What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Review ফরহাদ মজহারের ‘পাঠ: বেদের মেয়ে জোস্‌না’ (1 Viewer)

Nagar Baul

Board Senior Member
Elite Leader
Joined
Mar 2, 2018
Threads
1,152
Messages
13,339
Credits
547,766
Pen edit
Sailboat
Profile Music
wHN75qo.jpg


প্রসঙ্গ প্রবেশের আগে : জোস্‌না কেমন ফুটেছে!

বেদের মেয়ে জোস্‌না ছবিটি প্রথমে মফস্বলে মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটি মেলা দর্শক টানছে এই খবর যখন কাগজে দেখেছি তখনই নামটা খেয়াল করি। বেদের মেয়ের নাম 'জ্যোৎস্না' নয়–জোস্‌না'–এটা লক্ষ্য করে মজা পেয়েছিলাম। 'জ্যোৎস্না' শব্দের অপভ্রংশ এক্ষেত্রে খণ্ড-ত (ৎ) ত্যাগ করে সহজ ও লৌকিক উচ্চারণের পথ ধরেছে। মূল শব্দে খণ্ড-ত (ৎ) ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। শব্দের প্রাচীনতা, বিশুদ্ধতা ও সংস্কৃত ব্যুৎপত্তির গর্ভ বা স্বকীয়তা এই খণ্ড-ত-য়ের মধ্যে ধৃত। লৌকিক উচ্চারণে তার লোপ একটা গ্রামীণ দ্যোতনার সৃষ্টি করে, ফলে নামের মধ্যে একটা কৃষক বালিকার মুখচ্ছবি তড়পায়। জ্যোৎস্না শব্দের আভিধানিক মানে ইন্দুদ্যুতি বা চাঁদের কিরণ, এটা অবশ্য যে কেউই জানেন। কিন্তু তিনি যে ব্রহ্মার শরীর থেকে উৎপন্ন এবং গন্ধর্বগণের পত্নী এটা সবার জানার কথা নয়। খণ্ড-ত(ৎ) চ্যুতির আগৌরব 'জোস্‌না'কে এই সকল শরীফ কিংবদন্তির ওজন থেকে হালকা করেছে। ফলে বেদের মেয়ে হতে তার বাধা হয়নি। শব্দের বৃত্তান্ত খুঁজে এসব বের করা অনর্থক নয়, কারণ ওর সূত্র ধরে এগুলোয় এমন সব চিহ্ন আবিষ্কার করা সম্ভব, যা ছবিটির বিচার করতে আমাদের কাজে লাগে, ওতে সামাজিক অবচেতনার নানান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার হদিস মেলে, যার সম্পর্কে আমাদের পোশাকি সচেতনতা হামেশাই বেখেয়াল। যেমন, খুব গভীরে না গিয়েও জ্যোৎস্না নামের অপভ্রংশিত রূপান্তরের সরাসরি তাৎপর্যটা অন্তত খেয়াল করা যায়।

যে 'জোস্‌না' একেবারেই একটি গ্রাম্য সাধারণ, সহজ এবং স্বতঃস্ফূর্ত–যার কোনো আভিজাত্যমূলক অতীত নেই, উৎপত্তি নেই কিংবা উৎস নেই।ফলে বেদের মেয়ে জোস্‌নানামটা আমার ভালো লেগেছিল। আমি আরো মজা পেয়েছি এই ভেবে যে, জ্যোৎস্নার পরিচিত ভ্রংশ রূপটা এখানে ব্যবহৃত হয়নি। অর্থাৎ নামটা 'জোছনা' হয়নি। যেমনটি আছে রবিবাবুর গানে: যথা, 'জোছনা কেমন ফুটেছে' ইত্যাদি। পদ্যমূলক বাবু সংস্কৃতির পথে 'জোস্‌না' যে যায়নি তাতে আমি খুশি। কারণ তাহলে সর্দিলাগা গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া কোনো এক উন্নাসিক মধ্যবিত্তের বিবাহযোগ্য কন্যার কথা মনে পড়ে যেত। তখন রবীন্দ্র সঙ্গীতের ব্রাহ্ম গাম্ভীর্য থেকে জোস্‌নাকে কিছুতেই উদ্ধার করা যেত না। 'জোছনা'র চেয়ে 'জোস্‌না' কটমটে অশিক্ষিত গদ্যপ্রধান এবং গ্রাম্য। সে কারণে মধ্যবিত্তের রসবোধ ও ইন্দ্রিয়বৃত্তিরও বিরোধী। লক্ষণীয় 'জোস্‌না'য় জিহ্বাকাতর 'ছ' নেই, যা মূর্ধা বা স্পর্শাতীত তালুকে স্পর্শ করতে ব্যাকুল, কিন্তু যা পর্যবসিত হয় কেবলি ব্যর্থতায়। কারণ প্রশ্বাসকে এই 'ছ' উচ্চারণের সময় নির্গত করতে হয় আলতোভাবে, অনেকটা জিহ্বার আগা দিয়ে ধরে ধরে। মধ্যবিত্ত এতে একটা কামজ বা সেকচুয়াল পরিতৃপ্তি লাভ করে। 'জোস্‌না' নামের মজা হচ্ছে, ওখানে যে, এখন 'ছ' উচ্চারণ করা মধ্যবিত্ত ও সুশিক্ষিত আদব আমাদের বেদের মেয়ের নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে শেখার প্রয়োজন পড়বে না। আমার হসন্তযুক্ত দন্ত্য 'স' মধ্যবিত্তের পাতিবুর্জোয়া সংস্কৃতির গালে একটা, একটা কষে থাপ্পড় মারে, কিন্তু মধ্যবিত্ত টের পায় না যে সে থাপ্পড়টা খাচ্ছে। এবং খাচ্ছে কৃষকের দোফসলি হাতের, লোম-ওঠা কামাড়খালি চাপড়, সেটাও মধ্যবিত্ত তার সাংস্কৃতিক নির্বুদ্ধিতার জন্য বুঝতে পারে না। সেটাই সবচেয়ে মজার। 'জোস্‌না'র হসন্ত যুক্ত দন্ত্য 'স'-এর তুলনা হয় না।

নাম দেখেই আমার এসব মনে হয়েছিল। এর সঙ্গে ছবির কোনো সম্পর্ক আছে কি নেই সেটা পরের কথা। একটি ছবির নামকরণের মধ্যে সেটা কার ছবি কাদের জন্য ছবি, কিসের ছবি, প্রভৃতি আঁচ করা যায়। আমিও আঁচ করার চেষ্টা করেছি মাত্র। নামেই টের পাওয়া যায় যে, 'জোস্‌না' একদিকে রাজকীয় আভিজাত্য থেকে চ্যুত, তার অতীত খুঁজে বের করা সম্ভব, কিন্তু তার সামাজিক পরিচয়ের সঙ্গে অপভ্রংশিত পাতিবুর্জোয়া শহুরে মধ্যবিত্তের বিপরীত মেরুর চৈতন্যকে ধারণ করে। গ্রাম্য অকৃত্রিম, সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত কৃষকের সরল সংস্কৃতির চাঁচাছোলা আবেগ জোস্‌না নামের মধ্যে ধৃত। ছবির কথা এখনো বলছি না, নাম নিয়েই এতো কথা বলা যায়; আরো যেতো, কিন্তু আমি ছবির প্রসঙ্গে যেতে চাই।

ছবির প্রসঙ্গে যাবার আগে ছবিটা কেন আমি দেখেছি তার ব্যাখ্যা দেয়া জরুরি বোধ করছি। আগেই বাতিল স্রেফ 'জোস্‌না' নামের মাহাত্ম্যে তাড়িত হয়ে দেখতে যাইনি, যদিও নাম নিয়ে ইতোমধ্যেই আমি বেশ কয়েক লাইন খরচ করে ফেলেছি। ছবিটি মফস্বলে মুক্তি পাবার পর একে কেন্দ্র করে নানা গল্প খবর কাগজে ছাপা হতে শুরু করে। সন্দেহ নেই ছবিটির তুমুল জনপ্রিয়তা এই সকল খবরের পশ্চাৎকারণ। একটি খবর তো অনেকের হৃদয়কে টোকা দিয়েছিল। পাড়াগাঁয়ে এক বউ ছবিটি দেখতে কাতর হয়ে বার বার তার স্বামীকে অনুরোধ-উপরোধ জানিয়েছিল স্বামী যেন তাকে ছবিটি দেখাতে নিয়ে যায়। কিন্তু স্বামী নেয়নি। বউটি জোস্‌নাকে দেখতে না নিয়ে যাবার অবহেলায় এতোই অভিমানাহত হয়েছিল যে, সে আত্মহত্যা করে মরে। এই আত্মহননকারী অভিমান অনেকের বুকেই বেজেছিল। আমারও।

আরেক মহিলার কথা শুনেছি, ময়মনসিংহে বাড়ি, বেদের মেয়ে জোস্‌নাতিনি নাকি ষোলোবার দেখেছেন। দেখা যাচ্ছে মহিলাদের মধ্যে ছবিটি তুমুল আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। এর আগে কোনো ছবি গাঁয়ের মেয়েদের প্রাণের শেকড় এতো জোরে টেনে ধরতে পারেনি।

একটি খবরে দেখলাম এই সকল ঘটনাকে ফালতু গুজব বলে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এক মফস্বলেই ছবিটি পাঁচ কোটি টাকা কামিয়েছে সেটাও নাকি ফন্দি করে বাজারে ছাড়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, ছবিটির অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার গুজব ফেঁদে দর্শকদের মধ্যে একটা কৌতূহল সৃষ্টি করা। বেদের মেয়ে জোস্‌নার যাঁরা বেপারি তাঁরা যদি কাজটি করেও থাকেন তাহলে খুব মন্দ করেননি বলা যায়, কারণ কৌতূহল আসলেই সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিচক্ষণরা জানেন যে, সব ছবিতেই এই প্রকার কৌতূহল জাগিয়ে তোলা যায় না। ছবির মধ্যে তাহলে কিছু অতিরিক্ত ব্যাপার আছে, যাতে এই প্রকার কৌতূহল সৃষ্টি হয়। সেটা কী? সেটার উত্তর কিন্তু খবরে পাইনি। সে যাই হোক, ছবিটির প্রবল দর্শক সমাগম আমি নিজেই দেখেছি এবং টাঙ্গাইলে একটি গ্রামে কাজ করতে গিয়ে গাঁয়ের মেয়েদের মুখে ছবিটির কথা শুনে বুঝেছি ছবিটি যথার্থই জনপ্রিয় হয়েছে।

কিন্তু আমি কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য ছবিটি দেখতে যাইনি। জীবনে বহু বিষয়ে আমাদের কৌতূহল জাগে এবং তা যে সদা নিবৃত্ত করতেই হবে তার কোনো কথা নেই। বেদের মেয়ে জোস্‌নাকে সচক্ষে দেখার কৌতূহল আমার অবদমিত থাকলে আমার কোথাও কিছু ক্ষতি হতো না।

যে ব্যাপারটা আমাকে ছবিটি দেখিয়ে ছেড়েছে তা হচ্ছে ছবিটির বিরুদ্ধে তীব্র সব সমালোচনা। প্রায় সবাই একবাক্যে বলেছেন, ছবিটি কুরুচিপূর্ণ–একটা সামাজিক বিবৃতির অভিব্যক্তি। এই কথা বলার জন্য দুটো বিখ্যাত সাপ্তাহিক সিনেমাটির ওপর প্রচ্ছদ কাহিনীও ছেপেছে। যাঁরা ছবিটিকে বিকৃত রুচির বলেছেন তাঁরা অনেকেই আমার শ্রদ্ধেয় এবং বন্ধুস্থানীয় এবং আমি তাঁদের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকি। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে আর্ট ফিল্মের আন্দোলন করেছেন, তাঁরা ছবি বোঝেন এবং আর যাই হোক, আমার মতো তাঁরা কেউই সিনেমার বিষয়ে আকাট মূর্খ নন। কিন্তু আমার খালি মনে হয়েছে, ছবিটি যদি এতোই কুরুচিপূর্ণ হয় তাহলে গায়ে পড়ে ছবিটির বিরুদ্ধে এতো লেখালেখির দরকার কী?

কুরুচিপূর্ণ ছবি অথচ জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছবিটি দেখছে, এটা অসম্ভব নয় কিন্তু ভাবতে কষ্ট লাগে। বিশেষত, যখন জনগণ, মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ও নিম্নবিত্ত জনগণ। কুরুচির আতঙ্কে আমিও আক্রান্ত হয়েছি এটা স্বীকার করা ভালো। আমার মনে সত্যি সত্যিই প্রশ্ন জেগেছে, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ও নিম্নবিত্ত জনগণের রুচি কি আসলেই বিকৃত? রুচির নিশ্চয়ই শ্রেণীভেদ আছে, তাহলে কৃষক আর নিম্নবিত্তের রুচিটাই বা কী আর আমাদের রুচিটাই বা কাদের? এটা বেশ বড় মাপের প্রশ্ন। কিন্তু এই প্রশ্নটির সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য এতো সুদূরপ্রসারী যে, বেদের মেয়ে জোস্‌নাকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না। দেখতে হলো।

মার্কসের বরাতে কতিপয় মন্তব্য

ছবিতে যারা টাকা খাটান তাঁরা শিল্পচর্চার তাগিদ থেকে টাকা খাটান না। সিনেমাশিল্পে শিল্পরসবোধ খাটে না, খাটে পুঁজি এবং তার সাফল্যটাও অতএব শিল্পরসবোধের মাত্রা দিয়ে নির্ণীত হয় না, নির্ণীত হয় মুনাফা দিয়ে। ব্যবসায়ীরাই সিনেমাশিল্পে টাকা খাটাচ্ছেন এবং টাকা বানাচ্ছেন। এটা স্রেফ মুনাফা কামাবার জায়গা, এতটুকুন মার্কসবাদ সিনেমা সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনায় আমাদের দেশে এসেছে, লক্ষ্য করা যায়। তবে এতটুকুন বোঝার জন্য মার্কসের দ্বারস্থ হবার দরকার নেই। কাণ্ডজ্ঞান থেকেও কথাগুলো বলা যায়। যাঁরা শিল্প-সংস্কৃতির সমালোচক তাঁরা নিজেদের প্রগতিশীল দেখতে ভাবতে পছন্দ করেন বেশি। তাঁরা এই পুঁজি ও মুনাফার কথা তুলে এমন একটা পণ্ডিতির ভাব করেন, যাতে মনে হয় মুনাফাকারী সংস্কৃতি সম্পর্কে এটাই বুঝি শেষ কথা। বুঝিবা সাংস্কৃতিক বিষয়ে গভীরতর ব্যবচ্ছেদের দরকার নেই, অর্থনীতির দু'একখানা আপ্তবাক্য উচ্চারণ করলেই সংস্কৃতির বিচার সারে।

এটা সত্যি যে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে সবকিছুই তৈরি হয় পণ্য হিশেবে, বাজারে বিক্রির জন্যে। সিনেমা মোটেও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু উৎপাদিত সামগ্রী পণ্য হয়ে ওঠার একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে তার উপযোগিতা মূল্য। পণ্যকে কোনো না কোনো দরকার মেটাতেই হবে। সে দরকারের উৎপত্তি মার্কসের ভাষায় হতে পারে 'পেটের আঁত থেকে অথবা কল্পনা থেকে' (মার্কস: ১২৫)। তাহলে সিনেমা যিনি বানান তিনি কেবল তখনই মুনাফা উসুল করতে পারেন, যদি তা তাঁর দর্শকদের প্রয়োজন মেটায়। কৃষক ও নিম্নবিত্তের আঁতের জ্বালা সিনেমা মেটায় না, কিন্তু তার কল্পনার জগতের অবচেতনা, ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাকে সিনেমা স্পর্শ করে ও নিবৃত্ত করে এবং এই স্পর্শ ও নিবৃত্ত করার ক্ষমতাই সিনেমার উপযোগিতা মূল্য, এই শর্তটা পূরণ করেই সিনেমা পণ্য হয়ে ওঠে। মুনাফা কামায়।

তাহলে একটি সিনেমা যে শ্রেণীর কাছে জনপ্রিয়, সেই সিনেমায় সে শ্রেণীর ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা-ক্ষোভ-বিদ্রোহ-প্রতিবাদের প্রতিফলন থাকে। নইলে গাঁটের পয়সা খরচ করে কেউ সিনেমা দেখতে যেত না। গরিব কৃষক ও নিম্নবিত্তের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরো প্রাসঙ্গিক। পেটের জন্য তার পয়সা খরচ করা অনেক বেশি স্বাভাবিক। কুরুচি কেনার জন্য পয়সা খরচ সে তুলনায় খুবই অস্বাভাবিক। কারণ তার সর্বাঙ্গগ্রাসী আঁতের মোচড় কুরুচির মোচড়ের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।

মার্কসের এই অতি প্রাথমিক বক্তব্য ধরে শুরু করলেও দেখা যায় যে, দর্শকের ইচ্ছা আকাক্সক্ষা ও কল্পনার একটা খতিয়ান না নিয়ে সিনেমার বিশ্লেষণ শুরুই করা যায় না। যদি দর্শক অবদমিত যৌনাকাক্সক্ষার পরিতৃপ্তির জন্যও কোনো একটি সিনেমা দেখে, তবুও জানা চাই এই আকাক্সক্ষার চরিত্র কেমন? বা এই অবদমিত আকাক্সক্ষাটা কংক্রিট অর্থে কী? কীসের আকাক্সক্ষা? কার আকাক্সক্ষা? কোন শ্রেণীর আকাক্সক্ষা? কোন সময়ের আকাঙ্ক্ষা? ইত্যাদি।

একটা উদাহরণ বলি। এটা আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর, ও কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে সিনেমার নায়িকা মোটা আর স্বাস্থ্যবতী হয়, যা পশ্চিমের সম্পূর্ণ বিপরীত। পশ্চিমের ধনী দেশগুলোতে নায়িকাকে হতে হয় স্লিম, পলকা গা আর অনিবার্যভাবেই চাপা ভাঙা। বিশেষত মাজা হাতের বেড়ের মধ্যে না থাকলে পশ্চিমের কোনো নায়িকা পুরুষ দর্শকের মন কাড়তে সক্ষম হয় না। যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটা তাদের এক নম্বর গুণ। কিন্তু আমাদের নায়িকার মেদবাহুল্য যৌনতার ভিন্ন সংজ্ঞা খাড়া করে। আমাদের কৃষক ও নিম্নবিত্ত দর্শক প্রতিনিয়ত অপুষ্টি ও অনাহারে থাকেন বলেই কি সৌন্দর্যের সংজ্ঞা এখানে মোটা ও স্বাস্থ্যবতী হওয়া? আর অতি আহার ও অতি পুষ্টির জন্য পশ্চিমে তার উল্টা?

অপরদিকে হাতের বেড়ের মধ্যে মাজা পেয়ে যাওয়ার মধ্যে নারীকে খেলনার মতো ব্যবহার করার আকাক্সক্ষা নগ্নভাবে ব্যক্ত। নারী হচ্ছে পুতুল, যাকে উল্টেপাল্টে ব্যবহার করা যায়। এই সৌন্দর্যবোধ নারীর ব্যক্তিসত্তার চূড়ান্ত অস্বীকৃতি। পশ্চিমে নারী সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই ব্যক্তিসত্তাহীন জায়গায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সে নিক্ষেপ এতো গভীর যে, মাজা পুরুষের হাতের বেড়ের মধ্যে রাখা এখন নারীদেরও সাধনার বিষয় হিশেবে পরিগণিত।

কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে নেই। তার মানে এই নয় যে, আমাদের নারীরা ভালো আছেন। এতটুকুই কেবল বলতে চাচ্ছি যে, যৌনতা ও কামের উপলব্ধির ক্ষেত্রে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে কি দেশে দেশে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। বড়ো কথা, কাম ও যৌনতারও শ্রেণীভেদ আছে এবং একটি দেশের বৈষয়িক বিকাশের সঙ্গে অবদমিত ইন্দ্রিয়াকাক্সক্ষার যোগসাজশ অলঙ্ঘনীয়।

বলা বাহুল্য বেদের মেয়ে জোস্‌না সম্বন্ধেও এই সকল কথা প্রযোজ্য। আমার প্রগতিশীল বন্ধুদের বলি, অঞ্জু ঘোষের নর্তন কুর্দন আর যৌনতাই যদি এ ছবিতে তারা দেখে থাকেন তবে ঠিক এই ধরনের যৌনতা আমাদের কৃষক ও নিম্নবিত্তের মধ্যে গড়ে উঠল কেন, তার একটা ব্যাখ্যা খাড়া করার কর্তব্য তবুও থেকে যায়। ছবিটি দেখতে গিয়ে আমি অনে¦ষণ করেছি। কারণ সিনেমা পণ্য হলেই তার এই সকল সামাজিক ও আত্মিক তাৎপর্য খাটো হয়ে যায় না। জনপ্রিয়তার কারণে বরং তা বাড়ে। অতএব বেদের মেয়ে জোস্‌না ছবিটি স্রেফ ছবি হিশেবে কেমন সে মন্তব্যের চেয়েও ছবিটিকে বিচার ও বুঝতে পারার চেষ্টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা বুঝি তাহলে কৃষক ও নিম্নবিত্ত জনগণের চৈতন্যকে অনুধাবনের ক্ষেত্রে আমরা এক কদম আগুয়ান হতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।

গল্পটি ঘটেছে এক কাল্পনিক বঙ্গরাজ্যে–বাংলাদেশে!

বেদের মেয়ে জোস্‌নার গল্পটা ঘটেছে এক কাল্পনিক বঙ্গরাজ্যে। ছবিটি শুরু হয় এক করুণ পরিবেশে। দেখা যায় এক তরুণ পিতার আহাজারি, তিনি শোকাহত। তার একমাত্র শিশুকন্যা সর্পদংশনে মৃত। কলার ভেলায় শীতলক্ষ্যা নদীতে তাকে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। সাপে কাটা দেহ কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয়ার রীতি এ দেশে বহু প্রাচীন দিন থেকে প্রচলিত। নদীতে ভেসে যাওয়া দেহ কোনো প্রাজ্ঞ ওঝা হয়ত কূলে টেনে এনে আবার বিষ ঝেড়ে মৃতকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে সেই আশায় এই রীতি।

তো জোস্‌না এসে ভিড়ল এক আটকুঁড়ে বেদে দম্পতির কাছে। ভেলার সঙ্গে একখানি চিঠি ছিল, বেদে দম্পতি সে চিঠিতে জানতে পারলেন যে, এই শিশু বালিকার নাম জোস্‌না। জোস্‌নাকে তারা তাদের নাতি হিশেবে বড়ো করে তুললেন। বেদে হিসেবে জোস্‌না পারঙ্গম হয়ে উঠল ক্রমে ক্রমে।

একদিন বঙ্গরাজ বাড়িতে সাপ খেলা দেখিয়ে ফেরার পথে জোস্‌না উজিরপুত্রের কামুক বাসনার শিকার হলো, আর রাজকুমার আনোয়ার তাকে সেই কামুক হামলা থেকে বাঁচিয়ে মন জয় করে নিলো। এই আক্রমণ ও উদ্ধার পর্বের নাটক চলবার কালে জোস্‌নার রূপ রাজকুমারের হৃদয় জয় করে নেয়, রাজকুমারও জোস্‌নার প্রাণে গাঁথা হয়ে যায়। এরপর থেকে রসিয়ে উভয়ের প্রেম চলতে থাকে, আর ভিলেনের হামলা ও আবশ্যিক প্রতিরোধও নাটকীয়ভাবে অব্যাহত থাকে।

অপরদিকে উজির চক্রান্ত করেছিল বঙ্গরাজের রাজ্য হাতিয়ে নিজের কব্জায় তুলে নেবার। উজির চান মেয়ে তারার সঙ্গে রাজকুমারের বিয়ে হোক, বাবার প্রণোদনায় উজির কন্যা তারা লেগে রইল রাজকুমার আনোয়ারের পেছনে।

রাজকুমারের বন্ধু হচ্ছে সেনাপতির ছেলে রাজ্জাক। সে কারণে উজিরপুত্র ক্ষুব্ধ। কারণ সেনাপতির ছেলের চেয়ে উজিরপুত্র স্ট্যাটাসের দিক থেকে বড়ো, এই সামন্ত নিকাশ কাহিনীর আরেকটি পশ্চাৎভূমি তৈরি করে। অপরদিকে আবার রাজ্জাক ভালোবাসে তারাকে। কিন্তু তারা রাজ্জাকের প্রেমকে ধৃষ্টতা মনে করে। কারণ তারা হচ্ছে গিয়ে উজিরের কন্যা আর রাজ্জাক কিনা এক ক্ষুদ্র সেনাপতির পুত্র। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেই সামন্তীয় হিশাব-নিকাশ প্রেমের নতুন সংঘাত সৃষ্টি করে।

আর আনোয়ার এই সব হিসাব-নিকাশের বাইরে বেদের মেয়ের প্রেমে মাতোয়ারা। কিন্তু এই অসঙ্গত প্রেম চলতে পারে না। জোস্‌নাও বুঝতে পারে রাজকুমারকে পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে তাদের দেখাশোনায় একটা ছেদ পড়ে।

এই সময় ঘটল সেই নাটকীয় ঘটনা। এক সাপ দংশন করলো রাজকুমারকে। কোনো ওঝাই রাজকুমারকে বাঁচাতে এগিয়ে আসলো না। কারণ যে এ সাপের বিষ তুলতে যাবে মুখে রক্ত উঠে মরবে। মরবার ঝুঁকি কোনো ওঝাই নিতে রাজি হলো না। ঝুঁকি নিলো জোস্‌না তার দাদি বেদেনির নিষেধ সত্ত্বেও। জোস্‌না দাদিকে বলল, যদি সাপ রাজকুমারের পায়ের দংশনক্ষত থেকে বিষ তুলে নিজেই সেই দূষিত রক্তের বিষে মরে তাহলে সে বেঁচে যাবে।

বেজে উঠল জোস্‌নার সাথে মরণবীণ। এই সেই মুহূর্ত, যখন দর্শক নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেকেন্ড গুনতে থাকে। জোস্‌নার মুখে রক্ত উঠে আসে, জোস্‌নার প্রাণের আশঙ্কায় দর্শক আতঙ্কিত হয়, কিন্তু জোস্‌না মরে না। সাপ নিজের বিষ নিজে তুলে মরে যায়।

বঙ্গরাজা জোস্‌নাকে বললেন, তাঁর একমাত্র পুত্রের প্রাণ রক্ষার জন্য সে যা পুরস্কার চায় তাই দেয়া হবে। প্রতিশ্রুতি পেয়ে জোস্‌না চাইল রাজকুমারকে। পুরো চলচ্চিত্রটির নাটকীয় মর্মের শাঁসটা জোস্‌না ও বঙ্গরাজার ডায়ালগে বিধৃত হয়ে আছে। বঙ্গরাজা জোস্‌নার এই চাওয়াকে ধৃষ্টতা মনে করলেন এবং জোস্‌না তার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে বলে তিরস্কার করলেন। তারপর গলাধাক্কা দিয়ে কপাল ফাটিয়ে জোস্‌নাকে রাজসভা থেকে তাড়িয়ে দিলেন।

জোস্‌নার যুক্তি সোজা। আমি নিজের প্রাণ বাজি রেখে রাজকুমারকে বাঁচিয়েছি অতএব রাজকুমার আমার। রক্তাক্ত জোস্‌না রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করার সময় তার কপালের রক্তে রাজপ্রাসাদের মেঝে রঙিন করে দিয়ে বলল, যে গরিবের প্রতি ঘৃণায় বঙ্গরাজা তার প্রতিশ্র"তি ভঙ্গ করেছেন, সেই গরিবের রক্তে এই প্রাসাদকে সে কলঙ্কিত করে দিয়ে যাচ্ছে।

রাজকুমার সুস্থ হয়ে সব শোনার পর পাগলের মতো জোস্‌নার খোঁজে বেরুল এবং তাকে বিয়ে করে রাজপ্রাসাদে ফিরল। ফিরে এসে পিতাপুত্রের বচসা তুঙ্গে উঠল। নিজের অহংকার রক্ষার রাগ এতই অসহনশীল মাত্রায় গিয়ে ঠেকল যে, রাজা নিজের পুত্রকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে অবিলম্বে কোতল করার নির্দেশ দিলেন। বঙ্গরাজের অভিযোগ, তার পুত্র বেদের মেয়ের মতো ছোট জাতের মেয়েকে রাজপ্রাসাদে তুলে তাদের আভিজাত্যকে ক্ষুণ্ন করেছে। কিন্তু জল্লাদ রাজকুমারকে যখন হত্যা করতে যাবে বঙ্গরানি তখন জল্লাদকে অনুরোধ করলেন রাজকুমারকে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। তিনি রাজকুমার ও জোস্‌নাকে অন্যত্র নির্বাসনে পালিয়ে যেতে উপদেশ দিলেন। জোস্‌না নিজের হাত কেটে জল্লাদের দা রঞ্জিত করে দিলো। এতে রাজকুমারের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে প্রমাণ করা গেল।

নির্বাসনে রাজকুমার কাঠ কেটে ঘরে আনে, জোস্‌না রাঁধে বাড়ে। এদিকে উজির পুত্র সেই যে জোস্‌নার পেছনে লেগেছে তো লেগেছেই। সে জোস্‌নাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে পেয়ে যায় এবং রাজকুমারকে দেখে অবাক হয়, কারণ তার মৃত্যু হয়েছে বলেই সে জানে। সেই এলাকার জমিদারের বাড়িতে প্রহরীকে হত্যা করে রক্তাক্ত খঞ্জর রাজকুমারের কুঁড়েঘরের পাশের কাঠের গাদায় উজিরপুত্র লুকিয়ে রাখে। রাজকুমার প্রহরীকে খুনের দায়ে ধরা পড়ে এবং জমিদারের কারাগারে চাবুক খেয়ে বন্দি হয়।

ওদিকে রাজকুমারের দোস্ত রাজ্জাকের কাছে ফাঁস হয়ে যায় যে রাজকুমার মরেনি, বেঁচে আছে। রাজকুমারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বঙ্গরাজা নিজেও শোকে কাতর হয়ে পড়েন। রাজকুমারের দোস্ত সেনাপতিপুত্র রাজ্জাককে তিনি রাজ্যভার দিয়ে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এতে রাজকুমারের মা বাধ্য হয়ে রাজ্জাককে জানান যে রাজকুমার আসলে মরেনি, বেঁচে আছেন, অতএব রাজ্জাকের উচিত রাজকুমারকে খুঁজে এনে তার হাতেই রাজ্যভার সোপর্দ করা।

উজির ঘটনার এই নতুন মোড়ে বিচলিত বোধ করে, বঙ্গরাজ্য তার নিজের হাতে কব্জা করার চক্রান্ত বুঝি ফসকে যায়। উজির ও উজিরপত্নী এবার তাদের কন্যা তারাকে বলল সে যেন সেনাপতিপুত্র রাজ্জাককে প্রেম করে বাগিয়ে নেয়, কারণ রাজ্জাকই এখন রাজকুমারের অনুপস্থিতিতে রাজা হতে যাচ্ছে।

কিন্তু আশ্চর্য যে, তারা প্রতিবাদ করে। রাজ্য ও সম্পদের লোভে তার বাবা-মা তাকে যেভাবে ব্যবহার করছে তাতে তার নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মে এবং সে আত্মহত্যা করতে গাছে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ে। কিন্তু নাটকীয়ভাবে সেখানে রাজ্জাকের আবির্ভাব ঘটে ও ফাঁসির দড়ি তলোয়ার দিয়ে কেটে রাজ্জাক তারাকে বাঁচায়। রাজ্জাকের প্রেমের নিষ্ঠায় তারা অভিভূত হয় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই রাজ্জাকের প্রেমে পড়ে। এই নাটকীয় ভাবান্তরের মধ্য দিয়ে উজিরকন্যা তারা বুঝতে পারে রাজ্জাক তাকে আসলেই ভালোবাসে এবং সেও রাজ্জাককে ভালোবাসে। আভিজাত্যের ওপর প্রেমের সাম্য জয়লাভ করে। উভয়েই এখন উজিরের চক্রান্তের হাত থেকে রাজ্য রক্ষার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়।

রাজকুমারের খোঁজে পুরুষ সেজে তারা যে পরগণায় রাজকুমার বনবাসে কাল কাটাচ্ছে সেখানকার জমিদার বাড়িতে গিয়ে ওঠে। জমিদার ছিলেন রাজ্জাকের মামা। তিনি নিঃসন্তান। পুরুষবেশী তারা হয় তার সন্তানতুল্য। সেই জমিদারের কারাগারেই রাজকুমার ছিলেন বন্দি।

তারা অতএব রাজকুমারকে কারাগারেই পেয়ে যায় এবং রাজ্জাককে খবর পাঠায়। খবর বঙ্গরাজার কানে ওঠে। পুত্র জীবিত আছে শুনে বঙ্গরাজা উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন এবং সন্তানের উদ্ধারের জন্য ছোটেন। ইতোমধ্যে খুনের মামলায় রাজকুমারের বিচার শুরু হয়ে যায়।

বিচার করতে বসেন কাজি। এখানেই হঠাৎ জানা যায়, এই কাজি আসলে জোস্‌নার বাবা। বঙ্গরাজা তার ভগ্নিপতি। জোস্‌না নদীর ধারে কাজিকে এর আগেই দেখেছিল এবং সেখানে তাদের পরিচয় হয়। কিন্তু কাজি বুঝতে পারেনি এ তারই মেয়ে জোস্‌না। জোস্‌নাও বোঝেনি তবু জোস্‌না তাকে বাবা ডাকে, কারণ কন্যাহারা পিতার বেদনা তাকে আপ্লুত করে।

কাজির বিচারালয়ে ছবির সকল কুশীলব একত্রিত হয়। বঙ্গরাজাও ছুটে আসেন কাজির দরবারে। উজিরপুত্রের কারসাজি উজিরপুত্রের মুখেই প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয় যে বন্দি আসলে বঙ্গরাজার পুত্র, যদিও পুত্র পিতার প্রতি তীব্র অভিমানে সে পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক ছিল এবং অবশেষে এটাও প্রমাণিত হয় বেদের মেয়ে জোস্‌না আসলে বেদের মেয়ে নয়, সে কাজির মেয়ে। এর ফলে জোস্‌নাকে বৌ হিসেবে স্বীকার করে নিতে বঙ্গরাজার আভিজাত্যে আর বাধে না। পুত্র ও পুত্রবধূকে রাজা বরণ করে নেন।

আমি সংক্ষিপ্তভাবে পুরো কাহিনীটি বলতে বাধ্য হলাম এ কারণে যে, যারা ছবিটি দেখেননি তাদেরকে কাহিনীটি বলার দরকার ছিল। তাছাড়া এরপর আমি যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করব তার জন্য কাহিনীটি আগেই বলে নেয়া জরুরি। যারা ছবিটি দেখেছেন তাদেরকেও ফের মনে করিয়ে দেবার দরকারে আরেক দফা কাহিনীটি বলা ছাড়া উপায় ছিল না।

প্রথমেই সরল যে প্রশ্নটা আমি করতে চাই তা হলো এই গল্পের কোথায় কুরুচি বা সামাজিক বিকৃতি? আমি তন্ন তন্ন খুঁজেও কূল করতে পারিনি। গল্পের কংকালটাই আমি কেবল বলেছি, কারণ আসলে কাহিনীর সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মাত্রা আছে। সে মাত্রা অনেকের চোখে ধরা নাও পড়তে পারে। সে প্রসঙ্গে আসব। কিন্তু যারা কেবল গল্পের কাঠামো খুঁজে ছবিটি বিচার করেছেন তাদের আমি ভাবতে অনুরোধ করি, এই সাধারণ কাহিনীর মধ্যে তারা কি আসলেই বিকৃতি দেখতে পাচ্ছেন? আমি দ্বন্দ্ব সংঘাত ও নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ একটি চমৎকার কাহিনীর কাঠামো দেখে বরং বিস্মিত হয়েছি।

অনেকে আজকাল দেখছি 'ফোকফ্যান্টাসি' শব্দটি ব্যবহার করছেন। এই অদ্ভুত শব্দটির মানে যে কী আমি জানি না এবং অন্য কোনো ছবির মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু বেদের মেয়ে জোস্‌নার মধ্যে আমি এক কণা ফ্যান্টাসি দেখিনি। একজন রাজকুমারের সঙ্গে একটি বেদের মেয়ের প্রেম হওয়াটা হয়তো অসম্ভব কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। হতেই পারে। যদি বিকৃতি অর্থে অস্বাভাবিক বুঝি আমরা তাহলে বেদের মেয়ে জোস্‌নার ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।

তাছাড়া লোকায়ত বিশ্বাস আর ফ্যান্টাসি এক কথা নয়। গ্রামীণ জনগণের বিশ্বাস বা ঐতিহ্যাতীত ধারণা ফ্যান্টাসি নামক উৎকল্পনা নয়। কালনাগিনীর ছোবলে মৃত মানুষের বিষ কালনাগিনী নিজের মুখে তুলে নেয় কি না সেটা নিয়ে তর্ক করা যায় এবং তা মিথ্যা হলে প্রমাণ করে দেখিয়েও দেয়া যায়। কিন্তু এটা লোকায়তিক বিশ্বাস। এটা ফ্যান্টাসি নয়। এই ফারাকটা অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার।

ফ্যান্টাসি কী বস্তু তার উদাহরণ দেয়ার জন্য একটা তাগিদবোধ করছি। শব্দটি ইংরেজি, যার মানে সোজা কথায় বাঁধনহীন কল্পনা, আপনার অবদমিত বাসনা প্রক্ষেপ। এর অর্থ কিন্তু আজগুবি নয়, অথচ অনেককে দেখেছি শব্দটি আজগুবি শব্দের প্রতিশব্দ হিশেবে ব্যবহার করতে। ল্যাটিন আমেরিকার আধুনিক সাহিত্যে ফ্যান্টাসির বিপুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। শক্তিশালী লেখকরা প্রায়ই তাদের গল্পে ও উপন্যাসে ফ্যান্টাসি ব্যবহার করেন যা কল্পনার সীমান্তকে এমন জায়গায় স্পর্শ করে, যেখানে বাস্তব আর অলৌকিকতা অভিন্ন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজের পারদর্শিতা কিংবদন্তির মতো। সম্প্রতি তার একটা ছবিতে ফ্যান্টাসির ব্যবহার দেখে অবাক হয়েছি। কারণ সাধারণ ভাষায় আমরা যাকে আজগুবি বলি মার্কেজ তাকেও ব্যবহার করতে ছাড়েননি। ফ্যান্টাসি ও আজগুবির সমীকরণ আমাদের দেশে অতি প্রবল, মার্কেজের ছবিটি এই সমীকরণের মধ্যে পড়ে বলে উদাহরণ হিশেবে সম্ভবত ভালো। ছবির চিত্রনাট্যটা মার্কেজের নিজের হাতেই লেখা। গল্পটা অনেকটা এরকম : এক মডেল মেয়ে ধর্ষিত হয় কিন্তু ধর্ষণ তার মধ্যে এক বিপরীত কামবোধের জন্ম দেয়, যা তাকে নিয়ে গিয়ে পৌঁছায় এই ফ্যান্টাসির জগতে। দর্শকের কাছে সে জগৎটাকে মনে হয় খুবই বাস্তব। ধর্ষিতা নারী এরপর থেকে তার ধর্ষণকারীকে খোঁজে। ধর্ষণকারীর ঘাম ও নিঃশ্বাসের মধ্যে যে জান্তবতা ছিল তা তাকে অবচেতনে তাড়ায়, সে এক অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করে।

বলা উচিত বিজ্ঞাপন ও মডেলিং-এর সাধনা হচ্ছে আমাদের কামার্ততার বিচিত্র গ্রন্থিগুলোকে তাতানো। যার পরিণতি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের হরেক পণ্যের বাজার বৃদ্ধি। আমাদের কামার্ততা শেষমেশ চরিতার্থ হয় পণ্যের ভোগে। বিজ্ঞাপন ও মডেলিং সে হিশেবে আমাদের ওপর পুঁজির ধর্ষণ যা আমরা শেষাবধি (উপভোগ) করি।

ধর্ষিতা মডেলকন্যা ধর্ষণকারীর খোঁজে সহায়তা প্রার্থনা করে সালামান্দারের। সালামান্দার এই ছবিতে একটি মানুষ চরিত্র। আসলে সালামান্দার একটি সরীসৃপজাতীয় জন্তু এবং ধারণা করা হয়ে থাকে যে, জন্তুটি বাস করে আগুনে। প্রেমের আগুন সালামান্দারের মধ্যে এতো বেশি যে, সত্যি সত্যিই তার শরীরে আপনাতেই আগুন ধরে, যা দেখে দর্শকদের মোটেও অবাক লাগে না ইত্যাদি। ছবিটির নাম, ইউ আর দি ওয়ান আই অ্যাম লুকিং ফর (তুমিই সেই যাকে আমি খুঁজছি)। যারা ফ্যান্টাসি কী বুঝতে চান তাদেরকে আমি এই ছবিটি দেখতে অনুরোধ করি।

সেই বিচারে বেদের মেয়ে জোস্‌নায় আমি ফ্যান্টাসি বা আজগুবি কিছু দেখিনি। একজন সাধারণ কৃষক ও নিম্নবিত্তের চোখে বেদের মেয়ে জোস্‌নার কোনো ঘটনাই আজগুবি তো নয়ই, ফ্যান্টাসিও মনে হবে না। ঘটনা যা ঘটেছে তার মধ্যে কোনো অতিকল্পনা আছে, সেটা তাদের অবিশ্বাস্য মনে হবে না। কারণ পুরো ঘটনাই তাদের কাছে একটি স্বাভাবিক গল্প হিশেবেই আবির্ভূত হবে। লোককাহিনীর চেনা ও পরিচিত পরিপ্রেক্ষিতের সীমা এখানে এক সেন্টিমিটারও লংঘিত হয়নি। বলা বাহুল্য লোককাহিনী মানেই ফ্যান্টাসি নয়। কিন্তু 'শিক্ষিত' বা 'আধুনিকমনস্ক' মধ্যবিত্তের চোখে এ সকল কাহিনী ফ্যান্টাসি মনে হবে। এই শ্রেণী সাধারণত তার নিজের সমাজ ও সংস্কৃতির কোনো খোঁজখবর রাখে না বা রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। গ্রামীণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চেতনার বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিটা যে আসলে কী সে সর্ম্পকে এই শ্রেণীর মধ্যে আজতক কোনো গভীর অনুসন্ধিৎসা চোখে পড়েনি। অপরদিকে উন্নত দেশের দিকে তাকিয়ে যে মন ও মানসিকতার চর্চা এই শ্রেণী করে তা পর্যবসিত হয় নেহাতই অনুকরণে। কারণ সেসব তার বোধ ও অভিজ্ঞতার বাইরের জিনিস। সে আসলে বুঝতে পারে না নিজের একটা মনগড়া 'আধুনিকতা' নিয়ে বুক চিতিয়ে সমাজে পণ্ডিতি করে বেড়াচ্ছে। বলা যায়, সে না ঘরকা না ঘাটকা।

বেদের মেয়ে জোস্‌নার কাহিনী পুরনো একটি যাত্রার বলে শুনেছি। জসীমউদ্দীনেরও নাকি একই কাহিনী অবলম্বনে একটি কাব্যগাথা আছে। এ দুটোর কোনোটিরই দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। যদি সত্যি সত্যিই তাই হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই কাহিনীটির একটি সর্বজনীন জনপ্রিয়তা সব সময়ই ছিল। তাহলে অন্তত কাহিনীর ক্ষেত্রে কোনো বিকৃত মানসিকতার অভিযোগ ছবিটির বিরুদ্ধে খাটে না। কিন্তু আমি আগেই বলেছি কাহিনীটি কংকাল মাত্র। এই কংকালকে আশ্রয় করে ছবিটির মধ্যে আরো গভীরতর ও ভিন্ন মাত্রার বক্তব্য আছে, সেই বক্তব্যের মধ্যে ছবিটির জনপ্রিয়তার শেকড় নিহিত বলে আমার মনে হয়েছে।

ছবিটি আকৃষ্ট করেছে কৃষকদের… কৃষকসুলভ চৈতন্যের যারা ধারক

ছবিটি সম্পর্কে প্রথমেই যে কথা বলা দরকার তা হলো ছবিটি আকৃষ্ট করেছে 'কৃষক'দের। কৃষক বলতে আমি সরাসরি যারা কৃষিকাজ করেন তাদেরকেই কেবল বোঝাচ্ছি না। বোঝাচ্ছি তাদেরকেও, কৃষকসুলভ চৈতন্যের যারা ধারক। অর্থনৈতিক দিক থেকে কৃষকের নানা স্তর আছে। যারা কেবল কৃষিকাজ করেন কৃষকদের মধ্যে তারা একটা স্তর মাত্র। গ্রামের কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে নানান সূত্রে যারা জড়িত, শহর ও শিল্পায়নের বেগ বা আবেগ যে চৈতন্যে এখনো দানা বাঁধেনি কিন্তু কৃষকসুলভ বুর্জোয়া আকাক্সক্ষা স্ফূরণ যে চৈতন্যে কমবেশি অংকুরিত হচ্ছে, লেনিনের সূত্র ধরে আমি এই আলোচনার সুবিধার্থে তাদের কৃষক বলছি। এক্ষেত্রে 'গ্রামীণ পেটিবুর্জোয়া' শব্দটি হয়তো আরো যুৎসই হতো। তবে 'কৃষক' শব্দটির মধ্যে সে দ্যোতনা এসে যায় বলেই আমার বিশ্বাস।

আমি মোটামুটি লক্ষ্য করতে চেষ্টা করেছি ছবিটি কারা দেখছেন। পরিসংখ্যান দেবার মতো খোঁজ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবুও মফস্বল শহরে আমি দেখেছি হাটে বা মিউনিসিপ্যালিটির বাজারে আলু, ধান বা সবজি বেচার পর গেরস্ত কৃষক ছবি দেখতে সিনেমা হলে ঢুকেছে। গ্রামের গরিবদেরকেও দেখেছি, যারা ভূমিহীন এবং সত্যি সত্যি গরিব, ভাঙা ছাতির আড়ালে পর্দা বাঁচিয়ে প্রিয় স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন বেদের মেয়ে জোস্‌না দেখতে। আণ্ডা বিক্রি করে সিনেমার টিকেট কিনেছে টুপি পরা অতি সরল উৎসাহী গ্রামের মানুষ, দুই হাতে তার কিশোরী মেয়ে ও বালক পুত্র। তবে কৃষির সঙ্গে জড়িত ছোট ব্যবসায়ী, কারিগর, মুদি দোকানদার প্রভৃতি নানা ধরনের পেটি বুর্জোয়ার সংখ্যাই সম্ভবত ছিল বেশি।

ঢাকা শহরে, লক্ষ্য করেছি, নিম্নবিত্তদের মধ্যে যারা দীর্ঘদিন এই শহরে বাস করছেন, ছবিটি তাদের কাছে তেমন জনপ্রিয় হয়নি, যেমনটি হয়েছে সদ্য শহরে আসা মানুষটির–গাঁয়ের গন্ধ যার গা থেকে এখনো যায়নি। এ রকম শহুরে হয়ে যাওয়া একজন রিকশাচালককে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি ছবিটি তার তেমন ভালো লাগেনি, তবে ছবিটি তার দেখা আছে। অথচ ফরিদপুরের একজন রিকশাচালককে ছবিটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করায় সে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সিনেমার গল্পটি ডায়ালগসহ আমাকে ক্লান্তিহীন বলেছে। তার উৎসাহ দেখে গন্তব্যে পৌঁছার পরও অন্তত বিশ মিনিট ধরে তার কাহিনী বলা শুনতে হয়েছে। সে শহরে এসেছে দশ কি এগারো মাস আগে। আদমজি বা তেজগাঁওয়ের শ্রমিকদের তেমন আদিখ্যেতা নেই। কিন্তু অনিবার্যভাবেই গার্মেন্টসের মেয়ে শ্রমিকরা পয়সা ও সময়ের কূল করতে পারলেও ছবিটি দেখেছেন।

তাহলে কোথায় যেন ছবিটি গ্রাম ও শহরের একটা পার্থক্য ঘটাতে পেরেছে। একে মূর্তভাবে চিহ্নিত করার তাত্ত্বিক মুশকিলটা পাশে থুয়ে মোটা দাগে যদি ছবিটির রসপিপাসু শ্রেণীকে আমি ব্যাপ্ত অর্থে কৃষক বলি আশা করি পাঠক আমার সঙ্গে ধৈর্য ধরবেন। আমি এটা অন্তত স্পষ্ট বুঝেছি যে, শহরের আবেগ ও সংস্কৃতির সঙ্গে অভ্যস্ত ধনী, মধ্যবিত্ত বা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি শহুরে শ্রমিকদের কাছেও ছবিটি তেমন গ্রহণযোগ্য হয়নি। কিন্তু হয়েছে গ্রামে–কৃষকসুলভ গ্রামীণ চৈতন্যকে ছবিটি নাড়া দিয়েছে। এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।

অস্পষ্ট মজা কল্পনার থাবা এড়িয়ে পালাতে পারে না
ঘটনাটি ঘটেছে বঙ্গরাজ্যে। বঙ্গরাজ্য নামের মধ্যে বাংলাদেশ নামের ইশারা আছে। ফলে দর্শককে নামের প্রতীকী ইঙ্গিত ধরতে বেগ পেতে হয় না। বঙ্গরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে মিল খুঁজে পাবার জন্য আধুনিক বুদ্ধির দরকার পড়ে না, ফলে কৃষক চৈতন্যের কাছেও প্রতীকী ইশারার মজা ধরা পড়ে। কিন্তু কাহিনীটি বঙ্গরাজ্যের এবং এটি একটি লোককাহিনীর 'কাল্পনিক' রাজ্য। অতএব কৃষক ও নিম্নবিত্ত জনগণের চাষীসুলভ বুদ্ধি সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে ভান করে যে, আদতে কল্পিত বঙ্গরাজ্যের ঘটনাই বুঝি তারা দেখছেন। এই ভানের মধ্যে এক অর্বাচীন আমোদ আছে, যা তাকে শুরু থেকেই তাতায়। এই ভানে মেতে সাধারণ জনের সরল বুদ্ধি নিজের খুশি বোধ করে, প্রতীকের মানে খুঁজে পাবার কারণে নিজের বুদ্ধির ওপর তার বিশ্বাস বাড়ে। ছবিটির অস্পষ্ট মজা ফলে তার কল্পনার থাবা এড়িয়ে পালাতে পারে না।

জোস্‌না, আনোয়ার, রাজ্জাক তারা ইত্যাদি নাম কৃষক মনের পরিচয়। কিন্তু ভিন্নভাবে এ সকল নাম লোককাহিনীর মতো নয়। রহিম বাদশা-রূপবানকন্যা, গাজীকালু-চম্পাবতী, সয়ফুলমূলক-বদিউজ্জামান, বেহুলা-লখিন্দর প্রভৃতির নামের সঙ্গে এই সকল নামের এমন এক গভীর অমিল রয়েছে যে, এই নামগুলো যে লোককাহিনীর নয় কৃষকমন তার সহজ বুদ্ধিতে অনায়াসেই অনুধাবন করতেই পারে।

অপরদিকে এই নামগুলো সম্প্রতিকালের নাম। নামগুলো অতি আধুনিক নয়, আবার প্রাচীন বা গ্রাম্যও নয়। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গত কয়েক দশকে কৃষকের মধ্যে আকাক্সক্ষা ও চিন্তা-চেতনার যে রূপান্তর ঘটছে, এই নামগুলো কি তারই অভিব্যক্তি? শহরের আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণী বা মধ্যবিত্ত সাধারণত এই নামগুলোকে গ্রাম্যতায় দুষ্ট ও পুরনো মনে করে। নাজনীন, ইসমত, ইশতিয়াক নামের মধ্যে যে স্মার্টময় চটপটে জৌলুস আছে জোস্‌না, রাজ্জাক, আনোয়ারের মধ্যে তা নেই। আবার তারা করিম, রহিম, ছমিরন, আছিয়ার মতো অতি গ্রামীণ বা প্রাচীনও নয়।

স্বীকার করি, নামগুলো সিনেমাওয়ালাদের দেয়া। কিন্তু নামগুলোর গ্রহণযোগ্যতা দেখে মনে হয় এর সঙ্গে কৃষকের নয়া চৈতন্য সমান্তরাল। এই নামগুলো শহুরে নয়, কিন্তু প্রাচীনও নয়। নয়া চৈতন্যসম্পন্ন কৃষকমন এই নামগুলোকে কাছের মনে করে এবং কাহিনীর মধ্যে নিজ শ্রেণীর চিহ্ন পরিদৃশ্যমান দেখতে পায়।

ছবিটি শুরু হবার পরপরই দর্শক টের পেতে শুরু করে যে, ছবির বিষয় ও পরিপ্রেক্ষিত বর্তমানকে নিয়ে, কোনো অতীত বা কাল্পনিক বিষয় নিয়ে নয়। যে অভিজ্ঞতা-আবেগ-ইচ্ছা সংকল্প ঐতিহাসিকভাবে অতিক্রম করে এলে আমরা ছবিতে ব্যক্ত অভিজ্ঞতা-আবেগ-ইচ্ছা-সংকল্পকে অতীত ভাবতে পারতাম তা বাংলাদেশের জনগণ এখনো অতিক্রম করেনি। ফলে ছবিটির মধ্যে বর্তমান যারপরনাই বিদ্যমান। কালবোধের এক বিচিত্র বর্তমানতা ছবিটি সঞ্চার করতে সক্ষম। এই উপলব্ধিগত কাল ছবিটিকে দর্শকদের কাছে নিয়ে আসে। এরপর ছবিটি কৃষকমনকে তার অবচেতনের মধ্যে অতীত দিয়ে যেতে থাকে। কৃষক তার ইচ্ছা-সংকল্প-আবেগের প্রতিধ্বনি অবচেতনে ছবিটির মধ্যে পেয়ে যায়।

বেদের মেয়ে জোস্‌না কৃষক চৈতন্যের বেশ কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত স্তরকে স্পর্শ করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। আলাদা আলাদা শিরোনামে তাদের আলোচনা অধিক আরামের হবে।

মৌলিক সংঘাত কিংবা সংগ্রামের মর্মশাঁস

ছবিতে মৌলিক সংঘাতটা বেদের মেয়ে জোস্‌নার সঙ্গে বঙ্গরাজার। জোস্‌না অনেকবারই তার ডায়ালগে বলে যে, সে গরিব এবং বেদেপাড়ায় আমরা সত্যি সত্যিই গরিব অধিবাসীদেরকে দেখি। অতএব আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সে গরিবের প্রতিনিধি।

তাহলে রাজা কি বড়লোকদের প্রতিনিধি? গরিবের নিপীড়ক, শোষক বা অত্যাচারী শ্রেণীর প্রতিভূ? আশ্চর্য যে, আমরা মোটেও রাজাকে একজন নিপীড়ক, শোষক বা অত্যাচারী ভূমিকায় দেখি না। বরং শুরু থেকেই তাকে প্রজার হিতাকাক্সক্ষী হিসেবে দেখানো হয়। তার রাজ্যে প্রজাদের নিপীড়ন হয়েছে এমন কোনো ঘটনা জানিয়ে বা দেখিয়ে বা সে ধরনের কোনো টেনশন সৃষ্টি করে ছবিটি শুরু হয়নি। তবে জোস্‌না যখন রাজকুমারকে দাবি করে বসল, তার ফলাফল হিশেবে আমরা বেদে বস্তি জ্বলে যেতে দেখেছি। কিন্তু সেটা গরিবের ওপর বড়োলোকের আক্রমণ নয়। বরং জোস্‌না বঙ্গরাজার ভাষায় দুর্বলতার সুযোগ নিতে গিয়েছে বলেই এই শাস্তি। এমনকি বস্তি জ্বালাবার ক্ষেত্রে উজিরের শয়তানিটাই বরং আমাদের চোখে পড়ে, বঙ্গরাজের ভূমিকা এক্ষেত্রে গৌণ।

মৌলিক সংঘাতটা তাহলে মোটেও গরিবের সঙ্গে বড়লোকের কিংবা প্রজার সঙ্গে রাজার নয়। অর্থাৎ শ্রেণীসংগ্রামের যে ঠিসুং ঠিসুং ভাল্গার চেহারা সচরাচর আমরা হিন্দি ও বাংলাদেশী ছবিতে দেখি, এখানে তা সম্পূর্ণ গৌণ ব্যাপার। অপরদিকে মৌলিক সংঘাত এমনকি নিপীড়কের সঙ্গে নিপীড়িতেরও নয়। অত্যাচারীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে জোস্‌না লড়েনি। ছবিটির কোথাও শ্রেণীসংগ্রামের এই সকল পরিচিত রূপের ইঙ্গিত নেই।

অথচ একটি গভীরতর সংঘাতের পাটাতনের ওপর ছবিটা দাঁড়ানো। সে সংঘাতটার মর্ম তুলে ধরার জন্য ছবিটির সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ থেকে হুবহু তুলে দেয়ার লোভ আমি সামলাতে পারছি না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top