রাতে বাবা,মা, চাচা, চাচি এবং আমি সবাই একসাথে খেতে বসেছি।আজ বিকেলে ব্যাংক থেকে বাড়ি ফিরে দেখি ঢাকা থেকে চাচা, চাচি বেড়াতে এসেছেন।চাচি গদগদকণ্ঠে বাবা মা কে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমাদের সুমি তো মাশাল্লাহ দেখতে খুবই সুন্দর হয়েছে।আমি একটা প্রস্তাব দিই, সুমির সাথে আমার রাজিবকে বেশ মানাবে তোমরা যদি রাজি থাকো তাহলে সুমিকে আমার ছোট বৌমা করতে চাই।
চাচির কথা শুনে মা বাবা খুব খুশি হলেও আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল, খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লাম।
মা হাহাকার করে উঠল, কি হলো সুমি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লি কেন?
মা আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, তোমরা কথা বলো আমি ঘুমাতে গেলাম।ঘরে এসে অস্থির লাগছে চাচির কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে আমার গায়ে কেউ বিছুটি পাতা ডলে দিয়েছে। চাচি এরকম প্রস্তাব কিভাবে দিল! পুরনো কথা সব ভুলে গেছে! কিন্তু আমি তো একমুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না।
আমার চাচা বেশ বড়লোক, চাচার দুই ছেলে এক মেয়ে বড় ছেলে সপরিবারে বিদেশ থাকে মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে নিয়ে চাচারা ঢাকায় থাকেন ছোটছেলের পড়াশোনা তেমন হয়নি টুকটাক ব্যাবসা করে।
আমি তিনমাস হল পড়াশোনা শেষ করে সোনালি ব্যাংকে চাকরি পেয়েছি।
আমাদের বাড়ি গ্রামে আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার বাবা খুব গরীব গ্রামে সামান্য জমি আছে তাই দিয়ে কোনরকমে সংসার চলে।
চাচা, চাচি বছরে একবার গ্রামে আসতেন সাথে করে আনতেন অনেক পুরনো কাপড়। চাচাত বোন রুমা আপা ছিল আমার একবছরের বড় তার সব পুরনো জামা কাপড় আমাকে দিত চাচির পুরনো শাড়ি মাকে আর চাচার পুরনো সার্ট বাবাকে দিত।আমি কোনদিনও চাচা চাচিকে আমাদের জন্য নতুন কাপড় আনতে দেখিনি।
চাচা, চাচি গ্রামে এসে আমার বাবা মায়ের উপরে খুব হম্বিতম্বি করতেন, যে কয়দিন উনারা থাকতেন মা সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতো।
ছোট থেকেই আমি পড়াশোনায় খুব ভাল।এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন প্লাস পেয়ে পাশ করে ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাই।
আমার মত গ্রাম্য দরিদ্র পরিবারের মেয়ের ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া মানে হাতে স্বর্গ পাওয়া।বাবা খুশিতে আত্মহারা হলেও মা একটু চিন্তিত হয়েই বাবাকে বলল,সুমি ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে আমি খুব খুশি হয়েছি কিন্তু ওর পড়ার খরচ, থাকা ও খাওয়া খরচ কোথা থেকে কিভাবে আসবে এই নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।
বাবা দরাজ হেসে হৃষ্টচিত্তে বললেন,চিন্তার কিছু নেই সুমির মা, এক মায়ের পেটের আমার আপন ভাই আছে না ঢাকায়! সুমি মিয়া ভাইয়ের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করবে আর তুমি দেখবে, সুমির পড়ার খরচ সব মিয়া ভাই দেবে।
বাবার স্বান্তনার বাণীতে মা একটু চিন্তা মুক্ত হলেও পুরোপুরি হতে পারল না। মা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল,মা গো কোন রকম অসুবিধা হলে তুই আমাদের জানাবি আমি লোকের বাড়িতে কাজ করে হলেও তোর লেখাপড়ার খরচ জোগাবো।
বাবা আমাকে সাথে নিয়ে চাচার বাড়িতে উঠলেন একদিন থেকে বাবা গ্রামে ফিরে গেলেন। আমি বাবা মাকে ছেড়ে কোনদিনও কোথাও থাকিনি কেন যেন বাবা মাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল।
প্রথম প্রথম চাচা বাড়ি বেশ ভালোই ছিলাম রুমা আপু ও চাচির টুকটাক ফাইফরমাশ শুনতাম। নতুন ভার্সিটিতে যাচ্ছি খুব ভাল লাগছে দু'একজন নতুন বন্ধু পেলাম তারমধ্যে অদিতির সাথে বেশি ভাব হলো।
চাচাবাড়ি থাকার পনেরো দিন পর চাচাদের বাড়ির সবসময়ের জন্য রাখা কাজের মহিলা গ্রামে নিজের বাড়ি বেড়াতে গেলো আর ফিরে আসলো না। চাচি সবসময়ের জন্য কাজের মহিলা না রেখে ছুটা কাজের মহিলা রাখলেন।নির্দিষ্ট তিনটি কাজ করে কাজের মহিলা চলে যেত সংসারের অন্যান্য কাজ আমাকেই বেশি করতে হতো।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে সকালের জন্য চা নাশতা বানিয়ে তরকারি কেটে আমি ভার্সিটি যেতাম চাচি শুধু দুপুরে রান্না করতেন ভার্সিটি থেকে ফিরে বিকেলের চা নাশতা বানানো রাতের রান্না সব আমাকেই করতে হতো। সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রাত দশটার পর আমি ঘরে এসে পড়তে বসতাম ঘর বলতে ষ্টোর রুমে একটা ছোট চৌকি পেতে আমার থাকার ব্যাবস্হা করে দিয়েছিলেন চাচি। আমাকে সাথে নিয়ে কোনদিন চাচি একটেবিলে খেতেন না সবার খাওয়া হয়ে গেলে আমার খাবার টেবিলে ঢাকা থাকতো আমি পরে খেতাম।
এতো কষ্ট করে চাচা বাড়ি থাকছি শুধু মাত্র এই আশায় যে থাকা খাওয়া তো একরকম হচ্ছে পড়ার খরচটা চাচা দিলে বাবা মায়ের কোন কষ্ট হবে না।
কিছু বই কিনতে হবে ভার্সিটির আনুষঙ্গিক খরচ লাগবে কিন্তু চাচা একটা টাকাও দিচ্ছেন না বাধ্য হয়ে আমার নানির দেওয়া শেষ স্মৃতি চিহ্ন আমার কানের দুল জোড়া বিক্রি করে চাহিদা মেটালাম কিন্তু এভাবে তো চলবে না বাড়িতে কিছু জানাতেও পারছি না।আমার মা লোকের বাড়িতে কাজ করবে এইটা আমি কল্পনাও করতে পারি না।
না পেরে বান্ধবী অদিতিকে একটা টিউশনি জোগাড় করে দিতে বললাম।
কয়েকদিন পর অদিতি আমার জন্য একটা টিউশনি জোগাড় করে দিলো।আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
মাঝে মাঝে বাবা,মা চাচার মোবাইলে কল দেয়, আমি হাসিমুখে জানাই আমি খুব ভাল আছি চাচা চাচি আমাকে অনেক ভালবাসেন। আমার কথা শুনে বাবা মা আশ্বস্ত হয়।
এ ভাবে দুবছর কেটে যাওয়ার পর এক দিন চাচি আমাকে ডেকে বললেন,সুমি আজকে ভার্সিটি যেতে হবে না আমার বান্ধবীরা বেড়াতে আসবে দুপুরে এখানে খাবে বাড়িতে অনেক কাজ।আমি চাচির সহযোগিতায় রান্না করলাম ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখলাম। বান্ধবীরা আসার পর টেবিলে খাবার রেডি করে চাচিদের খেতে ডাকলাম। চাচি বান্ধবীদের নিয়ে খাচ্ছে আমি এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছি হঠাৎ চাচির এক বান্ধবী আমাকে দেখিয়ে বললেন,মেয়েটি কে রে জেসমিন? বেশ কাজের।
আমার সামনেই চাচি উনার বান্ধবী কে বললেন, আর বলিস না, আমাদের গ্রামের মেয়ে , গ্রাম সুবাদে ওর বাবা আমাকে ভাবি বলে ডাকে খুব গরীব তাই মেয়েটিকে আমার বাড়ি রেখেছি আমার বাড়ির টুকটাক কাজ করে।
চাচির কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম আপন দেওরের মেয়ে হয়ে গেল কাজের মেয়ে ! চোখ ফেটে পানি আসতে চাইছে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই পারলাম না দ্রুত ওয়াশরুমে যেয়ে কল ছেড়ে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লাম শুধুমাত্র আমার বাবার টাকা নেই বলে এত অপমান! তবে সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে আর থাকবো না।
পরেরদিন অদিতিকে অনুরোধ করলাম আমাকে আরও দু-তিনটে টিউশনি জোগাড় করে দিতে।
অদিতি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,এতগুলো টিউশনি করলে তুই নিজে পড়বি কখন? তুই ইংলিশে অনার্স করছিস টিউশনি পেয়ে যাবি কিন্তু এত টাকা দিয়ে তুই কি করবি? তার চেয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা কর।
তোকে বলতে লজ্জা নেই অদিতি, আমি আর চাচা বাড়ি থাকবো না মেসে থাকবো আর হলের সিটের জন্য চেষ্টা করবো সিট পেয়ে গেলে তখন না হয় টিউশনি ছেড়ে দেবো।
কয়েকদিনের মধ্যে আমি তিনটি টিউশনি পেয়ে গেলাম,আগের একটা দিয়ে মোট চারটি।
একমাস কষ্ট করে শত অপমান সহ্য করে চাচার বাড়িতে ছিলাম এক-একটা দিন মনে হত এক এক বছর। চারটি টিউশনির বেতন পেয়ে চাচার বাড়ি ছেড়ে আমি মেসে উঠলাম, চাচি কিছুতেই আমাকে যেতে দেবে না বিনা পয়সায় এমন কাজের মেয়ে চাচি আর কোথায় পাবে! বাড়িতে জানালাম হলে সিট পেয়েছি আমি এখন থেকে হলে থাকবো।
অনেক কষ্ট করে আমি লেখাপড়া করেছি, মাঝে মাঝে টিউশনির টাকা আমি বাড়িতেও পাঠাতাম আর মা'কে বারবার বলতাম এই টাকায় যেন একটু মাছ মাংস কিনে খায়।
কষ্টের ফল পেয়েছি খুব ভাল রেজাল্ট করে পড়াশোনা শেষ করে আমি ব্যাংকে চাকরি পেয়েছি পোস্টিং আমার হোম ডিস্ট্রিক্টে। বাড়ি থেকে আমার ব্যাংকের দুরত্ব তিন মাইল বাবা মা কে সাথে নিয়ে খুব আনন্দে বাড়িতে আছি বাবা মা আমার বিয়ের কথা বলে কিন্তু মনে মনে আমি এমন একটা পরিবার খুঁজছি যারা আমার বাবা মা কে ভালবাসবে সম্মান করবে, বাবা মাকে যদি আমি মাসে মাসে কিছু টাকা দিই তাহলে কোন আপত্তি করবে না।
আজ চাচা চাচি ঢাকা থেকে এসেছে তার ছেলের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, এ বিয়ে তো আমি কিছুতেই করবো না কিন্তু বাবা মাকে কি বলবো? চাচিরা আমার সাথে যে ব্যবহার করেছে, বাবা মা জানলে কষ্ট পাবে এজন্য আমি তাদের কিছুই জানায়নি। এখন উপায়? একটাই উপায় যারা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তারাই বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দেবে।
আমি বিছানা ছেড়ে উঠে চাচাদের ঘরের দরজায় নক করলাম।
চাচি দরজা খুলে আবেগভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, সুমি মা যে! এসো ভিতরে এসো, কিছু বলবে মা?
চাচি এই বিয়ে ভেঙে দেন, আমার পক্ষে রাজিব ভাইকে বিয়ে করা সম্ভব না।
চাচা উদ্বিগ্ন গলায় জিগ্যেস করলেন কেন তোমার মত নেই মা ?
আমি শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে চাচিকে উদ্দেশ্য করে বললাম,চাচি একদিন আপনি আপনার বান্ধবীদের সাথে আমাকে কাজের মেয়ে হিসেবে পরিচয় করে দিয়েছিলেন সেই বান্ধবীদের সাথে আমাকে বাড়ির বউ হিসেবে পরিচয় দিতে আপনার লজ্জা না লাগলেও আমার লজ্জা লাগবে। একদিন রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করে আমার বাবাকে গ্রামের গরিব মানুষ বলতে আপনার বিবেকে না বাধলেও যে বাড়িতে আমার বাবাকে এত ছোট করা হয়েছে সেই বাড়ির বউ হতে আমার বিবেকে বাধবে।
চাচা আস্তে করে বললেন কিন্তু সুমি বিয়ের প্রস্তাব আমরা দিয়েছি আমরা কিভাবে ভেঙে দেবো?
সে আপনারা যা ভাল মনে করেন বলবেন রাজিব ভাই রাজি না এই বলেও বিয়ে ভেঙে দিতে পারেন অথবা আপনাদের যা খুশি বলতে পারেন , যদি আপনারা বিয়ে ভেঙে না দেন তাহলে বাধ্য হয়ে আমিই বাবাকে বলবো তার আপন মায়ের পেটের ভাই ও ভাবি আমার সাথে কি ব্যাবহার করেছিল! চাচা,আমি শুধুমাত্র আপনার এবং বাবার কথা ভেবে এতদিন বাবাকে কিছু বলিনি বাবা আপনাকে অনেক শ্রদ্ধা করে ভরসা করে। আপনাদের কথা বাবাকে বললে বাবা ভিষণ কষ্ট পাবে আপনার প্রতি বাবার শ্রদ্ধা ভালবাসা সব বিলীন হয়ে যাবে আমি সেটা চাই না।আপনারা আমার চাচা চাচি আছেন সেভাবেই থাকুন অন্য কিছু হওয়ার চিন্তা করবেন না।
এই বলে আমি চাচাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম মনে মনে আমি একটু শান্তি পেলাম আরও কিছু কঠিন কথা বলতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু বলতে পারলাম না হাজার হলেও গুরুজন রক্তের সম্পর্কে চাচা চাচি আমার বাবার আপন ভাই, তাদেরকে আঘাত করলে নিজেরও যে খারাপ লাগে।
(সমাপ্ত)
চাচির কথা শুনে মা বাবা খুব খুশি হলেও আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল, খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লাম।
মা হাহাকার করে উঠল, কি হলো সুমি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লি কেন?
মা আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, তোমরা কথা বলো আমি ঘুমাতে গেলাম।ঘরে এসে অস্থির লাগছে চাচির কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে আমার গায়ে কেউ বিছুটি পাতা ডলে দিয়েছে। চাচি এরকম প্রস্তাব কিভাবে দিল! পুরনো কথা সব ভুলে গেছে! কিন্তু আমি তো একমুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না।
আমার চাচা বেশ বড়লোক, চাচার দুই ছেলে এক মেয়ে বড় ছেলে সপরিবারে বিদেশ থাকে মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে নিয়ে চাচারা ঢাকায় থাকেন ছোটছেলের পড়াশোনা তেমন হয়নি টুকটাক ব্যাবসা করে।
আমি তিনমাস হল পড়াশোনা শেষ করে সোনালি ব্যাংকে চাকরি পেয়েছি।
আমাদের বাড়ি গ্রামে আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার বাবা খুব গরীব গ্রামে সামান্য জমি আছে তাই দিয়ে কোনরকমে সংসার চলে।
চাচা, চাচি বছরে একবার গ্রামে আসতেন সাথে করে আনতেন অনেক পুরনো কাপড়। চাচাত বোন রুমা আপা ছিল আমার একবছরের বড় তার সব পুরনো জামা কাপড় আমাকে দিত চাচির পুরনো শাড়ি মাকে আর চাচার পুরনো সার্ট বাবাকে দিত।আমি কোনদিনও চাচা চাচিকে আমাদের জন্য নতুন কাপড় আনতে দেখিনি।
চাচা, চাচি গ্রামে এসে আমার বাবা মায়ের উপরে খুব হম্বিতম্বি করতেন, যে কয়দিন উনারা থাকতেন মা সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতো।
ছোট থেকেই আমি পড়াশোনায় খুব ভাল।এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন প্লাস পেয়ে পাশ করে ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাই।
আমার মত গ্রাম্য দরিদ্র পরিবারের মেয়ের ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া মানে হাতে স্বর্গ পাওয়া।বাবা খুশিতে আত্মহারা হলেও মা একটু চিন্তিত হয়েই বাবাকে বলল,সুমি ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে আমি খুব খুশি হয়েছি কিন্তু ওর পড়ার খরচ, থাকা ও খাওয়া খরচ কোথা থেকে কিভাবে আসবে এই নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।
বাবা দরাজ হেসে হৃষ্টচিত্তে বললেন,চিন্তার কিছু নেই সুমির মা, এক মায়ের পেটের আমার আপন ভাই আছে না ঢাকায়! সুমি মিয়া ভাইয়ের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করবে আর তুমি দেখবে, সুমির পড়ার খরচ সব মিয়া ভাই দেবে।
বাবার স্বান্তনার বাণীতে মা একটু চিন্তা মুক্ত হলেও পুরোপুরি হতে পারল না। মা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল,মা গো কোন রকম অসুবিধা হলে তুই আমাদের জানাবি আমি লোকের বাড়িতে কাজ করে হলেও তোর লেখাপড়ার খরচ জোগাবো।
বাবা আমাকে সাথে নিয়ে চাচার বাড়িতে উঠলেন একদিন থেকে বাবা গ্রামে ফিরে গেলেন। আমি বাবা মাকে ছেড়ে কোনদিনও কোথাও থাকিনি কেন যেন বাবা মাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল।
প্রথম প্রথম চাচা বাড়ি বেশ ভালোই ছিলাম রুমা আপু ও চাচির টুকটাক ফাইফরমাশ শুনতাম। নতুন ভার্সিটিতে যাচ্ছি খুব ভাল লাগছে দু'একজন নতুন বন্ধু পেলাম তারমধ্যে অদিতির সাথে বেশি ভাব হলো।
চাচাবাড়ি থাকার পনেরো দিন পর চাচাদের বাড়ির সবসময়ের জন্য রাখা কাজের মহিলা গ্রামে নিজের বাড়ি বেড়াতে গেলো আর ফিরে আসলো না। চাচি সবসময়ের জন্য কাজের মহিলা না রেখে ছুটা কাজের মহিলা রাখলেন।নির্দিষ্ট তিনটি কাজ করে কাজের মহিলা চলে যেত সংসারের অন্যান্য কাজ আমাকেই বেশি করতে হতো।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে সকালের জন্য চা নাশতা বানিয়ে তরকারি কেটে আমি ভার্সিটি যেতাম চাচি শুধু দুপুরে রান্না করতেন ভার্সিটি থেকে ফিরে বিকেলের চা নাশতা বানানো রাতের রান্না সব আমাকেই করতে হতো। সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রাত দশটার পর আমি ঘরে এসে পড়তে বসতাম ঘর বলতে ষ্টোর রুমে একটা ছোট চৌকি পেতে আমার থাকার ব্যাবস্হা করে দিয়েছিলেন চাচি। আমাকে সাথে নিয়ে কোনদিন চাচি একটেবিলে খেতেন না সবার খাওয়া হয়ে গেলে আমার খাবার টেবিলে ঢাকা থাকতো আমি পরে খেতাম।
এতো কষ্ট করে চাচা বাড়ি থাকছি শুধু মাত্র এই আশায় যে থাকা খাওয়া তো একরকম হচ্ছে পড়ার খরচটা চাচা দিলে বাবা মায়ের কোন কষ্ট হবে না।
কিছু বই কিনতে হবে ভার্সিটির আনুষঙ্গিক খরচ লাগবে কিন্তু চাচা একটা টাকাও দিচ্ছেন না বাধ্য হয়ে আমার নানির দেওয়া শেষ স্মৃতি চিহ্ন আমার কানের দুল জোড়া বিক্রি করে চাহিদা মেটালাম কিন্তু এভাবে তো চলবে না বাড়িতে কিছু জানাতেও পারছি না।আমার মা লোকের বাড়িতে কাজ করবে এইটা আমি কল্পনাও করতে পারি না।
না পেরে বান্ধবী অদিতিকে একটা টিউশনি জোগাড় করে দিতে বললাম।
কয়েকদিন পর অদিতি আমার জন্য একটা টিউশনি জোগাড় করে দিলো।আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
মাঝে মাঝে বাবা,মা চাচার মোবাইলে কল দেয়, আমি হাসিমুখে জানাই আমি খুব ভাল আছি চাচা চাচি আমাকে অনেক ভালবাসেন। আমার কথা শুনে বাবা মা আশ্বস্ত হয়।
এ ভাবে দুবছর কেটে যাওয়ার পর এক দিন চাচি আমাকে ডেকে বললেন,সুমি আজকে ভার্সিটি যেতে হবে না আমার বান্ধবীরা বেড়াতে আসবে দুপুরে এখানে খাবে বাড়িতে অনেক কাজ।আমি চাচির সহযোগিতায় রান্না করলাম ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখলাম। বান্ধবীরা আসার পর টেবিলে খাবার রেডি করে চাচিদের খেতে ডাকলাম। চাচি বান্ধবীদের নিয়ে খাচ্ছে আমি এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছি হঠাৎ চাচির এক বান্ধবী আমাকে দেখিয়ে বললেন,মেয়েটি কে রে জেসমিন? বেশ কাজের।
আমার সামনেই চাচি উনার বান্ধবী কে বললেন, আর বলিস না, আমাদের গ্রামের মেয়ে , গ্রাম সুবাদে ওর বাবা আমাকে ভাবি বলে ডাকে খুব গরীব তাই মেয়েটিকে আমার বাড়ি রেখেছি আমার বাড়ির টুকটাক কাজ করে।
চাচির কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম আপন দেওরের মেয়ে হয়ে গেল কাজের মেয়ে ! চোখ ফেটে পানি আসতে চাইছে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই পারলাম না দ্রুত ওয়াশরুমে যেয়ে কল ছেড়ে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লাম শুধুমাত্র আমার বাবার টাকা নেই বলে এত অপমান! তবে সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে আর থাকবো না।
পরেরদিন অদিতিকে অনুরোধ করলাম আমাকে আরও দু-তিনটে টিউশনি জোগাড় করে দিতে।
অদিতি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,এতগুলো টিউশনি করলে তুই নিজে পড়বি কখন? তুই ইংলিশে অনার্স করছিস টিউশনি পেয়ে যাবি কিন্তু এত টাকা দিয়ে তুই কি করবি? তার চেয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা কর।
তোকে বলতে লজ্জা নেই অদিতি, আমি আর চাচা বাড়ি থাকবো না মেসে থাকবো আর হলের সিটের জন্য চেষ্টা করবো সিট পেয়ে গেলে তখন না হয় টিউশনি ছেড়ে দেবো।
কয়েকদিনের মধ্যে আমি তিনটি টিউশনি পেয়ে গেলাম,আগের একটা দিয়ে মোট চারটি।
একমাস কষ্ট করে শত অপমান সহ্য করে চাচার বাড়িতে ছিলাম এক-একটা দিন মনে হত এক এক বছর। চারটি টিউশনির বেতন পেয়ে চাচার বাড়ি ছেড়ে আমি মেসে উঠলাম, চাচি কিছুতেই আমাকে যেতে দেবে না বিনা পয়সায় এমন কাজের মেয়ে চাচি আর কোথায় পাবে! বাড়িতে জানালাম হলে সিট পেয়েছি আমি এখন থেকে হলে থাকবো।
অনেক কষ্ট করে আমি লেখাপড়া করেছি, মাঝে মাঝে টিউশনির টাকা আমি বাড়িতেও পাঠাতাম আর মা'কে বারবার বলতাম এই টাকায় যেন একটু মাছ মাংস কিনে খায়।
কষ্টের ফল পেয়েছি খুব ভাল রেজাল্ট করে পড়াশোনা শেষ করে আমি ব্যাংকে চাকরি পেয়েছি পোস্টিং আমার হোম ডিস্ট্রিক্টে। বাড়ি থেকে আমার ব্যাংকের দুরত্ব তিন মাইল বাবা মা কে সাথে নিয়ে খুব আনন্দে বাড়িতে আছি বাবা মা আমার বিয়ের কথা বলে কিন্তু মনে মনে আমি এমন একটা পরিবার খুঁজছি যারা আমার বাবা মা কে ভালবাসবে সম্মান করবে, বাবা মাকে যদি আমি মাসে মাসে কিছু টাকা দিই তাহলে কোন আপত্তি করবে না।
আজ চাচা চাচি ঢাকা থেকে এসেছে তার ছেলের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, এ বিয়ে তো আমি কিছুতেই করবো না কিন্তু বাবা মাকে কি বলবো? চাচিরা আমার সাথে যে ব্যবহার করেছে, বাবা মা জানলে কষ্ট পাবে এজন্য আমি তাদের কিছুই জানায়নি। এখন উপায়? একটাই উপায় যারা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তারাই বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দেবে।
আমি বিছানা ছেড়ে উঠে চাচাদের ঘরের দরজায় নক করলাম।
চাচি দরজা খুলে আবেগভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, সুমি মা যে! এসো ভিতরে এসো, কিছু বলবে মা?
চাচি এই বিয়ে ভেঙে দেন, আমার পক্ষে রাজিব ভাইকে বিয়ে করা সম্ভব না।
চাচা উদ্বিগ্ন গলায় জিগ্যেস করলেন কেন তোমার মত নেই মা ?
আমি শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে চাচিকে উদ্দেশ্য করে বললাম,চাচি একদিন আপনি আপনার বান্ধবীদের সাথে আমাকে কাজের মেয়ে হিসেবে পরিচয় করে দিয়েছিলেন সেই বান্ধবীদের সাথে আমাকে বাড়ির বউ হিসেবে পরিচয় দিতে আপনার লজ্জা না লাগলেও আমার লজ্জা লাগবে। একদিন রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করে আমার বাবাকে গ্রামের গরিব মানুষ বলতে আপনার বিবেকে না বাধলেও যে বাড়িতে আমার বাবাকে এত ছোট করা হয়েছে সেই বাড়ির বউ হতে আমার বিবেকে বাধবে।
চাচা আস্তে করে বললেন কিন্তু সুমি বিয়ের প্রস্তাব আমরা দিয়েছি আমরা কিভাবে ভেঙে দেবো?
সে আপনারা যা ভাল মনে করেন বলবেন রাজিব ভাই রাজি না এই বলেও বিয়ে ভেঙে দিতে পারেন অথবা আপনাদের যা খুশি বলতে পারেন , যদি আপনারা বিয়ে ভেঙে না দেন তাহলে বাধ্য হয়ে আমিই বাবাকে বলবো তার আপন মায়ের পেটের ভাই ও ভাবি আমার সাথে কি ব্যাবহার করেছিল! চাচা,আমি শুধুমাত্র আপনার এবং বাবার কথা ভেবে এতদিন বাবাকে কিছু বলিনি বাবা আপনাকে অনেক শ্রদ্ধা করে ভরসা করে। আপনাদের কথা বাবাকে বললে বাবা ভিষণ কষ্ট পাবে আপনার প্রতি বাবার শ্রদ্ধা ভালবাসা সব বিলীন হয়ে যাবে আমি সেটা চাই না।আপনারা আমার চাচা চাচি আছেন সেভাবেই থাকুন অন্য কিছু হওয়ার চিন্তা করবেন না।
এই বলে আমি চাচাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম মনে মনে আমি একটু শান্তি পেলাম আরও কিছু কঠিন কথা বলতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু বলতে পারলাম না হাজার হলেও গুরুজন রক্তের সম্পর্কে চাচা চাচি আমার বাবার আপন ভাই, তাদেরকে আঘাত করলে নিজেরও যে খারাপ লাগে।
(সমাপ্ত)