নানিয়ারচরে চাঞ্চল্যকর দুই হত্যাকান্ডে এখনো কোন কুলকিনারা হয়নি। গত ৩ ও ৪ মে সংঘটিত এই হত্যকন্ডে ৪ দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত থানায় কোনো মামলাও দায়ের হয়নি। সন্ত্রাসীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালালেও ধরা পড়েনি ঘটনার মূল হোতারা। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, যে কোনো মূল্যে অপরাধীদের অচিরেই গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু এতো আশ্বাসের পরও সাধারণ মানুষের মনে ভয় ও আতঙ্ক কাটেনি। অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। জনপ্রতিনিধিদের কেউ আছেন আত্মগোপনে, কেউবা সরে পড়েছেন নিরাপদ স্থানে। গোটা নানিয়ারচর এখন পরিণত হয়েছে এক আতঙ্কের জনপদে। নানিয়ারচর উপজেলার সাধারণ মানুষ মনে করছেন, আঞ্চলিক দলগুলোর আধিপত্যের লড়াই বন্ধ না হলে পাহাড়ে কখনোই শান্তি ফিরে আসবে না।
রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির জানান, নানিয়ারচর উপজেলায় যে হত্যাকান্ডে ঘটেছে তা পুলিশ খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এই হত্যাকান্ডে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা তদন্ত চলাচ্ছি, হয়তো মামলাটি রুজু হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে ঘটনার পর পরই নানিয়ারচর উপজেলায় অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানো হয়েছে। সর্বত্র পুলিশের পহরা বসানো হয়েছে। তিনি বলেন, যারা এই হত্যাকান্ডে সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এখানে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। সন্ত্রাসীরা যেই হোক তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ জানান, রাঙ্গামাটির সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। জনগণের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। জনগণের পাশে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও প্রশাসন রয়েছে। সাধারণ মানুষ যাতে সার্বিক নিরাপত্তা পায়, তার জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। তিনি বলেন, আসামিরা যে দলেরই হোক যতই শক্তিশালীই হোকÑ তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
নানিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আব্দুল লতিফ জানান, নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা এবং গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার পরিবারের কেউ এখনো মামলা দায়ের করতে আসেনি। নিহতদের স্বজনরা যদি মামলা না
করেন তাহলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করবে।
এদিকে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এডভোকেট শক্তিমান চাকমার হত্যার প্রতিবাদে গতকাল রবিবার রাঙ্গামাটিতে মানববন্ধন করেছে জেলা আইনজীবী সমিতি। রাঙ্গামাটি জেলা জজ কোর্ট প্রাঙ্গণের সামনে সকালে অনুষ্ঠিত এই মানববন্ধনে রাঙ্গামাটি আইনজীবী সমিতির শতাধিক আইনজীবী ও তাদের সহকারীরা অংশ নেন। তারা শক্তিমান চাকমার হত্যাকান্ডে প্রতিবাদ ও বিচারের দাবি জানান।
রাঙ্গামাটি আইনজীবী সমিতির সভাপতি পিপি রফিকুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন প্রবীণ আইনজীবী জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, প্রতিম রায় পাম্পু, সুস্মিতা চাকমা, মোক্তার আহমেদ প্রমুখ।
আইনজীবীরা শক্তিমান চাকমার হত্যাকান্ড কাপুরুষোচিত ঘটনা আখ্যায়িত করে বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় দলগুলোর হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানির রাজনীতির কারণে শক্তিমান চাকমাকে নিমর্মভাবে খুন হতে হয়েছে। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। পাহাড়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন আইনজীবী নেতারা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের দুইটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ায় পাহাড় আবারো অশান্ত হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতিতে আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের জন্য দলগুলো এখন একের পর এক খুনাখুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে মনে করেছেন রাঙ্গামাটির সুশীল সমাজের মানুষ। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির পর থেকে পাহাড়ি দলগুলোর বন্দুক যুদ্ধ, অপহরণ ও চাঁদাবাজির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। পাহাড়ের মানুষের শান্তির জন্য আঞ্চলিক দলগুলোর দ্ব›দ্ব সংঘাত বন্ধে তাদের সমঝোতায় আসা প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
উল্লেখ্য, গত ৩ মে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন রাঙ্গামাটির নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা। এর পরদিনই গুপ্ত হামলার শিকার হয়ে নিহত হন 'ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক' দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ ৫ জন। তারা প্রয়াত শক্তিমান চাকমার শশ্মানযাত্রী ছিলেন। খাগড়াছড়ি থেকে একটি মাইক্রোবাস করে নানিয়ারচর আসার পথে ওঁৎ পেতে থাকা অস্ত্রধারীরা তাদের ব্রাশফায়ারে করে। এ ঘটনার পর পাহাড়ের মানুষের মনে ভর করেছে আতঙ্ক।