What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Other মেরা নাম শবনম : পাকিস্তানি সিনেমার বাঙালি সুপারস্টার! (1 Viewer)

Starling

Board Senior Member
Elite Leader
Joined
Mar 7, 2018
Threads
775
Messages
12,015
Credits
220,609
Recipe wine
Kaaba
Profile Music
Birthday Cake
OSZCda6.jpg


(বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত নায়িকা শবনমকে নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় দৈনিক এইসময়ে লেখাটি প্রকাশ হয় ২ মার্চ। লিখেছেন রূপায়ন ভট্টাচার্য। মূল শিরোনাম 'মেরা নাম শবনম : পাকিস্তানি সিনেমার সুপারস্টার যখন বাঙালি অভিনেত্রী!' এছাড়া লেখার মাঝে এক জায়গায় আছে— বিয়ে করে আমেরিকা পাড়ি জমান শাবানা। আশা করি, পাঠক ভিনদেশি লেখকের তথ্য ঘাটতিতে অবগত আছেন। তবে শবনমকে নিয়ে এমন লেখা পেয়ে আমরা গর্বিত। প্রকাশের লোভ সামলানো গেল না।)

মেহেদি হাসান মৃত্যুশয্যায় শুয়ে-বাক্যটি লিখতেই কেমন লাগে! অথচ সত্যিই তিনি তখন মৃত্যুশয্যায়৷ সে দিন এক বাঙালি অভিনেত্রীকে দেখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল পক্ষাঘাতদগ্রস্ত গজল সম্রাটের মুখ৷ বহুদিনের চেনা ওই মুখ তিনি ভোলেননি, বোঝাই গেল৷ আর করাচিতে তার বাড়িতে চার পাশের লোকদের মুখে সম্ভ্রম ঠিকরে বেরোচ্ছিল অভিনেত্রীর রাজকীয় ভঙ্গি দেখে৷

পাঁচ বছর আগে এপ্রিলে মেহেদি সাহেবকে দেখতে গিয়েছিলেন ওই বাঙালি নায়িকা৷ জুনেই মেহেদির ইন্তেকাল৷

ক'দিন আগে গত ফেব্রুয়ারিতে সেই অভিনেত্রী আবার লাহোর লিটারারি মিটের মঞ্চে৷ তাঁকে দেখার জন্য কী আকুতি আম পাকিস্তানিদের৷ কেউ তার পুরোনো ছবি এনেছেন অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য৷ তার চুলের খোঁপায় কাঠগোলাপের ফুল নিয়ে কী চর্চা৷ তাঁকে নিয়ে পাকিস্তানিদের অপার কৌতূল দেখে অবাক হতে হয়৷

ইন্টারনেটে তার নামে সার্চ দিলে অজস্র উর্দু সিনেমার ছবি৷ পাকিস্তানে তাঁকে নিয়ে কত অনুষ্ঠান৷ টিভিতে, রেডিওতে৷ সব দেখি এবং বারবার খেয়াল করি, তাকে দেখে পাকিস্তানি আম জনতার অভিব্যক্তি৷ যেন মুম্বাইয়ে এক লহমায় আবার একসঙ্গে উঠে এসেছেন মধুবালা এবং নার্গিস৷ সুপারস্টার৷ হারিয়ে যাওয়া কোনও সুপারস্টার আবার হাজির চোখের সামনে৷ গত মাসে তিনি পাকিস্তানে যাওয়ার পর, যখন বলেছেন, 'আমি আবার অভিনয় করতে চাই, তার জন্য উপচে পড়েছে প্রস্তাব৷ পাক রেডিওতে বিশেষ খবর বলা হয়, আবার পাকিস্তানে সিনেমায় নামছেন তিনি৷ ললিউডে নাকি শুটিং শুরু হবে ক'দিন পরে৷

এই বাঙালি নায়িকার নাম জানেন কেউ?

সুচিত্রা সেনকে নিয়ে এই বাংলার আমজনতা উদ্বেলিত৷ সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী চক্রবতী, সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে উদ্বেলিত কলকাতার সমালোচক কূল৷

O3Gladf.jpg


কিন্তু ইনি তো এদের কেউ নন৷ একে নিয়ে কোথাও কোনও কোনও কাগজে লেখা দেখিনি এই বাংলায়৷ পাকিস্তানি সিনেমায় সুপারস্টার এক বাঙালি অভিনেত্রী-ব্যাপারটার থেকে কম রোমাঞ্চক আর কী হতে পারে?

এ পারের বাঙালিরা তাকে না চিনুক, তাতে কিছু এসে যায় না ঝর্ণা বসাকের৷ তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিক সীমানার বাধা পেরিয়ে প্রথম বাঙালি সুপারস্টার৷ হয়তো শেষও৷ সীমান্তের কাঁটাতার তার বাধা হতে পারেনি৷

আজ্ঞে হ্যাঁ, ঝর্ণা বসাক নামটা ঠিকই লিখেছি৷ ঢাকার এক ফুটবল রেফারি ননী বসাকের মেয়ে৷ পাকিস্তানের কাগজে আজও তাঁকে নিয়ে যা চর্চা দেখি, তা দেখলে মনে হয়, আমাদের টলিউডে প্রতিদিন ছবি বেরোনো অভিনেত্রীরা কত ভাগ্যবতী৷ একটা সিনেমাতেই এঁদের কত প্রচার৷

আর ঝর্ণা বসাক পাকিস্তানের ললিউডে অন্তত ১৫২ উর্দু সিনেমা করেছেন৷ ভুল নয়, ১৫২ সিনেমা৷ সঙ্গে ৪ টি পাঞ্জাবি সিনেমা৷ ষাটের দশক থেকে আশির দশক-মানে বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার পরেও রাজত্ব চালিয়ে গিয়েছেন সেখানে৷ যখন দুটো দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক চরম তিক্ত, তখনও ভালোবাসা কুড়িয়েছেন ওয়াঘার ও পারে৷ পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা অভিনেত্রী হওয়ার দাবিদার৷ আমাদের এখানে যেমন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, পাকিস্তানে তেমন নিগার পুরস্কার৷ ঝর্ণা সেরা নায়িকার স্বীকৃতি পেয়েছেন ১৩ বার৷ পাকিস্তানে কোনও নায়িকা এতবার এই স্বীকৃতি পাননি৷

পাকিস্তানে এই ঝর্ণা বসাক পরিচিত 'শবনম' নামে৷

শবনমের কাছে অন্য বাঙালি অভিনেত্রীরা কোথায় লাগে? কোনও বাঙালি নায়িকাই আর এই নজির গড়তে পারবেন না৷ নিজের ওপর ধিক্কারই লাগে, বাংলাদেশের বাঙালি অভিনেত্রী বলে আমরা কত নাম জানি৷ ববিতা (অশনি সঙ্কেত), চম্পা (পদ্মা নদীর মাঝি), শাবানা (শক্রু, হিন্দি ছবি রাজেশ খান্নার সঙ্গে), রোজিনা (অন্যায় অবিচার), সুছন্দা (ববিতা, চম্পার বোন), অঞ্জু ঘোষ (বেদের মেয়ে জ্যোত্স্না)৷ হাল আমলের জয়া এহসান, মাহিয়া মাহি, কুসুম শিকদার, দিলরুবা রুহি, সোহানা সাবা৷ কিন্তু নামটা শুনিনি৷ অবশ্য শবনমকে ব্যবহারই করেনি বাংলা সিনেমা৷ ১৯৯৯ সালেও পাকিস্তান ফেরত শবনম একটি বাংলা সিনেমা করেন ঢাকায়৷ আম্মাজান-ফিল্মের লাইনের ভাষায় ব্লক ব্লাস্টার৷ তার পরে আর সে দেশেই বা তাঁকে ব্যবহার করা হল কোথায়?

IwptNbC.jpg


তার জীবনই তো একটা সিনেমার মতো৷

শবনমের মতো শাবানাও পুর্ব পাকিস্তানে থাকার সময় উর্দু ছবিতে অভিনয় করেছেন অনেক৷ নাদিমও ছিলেন তার নায়ক৷ দু'জনের 'চকোরি' সিনেমা ছিল সুপারহিট৷ কিন্তু পরে বাংলাদেশ ছাড়তে না পারায় পাকিস্তানে ঝড় তুলতে পারেননি৷ যতদূর জানি, সেই শাবানা ১৯৯৮ সালে অভিনয় ছেড়ে দেন৷ ২০০০ সালে চলে যান আমেরিকায়৷

শবনমের ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করে কোনও লাভ হয় না৷ ফোন বেজেই যায়৷ পাকিস্তান থেকে ফেরেননি তখনও৷ বাংলাদেশি সাংবাদিকদের কাছে শুনলাম, তিনি অত্যন্ত ঘরোয়া৷ খুব সাদামাঠা জীবন৷ রুনা লায়লার বাড়ি পার্টি হলে চলে যান হইচই করতে৷ কিন্তু বাংলাদেশের কাগজে তাঁকে নিয়ে যে খুব লেখালেখি, সেটাও তো দেখলাম না৷ যত ইন্টারভিউ, কাগজে, টিভিতে, সব পাকিস্তানের কাজে৷ তার সঙ্গে কথা না বলে লেখা, অনেক তথ্য গোলমেলে হতে পারে৷ ইতস্তত করছিলাম, লেখাটা উচিত কিনা৷ কিন্তু পরে মনে হল, লেখা উচিত৷ তার জীবন নয়তো আড়ালেই থেকে যেত৷

তিন দশক ধরে কী করে তিনি পাকিস্তানে সাম্রাজ্য চালালেন?

১৯৬২ সালে করাচির নিশাত সিনেমা হলে ঝর্ণার প্রথম উর্দু সিনেমা রিলিজ করে৷ নাম 'চন্দা'৷ পরিচালক এতেসামই ঝর্ণার নাম পাল্টে রাখেন 'শবনম'৷ সিনেমাটা সুপারহিট হলেও নায়িকা ছিলেন অন্য এক জন, সুলতানা জামন৷ কিন্তু সব মনোযোগ কেড়ে নেন শবনম৷

পুর্ব পাকিস্তান থাকার সময় বেশ কিছু উর্দু সিনেমা করে 'শবনম' হয়ে ওঠেন অনন্য এক অভিনেত্রী৷

পাকিস্তানের 'চকোলেট হিরো' ওয়াহিদ মুরাদ পাকিস্তানের ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রির সঙ্গে সরাসরি প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন ঝর্ণার৷ ১৯৬৮ সালে 'সমন্দত' সিনেমায় প্রথম পাক যাত্রা শুরু৷ বাংলাদেশ যুদ্ধ যখন শুরু, তার অনেক আগে রবীন ও ঝর্ণা করাচিতে ডেরা বেঁধেছেন৷ তার পর এত সিনেমা, এত নানা বৈচিত্র্যময় চরিত্রে সই করেন তিনি৷ কোনও সমস্যা হয়নি৷ করাচিতে প্রথম কয়েক যুগ কাটানোর পর তাঁরা সংসার করেন লাহোরে৷ পাকিস্তানে এই দম্পতির দুটো অধ্যায় দুটো শহরে৷

ভাবুন, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হয়ে গিয়েছে তখন৷ ১৯৭৭ সাল৷ তার ও অভিনেতা নাদিমের জুটি পাকিস্তানে রাজ কাপুর-নার্গিস, ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনী, উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেনের জুটির মতো জনপ্রিয়তা পায়৷ শবমন-নাদিমের 'আয়না' পাক বক্স অফিসে সব রকম রেকর্ড ভেঙে দেয়৷ পাকিস্তানের একমাত্র 'ক্রাউন জুবিলি' ফিল্ম এই আয়না৷ করাচির দুটো সিনেমা হল 'ব্যাম্বিনো' ও 'স্কালা'তে মুক্তি পায় প্রথমে৷ টানা ৪৮ সন্তাহ চলে৷ গোটা দেশে সব মিলিয়ে ৪০১ সন্তাহ চলেছিল৷ এখনও সেই রেকর্ড ভাঙতে পারেনি কোনও পাক ছবি৷ বরং ২০১৩ সালে ওই এক প্লটে রিলিজ করে 'আয়না'৷

ভাবা যায়, ১৯৭৭ সালে এক বাঙালি অভিনেত্রীকে নায়িকা করে এক সিনেমা মাতাচ্ছে পাকিস্তান৷ সেই ছবি চলছে চিনেও৷ পাকিস্তানে ১২ টি পুরস্কার জিতে ফেলেছে সেই সিনেমাই৷ মেহদি হাসানের গলায় 'মুঝে দিল সে না ভুলানা' পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠেছে৷ মেহদি হাসানের মৃত্যুর আগে শবমন যখন পাকিস্তানে গিয়ে তার হাতে ফুল দিচ্ছেন, তখনও পাক টিভিতে ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজেছে 'মুঝে দিল সে না ভুলানা'৷

পাকিস্তানের কাগজে পড়ে যা বুঝলাম, বাঙালি রেফারির মেয়ে উর্দু সিনেমা মাতিয়ে দিয়েছিলেন দুটো কারণে৷ অভিনয় প্রতিভা এবং বৈচিত্র্যে৷ এখনও পাকিস্তানের লোকেরা ভোলেন না তার নানা চরিত্র৷ 'জঞ্জির' (১৯৭৫) ছবির ক্লাব ড্যান্সার, 'শরাফত' (১৯৭৪) ছবির নর্তকী, 'বন্দিশ' ছবির দুঃখী কে স্ত্রী, 'নহি আভি নহি'র এক প্রবীণা (১৯৮০, মা ও মেয়ের ডাবল রোল 'জিনাত' ছবিতে৷ পাকিস্তানি কাগজে তার এক ইন্টারভিউতে পড়লাম, ঝর্ণা বসাকের অন্যতম ফেভারিট উর্দু ছবি হল 'দুঁরিয়া'৷ যে ছবিতে অভিনয়ের পর পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার পান তিনি৷ আনমল, বন্দিশ, লাজাওয়াল-টুকরো টুকরো করে পাকিস্তানি সিনেমাগুলো ইউটিউবে দেখে মনে হয়, শবনমকে নিয়েই একটা আত্মজীবনী মূলক সিনেমা করা উচিত৷ নাদিম ছাড়া মহম্মদ আলি, শাহিদ-দুই সুপারস্টারের সঙ্গে শবনমের জুটি অসাধারণ জনপ্রিয় ছিল৷ কত হিট গান ছিল শবনমের লিপে৷ তার 'ক্যারাভান'ই প্রথম পাক ছবি, যার শুটিং হয় পাকিস্তানের বাইরে৷ নেপালে৷ পড়া কথা, সিনেমায় ব্যবহার করা ঝর্ণার সব শাড়ি যেত ভারত থেকে৷ পাঠাতেন তার মা ও বোন৷

5PafvWU.jpg


বাংলাদেশে চলে যাওয়ার পরেও তার অনেক সিনেমা রিলিজ হয় পাকিস্তানে৷ কেমন দাপট ছিল তার? তিনি থাকলে ছবিতে আর দ্বিতীয় নায়িকার দরকার পড়ত না ওই সিনেমায়৷ পাকিস্তানের কাগজেই তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি কেন অন্য নায়িকার সঙ্গে কাজ করতেন না? এটা কি আত্মবিশ্বাসের অভাব? শবনম বলেছিলেন, 'এটা আত্মবিশ্বাসের অভাবের জন্য নয়৷ একটা খুব খারাপ অভিজ্ঞতার জন্য৷ প্রয়াত পরিচালক হাসান তারিকের সঙ্গে একটা সিনেমায় কাজ করব বলে সই করেছিলাম৷ তখন তার স্ত্রী ছিলেন অভিনেত্রী৷ তার নাম রাণি৷ আমাকে যা স্ক্রিপ্টের কথা বলা হয়েছিল, পরে দেখলাম লোকেশনে গিয়ে সব একেবারে পাল্টে গিয়েছে৷ আমার গুরুত্ব অনেক কমে গিয়েছে৷ আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, এমন ধরনের মুভি আর করব না৷'

দাপট সত্যিই একে বলে বলিউডে হেমা মালিনী, নার্গিস, নতুন, মধুবালাদের ক্ষেত্রে যেমন গল্প শোনা যেত৷

২০১২ সালে ১৪ বছর পর আবার পাকিস্তান গিয়েছিলেন শবনম৷ সেখানে তার সংবর্ধনায় হাজির ছিল পুরো ললিউড৷ এখনকার সুপারস্টার নায়িকা বিন্দিয়াকে অভিভূত দেখায় শবনমের সামনে৷ আর শবনমের সঙ্গে যাঁর জুটি একেবারে রাজকাপুর-নার্গিসের মতো জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেখানে, সেই নাদিম বলেন, 'আমাদের জুটির যে সব সিনেমা হিট হয়েছিল, তার সব কৃতিত্ব দেওয়া উচিত শবনমকে৷ কেননা ওর যতটা অংশই থাক না কেন, দারুণ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছিল ও৷' তখন রবীন ঘোষ জীবিত৷ তার গানের জনপ্রিয়তার জন্য তাঁকে অনেকে বলতেন, 'পাকিস্তানের মদনমোহন৷' নাদিম বাংলাদেশের স্বামী-স্ত্রীকে বলেছিলেন, 'চোদ্দো বছর পর পরে পাকিস্তানে এলে তোমরা৷ মোটেই ঠিক হয়নি৷ তোমাদের আসা উচিত চোদ্দো মাস বা চোদ্দো দিন অন্তর৷ তোমরা আমাদেরই অংশ৷ এতদিন তোমরা দূরে থাকতে পারো না৷' শবনম সে বার মেহদি হাসানের পাশাপাশি দেখা করেছিলেন তার সহঅভিনেতা, পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা কমেডিয়ান লহেরির সঙ্গে৷ খুব আন্তরিকতা নিয়ে৷ অসুস্থ লহেরি সে বছরই প্রয়াত হন৷

সে বার লাহোরের বিখ্যাত এফসি কলেজে তাঁকে ঘিরে ছাত্রছাত্রীরা কী কৌতূল নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন করছিলেন৷ আপনার চুল এখনও এত কালো কী করে? পাকিস্তানের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এমন খারাপ অবস্থা হল কী করে? প্রথম প্রশ্নে শবনম হেসে বলেছিলেন, 'চুলের ব্যাপারটা পারিবারিক আর নারকেল তেলের যোগ৷' দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা আরও মজার, 'আমি তো পাকিস্তানি ইন্ডাস্ট্রিতে আর যুক্ত নই বহুদিন৷ আমি কী করে বলব?'

ঢাকায় এখন কী করে সময় কাটে শবনমের? শুনলাম, ঢাকার বাড়িতে তিনি নিয়মিত পাকিস্তানের সিনেমা দেখেন ফিল্মআজিয়া চ্যানেলে৷ ঝর্ণা বসাকের অন্যতম শক্তি ছিলেন স্বামী রবিন ঘোষ৷ তিনি নিজে এক বিখ্যাত সুরকার৷ পাক সঙ্গীত জগতের লোকেরা এক ডাকে চেনে৷ অনেক ভালো ভালো সিনেমায় সুর রয়েছে তার৷ পাকিস্তানের ঐতিহাসিক ছবি 'আয়না' তে সুর রবিনের৷ পাঁচের দশকে ঢাকায় রেডিওতে রবীনকে কাজের প্রস্তাব দেন তার এক বন্ধু৷ সেই বন্ধুর বোনই ঝর্ণা৷ তাঁদের প্রেম এবং বিয়ে।

নিজের দেশ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর একেবারে অন্যরকম পরিবেশে গিয়ে ঝর্ণা যে রাজত্ব করেছেন, তার কারণ রবীন৷ গত বছর ফেব্রুয়ারিতে যিনি প্রয়াত হন৷ পাকিস্তানে গেলে প্রতিবার শবনম ও রবীনকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান হত নানা চ্যানেলে৷ মনে হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যে পাকিস্তানে গিয়ে অত কাজ করে গিয়েছেন, তার কারণ রবীনের উপস্থিতি৷ এই ঘটনা আর একবার দেখিয়ে দিয়ে যায়, শিল্প সংস্কতির কাছে শেষ পর্যন্ত ঠিক হেরে যায় রাজনীতি৷ কেন যে এই কাহিনী ভালো করে প্রচার হয় না?

ক'দিন আগে লাহোর লিটারারি মিটে গিয়ে সাংবাদিকদের শবনম বলেছেন, 'পঞ্চাশ বছর হল পাকিস্তানে আসছি৷ এই প্রথম আমি একা৷ পাশে রবীন নেই৷ পঞ্চাশ বছর ওর সঙ্গে কাটিয়েছি৷ প্রতিটি পদক্ষেপে ওকে দেখতে পাই৷' ওখানেই তার সহজ সরল স্বীকারোক্তি, 'পাকিস্তান আমার দ্বিতীয় বাড়ি৷ পাকিস্তানকে আমি ভুলতে পারব না৷ আমার অনেক বন্ধু ওখানে৷ আমার এখনও বিশ্বাস, আমার দুটো মা৷ এক মা, বাংলাদেশ, আমায় জন্ম দিয়েছে৷ অন্য মা, পাকিস্তান আমায় বড় করে তুলেছে৷ আমার নাম, সম্মান সব পাকিস্তানের জন্য৷' তার কথাবার্তা, অভিব্যক্তি সব ইন্টারনেটের দৌলতে চেনা৷ কী রাজকীয় অভিব্যক্তি ও চালচলন এই বয়সে৷ দেখে অবাক হতে হয়৷

স্বাভাবিক৷ ঠিক বলেছেন৷ এখানেই দুটো প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘোরে৷ এ পারের হিন্দি বা বাংলা সিনেমায় কেন কাজে লাগানো হল না পাকিস্তানের এক নম্বর অভিনেত্রী ও সুরকারকে?পাকিস্তানে আবার প্রশ্ন অন্য৷ এই প্রশ্নটা দেখলাম বারবার ওখানে করা হয় তাঁকে৷ কেন আপনি দুম করে সব রাজত্ব ছেড়ে চলে গেলেন বাংলাদেশে? তার পর বহু বছর যাননি৷ স্বাভাবিক কারণেই তাঁকে নিয়ে নানা রটনা রয়েছে পাকিস্তানে৷ অসুস্থতাই কি প্রধান কারণ, না, অন্য কিছু? রাজনৈতিক টানাপোড়েনও কি কারণ হতে পারে? পাকিস্তানে তার একটা স্ট্রোক হয়েছিল ওই সময়৷ দেখলাম, পাক সাংবাদিকদের কাছে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্পষ্ট করে৷ 'আমি মোটেই হুট করে পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাইনি৷ আমার বাবা-মা ছিলেন গুরুতর অসুস্থ৷ আমি তাঁদের মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে চেয়েছিলাম৷ ওঁদেরকে আমি পাকিস্তানে এনেছিলাম আমার সঙ্গে থাকার জন্য৷ কিন্ত্ত ওঁদের ভাষা নিয়ে সমস্যা ছিল৷ একটা সময় আসে, বয়স বাড়লে লোকে নিজেদের লোকের কাছে থাকতে চায়৷ তা ছাড়া আমি আর ভালো রোল পাচ্ছিলাম না পছন্দের মতো৷ সব অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হয়ে আসছিল৷ আমি মনে করি, গ্রেসফুলি বিদায় নেওয়াটা ভালো৷ গুরুত্বহীন রোলের জন্য পড়ে থাকার কোনও মানে হয় না৷ আমার পাকিস্তানে স্ট্রোক হয়েছিল৷ তার পর সেরে উঠি৷ বাংলাদেশে কিছুটা সমস্যা হয়৷ তারপর আমি পুরো ফিট৷' শুনে নাছোড়বান্দা পাক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্ত্ত কেন পাকিস্তানে আপনার কোনও খবর পাওয়া যেত না? শবনম বলেছিলেন, 'আমি আর পাক ফিল্ম ইনডাস্ট্রির কেউ নই বলে৷'

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে তার ইন্টারভিউগুলো দেখে শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়৷ আপনি আর স্টুডিওর জীবন মিস করেন না? এই প্রশ্নে চমত্কার বলেছেন, 'সত্যি বলতে কী, একেবারে করি না৷ ১৯৭৭ সালে 'আয়না' হিট হওয়ার পরই আমি ভেবেছিলাম, আমার নামার পালা এ বার৷ কিন্ত্ত ঈশ্বর আমার প্রতি সদয় ছিলেন৷ পাকিস্তানি ফিল্ম ইনডাস্ট্রিতে আমি লম্বা ইনিংস খেলেছি৷ একটা সময় একে বিদায় জানাতেই হত৷'

এ সব পড়তে পড়তেই দেখে শুনি শবনমের লিপে অজস্র উর্দু হিট গান৷ পাকিস্তানের সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী নুরজাহানের গলাতেই কত গান৷ তার নায়ক আবার গাইছেন মেহদি হাসানের গলায় গান৷ স্বপ্নের মতো ব্যাপার-প্রেমের ডুয়েট গাইছেন মেহদি হাসান-নুরজাহান৷ নায়িকা এক জন বাঙালি৷

শুনে প্রথমে মনে হয়, একেবারে আদ্যন্ত বাঙালি তরুণী কী করে এত চমত্কার লিপ দিলেন গানগুলোতে? তার সেই ভঙ্গি অনন্য৷ চুলের স্টাইল৷ ভ্রু-র ওঠানামা৷

'দিল্লাগি' সিনেমায় 'সাথ হামারা'তে মেহদি-নুরজাহানের ডুয়েটে দামী গাড়ি থেকে নেমে প্রেমিকের সঙ্গে গাইছেন ঢাকার মেয়ে৷

'আরজু' সিনেমায় 'জীবন ভর সাথ' গানে পাহাড়ের পথে মেহদি-নুরজাহানের গলায় লিপ দিচ্ছেন তিনি৷

'নসিব' সিনেমায় 'রুত বদলে চাহে মৌসম' গানে বাচ্চাকে নিয়ে কেক কাটা থেকে শুরু করে অতীতে ফিরে বাগানে প্রেম৷ সেটাও মেহদি-নুরজাহানের হিট ডুয়েট৷

'আব্রু' সিনেমায় 'না মেহরবা না আজনবি' গানে জলসায় নুরজাহানের গলায় গজল৷

ও রকমই অসাধারণ একটা গজল রয়েছে ঝর্ণার লিপে 'কিসি মেহরবা নে আকে মেরে জিন্দেগি সাজা দি'

পাক সুপারস্টার নাদিমের সঙ্গে ১৯৮০ সালের 'হাম দোনা' সুপারহিট ফিল্মে একটা কাওয়ালি 'কভি হাম দোনো'তে লিপ দিচ্ছেন ঝর্ণা৷ দেখলে বোঝা যায়, ষাটের দশক থেকে কী চমত্কার বিবর্তণ৷ নিজেকে পাল্টেছেন কী অসাধারণ৷ এই জন্যই বোধহয় অজানা দেশে অজানা ভাষায় এই বাঙালি অভিনেত্রী রাজত্ব করেছেন তিন দশক৷

এক একটা গান এক একটা মুক্তো৷ কত বলব? তালিকা বাড়ালেই বাড়বে৷

ঘুরেফিরে একটা প্রশ্নই উঠে আসবে৷ এই অমর সুপারস্টার ঝর্ণা বসাককে আমরা বাঙালিরা কতটুকু জানি?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top