে যান পরিবারের নারী সদস্যটি। জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের আঘাত থেকে সন্তানকে বাঁচাতে শেষ লড়াইটাও মায়ের।

এই জনপদের সর্বশেষ জনপদ দক্ষিণ বেদকাশি। এ গ্রামের পথটিও বন্ধুর। এক ইঞ্চি ঢালাই কোথাও নেই ইটের রাস্তায়। দক্ষিণ বেদকাশির আংটিহারা গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেন বললেন, গত বছরই তাঁদের গ্রামের এক নারীকে মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই সন্তান জন্ম দিয়েছেন এবং বাচ্চাটিকে বাঁচানো যায়নি।

২০০৯ সালে আইলার আঘাতের এক দিন পর গ্রামবাসীরা দেখেছেন, পানিতে ভেসে যাচ্ছে একই কাপড়ে নিজেদের বেঁধে রাখা মা ও তাঁর কয়েক মাসের সন্তানের ফুলে যাওয়া মৃতদেহ। নোনা নদীর পারের নারীরা শুধু সময়ের কাছে রেখে যাচ্ছেন তাঁদের এ যাপনের গল্প।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top