জসিম সাহেবের সুখ
মুল লেখকঃ জনাব আসিফ রহমান জয়
জসিম সাহেব সপ্তাহে একদিন খুব আয়োজন করে বাজার করেন।
আগের রাতে জনে জনে জিজ্ঞেস করেন-
-'তোরা কে কি খাবি? কালকে বাজারে যাবো।'
বউকে বলেন-
-'শোনো...কালকে বাজারে যাবো, লিস্ট করে দাও।'
লিস্ট হাতে সকাল সকাল বাজারে ঢুকে পড়েন। এইসময় ভিড় কম থাকে, দরদাম করে আরাম পাওয়া যায়।
বাজারে ঢুকেই তিনি একটা মিষ্টি পান মুখে দেন। পান তার পছন্দের জিনিস না কিন্তু তিনি খেয়াল করেছেন পান খেতে খেতে বাজার করলে, জিনিসপত্র দর-দাম করার কেমন যেন একটা মুড চলে আসে। বাজারের দোকানিদের সাথে তাদের ভাষায় কথা বলতে পারেন, কানেক্ট করতে পারেন।
জসিম সাহেব মিষ্টি পান মুখে দিয়ে সকাল সকাল গরুর মাংস দরদাম করতে শুরু করলেন। দরদাম করতে তার খুব ভালো লাগে। তিনি নিজে একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সেলস ম্যানেজার। কিভাবে ক্লায়েন্টদেরকে পটাতে হয়, এই আর্ট তিনি ভালো করেই জানেন। অফিসে তিনি বিক্রি করেন, ক্লায়েন্টরা কেনেন। এই কেনা-বেচাতে কখনও তিনি জেতেন, কখনোবা হেরে যান। সাপ্তাহিক এই বাজারে তিনি কেনেন, দোকানিরা বিক্রি করে, এখানে তিনি কিছুতেই হারতে চান না।
আজকে গরুর মাংসের রেট - ৫৮০ টাকা কেজি। তিনি মাংস নেড়ে চেড়ে হাঁক ছাড়লেন-
-'৫৫০ টাকা হলে দুই কেজি দাও।'
দোকানির মুখ শুকিয়ে গেলো। জসিম সাহেবকে এই দোকানি ভালোমতোই চেনে, ব্যাটা বিশাল খাটাইস। ৫৫০ টাকা বললে, ৫৫০ই দিতে হবে। তবু সে মিনমিন করে বললো-
-'স্যার, এতো কমে কিনতামও ফারি না। ৫৬০ টাকায় তো আমারই কিনা।'
জসিম সাহেব পান চিবুতে চিবুতে সুন্দর করে পিক ফেললেন-
-'কি বলো... তোমার ওই পাশের দোকান ৫৬০ টাকায় সাধতেছে। ওর থেকে নিলাম না, কারন তোমার থেকে সবসময় নিই। ঠিকমতো না কিনতে পারলে ব্যবসা করা ছেড়ে দাও, বুঝলে। কেনার সময়ই জিততে হবে-এটাই ব্যবসার মূল মন্ত্র।'
-'স্যার... আর দশটা টাকা দিয়েন।'
-'৫৫০ টাকার এক পয়সা বেশী দিবো না।'
দোকানি মুখ কালো করে গরুর মাংস বানাতে শুরু করলো। জসিম সাহেব যুদ্ধ জয়ের আনন্দে একটা সিগারেট ধরালেন। একটা সিগারেটের দাম ১৫ টাকা।
দোকানির ক্যাশ বাক্সের পাশে বসা ওর ছোট মেয়েটা এক দৃষ্টিতে গরুর মাংস বানানো দেখছে। সে বাপের গাঁ ঘেষে আবদারের সুরে বললো-
-'বাজান...মায়ে কইসে নিহারির জন্য অল্প একটু হাড্ডি-মাংশ রাখতে। বাজান, নিহারি খাইতে মন চায়। অনেকদিন নিহারি খাই না।'
দোকানি ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মাংস কাটতে কাটতে লুংগির খুটা দিয়ে ঘাম মুছলো। রাগের স্বরে বললো-
-'চুপ থাক। যা বাইত যা... বাইত যায়া ভাত খা।'
মেয়ে মুখ কালো করলো-
-'বাবা, মায়ে কইসে এক হালি ডিম কিইনা দিতা।'
-'ডিম কেনার টাকা নাই... যা বাইত যা।'
জসীম সাহেববের বড় ছেলের চিংড়ি মাছ খুব পছন্দ, তিনি ঘুরে ঘুরে ৭০০ টাকা কেজি দামে বিশাল সাইজের চিংড়ি মাছ কিনলেন। তার বউয়ের পছন্দ পাবদা মাছ। জসিম সাহেব দুই কেজি চিংড়ি আর আড়াই কেজি পাবদা মাছ কিনে ফেললেন।
জসীম সাহেব বাজার শেষে হিসাব করতে বসলেন। এতো দরদাম করে তার শ' তিনেক টাকা সেভ হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, গত রাতে তিনি সবাইকে নিয়ে চাইনিজ খেয়েছেন। বিলের সাথে টিপস ই দিয়েছেন প্রায় তিন'শ টাকা। আমাদের পিছন দিয়ে হাতি চলে যায় কিন্তু সামনে দিয়ে মাছি গেলেই চোখ টাটায়!
জসিম সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গরুর মাংসের দোকানির মেয়েটার করুণ, কালো মুখটা তার চোখের সামনে ভাসছে। জসীম সাহেবরা ছোট বেলায় অনেক গরীব ছিলেন। বাসায় কদাচিৎ মাছ-মাংস কেনা হতো। যেদিন হতো সেদিন ঘরে কেমন যেন খুশীর হাওয়া বইতো, তার কাছে ঈদ-ঈদ মনে হতো।
জসীম সাহেবের আর বাজার করতে ইচ্ছা করছে না। তার হাতের ব্যাগগুলো কেন জানি খুব ভারি মনে হচ্ছে।
জসীম সাহেবের বউ নিলুফা বেগম বাজারের ব্যাগ খুলে আকাশ থেকে পড়লেন!
-'কি ব্যাপার... কি বাজার করছো? শুধু মুরগী আর পাব্দা মাছ?'
-'চিংড়ি কই? গরুর মাংশ কই? ডিম কই?'
জসিম সাহেব হাত মুখ ধুতে ধুতে বললেন-
-'আর বলো কেন, সবই তো কিনেছিলাম। ব্যাগ পায়ের কাছে রেখে বাজারের একপাশে চা খাচ্ছিলাম। চা-সিগারেট শেষ করে তাকিয়ে দেখি, একটা ব্যাগ হাপিস। নাহ... মানুষ আর মানুষ নাই। দাও, দেখি আমাকে এক কড়া করে এক কাপ চা দাও।'
-'তোমাকে কতো করে বলি... বাজার করার সময় ফেসবুকে ঢুকবা না। নিশ্চয়ই ফেসবুকে ঢুকছিলা... মন তো আর সাথে থাকে না...মন থাকে ফেসবুকে। এক হাতে চা, এক হাতে সিগারেট, আরেক হাতে ফেসবুক... এমন তো হবেই...'
নিলুফা বেগম গজ গজ করতে করতে চা বানাতে গেলেন।
দোকানির বউ বাজারের ব্যাগ খুলে আকাশ থেকে পড়লো।
-'চিংড়ি মাছ... এতো দামী মাছ আনছো? কি ব্যাপার? সাথে গরুর মাংস, পোলাউয়ের চাল! আজকে কি ঈদ নাকি!'
দোকানি হাসতে হাসতে বললো-
-'কিয়েরে...ঈদ ছাড়া কি মাঝে-মইদ্দ্যে ভালো জিনিস খাইতে মন চায় না? মেয়েটা কই... মেয়েটারে ভালো মতো খাওয়াও।'
জসীম সাহেব দুপুরবেলা সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন। তিনি খুব মজা করে মুর্গীর হাড় চিবাচ্ছেন। ফার্মের মুর্গী তার একেবারেই পছন্দ না। তাতে কি? আজ তার খুব আনন্দ হচ্ছে। দোকানির মেয়েটার কালো মুখের মিষ্টি হাসি তার চোখের সামনে ভাসছে।
অফিসে আর বাজারে কেনা-বেচা করতে করতে তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন-
-"চাইলে খুব অল্প দাম দিয়ে অনেকখানি সুখ কেনা যায়।"
মুল লেখকঃ জনাব আসিফ রহমান জয়
জসিম সাহেব সপ্তাহে একদিন খুব আয়োজন করে বাজার করেন।
আগের রাতে জনে জনে জিজ্ঞেস করেন-
-'তোরা কে কি খাবি? কালকে বাজারে যাবো।'
বউকে বলেন-
-'শোনো...কালকে বাজারে যাবো, লিস্ট করে দাও।'
লিস্ট হাতে সকাল সকাল বাজারে ঢুকে পড়েন। এইসময় ভিড় কম থাকে, দরদাম করে আরাম পাওয়া যায়।
বাজারে ঢুকেই তিনি একটা মিষ্টি পান মুখে দেন। পান তার পছন্দের জিনিস না কিন্তু তিনি খেয়াল করেছেন পান খেতে খেতে বাজার করলে, জিনিসপত্র দর-দাম করার কেমন যেন একটা মুড চলে আসে। বাজারের দোকানিদের সাথে তাদের ভাষায় কথা বলতে পারেন, কানেক্ট করতে পারেন।
জসিম সাহেব মিষ্টি পান মুখে দিয়ে সকাল সকাল গরুর মাংস দরদাম করতে শুরু করলেন। দরদাম করতে তার খুব ভালো লাগে। তিনি নিজে একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সেলস ম্যানেজার। কিভাবে ক্লায়েন্টদেরকে পটাতে হয়, এই আর্ট তিনি ভালো করেই জানেন। অফিসে তিনি বিক্রি করেন, ক্লায়েন্টরা কেনেন। এই কেনা-বেচাতে কখনও তিনি জেতেন, কখনোবা হেরে যান। সাপ্তাহিক এই বাজারে তিনি কেনেন, দোকানিরা বিক্রি করে, এখানে তিনি কিছুতেই হারতে চান না।
আজকে গরুর মাংসের রেট - ৫৮০ টাকা কেজি। তিনি মাংস নেড়ে চেড়ে হাঁক ছাড়লেন-
-'৫৫০ টাকা হলে দুই কেজি দাও।'
দোকানির মুখ শুকিয়ে গেলো। জসিম সাহেবকে এই দোকানি ভালোমতোই চেনে, ব্যাটা বিশাল খাটাইস। ৫৫০ টাকা বললে, ৫৫০ই দিতে হবে। তবু সে মিনমিন করে বললো-
-'স্যার, এতো কমে কিনতামও ফারি না। ৫৬০ টাকায় তো আমারই কিনা।'
জসিম সাহেব পান চিবুতে চিবুতে সুন্দর করে পিক ফেললেন-
-'কি বলো... তোমার ওই পাশের দোকান ৫৬০ টাকায় সাধতেছে। ওর থেকে নিলাম না, কারন তোমার থেকে সবসময় নিই। ঠিকমতো না কিনতে পারলে ব্যবসা করা ছেড়ে দাও, বুঝলে। কেনার সময়ই জিততে হবে-এটাই ব্যবসার মূল মন্ত্র।'
-'স্যার... আর দশটা টাকা দিয়েন।'
-'৫৫০ টাকার এক পয়সা বেশী দিবো না।'
দোকানি মুখ কালো করে গরুর মাংস বানাতে শুরু করলো। জসিম সাহেব যুদ্ধ জয়ের আনন্দে একটা সিগারেট ধরালেন। একটা সিগারেটের দাম ১৫ টাকা।
দোকানির ক্যাশ বাক্সের পাশে বসা ওর ছোট মেয়েটা এক দৃষ্টিতে গরুর মাংস বানানো দেখছে। সে বাপের গাঁ ঘেষে আবদারের সুরে বললো-
-'বাজান...মায়ে কইসে নিহারির জন্য অল্প একটু হাড্ডি-মাংশ রাখতে। বাজান, নিহারি খাইতে মন চায়। অনেকদিন নিহারি খাই না।'
দোকানি ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মাংস কাটতে কাটতে লুংগির খুটা দিয়ে ঘাম মুছলো। রাগের স্বরে বললো-
-'চুপ থাক। যা বাইত যা... বাইত যায়া ভাত খা।'
মেয়ে মুখ কালো করলো-
-'বাবা, মায়ে কইসে এক হালি ডিম কিইনা দিতা।'
-'ডিম কেনার টাকা নাই... যা বাইত যা।'
জসীম সাহেববের বড় ছেলের চিংড়ি মাছ খুব পছন্দ, তিনি ঘুরে ঘুরে ৭০০ টাকা কেজি দামে বিশাল সাইজের চিংড়ি মাছ কিনলেন। তার বউয়ের পছন্দ পাবদা মাছ। জসিম সাহেব দুই কেজি চিংড়ি আর আড়াই কেজি পাবদা মাছ কিনে ফেললেন।
জসীম সাহেব বাজার শেষে হিসাব করতে বসলেন। এতো দরদাম করে তার শ' তিনেক টাকা সেভ হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, গত রাতে তিনি সবাইকে নিয়ে চাইনিজ খেয়েছেন। বিলের সাথে টিপস ই দিয়েছেন প্রায় তিন'শ টাকা। আমাদের পিছন দিয়ে হাতি চলে যায় কিন্তু সামনে দিয়ে মাছি গেলেই চোখ টাটায়!
জসিম সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গরুর মাংসের দোকানির মেয়েটার করুণ, কালো মুখটা তার চোখের সামনে ভাসছে। জসীম সাহেবরা ছোট বেলায় অনেক গরীব ছিলেন। বাসায় কদাচিৎ মাছ-মাংস কেনা হতো। যেদিন হতো সেদিন ঘরে কেমন যেন খুশীর হাওয়া বইতো, তার কাছে ঈদ-ঈদ মনে হতো।
জসীম সাহেবের আর বাজার করতে ইচ্ছা করছে না। তার হাতের ব্যাগগুলো কেন জানি খুব ভারি মনে হচ্ছে।
জসীম সাহেবের বউ নিলুফা বেগম বাজারের ব্যাগ খুলে আকাশ থেকে পড়লেন!
-'কি ব্যাপার... কি বাজার করছো? শুধু মুরগী আর পাব্দা মাছ?'
-'চিংড়ি কই? গরুর মাংশ কই? ডিম কই?'
জসিম সাহেব হাত মুখ ধুতে ধুতে বললেন-
-'আর বলো কেন, সবই তো কিনেছিলাম। ব্যাগ পায়ের কাছে রেখে বাজারের একপাশে চা খাচ্ছিলাম। চা-সিগারেট শেষ করে তাকিয়ে দেখি, একটা ব্যাগ হাপিস। নাহ... মানুষ আর মানুষ নাই। দাও, দেখি আমাকে এক কড়া করে এক কাপ চা দাও।'
-'তোমাকে কতো করে বলি... বাজার করার সময় ফেসবুকে ঢুকবা না। নিশ্চয়ই ফেসবুকে ঢুকছিলা... মন তো আর সাথে থাকে না...মন থাকে ফেসবুকে। এক হাতে চা, এক হাতে সিগারেট, আরেক হাতে ফেসবুক... এমন তো হবেই...'
নিলুফা বেগম গজ গজ করতে করতে চা বানাতে গেলেন।
দোকানির বউ বাজারের ব্যাগ খুলে আকাশ থেকে পড়লো।
-'চিংড়ি মাছ... এতো দামী মাছ আনছো? কি ব্যাপার? সাথে গরুর মাংস, পোলাউয়ের চাল! আজকে কি ঈদ নাকি!'
দোকানি হাসতে হাসতে বললো-
-'কিয়েরে...ঈদ ছাড়া কি মাঝে-মইদ্দ্যে ভালো জিনিস খাইতে মন চায় না? মেয়েটা কই... মেয়েটারে ভালো মতো খাওয়াও।'
জসীম সাহেব দুপুরবেলা সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন। তিনি খুব মজা করে মুর্গীর হাড় চিবাচ্ছেন। ফার্মের মুর্গী তার একেবারেই পছন্দ না। তাতে কি? আজ তার খুব আনন্দ হচ্ছে। দোকানির মেয়েটার কালো মুখের মিষ্টি হাসি তার চোখের সামনে ভাসছে।
অফিসে আর বাজারে কেনা-বেচা করতে করতে তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন-
-"চাইলে খুব অল্প দাম দিয়ে অনেকখানি সুখ কেনা যায়।"